সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১

মাটির রাজনীতি বনাম শীততাপ নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি : এড‌ওয়ার্ড রিয়াজ মাহামুদ 


প্রকাশিত:
৯ নভেম্বর ২০২০ ২০:৪১

আপডেট:
২৫ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:১৫

ছবিঃ এড‌ওয়ার্ড রিয়াজ মাহামুদ 

 

রাজনীতি একটি গূঢ় বিষয়। রাজনীতি এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কিছু ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত কোনো গোষ্ঠী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। রাজনীতি কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার ভিত্তিতে সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে গঠিত। সাধারণ মানুষ রাজনীতিকে রাজার নীতি বললেও কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও সামাজিক সম্পর্কের প্রশ্নে তারা এসে যায়। এ ছাড়া গণতন্ত্রে জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। সেই হিসেবেও রাজনীতিতে সাধারণ মানুষ থাকে।

মূলত রাজনীতি কেন্দ্র থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু এর সামগ্রিক সব তৃণমূলে লুকায়িত। বাংলাদেশ মূলত গ্রামেরই সমষ্টি। সেই হিসেবে সকল তৃণমূল সংগঠিত হয়েই রাজনীতির মেরুকরণ হয়। তৃণমূলের রাজনীতি বলতে আমরা বুঝি দেশের সব প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা রাজনীতি। আর রাজনীতির তৃণমূল বলতে সাধারণত রাজনীতির গ্রামীণ পটভূমি বোঝানো হয়।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। এ দলের লাখ লাখ নেতা-কর্মী দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। শত ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করেও দলটি টিকে থাকার কারণ এই সব প্রান্তিক নেতা-কর্মৗরাই। দলের দুঃসময়ে নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হয়েও তারা দল ত্যাগ করেনি।  মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার একটি স্মরণসভা অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মীর আত্মত্যাগের জন্যই দলটির কেউ ক্ষতি করতে পারেনি। আওয়ামী লীগে অনেক ত্যাগী নেতা ছিলেন বলেই বারবার আঘাত করেও কেউ এ দলকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, গণতন্ত্র ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখার জন্য দলের সব ত্যাগী নেতার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।’ ওই অনুষ্ঠানে তিনি আরো বলেন, এসব নেতাকর্মীরা দলীয় আদর্শ ও নীতিতে বিশ্বাসী এবং তাঁরা অর্থ-সম্পদ কুক্ষিগত করার চেষ্টা করেননি।’ তাই দলের দুঃসময়ের নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন করতে বারবার নির্দেশ দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এমন কি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও জননেত্রী শেখ হাসিনার এমন নির্দেশের কথা নেতা কর্মীদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। 

কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার এ নির্দেশ এখন ইতিহাস বলে মনে হচ্ছে। কারণ এর কোন বাস্তবায়ন নেই। দলের ত্যাগী নেতা কর্মীদেরও কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে না। এমন কি নির্বাচন পরবর্তী কোনো অনুষ্ঠানেও তাদের ডাকা হচ্ছেনা। যে কোনো রাজনৈতিক অনুষ্ঠান বা পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত অতিথি হয়ে যান ওইসব সুবিধাবাদী চক্র। যারা কোনো দিন আওয়ামী লীগ করেনি, এখন নতুন আওয়ামী লীগ সেজেছে। তাদেরকে যদি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ৫ মিনিটের বক্তব্য দিতে বলা হয় তারা দিতে পারবেনা। অথচ তারা এখন নতুন করে বঙ্গবন্ধুপ্রেমী সেজেছে। 

তৃণমূলের বা প্রান্তিক নেতা-কর্মীদের অবমূল্যায়ন যেন একটি নিত্যনৈমত্তিক রাজনৈতিক সংষ্কৃতি। আর আসলের চাইতে এখন হাইব্রিডের কদর বেশী। মূল্যায়িত না হওয়ার অভিমানে দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখছেন অনেক নেতাকর্মী। একদিকে অবমূল্যায়ন আর অন্যদিকে গোদের ওপর ক্যানসারের মত নিজ দলের নেতা কর্মীর দ্বারা আক্রমণ, মামলা, হামলা আর হয়রানি। বিচারের বানী নিভৃতে কাঁদে। এই বঞ্চিত-লাঞ্চিতদের গোপন কান্না দলের উচ্চ পর্যায়ে পৌছায় না। এই সব সুবিধাবাদী চক্র এখন মন্ত্রী এমপিদের ডান হাত। এমনটা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে প্রকৃত কর্মীর সংখ্যা দিন দিন কমতে থাকবে।

বর্তমানে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে যুক্ত থাকলেও, আমার রাজনৈতিক উত্থান ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে। তাছাড়া রাজনীতি নিয়ে লেখা ও গবেষণা করছি প্রায় ১২ বছর ধরে। তবে হ্যাঁ, দল আমাকে মূল্যায়ন করেছেন। এবার আসি মূল কথায়। আমি তৃণমূল রাজনীতি নিয়ে কিছু চিন্তা করেছি। আমার সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকে যতটুকু বুঝি তা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। 

তৃণমূল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যাঁরা নিবেদিতপ্রাণ বলে পরিচিত ছিলেন, দলের দুর্দিনে যাঁরা ত্যাগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন, আজ তাঁরাই নিপতিত হয়েছেন চরম দুর্দিনে। ক্ষমতাবান, সুবিধাভোগী আর স্বার্থবাজ নেতারা তাঁদের দূরে ঠেলে রেখেছেন। এমপি-মন্ত্রীদের ঘিরে রাখেন নব্য সুযোগসন্ধানী নেতারা। দেশের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী রাজনীতির ওপর অনুসন্ধান চালিয়ে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে অধিকাংশ স্থানে। 

কথাগুলো না লিখলে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। তৃণমূলে থাকার কারণে অনেক সময় সাধারণ মানুষকে বলতে শুনি, ‘আওয়ামী লীগে এখন কর্মীর চেয়ে নেতা বেশি’। কথাটি আমাকে দুঃখ দেয়। এটাও সত্য অনেকেই এখন আওয়ামী লীগে আসে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার করতে, নেতা হতে; কর্মী হতে নয়। স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের খণ্ড খণ্ড গ্রুপ তৈরি হয়েছে। একটি গ্রুপ সুযোগ পেলে অপর গ্রুপকে হয়রানি করছে, কর্মীদের বঞ্চিত করছে। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এমন চিত্র দেখেছি। আওয়ামী লীগের এমন চিত্র কোনো ভাবে আমাদের কাম্য নয়। কারণ দলটি জন্মলগ্ন থেকেই গণমুখী। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য আন্দোলন করে এসেছে। এখন সেই দলের নেতা কর্মীদের মধ্যে বিরোধ প্রতিহিংসা , কর্মীর চেয়ে নেতা হওয়ার আগ্রহ বেশি। যা দু:খজনক। 

অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের নেতা কর্মীদের বারবার বলেছেন, দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিভেদ থাকা চলবে না। যদি কোনো নেতার সঙ্গে কর্মীর বিরোধ থাকে, তাহলে সেই বিরোধ দ্রুত মিটিয়ে ফেলতে হবে। দলের সঙ্গে জাতীয় ও স্থানীয় ত্যাগী নেতা কর্মীর দূরত্ব থাকা চলবে না। আর তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনা, আমার হাসু বুবুর কাছে একটি অনুরোধ করছি। আওয়ামী লীগের তৃণমূল অনেক ত্যাগী নেতা-কর্মী আছেন যারা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে কাছ থেকে কখনো দেখেননি। সারাজীবনে দশ সেকেন্ড কথা বলার সুযোগও হয়নি জননেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। তবু তারা নিরলসভাবে দেশ ও দলের জন্য কাজ করে গেছেন। কাজ করে যাচ্ছেন। দলের প্রতি তাদের ভালোবাসা অকৃত্রিম। বঙ্গবন্ধু কন্যা কি তাদের জন্য গণভবনে কিছু সময় ব্যয় করবেন? যাতে করে তারা নিজেদের কথাগুলো বলতে পারে?

এখন অধিকাংশ মানুষই রাজনীতিবিমুখ। এর কারণও দলগুলোর বা রাজনীতিকের তৃণমূলের ভাষা না বোঝা। সচরাচর দৈবিক লাভ ছাড়া কেউ রাজনীতির ময়দানে পা বাড়ান না। এতে কি বলা যায় না রাজনীতি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে? যদিও প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। রাজনীতি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বলা যায় যখন মানুষ রাজনীতির সুফল না ভোগ করে এর শিকার হয়। বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে আপনিই ভালো জানেন, আপনি রাজনীতির শিকার না ফল ভোগ করছেন?

 

এড‌ওয়ার্ড রিয়াজ মাহামুদ 
তৃনমূল পর্যবেক্ষক ‌ও সদস্য, কেন্দ্রীয় উপকমিটি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top