সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

ধর্ষণ বনাম ব্লেইমিং এবং পারিবারিক শিষ্টাচার : ড. শাহনাজ পারভীন 


প্রকাশিত:
২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৮:৩২

আপডেট:
২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৮:৪৭

ছবিঃ ড. শাহনাজ পারভীন 

 

প্রতিদিন প্রাতঃভ্রমণের সময় থেকে শুরু করে দিনশেষে কাজ থেকে ফেরা অবধি যদি আপনাদের চোখ খোলা রাখেন, তাহলে দেখতে পাবেন নানান বয়সী মেয়েদের নানান রকম বোরখা আর হিজাবের ডিজাইন। এখন বোরখা আর হিজাবের জন্য স্মরণকালের সেরা সময় বলা যায়। অত্যন্ত যত্ন সহকারে নারীরা মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে রাখছে। তবুও নারীদের নিরাপত্তার এত অভাব? ভাবতেই শিউরে উঠি। প্রতি দশজনে একজন মেয়েকেও বোরখা, হিজাব বিহীন খুঁজে পাওয়া দায়। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, অফিস--আদালত, বাজার--ঘাট, শপিংমল সব খানেই একই চিত্র। তারপরও নারীদের কোনো নিরাপত্তা নেই। নিরাপত্তা নেই শিশুদের। সহিংসতার এই ভয়াবহতা জাতির জন্য অশনিসংকেত। এখনই যদি এই সহিংসতা থেকে রুখে দাঁড়ানো না যায়, তো সভ্যতার চাকা উল্টোদিকে ঘুরতে শুরু করবে। ২০২০ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছর প্রতিদিন দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন চারজনেরও বেশি নারী। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। প্রতি বছর প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৬৯৪ জন, যা গড়ে প্রতি মাসে ১৪১ জন। যার মধ্যে একক ধর্ষণের শিকার ১৩০২, সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ৩১৭, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫৩ জনকে। আর ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন। এ ছাড়া বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৩৪৬ জন নারী ও শিশু। যেখানে একক ধর্ষণের শিকার ১০৭৪ জন, সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ২৩৬ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জনকে। আর ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন তিনজন।

একটি নারীকে ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয় না, বরং ধর্ষণের সাথে সাথে নানান রকম কথা, ব্লেইমিং ছড়াতে থাকে এই সমাজ। প্রথমেই তার পোশাক, তার চলাচল, তার আচরণের অভিযোগ তোলা হয়। নিশ্চয়ই এতে নারীটির প্রেম, সম্মতি অথবা ইচ্ছাকৃত কোনো ত্রুটি ছিলো বলে নানান রকম অপবাদ দেওয়া হয়। অপবাদ দেওয়া হয় তার রুচি, শিক্ষা, পরিবার ও পরিবেশ নিয়ে। কিন্তু একটি ছেলে শিক্ষার্থী যেই পরিমান সুবিধা ভোগ করে একটি মেয়ে শিক্ষার্থী কিন্তু সেই পরিমান সুবিধা ভোগ করতে পারে না। ছেলে শিক্ষার্থীরা তার ছেলে সহপাঠীদের সাথে যখন তখন যেখানে সেখানে দলবেধে কিংবা একা একা পড়াশোনার জন্য মিলিত হতে বা ঘুরে বেড়াতে পারে, সেক্ষেত্রে মেয়ে শিক্ষার্থীদের কিছু সংকীর্ণতা থেকেই যায়। বিশেষ করে তাদের শারীরিক শক্তি, সৌন্দর্য, জন্মগত বৈশিষ্ট্যই এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই বিষয়গুলিই যদি পরিবার থেকে খুব ছোটবেলা থেকেই তাদের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তাদেরকে এই ব্যাপারে যথাযুক্ত জ্ঞান দান করা হয়। তাহলে তারা নিজেরাই এই ব্যাপারে সচেতনভাবে চলাফেরা করতে পারে। ছেলে শিক্ষার্থীদের মতো যখন তখন গ্রুপ স্টাডির কথায় নিজের নিরাপত্তার কথা না ভেবে না জেনে শুনে একা একা অন্য কোন ছেলে শিক্ষার্থীর মতো কোন ছেলে শিক্ষার্থীর বাসায় একা একা যেতে হিসেব কষতে পারে। সবক্ষেত্রেই যে এই হিসেবের গুণ ঠিকঠাক মতো মিলে যায়, তা কিন্তু নয়। 

এই সমাজে দুই, তিন, পাঁচ বছর থেকে শুরু করে ষাটোর্ধ নারীও রেহাই পায় না, রেহাই পায় না রাস্তায় রাস্তায় অসহায় ঘুরে বেড়ানো প্রতিবন্ধী নারীরাও। রেহাই পায় না আনুশকার মতো উচ্চবিত্ত শিক্ষার্থীরাও। এই সব দিহানদের মতো বখে যাওয়া কিশোর থেকে শুরু করে সত্তরের বৃদ্ধ পর্যন্ত যেন তেন ভাবে তাদের কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে পিছপা হয় না। পয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধ পাঁচ টাকার লোভ দেখিয়ে পাঁচ বছরের শিশুকেও ধর্ষণ করে। কোন সমাজে আমরা এসে পড়েছি? 

অথচ আশির দশকে আমরা যখন ছাত্রী ছিলাম, তখন হাতে গোনা দু'একজন বিবাহিতা শিক্ষার্থীকেই শুধু কলেজে বোরখা পড়তে দেখেছি, কিন্তু ধর্ষিত হতে দেখি নি কারো। বর্তমান সময়ে স্বামীর সাথে বাইরে গেলেও একজন নারীর নিরাপত্তার অভাব দেখতে পাই। এমনটি কেন হচ্ছে? আমার মনে হয়, পারিবারিক শিক্ষার অভাব এর প্রধান কারণ। যেই পরিবারে প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমে মানবিক শিষ্টাচার, সচেতনতা বিদ্যমান, যেই পরিবারে ছোট বেলা থেকেই মা, বোনদের সমীহের চোখে দেখা হয়, সেই পরিবারের কোনো সন্তানের পক্ষে এহেন কুকাজ করা সম্ভবপর হয় না। যেই পরিবারে দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি অনৈতিক আচরণ, ঘুষ, দুর্নীতি, বাবা মায়ের মধ্যে সুসম্পর্কের অভাব থাকে সেই পরিবারের মধ্যে বেড়ে ওঠা সন্তান গুলোই এক একজন দিহান হয়ে জন্ম নেয়। 

এই দিহানরা তো একদিনে জন্ম নেয় না। ধীরে ধীরে তারা এভাবে জন্ম নেয়, গড়ে ওঠে। যেভাবে পরিপূর্ণ শিক্ষার মাধ্যমে একটি শিশু ধীরে ধীরে প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে ওঠে, সেই একইভাবে একটি শিশু ভুল মানুষ, ভুল বন্ধুদের সাহচার্যপ্রাপ্ত হয়ে ধীরে ধীরে বিপথগামী হয়ে ওঠে। তার এই বিপথগামীতা প্রথমেই তার ঘরের, তার পরিবারের নজরে আসে। কিন্তু অনেক সময় পারিবারিক অবহেলা, উপেক্ষা, অযত্ন শিশুটাকে সঠিক পথের সুশৃঙ্খল জীবন বিন্যাসের পথের অন্তরায় হয়। এক সময় সঠিক পথের নিশানা থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্ধকারে হারিয়ে যায়। অথচ শুরুতেই যদি পারিবারিক পরিচর্যার সুযোগ পেতো, তাহলে সে সঠিক পথে ফিরে আসতে পারতো। 

আমরা যদি বিপথগামী শিশুদের পরিসংখ্যান দেখি তো বুঝতে পারি, সাধারণত অস্থিতিশীল, দুর্নীতি পরায়ন পরিবারের সন্তানরা যত সহজে অন্ধকারে পা বাড়াতে পারে তত সহজে স্থিতিশীল পরিবারের সন্তানদের পক্ষে তা সহজ হয় না। আনুশকা হত্যার পর আমরা তার সহপাঠীদের প্রতিবাদের ভাষা দেয়ালে দেয়ালে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, প্রতিবাদের ভাষায় রুষে উঠতে দেখছি। দেখছি, প্রতিনিয়ত তাদের ক্রমান্বিক যন্ত্রণা ও প্রতিবাদের পান্ডুলিপি। তারাও তো এই সমাজেরই, এই একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের! তাহলে? তাহলে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? এখানে একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পর পর তিনটি শ্রেণীকে দেখছি। এক অত্যাচারী, দুই, অত্যাচারিত এবং তিন প্রতিবাদকারী। এখানে অত্যাচারীর সংখ্যা যেমন কম, তেমনি অত্যাচারিতের সংখ্যা তেমনই কম কিন্তু প্রতিবাদীর সংখ্যা অনেক অনেক বেশি দেখতে পারছি। অর্থাৎ এই মাস্টার মাইন্ড শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতোই সারা দেশেও কিন্তু একই অবস্থা। অত্যাচারী এবং অত্যাচারিতের সংখ্যা কিন্ত প্রতিবাদীদের সংখ্যার চাইতে অনেক কম। তবুও প্রতিনিয়ত, অত্যাচারী অত্যাচার করে যাচ্ছেন মুষ্টিমেয় সংখ্যার প্রতি আর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘশ্রেণী তা থেকে প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন। তবুও কি থামছে সে অত্যাচার আর অত্যাচারীর বোবা কান্না? নাহ থামছে না। এখানেই আসলে মূল পরিবার থেকে পরিবারের পার্থক্য প্রতিভাত হয়। একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, একই পরিবেশ কিন্তু পরিবারের ভিন্নতার কারণে এই অত্যাচার, অত্যাচারিত এবং প্রতিবাদের ভিন্নতা। তাই আমার মনে হয়, একটি শিশুর বেড়ে ওঠার পেছনে মূল ভূমিকা একটি পরিবারের। পরিবারই একটি শিশুর গড়ে উঠবার প্রাথমিক ভিত্তি। এরপর আসে শিক্ষা ব্যবস্থা এবং মনোভঙ্গির পারষ্পরিক পরিলক্ষিতা। তাই পরিবার, মনোভঙ্গি এবং শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজ থেকে এই সহিংসতা দূর করা সম্ভব। অবশ্যই সময় এসেছে, শিক্ষা কারিকুলাম ও সিলেবাস সংশোধনের। সেখানে মানবিকতা, নৈতিকতা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মূল্যবোধের পাশাপাশি যৌন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সিলেবাস সঠিকভাবে সন্নিবেশিত করতে হবে। আর পাঁচটি শিক্ষার পাশাপাশি যৌন বিষয় সম্পর্কেও সরাসরি সুস্পষ্ট সিলেবাস থাকতে হবে, যা খুবই জরুরি, সময়ের দাবি।

 

 . শাহনাজ পারভীন 
কবি, ভাইস প্রিন্সিপ্যাল, উপশহর মহিলা কলেজ, যশোর

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top