সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর আইনী ভাবনা ও বঙ্গবন্ধু জারিকৃত আইনসমূহ : সাহিদা বেগম


প্রকাশিত:
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৯:১৮

আপডেট:
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২২:৩৩

ছবিঃ সাহিদা বগেম 

 

একজন মানুষের জন্যে দেশের আইন পরপর তিনবার পরিবর্তন হয় এমন ঘটনা পৃথিবীতে বিরল। আমার জানামতে পৃথিবীর এমন বিরল ঘটনাটি ঘটেছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি মহাননেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রে। দেশের আইন পরপর তিনবার পরিবর্তন হয়েছিল এই একটি মানুষের জন্যে এবং সেটা হয়েছিল ধারাবাহিকভাবে।

প্রথমবার হয়েছিল পাকিস্তান আমলে-পাকিস্তানের রাষ্টক্ষমতায় তখন দুর্দান্ত প্রভাবশালী ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মোঃ আয়ুব খান। দশ বছর ধরে টানা দেশ শাসন করছে দুর্দান্ত প্রভাবে। প্রথমে দেশে মার্শাল জারি করে দেশবাসির বুকের উপর চেপে বসে। তারপর বুনিয়াদি গণতন্ত্র নামক নিজের উদ্ভাবিত এক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতারোহনকে পাকাপোক্ত করে নেয়।

অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারের শোষণ; দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে মুক্ত করার দেশের শোষণ দুর্নীতি দূর করার পথ হিসেবে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান তার দল আওয়ামী লীগের তরফ থেকে ৬ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করলেন। ছয়দফা ধীরে ধীরে জনগণের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ছয়দফা হয়ে উঠল পূর্ব পাকিস্তানিদের তথা বাঙালির মুক্তির সনদ। 

বাঙালির স্বার্থান্যাসি জনগণের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির কাছে হয়ে উঠলেন মুজিব ভাই। শেখ মুজিব তাঁর ৬ দফা কর্মসূচী নিয়ে দেশের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছুটে বেড়াতে লাগলেন। শেখ মুজিবের এই ৬ দফা কর্মসূচীকে স্তব্ধ করার কৌশল হিসেবে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আয়ুব সরকার একের পর এক মামলা দিতে থাকে দেশের বিভিন্ন আদালতে। সর্বশেষ এবং ভয়ঙ্কর প্রচেষ্টা হিসেবে দায়ের করে “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা” ১৯৬৮ সালে। পাকিস্তান চধহধষ ঈড়ধফ এর কিছু সংশোধনী এনে দন্ডবিধির ১২১(ক) ধারা ও ১৩১ নং ধারা মোতাবেক বিশেষ ট্রাইবুন্যাল গঠন করা হয় এবং এই বিশেষ ট্রাইবুন্যাল মামলাটি দায়ের করা হয়। শুধুমাত্র শেখ মুজিবকে এই মামলায় ফাঁসানোর বা জড়ানোর জন্যে। সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন করার প্রচেষ্টার মূল হোতা ছিলেন পাকিস্তান নৌবাহিনীর বাঙালি অফিসার কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন; পাকিস্তান নৌবাহিনীতে চাকরী করে পাকিস্তান সরকার তথা পশ্চিমাদের অত্যাচার নীপিড়নে অতিষ্ট হয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে সশস্ত্রবিদ্রোহের মাধ্যমে স্বাধীন করে ফেলার এক দুঃশাসহিক স্বপ্নে একটি বিপ্লবী কমান্ডো বাহিনী গড়ে তুলেছিল পাকিস্তান নৌ-বিমান ও সেনাবাহিনীর চাকুরীরত ও অবসরপ্রাপ্ত কিছু সেনা সদস্য।

পাকিস্তান সরকারের কাছে সেনা সদস্যদের এই গোপন প্রস্তুুতির কথা ফাঁস হয়ে গেলে সেনা ও প্রতিরক্ষা আইনে দুই হাজারের মতো লোককে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা। সারা পাকিস্তান তন্য তন্য করে খুঁজে এক বছরের বেশী সময় ধরে গোপন গ্রেফতার অভিযান চালায় সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা।

গ্রেফতারকৃতদের মধ্য থেকে বেছে ৩৫ জনকে আসামী করে একটি মামলা সাজানো হয়। প্রাথমিক চিন্তায় পাকিস্তান সরকার ধৃত ব্যক্তিদের সামরিক আইনে মার্শাল কোর্টে বিচার করার চিন্তাভাবনা ছিল; কিন্তুু পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের পরামর্শদারের পরার্মশে ৬ দফার প্রবর্তক বাঙালির জনপ্রিয় নেতাকে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝোলানোর চক্রান্তে আওয়ামীলীগ নেতা শেখ মুজিবকে এই মামলায় জড়ানো হয় এবং নতুনভাবে গ্রেফতার দেখানো হয়। শেখ মুজিব অবশ্য অনেক আগে থেকেই অন্যান্য রাজনৈতিক মামলায় জেলের ভেতর ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে নতুনভাবে গ্রেফতার দেখিয়ে নতুন মামলা সাজানো হয়। যার নাম ইতিহাসে “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা” হিসেবে প্রচার লাভ করে। এই মামলায় গ্রেফতারকৃত ৩৫ জন আসামীর মধ্যে ২৮ জনই ছিলেন পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর সেনা ও অফিসার। তাদের বিরুদ্ধে মার্শাল কোর্টে গোপন বিচারের মাধ্যমে সেই সব দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ বাঙালি সেনা ও অফিসারদের মৃত্যুদন্ড দিয়ে দিলে দেশবাসী কেউ টের পেতো না বা দেশবাসীর কিছু বলার থাকতো না। কিন্তুু দুর্ভাগ্য আয়ুব খান আর তার রাজনৈতিক পরামর্শদাদের দূরদর্শীতার অভাবে তাদের পরার্মশমতো একমাত্র রাজনৈতিক নেতা আসামী হিসেবে শেখ মুজিবকে যুক্ত করা। আয়ুব খানের পরার্মশদাতাদের পরামর্শ ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে শেখ মুুজিবুর রহমানকে জড়িয়ে মামলা করে দেশের জনমনে শেখ মুজিবকে ভারতের সঙ্গে ষড়যন্ত্রকারী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে শেখ মুজিবকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো সরকারের পক্ষে সহজ হবে। ৬ দফা স্তব্ধ করা যাবে এবং দেশপ্রেমিক জনগণের মধ্যে পাকিস্তান প্রেম শক্ত ও মজবুত হয়ে উঠবে। সরকারের গোপন এই ঘৃন্য উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য শেখ মুজিবকে এই মামলায় এক নম্বর আসামী করা হয় এবং মামলার নাম দেওয়া হয় “রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য।”

পাকিস্তান প্যানালকোড সংশোধন করে নতুন একটি আইন তৈরি করে বিশেষ ট্রাইবুন্যাল গঠন করে কুর্মিটোলা সেনা ছাউনির ভেতরে গোপন ট্রাইবুন্যালে অভিযুক্তদের বিচার শুরু করে পাকিস্তান সরকার। এই প্রথম পাকিস্তানে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক শুধুমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য বৃটিশ শাসকদের তৈরি করা পাকিস্তান প্যানালকোড সংশোধন করে নতুন আইন করা হয় শেখ মুজিবের বিচার করার জন্য।

২য়বার দেশের আইন পরিবর্তন করা হয় বাংলাদেশে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট ইতিহাসের সেই কলঙ্কময় অধ্যায়ের সূচনা হয়। একটি কুচক্রিমহল ষড়যন্ত্র করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করার পর খুনীদের বিচার যাতে না করতে পারে কোন সরকার তার জন্য, খুনীদের জঘন্য হত্যাকান্ডের বিচার বন্ধ করার উদ্দেশ্যে তৎকালীন রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান “ইন্ডিমিনিটি অধ্যাদেশ” নামে একটি অধ্যাদেশ জারি করেন। খুনীদের রক্ষা করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার বন্ধ করে দেয়া হয় কুখ্যাত এই আইন “ইন্ডিমিনিটি অধ্যাদেশ” জারি করে।

শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর জন্য, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার বন্ধ করার জন্য এই অধ্যাদেশ জারি করা হয়।

তৃতীয় এবং শেষবারের মতো বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৬ সালে সাধারন নির্বাচনে জয়ী হয়ে দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করে আর একটি অর্ডিন্যান্স জারি করে। কুখ্যাত ইন্ডিমিনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করা হয়। বাংলাদেশ প্যানাল কোডের ৩০২ ধারাসহ অন্যান্য ধারায় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কাজ চালু হয়। ইচ্ছে করলে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রতিহিংসাপরায়ন হলে বিশেষ ট্রাইবুন্যাল গঠন করে দ্রæত খুনীদের বিচার করতে পারতেন। কিন্তুু তিনি তা চাননি। দেশের প্রচলিত আইনে খুনীদের বিচার হয়েছে। জঘন্য খুনীরা সাজা পেয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে পাকিস্তান শাসনামল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ আমলে পর পর তিনবার বঙ্গবন্ধুর জন্য দেশের আইন পরিবর্তন, সংশোধন এবং নতুন আইন জারি করা হয়েছে। এ দিক থেকে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অনন্য, অদ্বিতীয় মানুষ এবং রাষ্ট্রনায়ক আমার জানামতে।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্মজীবনে আইনজীবী হওয়ার মানসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন ১৯৪৮ সালে। তাঁর ছাত্রজীবন, বেড়ে ওঠাকালের ভারত বর্ষের রাজনৈতিক পরিবেশ এর তার সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার কারনেই কর্মজীবনে তিনি আইনজীবী হতে চেয়েছিলেন। আইনে পড়াশোনা থাকলে সে স্থান তাঁর রাজনৈতিক জীবন গঠনে সহায়ক হবে এই দূরদৃষ্টি তাঁকে আইন পড়তে উদ্ধুদ করেছে। পিতা লুৎফর রহমানের কর্মক্ষেত্র ছিল কোর্ট-কাচারি, সেদিকটিও হয়তো তাঁকে আকর্ষন করেছে আইনজীবী হতে। 

আবার তখনকার রাজনৈতিক নেতাদের জীবন এবং কর্ম তাঁকে উদ্ধুদ্ধ করতে পারে। বঙ্গবন্ধু কিশোর বয়স থেকে রাজনীতির ছোঁয়া পেয়েছেন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র থাকাবস্থায় যখন বাংলার মূখ্যমন্ত্রী এ, কে, ফজলুল হক এবং শ্রম মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাঁদের স্কুল পরিদর্শনে এলেন, পরিদর্শন শেষে দু’জন নেতা যখন স্কুল ত্যাগ করে যাচ্ছিলেন বালক শেখ মুজিব নিজের অনুসারি ক’জন ছাত্র নিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ নেতাদের পথ আগলে দাঁড়ালেন স্কুল হোষ্টেলের ছাদ দিয়ে পানি পড়া বন্দের দাবীতে। 

পরবর্তীতে এই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলেন শেখ মুজিবের শিক্ষাগুরু, রাজনৈতিক পথ প্রদর্শক। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত আইনজীবী। শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হকের সঙ্গে ছিল তাঁর হৃদ্যতা। আর তৎকালীন ভারতীয় রাজনীতি অঙ্গনে ছিল উত্তাল উদ্দিপ্ত। বঙ্গবন্ধু যখন কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র, বেকার হোস্টেলে বসবাস, সেই সময়ে সারা ভারত জুড়ে স্বাধীনতার আন্দোলন উচ্চসিত। পুরো ভারতবাসী ইংরেজের বিরুদ্ধে ভারত ছাড় আন্দোলনে উজ্জিবিত। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোভাগের নেতৃস্থানীয় নেতাদের প্রায় সকলে বিলেতে পড়াশোনা করা ব্যারিষ্টার। কংগ্রেস নেতা করম চান গান্ধী, জহর-লাল নেহের, সরদার প্যাটেল, নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু। মুসলিম লীগের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। এ, কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, সকলেই ছিলেন আইনজীবী। সোহরাওয়ার্দীর একনিষ্ঠ কর্মী এবং অনুগামী হিসেবে শেখ মুজিব যখন স্থীর করেই ফেলেছেন জীবনে রাজনীতি করবেন তখন নিজেকে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর এবং নিজেকে সেভাবে গড়ে তোলার জন্য আইন পড়া অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল শেখ মুজিবের কাছে। তাই তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে বি.এ ডিগ্রী সমাপ্ত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। ততদিনে দেশভাগ হয়ে ভারত-পাকিস্তানের জন্য হয়েছে উপমহাদেশে। 

সারা জীবনের বড় একটি অংশ করাবাস এবং কারাজীবন ভোগও মুজিবকে আইন পড়ার প্রতি উদুদ্ধ করেছে। শেখ মুজিব প্রথম কারাজীবনের অভিজ্ঞতা লাভের সম্মুখীন হন “মাত্র ১৯ বছর বয়েসে, ১৯৩৯ সালে। ঘটনাটি ছিল”, ১. সে বছর গোপালগঞ্জে একটি মেলার আয়োজন করা হয়। স্থানীয় হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের মানুষ মিলে সম্মিলিতভাবে মেলার আয়োজন করা হয়। মেলা চলাকালীন হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক কলহ সৃষ্টি হয়। কলহ দাঙ্গায় রূপ নেয়। খবর পেয়ে মুজিব সঙ্গী সাথীদের নিয়ে দাঁড়ালেন দাঙ্গা থামাতে। দাঙ্গা থামলো বটে তবে কিছু হিন্দু নেতৃস্থানীয় লোকের স্বার্থের হানি হওয়াতে তারা মুজিবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেল। মুজিবকে শায়েস্তা করতে হবে, এই ‘পুচকে’ নেতার উচিত শিক্ষা দিতে হবে। তার উপর আবার এ পুচকে ‘যবনের ছেলে’। কিছুতেই ছাড়া যাবে না একে। এর মাথা এখনই কচলে দিতে হবে। হিন্দুু নেতারা থানায় গিয়ে শেষ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামী করে এজহার দায়ের করলো মেলায় ভাংচুর এবং আর্থিক ক্ষতি সাধনের অভিযোগে। এজহার দায়ের করেই ক্ষান্ত হয়নি, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করিয়ে সেই রাতেই মুজিবকে গ্রেফতার করানো হলো। যদিও শেখ মুজিব জীবনের প্রথম থেকেই ছিলেন সর্ম্পূন অসম্প্রদায়িক মনোভাবপন্ন একজন মানুষ। বিচারে শেখ মুজিবের ৭ দিন বিনাশ্রম কারাদন্ড হলো। জীবনের প্রথম তিনি কারাবাস যাপন করলেন। তবে শেখ মুজিবের এই ঘটনা থেকে একটি জিনিস। স্পষ্ট হয়ে ফুঠে উঠেছে যে, শৈশব-কৈশর থেকেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময়ের উল্লেখযোগ্য অংশ কাটাতে হয়েছিল কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে-নির্জন সেলে। কথিত রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক বক্তব্য প্রদান, দাঙ্গা-হাঙ্গাঁমা, খুনের চেষ্টাসহ বিভিন্ন হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলায়, দি বেঙ্গঁল স্পেশাল পাওয়ার অর্ডিন্যান্স, ১৯৪৬’ যা পরবর্তীতে অস্থায়ীভাবে পুনঃপ্রবর্তন ও ধারাবাহিকতা দেওয়া হয় ‘দি ইষ্ট বেঙ্গঁল অ্যাক্ট, ১৯৫১, নামে। ‘দি ইষ্ট পাকিস্তান পাবলিক সেফটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৫৮’ এবং ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুল্স, ১৯৬৫ যেগুলি ‘পাকিস্তানের নিরাপত্তা’ নামে অধিক পরিচিত ছিল। এসব আইনের আওতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বারংবার পাকিস্তান সরকার গ্রেফতার ও আটক করে রাখে। আদালতের আদেশে এক মামলায় মুক্তি পেলে জেলগেটেই আরেক মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আটক রাখে। ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ই তাঁকে তেমন গ্রেফতার দেখানো হয়।

তাঁর বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের এবং বিচার করার জন্য পাকিস্তানের রাষ্ট্র প্রধান ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আয়ুব খানের সরকার ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান প্যানাল কোডের ১২১(ক) ধারা এবং ১৩১ ধারা অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামী করে মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা বিশেষ ট্রাইবুন্যাল গঠন করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটি দায়ের করে এবং আগে থেকে আটককৃত শেখ মুজিবকে এই মামলায় নতুনভাবে আটক দেখিয়ে জেলে ভরে রাখা হয়। আপসহীন সংগ্রামী বঙ্গবন্ধু সেসব পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন অদম্য সাহস আর জনগণের উপর গভীর আস্থা রেখে। 

শেখ মুজিবের ছিল অসাধারন সাংগঠনিক দক্ষতা ও ক্ষমতা এবং অন্যায়ের প্রতিবাদী মনের পরিচয় ফুটে উঠেছে। শৈশবের এসব ঘটনা শেখ মুজিবকে আইন আদালতের প্রতি কৌতুহল করে তোলে। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে বি,এ পাশ করে দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন ১৯৪৮ সালে। কিন্তুু আন্দোলন সংগ্রাম যার ললাটে লেখা তার কী সুস্থীর হয়ে কোথাও লেগে থাকা সম্ভব?

১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন ধর্মঘট এবং কর্মবিরতিতে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে শেখ মুজিবকেও অর্থ জরিমানা করে।

অনেকে জরিমানা পরিশোধ করে ছাত্রত্ব বজায় রাখেন কিন্তুু শেখ মুজিব ‘অন্যায় জরিমানা’ দিতে অস্বীকার করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের পেছনে সরকারের কারসাজি ছিল, ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রতি শেখ মুজিবের সমার্থক এবং কার্যক্রম গ্রহণের প্রতিশোধ হিসেবে। এভাবেই শেখ মুজিবের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন-অসমাপ্ত রেখে সমাপ্ত হয়। 

তারপর সারা জীবন কাটে আন্দোলন-সংগ্রামে, কারাবাসের জীবনে আইন-আদালতে আইনজীবীদের সহচার্যে। তাইতো মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষমতা গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধু, জাতীর পিতা প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান বৃটিশ ও পাকিস্তানী বিভিন্ন নির্বতনমূলক এবং নির্যাতনমূলক আইনের সংশোধনী এনে জনজীবনের প্রয়োজনীয় নতুন নতুন আইন জারি করলেন।

১৯৭৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর নিজের স্বাক্ষরিত ৪০টি আইন পাশ হয় সংসদ কর্তৃক। তার আগে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বেশ কিছু আইন পাশ হয় জনকল্যানমূলক। রাষ্ট্র পরিচালনার প্রয়োজনীয় আইন। 

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু দেশে প্রত্যাবর্তনের পর এবং রাষ্ট্রভার গ্রহণ করার পর তাঁর শাসনামলে ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দেশে মোট ২৫২টি পি.ও (প্রেসিডেন্ট অর্ডার), আইন (অপঃ) অধ্যাদেশ, অর্ডিন্যান্স জারি হয়।

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে পৌছার আগে পর্যন্ত এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণের পর সদ্য স্বাধীন দেশ পরিচালনার জন্য মোট ৩৬টি চ.ঙ বা প্রেসিডেন্ট অর্ডার জারি করা হয়। ১৯৭৩ সালে ৩৪টি এ্যাক্ট বা আইন এবং ৩৩টি অধ্যাদেশ বা অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়। ১৯৭৪ সালে ৫৩টি এ্যাক্ট, ৯টি অধ্যাদেশ বা অর্ডিন্যান্স এবং ১৯৭৫ সালে ৩৭টি এ্যাক্ট বা আইন, ৫০টি অধ্যাদেশ বা অর্ডিন্যান্স জারি হয়। তার মধ্য ৪০টি আইনে শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতার প্রধান বা প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজে স্বাক্ষর করেন। 

সারা জীবন বঙ্গবন্ধু আইনের প্রতি ছিলেন গভীর শ্রদ্ধাশীল। যেটা আমরা দেখি একাত্তুরের পয়লা মার্চের পরবর্তী সময়ের সেই উত্তাল দিনগুলিতেও তিনি ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসি। তার প্রকৃষ্ট প্রমান পাই আমরা ৭ মার্চের ভাষণে। সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে তিনি যদি একটা ডাক দিতেন “আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন! আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দিলাম। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রæর উপর ঝাপিয়ে পরো।” তবে সেদিন কী হতো তা একমাত্র খোদাতালাই জানেন। কারন সাড়ে সাত কোটি বাঙালি সেদিন তার এই ডাকটিরই অপেক্ষায় উম্মুখ হয়ে ছিল। এতো চাপের মধ্যেও বঙ্গবন্ধু ধীরস্থীর ছিলেন নিজেও। আইন অমান্য করেননি সেদিন। আইন অমান্যের ডাকও দেননি। বলেছেন “তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুুত থাক”। তিনি তার ১৯ মিনিটের ভাষণে কী দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন। আইন অমান্যও করেননি আবার জনগণের প্রত্যাশাকেও সামাল দিয়েছেন ‘ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলা’র ডাক দিয়ে।

আইন-আদালত, জেল জরিমানা বঙ্গবন্ধুর জীবনের সাথে ওৎপরভাবে জড়িয়ে ছিল। ৫৪ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে ৪৬৮২ দিন তিনি জেল খেটেছেন। বিভিন্ন মামলায় তাঁকে জীবনের দীর্ঘ সময় কোর্ট কাচারির দরজায় হাজিরা দিতে হয়েছে। মামলা মোকদ্দমা পরিচালনার জন্যে আইনজীবীদের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ছিল এমনই ব্যক্তিত্ব যার কারনে দেশের বিশিষ্ট আইনজীবীরা তাঁর বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। অনেক আইনজীবী কোনরকম ফি না নিয়েই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মামলা পরিচালনা করেছেন। তেমনি একজন বন্ধু আইনজীবী ছিলেন তৎকালীন ঢাকা হাইকোর্টের জাদরেল আইনজীবী ও ঢাকা হাইকোর্ট বারের সভাপতি আব্দুস সালাম খান। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আইনজীবী।

সালাম খানের ছবি

১৯৬৮ সাল থেকে ৬৯ সাল, গণআন্দোলনের মুখে মামলাটি সরকার কর্তৃক প্রত্যাহার করে নেয়া পর্যন্ত সালাম খান দৃঢ়তার সাথে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনা করেছিলেন। মামলা পরিচালনায় তাঁর কৌশলের কারনেই পরবর্তীতে মামলাটি মিথ্যে মামলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মামলাটি ভেস্তে যায়।

 

জয় বাংলা
জয় বঙ্গবন্ধু।

 

সাহিদা বেগম
গবেষক সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল,
বাংলা একাডমেি পুরস্কার প্রাপ্ত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top