সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

বৃদ্ধাশ্রম নয়: পরিবারই হোক মায়েদের আনন্দ আশ্রম : ড. শাহনাজ পারভীন


প্রকাশিত:
১১ মে ২০২১ ০১:৫৩

আপডেট:
১১ মে ২০২১ ০২:৩৩

ছবিঃ : ড. শাহনাজ পারভীন

 

সূর্য হাসির দিনটাই মা থাকে না অন্ধকার, মা যেন সবার তাসনিম শোভা চোখে চোখে মাখে তার। ক্ষুধার্ত পৃথিবীর কোটি কোটি শব্দডালির মধ্যে ‘মা’ নামটাই সবচেয়ে মধুর এবং মাহাত্মপূর্ণ। মাকে কেন্দ্র করে বিশ্ব সাহিত্যে যে কত শত ছড়া কবিতা, গান, গল্প, লোক কথা, প্রবাদ, প্রবচন রচিত হয়েছে তার কোন নিখুঁত হিসাব বিশ্বকোষে মিলবে না। যার মা যেমনি হোক তার মাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ।

‘যে ছবিটি সন্তানের হৃদয়পটে আমৃত্য আঁকা থাকে’ সেই ছবিটি একজন মায়ের। মায়েরা সত্যি সত্যি বিস্ময়কর! সমস্ত অমানিশা অন্ধকার দুঃখ, রোগ, শোক মা ছুঁয়ে দিলে যেন অমৃত হয়ে যায়। সেই মাকে কেন্দ্র করেই মা দিবসটি এ বছরে আমাদের দুয়ারে কড়া নাড়তে আসছে। আমাদেরও প্রস্তুত হতে হবে মা দিবসটির মাহাত্ম উপলব্ধির মাধ্যমে তাকে যথাযথ গুরুত্ব দেবার। তবে একথা ঠিক যে, অন্য দিবসের মত ‘মা দিবস’ শুধু দিবসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। মা একটা অন্য ব্যাপার অনেক বড় কিছু। তাকে দিবসের জালে আবদ্ধ করা যাবে না, যায় না কখনো। 

পবিত্র কুরআনে নাযিল হয়েছে: আমি মানুষকে তার পিতা মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছি। কিন্তু সে যেন ভুলে না যায় যে, তার মাতা কত কষ্টের পর কষ্ট করে তাকে গর্ভে ধারণ করেছিল আর সুদীর্ঘ দুই বৎসর ধরে তাকে নিজের দেহ নিংড়ানো স্তন্য দান করেছিল। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। আল কুরআন: ৩১: ১৪। অন্যত্র এসেছে: আমি মানুষকে পিতা মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার তাকিদ দিয়েছি। (মায়ের সাথে সদ্ব্যবহার করার খুব তাকিদ দিয়েছি) কারণ (মা) তাকে খুব কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে, প্রসবও করেছে দুঃখ কষ্ট সহ্য করে। আল কুরআন: ৪৬: ১৫

হাদীসে এসেছে: ‘মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের বেহেস্ত’। আল কাদায়ী। কুরআন ও হাদীসের এই বাণীই মায়ের মর্যাদার ওজন বহন করে। বোঝা যায় মায়ের স্থান বিশ্বের শীর্ষে। বিশ্বের ইতিহাসে এটা একটা অবিস্মরণীয় অবদান। মা এলো বলেই পৃথিবীটা এলো।

বিশ্বের ইতিহাসে ‘মা দিবস’ পালনের ধারণাটি একেবারে নতুন নয়। গ্রিক ও রোমক পুরাণে বিশেষ করে বসন্ত উৎসবে যে সব দেবী মা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন তাদেরকে ঘিরেই আনুষ্ঠানিকভাবে মায়ের ভালোবাসা প্রকাশ পায়। খ্রিস্ট ধর্মের প্রথম যুগে মাসের চতুর্থ রোববার যীশু খৃস্টের কুমারী মা মেরীকে সম্মান জানানো হতো।

বর্তমান প্রচলিত মা দিবসের সূচনা বিংশ শতকের গোড়ার দিকে। মার্কিন নাগরিক ‘এ্যানামেরি জারভিস’ দিবসটির প্রতিষ্ঠাতা। ১৮৬৮ খ্রি. ‘এ্যানামেরি জারভিস’ গৃহযুদ্ধ আক্রান্ত পরিবারগুলোকে একত্রিত করে তিনি মায়ের মমতা দিয়ে তাদেরকে যুদ্ধের শোক ভোলাবার চেষ্টা করেছিলেন। তখনি তিনি সবার কাছে ‘মা’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিলেন। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ৯ মে অ্যানার মা মারা যান। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন মায়ের সম্মানে এমন কিছু করবেন যা মায়ের সম্মান বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। শুধু তাই নয়, তিনি মায়েদের প্রতি সন্তানের শ্রদ্ধা ভালোবাসার চর্চাকে ও একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চেয়েছিলেন। 

১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই তিনি এ ব্যাপারে বিশেষ প্রচারণা শুরু করেন। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মে পশ্চিম ভার্জিনিয়া, ফিলাডেলফিয়া, পেনসিল ভানিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে মা দিবস পালিত হয়। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকার সব রাজ্যেই দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় উদযাপিত হয়। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন অ্যানার সম্মানার্থে রাষ্ট্রীয়ভাবে মে মাসের দ্বিতীয় রোববার ‘জাতীয় মা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি ঐদিন সরকারী ছুটিও ঘোষণা করেন। সেই থেকে পশ্চিমা বিশ্বে বেশ জাঁকজমকের সাথেই এ দিবসটি পালিত হয়। সে হিসেবে এ বছর ৯ মে ‘বিশ্ব মা দিবস’ পালিত হবে।

দেশে দেশে এ দিনটি সন্তান আর মায়ের মিলন মেলায় পরিনত হয়। বিভিন্ন উপহার ফুলের মাধ্যমে সন্তানরা মাকে ভালোবাসা জানায়। বিশেষ করে যে সব মা বাবা প্রগাঢ় দাম্পত্য জীবন লীড করেন না, আলাদা আলাদাভাবে বসবাস করেন সেইসব মায়ের সন্তানরা এই দিনটি মায়ের সাথে কাঁটিয়ে সারাটা বছর সেই স্মৃতি রোমন্থন করেন। এতেই যেন তাদের পূর্ণতা, এতেই তারা ধন্য। যেমনভাবে দূরের বন্ধুদেরকে তাদের জন্মদিনে বছরে একবার উইশ করা। মেইল পাঠনো। ব্যস, এতেই তাদের মনে রাখা, সারা জীবন বন্ধুত্বের বন্ধন শেয়ার করা। 

কয়েক বছর থেকেই আমাদের দেশেও মা দিবস বেশ আড়ম্বরের সাথেই পালিত হচ্ছে। মা শব্দটি মনের পর্দায় ভেসে উঠলেই যে সর্বাংসহা মমতাময়ী হৃার্দিক মূর্তি ভেসে ওঠে তা পৃথিবীর পক্ষ থেকে একজন মানব সন্তানের জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা কি সেই সম্পর্ক অটুট রাখতে পারছি?  বদলে যাচ্ছে জগৎ, বদলে যাচ্ছি আমরা। সময়ের প্রেক্ষিতে তৈরি হচ্ছে ‘ওল্ডহোম’ মায়েদের বাবাদের শেষ আবাসস্থান। বিশ্বময় এই পেণ্ডামিকের কিছুদিন আগে একটি বিশেষ দিনে একটা ‘ওল্ডহোম’ এবং একটি সরকারী ‘শিশু পরিবার’ এ বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে এলাম। 

কয়েকজনের সাথে খুব নিবিড়ভাবে কথা বলে জানতে পারলাম, এই আনন্দঘন পান্তাভাত-ইলিশের দিনে তাদের মায়েদের কথা খুব বেশি মনে পড়ছে। তেমনি ওল্ডহোমের বৃদ্ধা মায়েরাও বৃদ্ধ বাবাদের মতো খবরের কাগজে নিবিষ্ট মুখ ডোবাতে পারছেন না।বারবার তাদের চোখের সামনে উঁকি দিচ্ছে তাদের বিগত দিনের স্মৃতি। তাদের ছেলেমেয়েসহ আনন্দঘন পারিবারিক মিলন মেলার চিত্রকলা, দৃশ্যাবলী। হা হুতাশ করে তাদের দিন যায়। মা দিবসের কথা তাদের বলতেই তাদের অশ্্রুসজল চোখ কেমন ঘোলাটে দেখাচ্ছিলো। না, তাদের সন্তানরা পশ্চিমা দেশের মতো অন্তত: মা দিবসেও দেখতে আসেন না, খোঁজ নেন না। উপহার তো সুদূর পরাহত। এই পেণ্ডামিকের সময়ে বাবা মাকে অবহেলা, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার নানান খবর আমাদের গোচরীভূত হয়েছে। আমরা চাই সেই অমানবিক খবরগুলো মিথ্যে হয়ে যাক, ভুল প্রমানিত হোক। বাবা মা থাকুক সকলের আদরে ও মমতায়।

যাযাবর বলেছিলেন: ‘বিজ্ঞান আমাদের বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে, কেড়ে নিচ্ছে আবেগ।’ সত্যি সত্যিই আমরা আবেগ অনুভূতিহীন ধু ধু শুন্যতায় ভুগছি! তবু আশার কথা এখনও পর্যন্ত আমাদের এই দেশে পশ্চিমাদের মতো যত্রতত্র ওল্ডহোমের ব্যাপক চর্চা শুরু হয়নি। এখনো আমরা পারতপক্ষে মা বাবা, শ্বশুর শ্বাশুড়িসহ একটি প্রগাঢ় লাবণ্যময় পারিবারিক জীবন উপভোগ করবার চেষ্টা করছি। কিন্তু তারপরও প্রাত্যহিক প্রয়োজনেই আমাদের যৌথ পরিবারগুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে একক পরিবার গড়ে উঠছে। কিন্তু আমাদের সদিচ্ছা থাকলে দিনের শেষে, সপ্তাহ শেষে কিংবা মাসের শেষে অবশ্যই মায়ের পাশে বসে মায়ের ভালোবাসার আদরে নিজেকে এবং সিক্ত করাতে পারি মায়েদেরকেও। এতটুকু ত্যাগ অবশ্যই স্বীকার করার সময় এসছে। আমাদেরকে ভাবতে হবে একটা সময় আসবে যখন আমরাও বর্তমান মায়েদের মতো কঠিন সময় পার করবো। তখন কিন্তু হাজার চেষ্টাতেও হিসাব মেলাতে পারবো না, মিলবে না হিসাব। আমরা তারই প্রতিদান পাব যা আমরা বিগত দিনে চর্চা করে এসেছি। 

তাই আসুন মায়ের মমত্ববোধকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সম্মান জানিয়ে মাকে ভালোবেসে আত্মার বন্ধনকে সুদৃঢ় করি। সর্বাবস্থায় মাকে পাশে রাখবার চেষ্টা করি। এবারের শ্লোগান হোক কোন অবস্থায়ই ওল্ড হোম নয়- পরিবারই হোক মায়েদের আনন্দ আশ্রম। মাকে কাছে রাখি, পাশে রাখি, ভালবাসি অনন্ত... তাঁর মত। মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগীরা’। তাকে শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার মধ্যে বিশ্ব মা দিবস উপভোগ করি। দীর্ঘজীবি হোক মা দিবস, দীর্ঘজীবি হোক মায়েরা, শান্তিতে থাকুক মায়েরা এটাই আমাদের প্রত্যাশা। 

 

শাহনাজ পারভীন
কবিকথাসাহিত্যিকপ্রিন্সিপালতালবাড়ীয়া ডিগ্রি কলেজযশোর

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top