সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১

চেনা অচেনা বাংলাদেশ  : ডাঃ একরাম চৌধুরী


প্রকাশিত:
২১ জুলাই ২০২২ ০৪:১১

আপডেট:
১৮ এপ্রিল ২০২৪ ০৬:৪৪

  ছবিঃ ডাঃ একরাম চৌধুরী

 

একঃ
আমার বেড়ে উঠা নোয়াখালীর মাইজদী শহরে। শহীদ ভূলু স্টেডিয়ামের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে মেইন রোডে ছিল আমাদের বাসা। খুব ছোট থাকতেই দেখতাম আব্বা আম্মা খুব পরহেজগার। নামাজ এবং কোরান তেলওয়াত উনাদের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ ছিল। নতুন বাস স্ট্যান্ড পেরিয়ে হাতের বামে পুলিশ লাইন মসজিদ। সেখানেই আরবিতে আমার ভাই বোনদের হাতে খড়ি। মসজিদের রাস্তা ধরে পূর্বদিকে গেলেই ছিল হিন্দু পাড়া। হিন্দুদের এমন কোনো পূজা পার্বন নেই যে আমরা দেখতে যাইনি। চরম ফরহেজগার আম্মাই আমাদের মনে করিয়ে দিতেন হিন্দুদের পূজার কথা। আমাদের জন্য বিশেষ সমাদর ছিলো হিন্দু পাড়াতে ।তাদের নারকেলের লাড়ুর স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। আমাদের বাসায় প্রসাদ আসতো প্রতি পূজা পার্বনে। আজান এবং নামাজের সময় পূজা বন্ধ করে রাখতেন পুরোহিতরা। পূজার সময় আমাদের হুজুর ধর্মীয় সহিষ্ণুতা শেখাতেন। বলতেন "লাকুম দ্বীনুকুম ওয়া লিয়া দ্বীন- তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম , আমার জন্যে আমাদের।"

দুইঃ
১৯৯৭ সাল। ইন্টার্নী শেষে আমি তখন নোয়াখালী প্রাইভেট হসপিটালে চাকুরি করি। বেশ রাতে একজন বয়োঃবৃদ্ধ রোগী আসলেন। আমাদের হসপিটালের ওয়ার্ড বয় প্রদীপের বাবা। এস্পিরেশন নিউমোনিয়া আর রক্ত বমি । আর অসম্ভব রকমের রক্ত শুন্যতা। জরুরী রক্ত দিতে হবে। এত রাতে রক্ত জোগাড় করা কঠিন। আমার রক্তের গ্রুপের সাথে মিললো। রক্ত দিলাম। কখনোই জাত ধর্মের কথা মনে আসেনি। সারা রাত জাগে রইলাম উনার প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে। সেই যাত্রার বেঁচে গিয়ে ছিলেন। যতবার প্রদীপের সাথে দেখা হয়েছে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে তাঁর বাবার জন্য আমার রক্ত দেওয়ার কথা পরম শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করেছে।

তিনঃ
ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের ছাত্র ছিলাম আমি। টার্মের শেষে নোয়াখালী আসতাম। ছুটির সময় পড়ানোর জন্য আব্বা টিউটর ঠিক করে রাখতেন। হারাণ স্যারের কাছে অংক আর নাগ বাবু স্যারের কাছে ইংরেজী পড়তাম। ঈদে চাঁদে স্যাররা পরিবার পরিজন নিয়ে আমাদের মাইজদীর বাসাতে আসতেন। আম্মা খুব যত্ন করে উনাদের আপ্যায়ণ করতেন। উনারা গরুর মাংস খেতেন না এটা আম্মা সব সময় মাথায় রাখতেন। আমার প্রাইভেট হসপিটালের কলিগরা বাসায় আসতো। আমার বন্ধু রতন চক্রবর্তী, গৌতম দা আর কিশোরের সাথে একসাথে চাকুরী করেছি। কে মুসলমান কে হিন্দু কখনোই চিন্তায় আসেনি।

চারঃ
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পাড়ার সময় অনেক হিন্দু বন্ধু ছিল আমার। বেশ কয়েকজন খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মাঝে মিঠুন, রতন, নিহার , রণজিৎ, চয়ন পীযুষ আর পূরবীর নাম স্মরণে আসছে। রোজায় ইফতারের সময় বয়েস হোস্টেলে তারা আমাদের সাথে আসে বসতো নির্দ্বিধায়। চয়ন দুষ্টামি করে কখনও টুপিও পরতো। আমরা হাসি ঠাট্টা করতাম। মনে আছে রায়টের সময় চয়ন মজা করে নাম পাল্টিয়ে মুসলমান নাম রাখতো। আমাদের সেই সব দিনের কথা খুব মনে পড়ে। আওয়ামী ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ কর্মী হয়েও মিঠুন আর চয়ন দেশ ছেড়েছে বহু কষ্ট বুকে নিয়ে। যেখানে নিজের নাড়ি পোতা সেই ভিটে মাটি ছাড়া খুব কষ্টের, খুব বেদনার।

পাঁচঃ
ফরিদপুর মেডিক্যালে লেকচারার হিসাবে চাকুরী করার সময় সুবাস দে, প্রণয় ,অজয় সরকারদের সাথে একসাথে থেকেছি। এক বিছানায় ঘুমিয়েছি, এক পাতিলে রান্না করে খেয়েছি। আমার বা তাদের ধর্মের তো কোনো ক্ষতি হয়নি। আমাদের ধর্মীয় পরিচয় ছিল গৌণ,সম্পর্কটাই ছিল মুখ্য। হাসি, ঠাট্টা আর গল্প করতে করতে মাঝে মাঝে দল বেঁধে হেঁটে , কখনও বা রিকশায় করে আমরা কলেজে ক্লাস করাতে যেতাম। বাসায় ফিরে গভীর রাত অব্দি আড্ডা, আহা সেই সব দিন। হৃদয়ের বন্ধনটাই ছিল বড়। ঠুনকো ধর্মীয় অনুভূতি নয়।

উপরের খন্ড খন্ড স্মৃতি টুকুই আমাদের চেনা বাংলাদেশের। সেই বাংলাদেশ এখন কত অচেনা মনে হয় ! এখন ইসলাম ধর্ম রক্ষার নামে যখন তখন অন্য ধর্মাবলম্বীদের আঘাত করা, লুটপাট, অগ্নি সংযোগ ভাঙ্গচুর যেন আমাদের অচেনা বাংলাদেশের খুব স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর নাম কি ইসলাম ? প্রকৃত ইসলাম তো আমাদের এই শিক্ষা দেয়নি !এরপর প্রতিবাদ, মানব বন্ধন, মিছিল আশ্বাস কিংবা ওয়েবিনার । আমি বির্বত, লজ্জিত, মর্মাহত -ভুক্তভোগীদের সহমর্মিতা জানাতে সেই সব গতানুগতিক প্রতিক্রিয়া !কিন্তু প্রতিরোধ কোথায়? আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে যদি পূজা মন্ডপ বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বসত বাটি পাহারা দিতে হয় তবে ধর্মীয় স্বাধীনতার মূল্য কোথায় থাকে? এত ঠুনকো হয়ে গেলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ? একজন কি পোস্ট দিলো ফেসবুকে তাতেই আমাদের ধর্মের বারোটা বাজে গেল ? এত ঠুনকো আমাদের ইসলাম প্রীতি ?

তা হলে আমাদের করণীয় কি? আমি মনে করি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার গোড়াতেই গলদ। শিক্ষা জীবনের শুরুতেই আমরা সহনশীলতা শেখার পরিবর্তে শিখে যাই সামাজিক, ধর্মীয় এবং লিঙ্গ বৈষম্য। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে একেবারে ছোটবেলা থেকে, শেখাতে হবে সহনশীলতা । শিশুদের অসাম্প্রদায়িক হিসেবে গড়ে তোলার বিকল্প আছে বলে আমি মনে করি না। সামাজিক, ধর্মীয় এবং লিঙ্গ বৈষম্য সমূলে লোপাটে পরিবারের ভূমিকা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে।

মূলত ১৯৭৫-সালে অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর থেকে স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে বাংলাদেশকে অকার্যকর মুসলিম রাষ্ট্র বানানোর সুদূরপ্রসারি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে ভিন্নধর্ম, ভিন্নমত ও ভিন্ন জীবনধারার অনুসারী নিরীহ নাগরিকদের উপর ধারাবাহিকভাবে হামলা চালাচ্ছে। নিকট এবং দূর অতীতের সকল সাম্প্রদায়িক হামলাকে বিশ্লেষণ করে এই কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে এর মূল টার্গেট হচ্ছে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ জীবনধারা, আমাদের সংষ্কৃতি এবং শিক্ষা ব্যবস্থা।সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধতার প্রভাব এখন তৃণমূল পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ক্রমশ গ্রাস করে ফেলছে। মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী দেশের সাংস্কৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট করার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের মাধ্যমে ধর্ম বিকৃতির অপচেষ্টা করছে।

আমরা, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ইতোমধ্যেই ভুলে গেছি মুক্তিযুদ্ধের সময় কীভাবে বাংলাদেশের সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ একে অপরকে সাহায্য সহযোগিতা করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে, ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একে অপরের সঙ্গে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ভাগাভাগি করেছিল। আমি সেই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ ফেরৎ চাই। শিক্ষাবিদ ও সংস্কৃতিকর্মী অধ্যাপক রতন সিদ্দিকীর ভাষায় বললে বলতে হবে আমাদের হারানো শুক্রবার আমরা ফেরৎ চাই। সকল ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং এর পাঠক্রমে সরকারের কঠোর নজরদারিত্ব চাই । বঙ্গবন্ধুর আদর্শে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকতার মূল উৎপাটন চাই। দেশ ও জাতিকে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার করাল গ্রাস থেকে বাঁচাতে হলে ধর্মান্ধ অপশক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করতে হবে এবং তা করতে হবে আমজনতাকে সাথে নিয়েই। শুধুমাত্র গতানুগতিক সভা সমাবেশ আর ওয়েবিনার প্রতিবাদ সীমাবদ্ধ রাখলে তিরিশ লাখ শহীদের রক্তের , দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রিয় দেশ মাতৃকা অচিরেই অচেনা ভূখণ্ড হয়ে যাবে। এই দেশ আমার মা, এই মাটি আমার প্রার্থনা ,এর আলো বাতাস আমাদের হৃদয়ের স্পন্দন। "ও মা, গরিবের ধন যা আছে তাই দিব, চরণতলে" - রবীন্দ্র সংগীতের এই লাইনটি যখন শুনি, বুক মোচড়ে কান্না আসে। আহা ২০ বছর দেশ ছাড়া; আমি অভাগা, তাই থাকতে পারিনি তোমার কোলে। তবু, "আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি", মুক্তিযোদ্ধার একজন সন্তানও জীবিত থাকতে এই পুন্য ভূমিকে ধর্মান্ধ কুপমুণ্ডুকতার চারণভূমি হতে দেয়া যাবে না, দেয়া হবে না।

 

ডাঃ একরাম চৌধুরী
সভাপতি
ফোরাম ফর সেক্যুলার বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া চ্যাপ্টার

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top