সিডনী রবিবার, ৮ই ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১

এ পাপ আপনার, আমার, আমাদের সবার : শাকিলা নাছরিন পাপিয়া 


প্রকাশিত:
২৫ আগস্ট ২০২৪ ১৫:২১

আপডেট:
২৫ আগস্ট ২০২৪ ১৯:০৯

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া 


হাস্যোজ্জ্বল মুখের ছবির ছেলেগুলো আজ আর নেই। তাদের কোলাহলে আর মুখরিত হবে না  ঘর, শিক্ষাঙ্গন, বন্ধুদের আড্ডা। যারা রাজপথে নেমেছিল তাদের অধিকার জানাতে। বঞ্চনার দীর্ঘকালের ক্ষোভ যাদের কণ্ঠে জেগে উঠেছিল শ্লোগান হয়ে, যাদের জমানো ব্যথা ভাষা পেয়েছিলো মিছিলে তাদের মৃ্ত্যুর পর তারা সারা বাংলার মায়েদের সন্তান হয়ে বুকের হাহাকার হয়ে, জেগে রইল চোখের জলে। এই ছেলেগুলোর চলে যাওয়া আমাদেরই পাপের ফল। মনে আছে,সেই যে শাপলা চত্বর! এতিম ছেলেগুলোকে আনা হয়েছিল। তারপর এক ভয়ঙ্কর সকালে আমাদের বিটিভিগুলো ক্রমাগত দেখাতে লাগলো ধ্বংসযজ্ঞের ছবি। কেউ প্রশ্ন করলো না এতোগুলো এতিম ছেলের কী হলো? তারা কোথায় গেলো? মিথ্যা বারবার বলে বলে সত্য তৈরি করা হলো। আমরা নিশ্চুপ ছিলাম। দেশের বুদ্ধিজীবি,  মিডিয়া,জ্ঞানী সবাই নীরবতা পালন করেছিল।

আবরারের মৃত্যুর পর অভিভাবকরা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সন্তানের নিরাপত্তায় নির্যাতন বন্ধের আবেদন জানাতে পারতেন। তারা তা করেন নি। বরং সন্তানকে ঠেলে দিয়েছেন হিংস্র হায়নার মুখে।

কুকুর, বিড়ালও তাদের সন্তানের নিরাপত্তায় রুখে দাঁড়ায় অথচ আমরা মানুষেরা আমাদের সন্তানের নিরাপত্তায় এক হতে পারি নি। মৌন থেকেছি প্রতিটি অন্যায়ে। ভোটবিহীন নির্বাচন, রাতের ভোট, নিজেরা নিজেরা ভোট নব নব কৌশলে দর্শকের ভূমিকা পালন করেছি। বাঁশের ব্যবহার দেখেছি রাস্তা তৈরি, রেললাইন মেরামত, স্থাপনা ঢালাইসহ আরো অনেক কিছুতে রডের পরিবর্তে। হাসপাতালে চিকিৎসা নেই, সরকারি অফিসে সেবা নেই, বিল দিয়েও গ্যাস নেই, জন্ম নিবন্ধন, আইডি কার্ডে হয়রানিসহ নানা অনিয়মে আমাদের কণ্ঠ ছিল বন্ধ। আমরা অন্যের ছেলে ক্ষুদিরাম হবে সে প্রত্যাশায় বসে ছিলাম।

আজ আমাদের সন্তানেরা নাবিকবিহীন জাহাজ। তারা নিজেদের পথ নিজেরাই তৈরি করে এগিয়ে যাচ্ছে। এ যাত্রায় আমরা নির্বাক। এ যাত্রায় আমরা সন্তানহারা পিতা মাতা। এ যাত্রায় আমরা চোখে জল আর  বুকে আশংকা নিয়ে প্রতি নিয়ত মরে যাচ্ছি দুঃশ্চিন্তায়। আমারা যখন রাজার পোশাকের জয়ধ্বনি দিচ্ছিলাম তখন আমাদের সন্তানেরা রাজা নেংটা উচ্চারণের সাহস দেখিয়েছে।

আমরা হতবাক হয়ে দেখছি, কুরুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছে ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাই। আমরা আমাদের সবটুকু দিয়ে তিল তিল করে গড়ে তোলা সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে স্বপ্ন দেখি আগামী সুন্দর সময়ের। সেই সন্তান অন্যের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে, ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে, ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত শাসকের সুরক্ষায় কখনো ছাত্রদল,  কখনো শিবির, কখনো ছাত্রলীগ হয়ে যায় মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে। আমাদের সন্তানদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে, আমাদের সন্তানদের পরস্পর শত্রুর ভূমিকায় অবতীর্ণ করে, তাদের সন্তানের শিক্ষা আর জীবনকে সুরক্ষিত রাখার প্রয়াস করে। ফলে তাদের সন্তান থাকে বিদেশে নিরাপদে, উন্নত জীবনমানে। এই মৃত্যুর মিছিলে কোন মন্ত্রী, এমপির সন্তান নেই। নেই পুলিশ কর্মকর্তা বা সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সন্তান।

আমাদের সন্তানেরা মাঠে লড়ছে তাদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। একটা সাধারণ বিষয়কে যার ঔদ্ধত্য বাণী শ্মশানে পরিণত করে দিল সারা দেশ তিনি একবারও লজ্জিত হননি। এ দেশের পুলিশ, সেনাবাহিনী কবে থেকে এতো আত্মমর্যাদাহীন হলো?
দেশের আইন শৃঙ্খলারক্ষার দায়িত্ব কি ছাত্র লীগের? একজন মন্ত্রী যখন ছাত্রলীগকে সাধারণ ছাত্রদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয় তখন আমাদের গর্বিত বাহিনীর আত্মসম্মানে কেন বাঁধে না। যে পুলিশের বুলেটে ঝাঁঝরা আমর সন্তানের বক্ষ তারা কি করে আমার দেশের পুলিশ হয়?

কতো কোটি টাকা ক্ষতি হলো সে হিসাব দেখে দেখে ক্লান্ত আমাদের চোখ। টাকার ক্ষতি একদিন পূরণ হবে কিস্তু যে তরুণেরা চলে গেল তাদের মায়ের হাহাকার, বাবার হতাশা, বোনের যন্ত্রণা কী দিয়ে মুছবে এই দেশ? কী দিয়ে পূরণ হবে এ শূন্যতা? অনেক বছরের জমানো পাপ আমাদের। আমাদের পাপে ঝরে যাচ্ছে আমাদের সন্তানগুলো। তাকিয়ে আছি উর্ধ্বপানে। আমাদের কি মুক্তি মিলবে? সন্তান কি ফিরবে ঘরে? বন্ধু হারানোর কষ্ট, অপমান, ক্ষোভ কি তারা ভুলবে? ভুলতে পারবে?

 

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
শিক্ষক ও কলামিস্ট

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top