সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

বিরুলিয়ার চাপা দীর্ঘশ্বাস


প্রকাশিত:
২১ মে ২০১৯ ০৩:৪৯

আপডেট:
৪ এপ্রিল ২০২০ ১৮:৫৫

বিরুলিয়ার চাপা দীর্ঘশ্বাস

আনোয়ারুল হক: বিরুলিয়া গ্রাম লালমাটিয়া থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরত্বে। গাড়িতে করে পৌঁছাতে লাগে ৪৫ মিনিটের মতো। মাজার রোড দিয়ে মিরপুরের বেড়িবাঁধ ধরে ১০ মিনিট চলে বিরুলিয়া ব্রীজে ঢোকার আগে বাঁয়ের রাস্তা ধরে এগুলে তুরাগনদী। খেয়া নৌকায় দু’মিনিটে নদী পার হলেই বিরুলিয়া গ্রাম। চৈত্র মাসের নদীতো এমনিতেই ছোট। তারপরও চারপাশটা এতো সবুজ যে পুরো এলাকাটাকে লাগে ছবির মতো। নৌকায় উঠেই দীর্ঘশ্বাস ফেলি। নদীর পানি কুচকুচে কালো। পানি থেকে আসা পঁচা ঝাঝালো গন্ধ নাকে লাগে। গাজীপুর আর আশেপাশের যত ডাইং কারখানা আছে তার সবকটার বর্জ্য মনে হয় পড়ে এই নদীতে। নিজেদের পরিবেশের তেরোটা বাজিয়ে অল্প দামে গার্মেন্টস প্রোডাক্ট আমরা উপহার দিচ্ছি প্রথম বিশ্বকে। এবার অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে একটা বড় শপিং মার্টে দেখি বাংলাদেশি প্রোডাক্টে ভরা। দাম অবিশ্বাস্য রকম কম।৮/১০ ডলারে যে টি-শার্ট বিক্রি করছে ঢাকার মার্কেটেও এর দাম বেশি। ব্যবসাতো সবার ভালোই হচ্ছে। চারিদিকে শুধুই লাভ আর লাভ। ঢাকা শহরের ঠাঁট বাট বাড়ছে। পিজার নতুন চেইনশপ ওপেন হচ্ছে। শুনছি সেখানে নাকি প্রথম দিনেই বিক্রির বিশ্ব রেকর্ড হয়েছে। এইসব লাভের গল্পের মাঝেই আমাদের জল-জলা সবশেষ।

ছবির মতো গ্রাম বিরুলিয়া। একটু ঘুরলেই বোঝা যায় গ্রামটি আসলে একটি ছোট্ট দ্বীপ। এখন শুকনো মৌসুম। গ্রামের একদিকে নদী আর অন্য সব দিকে অবারিত সবুজ ধানক্ষেত। বর্ষাকালে থাকে সবদিকে থাকে পানি। গ্রামের মাঝখান দিয়ে সরু ইটের একটা রাস্তা চলে গেছে। সেই রাস্তা ঘিরেই বসতি। আমাদের মতো শহুরে মানুষদের মূল আকর্ষণ এই গ্রামের পুরোনো সব দালান। ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় এগুলোর সবই হিন্দু বণিকদের বাড়ি। প্রাচ্যের স্থাপত্যরীতির ধরন অনুযায়ী তৈরি এই বাড়িগুলো এক-দেড়শো বছর আগে এ এলাকার যে প্রাণ-চাঞ্চল্য আর ঐশ্বর্য ছিল তার কথা মনে করিয়ে দেয়। বিরুলিয়া ছিল হিন্দু বণিকদের স্বচ্ছলগ্রাম। এখানকার নামকরা ব্যবসায়ী ছিলেন তারক চন্দ্রসাহা, গোপিবাবু, নিতাই বাবু আর রজনীঘোষ। কোলকাতার আদিঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়ের কর্ণধার নিতাইচন্দ্রের বাড়িও ছিল এইগ্রামে। তাদের বংশধরেরা নাকি চৈত্রসংক্রান্তির সময় এখনো এলাকায় আসেন মাটির টানে। রজনীকান্ত নামের এক জমিদারের বাড়িও নাকি ছিল বিরুলিয়ায়।

তবে আমার ধারণা বিরুলিয়া ছিল পূর্ণ ব্যবসা কেন্দ্র। আজ থেকে শতাধিক বছর আগে এইগ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা তুরাগ নদী যুক্ত ছিল বংশীনদী, ধলেশ্বরী আর বুড়ি গঙ্গার সঙ্গে। ভাওয়াল রাজার জমিদারী এস্টেটের পোর্ট বা বন্দর ছিল বিরুলিয়া। ভাওয়াল রাজা নাকি অস্থায়ী মোকাম বসিয়ে এখান থেকেই শাসন করতেন সাভার, কালিয়াকৈর, শ্রীপুর, বরমী আর আশেপাশের এলাকা। রাজার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে বণিকেরা পণ্য আনতেন। রাজারপাইক, বরকন্দাজ আর মুন্সীরা বাছাই করতো পণ্য। এ উপলক্ষ্যে বসতো বড় মেলা। এভাবেই আশেপাশের এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল আশুলিয়া।

গ্রামে ঢোকার মুখেই পুরোনা এক বটগাছ যেন কালের বিবর্তনের স্বাক্ষী। সঙ্গেই পুরোনো এক মন্দির। এরপর একটু এগুতেই পুরোনো দালান চোখে পড়ে। কোনো কোনো দালান পুনর্নিমাণ করে মানুষ বসবাস করছে। আর তা করতে গিয়ে পুরোনো আভিজাত্য আর নতুন চাহিদার বিশ্রী মিশ্রণ দৃষ্টিগোচর হয়। এক দালানের পেছনের দিকে পুলিশফাঁড়ি স্থাপিত হয়েছে। রাস্তা ধরে আরো সামনে গিয়ে ৫/৬টি ভবন দেখা গেলো। পরিচর্যার অভাবে সবগুলো ভবনের অবস্থাই করুণ। এর মধ্যেও টিকে আছে দেয়ালের কারুকার্য আর দালানের অপূর্বনকশা। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে ভবন গুলোর ছবি তুলছিলাম। সেই ছবি তোলার ফাঁকেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। কান পাতলেই যেন শুনছি মানুষের দীর্ঘশ্বাস। শুনছি পরিবারগুলোর চাপাকান্না। দালান গুলোর প্রতিটা ইট যেন বলছে তার কষ্টের কথা। দেশভাগের সময় কত কস্ট নিয়েই না পরিবারগুলো নিজের গ্রাম, ব্যবসা আর বাড়িঘর ছেড়ে অন্যখানে চলে গেছেন। চলে গেছেন দূরে, বহুদূরে হয়তো জীবনের মায়ায়। দূরের বসতিতে হয়তো তারা ভালো ছিলেন, হয়তো ভালো ছিলেন না। বিরুলিয়ার জীবন তারা হয়তো কোনো দিনই ভুলতে পারেন নি। বিরুলিয়ার স্মৃতি হয়তো তাদের সারাজীবন তাড়িয়ে বেরিয়েছে। আমার মন ভারি হয়ে আসে। সভ্যতার সব ইতিহাসই বর্বরতার ইতিহাস।

দালানগুলোয় আমি আর স্থাপত্যের সৌন্দর্য দেখতে পাইনা। শুধু চাপাকান্না আর দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাই। সে কান্না নারীর, সে কান্না শিশুর আর পুরুষের। ভারি মন নিয়ে আমি অবারিত সবুজ ধানক্ষেতের দিকে তাকাই আর নিজের কান্না লুকাই।

 


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top