সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

নীতি নৈতিকতার কনফারেন্সে একদিন : কাজী সুলতানা শিমি


প্রকাশিত:
২৯ নভেম্বর ২০১৯ ০১:৩৯

আপডেট:
৪ মে ২০২০ ২১:১১

কাজী সুলতানা শিমি

 

ওয়েস্টার্ন সিডনী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারামাটা ক্যাম্পাসে নীতি নৈতিকতা বিষয়ে দিনব্যাপী এক কনফারেন্সে ছিলাম এক শনিবার। সকাল ন‘টা থেকে রেজিস্ট্রেশন শুরু হলেও পৌছুতে পৌছুতে দশটাই বেজে গেলো। পার্কিং পেতেও খানিকটা দেরী হয়ে হওয়ায় এই দশা। ইতিমধ্যেই নাম নিবন্ধন করা থাকায় নাম সম্বলিত পরিচয় কার্ডটা হাতে ধরিয়ে অডিটরিয়াম দেখিয়ে দিলো ভলান্টরিয়ার মেয়েগুলো। দরজার পাশেই কফি কর্নার। এক কাপ কফি নিয়েই ভিতরে গিয়ে বসলাম। সারা রাজ্য থেকে প্রাইমারী স্কুলের নীতিবিদ্যা বিষয়ক শিক্ষক ও নৈতিকতা বিষয়ে আগ্রহী অনেকেই এসেছেন এই কনফারেন্সে। বহুদিন থেকেই এ বিষয়ে আমার সীমাহীন আগ্রহ। তাই আসা। 

বিভিন্ন বয়সের ও সংস্কৃতিরএই সমাবেশে এসে একটা অদ্ভুদ ভালোলাগা বোধ করছিলাম। বেশিরভাগ অংশ গ্রহণকারী নীতি নৈতিকতা বিষয়ক কাজের সাথে কোন না কোন ভাবে জড়িত। বেশ বড়সড় হল রুমের ভিতর বিশাল পর্দা জুড়ে নানা তথ্য সম্বলিত পাওয়ার প্রেজেন্টে উপস্থাপিত হচ্ছে নীতি নৈতিকতা বিষয়ক নানা কার্যক্রম। সারা দিনের কর্মসূচী দেয়া আছে। সম্মিলিত উপস্থাপনার পর আলাদা আলাদা করে ভিন্ন বিষয়ে প্রোগ্রাম সাজানো। যার যেটাতে আগ্রহ সে সেখানে যাবে। যেখানে বসলাম সেখানে পাবলিক ইন্সট্রাকশানএ্যক্ট ১৮৮০’ নিয়ে আলোচনা চলছিলো। শিক্ষা কার্যক্রম কিভাবে আজ এ অবস্থায় এসেছে তা নিয়ে বিস্তৃত বর্ণনা। ধর্মের অন্তর্ভুক্তি ছাড়া নৈতিক শিক্ষা আবশ্যিক করার প্রস্তাবে গির্জার পাদ্রীরাই প্রথম বিরোধিতা করেন। তারপর ধীরে ধীরে ব্যাপারটি বুঝানো হয় যে তাতে ধর্ম বিশ্বাসের কোন অবমাননা করা হবেনা বরং বিশ্বাসী অবিশ্বাসী সকলেই যেন নীতিবোধেরবিষয়টি অনুধাবন করতে পারে তার একটা চেষ্টা মাত্র। 

অস্ট্রেলিয়ান প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী ভ্যারটি ফার্ট জানান, এখন প্রায় ৫০০ স্কুলের ৪৫০০০ শিক্ষার্থী প্রাইমারী স্কুলে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। এ কার্যক্রমস্বেচ্ছাসেবী ভিত্তিতে। এ বিষয়টি খুব উৎসাহ মূলক। কেননা এখনো পর্যন্ত ধারণা করা হয় যে ধর্মের বাইরে নৈতিক শিক্ষা দেয়া হলে বুঝি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা। ব্যাপারটি কিন্তু তা নয়। ধর্মীয় বিশ্বাস একটি মানুষের ব্যক্তিগত অনুভূতি। প্রত্যেকে প্রত্যেকের ধর্মকেশ্রেষ্ঠ মনে করে। আর এটাই নানা সংঘর্ষের মূল কারণ। যদি এই শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিযোগিতায় না নেমে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধকে শেখানো যায় তাহলে এতোটা হানাহানি হয়তো হতোনা। আর এ কাজটিই শেখাবে নীতিবিদ্যা। অপরের মতকে গুরত্ব দেয়া। অন্যদের মতামত জানানোর সুযোগ তৈরি করা ও তাকেও প্রাধান্য দেয়া। কোন সমস্যাকে ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে উপলব্ধি করার অভ্যাস অনুশীলন করা সুন্দর জীবন যাপনের জন্য খুব প্রয়োজন। শুধু প্রাজ্ঞ আর বিজ্ঞ হলেই সমাজ ব্যবস্থা উন্নত হয়না। দরকার গভীর চিন্তা শক্তি অনুশীলন ও প্রয়োগ।

দশ বছরের একটি মেয়ে এই কথা গুলোই বলছিলো তার প্রেজেন্টেশনে। এই যে ছোট্ট মেয়েটি কথা গুলো জানালো সে এসব কোথায় শিখেছে এ প্রশ্নের উত্তরে বললো নৈতিক শিক্ষার ক্লাসে। প্রশ্নত্তোর পর্বে সে আরো জানালো জীবন গড়ার পাথেয় হিসেবে পাঠ্যসূচীর বাইরে এসব শিক্ষা মনো জগতের বিশালতা বাড়ায়। এসব কথা আমাদের, বিশেষ করে বাংলাদেশে শেখানো হয় কিনা জানিনা। তবে এই শিক্ষা্র যেসুদুরপ্রসারীগুরত্ব রয়েছ সেটা অনুধাবন করছি বেশ ভালো ভাবেই। 

চিন্তার বৈপরিত্যকে মেনে নেয়া এবং সেসবকে ইতিবাচক উত্তরণ হিসেবে রূপান্তরিত করার ইচ্ছা এক ধরণের মানবিক গুনাবলী। এইসব মানবিক গুণাবলী অর্জন খুব সহজ কাজ নয়। এর অনুশীলন থাকতে হবে খুব ছোট বয়স থেকেই। আমরা সেসবকে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে শিক্ষা দেয়ার প্রয়োজন মনে করিনা বলেই আমাদের সংস্কৃতিতে এখনো অনেক কিছুই গ্রহণীয় নয়। যেমন, বাস্তব ঘটনাই বলি, কোন অনুষ্ঠানে কারো পারফর্মেন্স চলাকালীন সময়ে কথা বলা বা হৈ চৈ করা যে সুশীল আচরণের মধ্যে পড়েনা সেকথা আমরা আমলেই নিইনা। সামাজিক নানা অন্তর্ভুক্তির কারণে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে এ ব্যাপারটা বেশ ভালো ভাবেই লক্ষ্য করেছি। অথচ এদেশের অনুষ্ঠানে সেরকম হয়না বললেই চলে। তারপর বেশীর ভাগ সময়েই খাবারের লাইনে শৃংখলা ও সারিবদ্ধ ভাবে অপেক্ষা করাটাও আমাদের চরিত্রের অন্তর্ভুক্ত নয়। যা অপেক্ষমাণ অন্যান্যদের জন্যঅত্যন্ত অবমাননাকর।এইসব ছোট ছোট বিষয় গুলো খুব ছোট বয়সেই শেখানো হয় বলেই এরা বড় হয়েও সেটা মেনে চলে। এছাড়া সময় জ্ঞানের অভাব। খুবই দরকারি একটা বিষয় হওয়া স্বত্বেও আজ অব্দি কোথাও তা মেনে চলা হয়না। নির্দিষ্ট সময় দেয়া অনুষ্ঠান অনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষার পর যখন শুরু করা হয়, ততক্ষণে দর্শক শ্রোতার বিরক্তির সীমা তুঙ্গে পৌছে। অনুষ্ঠান উপভোগ করা দুরে থাক সমালোচনা ও ফেরার ইচ্ছায় বাকি সময় টুকু কাটানো মাত্র।

আমরা এখনো অপরের মতামতকে গুরত্ব দিতে শিখিনি। বিশেষ করে নিজের মতামতের বিরুদ্ধে হলে তো কোন কথাই নেই। অনেক সময়ই বিশাল বাক-বিতণ্ডায় জড়িয়ে পরি। সমালোচনা ও নিন্দার পার্থক্য চিন্তা করিনা। এমনকি পরিশীলিত শব্দ বা ভাষা ব্যাবহার করার প্রয়োজন মনে করিনা। সুন্দর ও মার্জিত শব্দ থাকা স্বত্বেও তা ব্যাবহারের প্রতি গুরত্ব দিইনা। এসবই নৈতিক শিক্ষার বিষয় এবং সংঘর্ষ এড়াতে অত্যন্ত জরুরী। এছাড়া নৈতিক শিক্ষা যে ধর্ম বিশ্বাসের পরিপন্থী নয়, এই কনফারেন্সে অত্যন্ত চমৎকার ভাবে সেটা বিশ্লেষণ করা হয়। এমন একটি সমাবেশ আমদের সত্যিকার অর্থেই ভীষণ প্রয়োজন। 

লেখকঃ কাজী সুলতানা শিমি

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top