সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

নক্ষত্রের পতন : হোসনে আরা কামালী


প্রকাশিত:
২০ মে ২০২০ ২০:২৪

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ০৭:১৯

হোসনে আরা কামালী

 

মহীরূহের ছায়া সরে গেল, পতন হল বাঙালির আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের। জাতির এ ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। কারণ তিনি অধ্যাপক ইমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান। তাঁর সুবিশাল ব্যক্তিত্বই বলে দিয়েছে তিনি ব্যক্তি নন জাতি ও সমাজের একটি প্রতিষ্ঠানে নিজেকে উন্নীত করেছিলেনও বটে। তিনি শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, বাংলাসাহিত্য ও সংস্কৃতির সমজদার ছাত্র-শিক্ষক, পৃষ্ঠপোষক এবং আজীবনের কর্মী। তাঁর জীবন যেন গোটা এক বাংলাদেশ। বাঙালি জাতিসত্তার উন্মেষ ও স্বাধীনতা অর্জনের প্রতিটি পদক্ষেপে জড়িয়ে আছেন আনিসুজ্জামান স্যার। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে মাত্র পনের বছর বয়সের যুবক কলম ধরলেন হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় ’একুশে ফেব্রুয়ারি‘ সংকলনে, যেখানে উৎসর্গপত্রটি নিজের হাতে লিখে ফেলেন তিনি। সেই থেকেই এই ঔজ্জ্বল্য-লাস্যের আনিসুজ্জামানের পথচলা শুরু।

২.

ড.আনিসুজ্জামান আপাদমস্তক একজন শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু তাঁর জীবন ও চরিত্রের পরতে পরতে ছিল বহুমাত্রিকতা। একজন সুশীল, একজন তথাকথিত একাডেমিশিয়ান যেভাবে নিজেকে প্রকাশ করেন, আনিস স্যার ছিলেন তার ব্যতিক্রম। জ্ঞানগরিমার শক্ত মোড়কবন্দী হয়ে থাকা ছিল তাঁর অপছন্দের বিষয়। সামাজিক ও নাগরিক দায়িত্বে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পছন্দ করতেন তিনি। বাঙালি সংস্কৃতি ও প্রগতিশীল চিন্তা ভাবনার দায়িত্ব নিয়েও যে সাহস নিয়ে নিরবে করে কাজ করা যায় আনিস স্যরের মত তা আর কে পারেন? অনেক সরল স্বাভাবিকভাবেই  জীবন ও জ্ঞান চর্চা করে গেছেন তিনি।  ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উদযাপন, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারের পক্ষে জনমত তৈরি, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাভাষায় সংবিধান প্রণয়নে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন ইত্যাদি কাজগুলোতে তিনি  কেবল একজন একাডেমিশিয়ান নন। তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু তাঁকে শিক্ষাসচিব করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি সে নিয়োগ ঠেকিয়েছিলেন এই বলে যে জাতি একজন ভালো শিক্ষক হারাবে আর একজন বাজে আমলা পাবে। আর এর জন্যই তিনি জীবনভর একজন অদ্বিতীয় আনিসুজ্জামান স্যার হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। শুধু তাঁর ছাত্র বা প্রতিষ্ঠানের নয়, একজন জাতির শিক্ষক হয়ে উঠেছিলেন। জাতির অভিভাবকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। শুধুমাত্র একজন শিক্ষক হয়ে থাকলে হয়ত তাঁর ব্যক্তিগত গবেষণা ও গ্রন্থ সংখ্যা দ্বিগুন হতে পারত, কিন্তু এদেশ ও জাতি অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হত। আধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক তাঁকে এক বার বলেছিলেন-আপনি তো আর পড়া শুনাই করলেন না! আসলে নিজের নিজেদের বিষয়গুলো সমান ঐক্যে স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন আনিসুজ্জামান স্যার! এটা তাঁর অনন্য নজির!

৩.

অধ্যাপক ইমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান বাংলা ভাষার ছাত্র ও শিক্ষক হয়ে সীমাবদ্ধ থাকেন নি। জ্ঞানের নানা শাখায় তাঁর বিচরণ ছিল স্বতস্ফুর্ত। শিক্ষক হয়ে সারাজীবন থাকতে চেয়েছিলেন তিনি। এটি একটি খাঁটিঁ একাডেমিক কথাবার্তা,কিন্তু মোফজ্জল হায়দার চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মত মানুষের বাৎসল্য ও বন্ধুত্ব তার মানসচেতনায় প্রভাব ফেলেছিল। শিক্ষক মানে শুধু সিলেবাস পড়ানোর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা নয়, শিক্ষক  একটি ফলিত দর্শনও বটে। তার কাজ শ্রেণিকক্ষেই শুধু সীমাবদ্ধ নয়, তার দীক্ষকইতো স্বয়ং ড. আনিসুজ্জামান স্যার। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে পি,এইচ,ডি ডিগ্রি অর্জন করলেন ’মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য‘ বিষয়ে। উপনিবেশপূর্ব যুগের পুরনো বাংলা গদ্যের খোঁজ তাঁর ভাণ্ডারে। স্বরূপের সন্ধানে,  বাঙালি নারী, সমাজ ও সাহিত্যে, নারীর কথা, বাঙালি সংস্কৃতি ও অন্যান্য, ইত্যাদি গ্রন্থ রচনা করে বাংলাভাষা সাহিত্য, বাঙালিসংস্কৃতি  এবং বাঙালিত্ববাদকে পুষ্টি দান করেছেন তিনি। বিশেষত আমার একাত্তর, কালনিরবধি,  বিপুলা পৃথিবী গ্রন্থগুলো  তাঁর যতটা আত্মজৈবনিক ঠিক ততটাই সমাজমানসের ও রাজনৈতিক ইতিহাসের দলিল হয়ে ওঠেছে। তাঁর সহজ সরল অথচ নির্মেদ গদ্যভাষার নিজস্ব ঈর্ষণীয় একটি ভঙ্গি বাংলাসাহিত্যে একটি গদ্যঘরানা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের রচনা সম্ভার নিয়ে আলোকপাত করা আজ আমার উদ্দেশ্য নয়। একজন আনিসুজ্জামান যে কতটা বাঙালি, বাংলাদেশ ও বাংলাসাহিত্যের ছিলেন সে টুকুই পাঠকের সাথে বিনিময় করাই মূখ্য উদ্দেশ্য। এবং তাঁকে আমার হার্দিক শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করাই প্রধানতম উদ্দেশ্য। কিন্তু সংগতকারণে তার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি ও সমাজের একজন হয়ে যে শূন্যতা অনুভব করব, সেটাই স্বাভাবিক। ব্যক্তি ও সমষ্টির আমি, বাঙালির আমি, মানবিক আমির আশ্রয়ের জন্য অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কাছেই আশ্রয় চাইব সেটাও  আরও অধিক স্বাভাবিক।

৪.

ব্যাক্তি আমার সঙ্গে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সংযোগ পাঠ্যসূচি কেন্দ্রিকই। শ্রেণিকক্ষের পাঠ নিতে না পারলেও তাঁকে চূড়ান্তমৌখিক পরীক্ষায় লাভ  করেছিলাম! তিনি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন। তা-ও হয়ে গেল প্রায় বছর দশেক। কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগটা ঘনিষ্ঠ ছিল বরাবর। সেই সূত্রেই আনিসুজ্জামান স্যারের কাছে পরীক্ষা দেয়া। স্যার তাঁর গমগমে কণ্ঠ দিয়ে ‘মাগধীপ্রাকৃত’ উচ্চারণ শুদ্ধ করে দিয়েছলেন। কিন্তু আজকের বিষয় সেটাও নয়। ড.আনিসুজ্জামান কারও একার নয়, জাতির শিক্ষক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন! আজ আমি ও পরেছি তথাকথিত শিক্ষকের পোশাক—! মাঝে মাঝে নিজের সামনে দাঁড়াই। নিজের কাছে জবাব চাই, নিজের দৈন্যদাহে কম্পিত হয়ে ছুটে যাই আমাদের বাতিঘরের ই দরজায়! সে দরজার ক্রমসংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। কোথায় দাঁড়াব—আজ সে জায়গাটুকু র  তালাশ করি!

ওপারে ভালো থাকুন অদ্বিতীয় বাতিঘর আনিসুজ্জামান স্যার! অনেক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় আপনাকে স্মরণ করি!

 

হোসনে আরা কামালী
কবি, প্রাবন্ধিক; বিভাগীয় প্রধান, বাংলা, মদনমোহন কলেজ , সিলেট



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top