সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

‘মুসলমান মঙ্গল’ খুলে দিবে চিন্তার নতুন দিগন্ত (বুক রিভিউ) : শাকিলা নাছরিন পাপিয়া


প্রকাশিত:
২১ জুন ২০২০ ২১:৪০

আপডেট:
২৫ জুন ২০২০ ২১:১২

ছবিঃ বইয়ের প্রচ্ছদ

 

মহাভারতের যখন বাংলায় ডাবিং করে প্রচার করা হচ্ছিল জি টিভিতে তখন ঘরে আইন জারি করলাম ‘মহাভারত’ দেখা সবার জন্য বাধ্যতামূলক। ত্রিশ মিনিটের জন্য লেখা পড়া বন্ধ করে সবাই টিভির সামনে বসত। একটি ধর্মের নৈতিক শিক্ষা এত সহজে মানুষের মাঝে পৌঁছে দেবার কৌশল সত্যিবিস্ময়কর।
ইসলাম ধর্মকে সকল মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য যে মেধা এবং মণন প্রয়োজন সেই সঙ্গে প্রয়োজন গোঁড়ামী থেকে বের হয়ে সময়োপযোগী পদক্ষেপ। কোনটাই ছিল না মুসলমানদের মধ্যে। একমাত্র নজরুল ছাড়া আর কোন কবি, সাহিত্যিক, পরিচালক, চলচ্চিত্র নির্মাতা কাউকেই পাওয়া যায় না ইসলামের মানবতার বাণী, সৌন্দর্যের বাণী প্রতিটি মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য।

ধর্ম সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করা, অন্যের কাছে এই জ্ঞান পৌঁছে দেয়া, নিজ ধর্মের স্বর্ণালী অতীত জানা, অহংকারের গৌরবের বিষয়গুলো তুলে ধরা এ বিষয়ে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় কখনো এগিয়ে আসেনি। বরং ধর্মকে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের হাতে ছেড়ে দিয়ে শিক্ষিত, প্রগতিশীল বলে দাবীদার সম্প্রদায় চিরকালই ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। যার স্বার্থের সঙ্গে যতটুকু সুবিধা হয় সে ততটুকুই মেনেছে ধর্মকে। কাজী নজরুল ইসলামের পর বাংলা সাহিত্যে জাকির তালুকদার সৃষ্টি করেছেন ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে নতুন এক বিস্ময়কর নতুন প্রজন্মের সামনে উন্মোচিত হবে ইসলামের গৌরবময় সেই ইতিহাস যা জানার আগ্রহ বা সহজ পথ তাদের ছিল না। জাকির  তালুকদার রচিত মুসলমান মঙ্গলের মুখবন্ধ লেখাটিই দৃষ্টি আকর্ষণ করবে পাঠকের। শুধু মুসলিম নয়, যে কোন ধর্মের জ্ঞান পিপাসু পাঠক এই তথ্য এবং বিশ্লেষণধর্মী গবেষণালব্ধ উপন্যাসটি আনন্দের সঙ্গে পাঠ করবেন।

বইটি সম্পর্কে যে কথাগুলো পাঠককে মুগ্ধ করবে তা হলোঃ “আমি প্রতিটি অন্ধকার গুহা হাতড়েছি, আমি প্রতিটি অতল গহবরে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। আমি প্রতিটি দলের ধর্মমত পরীক্ষা করেছি। এসবই আমি করেছি যেন আমি সত্য ও মিথ্যার মধ্যে এবং নির্ভুল সুন্নাহ ও বিদআতের মধ্যে তারতম্য করতে পারি। যখনই আমি কোন বাতেনিকে দেখি তখনই আমি তার মতবাদ পড়তে চাই। যখনই আমি কোন জাহেরিকে দেখি তখন তার বিশ্বাসের মূল বিষয়গুলি জানতে চাই। যদি তিনি দার্শনিক হন তবে আমি তার দর্শনের অন্তঃসারগুলি জানতে চাই। যদি তিনি মুতাকাল্লিম হন তাহলে আমি তার ধর্মতত্ত্বের যুক্তি পরীক্ষায় ব্যাপৃত হই। যদি তিনি সুফি হন আমি তার সুফিতত্ত্বের রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যাকুল হই। যদি তিনি সংসার বিরাগী হন আমি তাহলে তার রৈাগ্যের আচার ব্যবহারের ভিত্তি অনুসন্ধান করি। যদি তিনি যিন্দিক হন তাহলে আমি তার এই ধরণের মত গ্রহণের সাহসিকতার কারণ অনুমন্ধানের জন্য অনেক গভীরে তাকাই”।

পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজ পাওয়া পাকিস্তানের আব্দুস সালাম মনে করেন, ’মুসলমানেরা গরীব কারণ তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান নেই।’ অথচ ৭০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১১০০ খ্রিষ্টাব্দ পুরোটাই ছিল ইসলামের স্বর্ণযুগ। তখন কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে একের পর এক চিহ্নিত হয়েছেন জাবির, খাওয়ারিজমি, রাজি, মাসুদি প্রমুখসহ ওমর খৈয়াম। আব্দুস সালাম খুঁজে পাননি কেন এরপর মুসলমানেরা জ্ঞান বিজ্ঞান ত্যাগ করলেন। তিনি হিসাব করে দেখেছেন, কোরআনে আইন সম্পর্কিত আয়াত ২৫০টি অথচ জ্ঞান-বিজ্ঞানের আয়াত ৭৫০টি।

বর্তমান ইসলামে যে অসংখ্য ভাগ, নানা মতবাদ তার উৎপত্তি এই বিভাজনের কারণ, তথ্য এবং অনিয়ম তুলে আনা হয়েছে উপন্যাস আকারে রচিত এই বইটিতে।
এর পড়তে, পড়তে নানা অজানা বিষয়ের অবতারণা। ধর্মকে নিজ স্বার্থে ব্যবহারের জন্য তার মৌলিকতা বিনষ্টের কাহিনী।
নতুন প্রজন্মের মেধাবীদের ধর্মের প্রতি আহ্বান, নিজ স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ধর্মের অপব্যবহারের নানা বিষয় উঠে এসেছে এখানে।

শিক্ষিত মেধাবীরা উদাসীন থাকার কারণে ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ পৌঁছে যায়নি সমাজের সাধারণ মানুষের দ্বারে। অপকৌশল অবলম্বন করে ভুল বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়েছে কৌশলে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে সমাজের সর্বত্র ইসলাম সম্পর্কে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য সন্ত্রাসী, মৌলবাদী, গোঁড়া হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে যুগে যুগে। এই অপকৌশল, ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে বেড়িয়ে আসার জন্য ইসলাম এবং তার পরবর্তী নানা বিবর্তন সম্পর্কে জানা, আল্ কুরআনের সঠিক নির্দেশনা উপলব্ধি করা, মানবিক দিকগুলো উন্মোচন করে নিজেদের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে আদর্শ হিসাবে তুলে ধরার দায়িত্ব বুদ্ধিজীবিরা কখনোই গ্রহণ করেনি। ফলে, একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মনগড়া মতবাদে বিশ্বের কাছে একটি সন্ত্রাসীরূপ পেয়েছে ইসলাম।

লেখক তার লেখায় তুলে এনেছেন, ইসলামের বিনয় অনুগত্য, মানবকল্যানের শাশ্বতরূপ। ইতিহাসের প্রতিটি স্তর থেকে তুলে এনেছেন ইসলামের ত্যাগ, সৌন্দর্য, জ্ঞানের কথা। যুগে যুগে ইসলামের যুদ্ধ সম্পর্কে সমাজে ছড়িয়ে দেয় ভুল ব্যাখ্যাগুলোকে তিনি চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন।

আগুন আলো জ্বালায় আবার পুড়িয়ে ভষ্ম করে। এ আগুন কার হাতে পড়ল সেটাই মূল কথা। ধর্ম যখন জ্ঞানীর হাতে থাকে তখন তা আলো জ্বালে আঁধারে, দূর করে অন্ধকার, আলোকিত করে অন্তর।

ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অন্যান্য ধর্মের মানুষের মনে যে ভুল ধারণা, বিষোদগার সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করার জন্য মুসলিমদের নিজেদেরই আগে জানতে হবে তার গৌরবময় অতীত, উপলব্দি করতে হবে কুরআনকে জানতে হবে প্রকৃত হাদিসকে। এ দায়িত্ব নিতে হবে মেধাবী তরুণদের। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে কুরআনের যে বিরোধ নেই সেটা তুলে ধরার জন্যই মেধাবীদের ধর্ম থেকে মুখ ঘুড়িয়ে রাখলে চলবে না। লেখক তার লেখায় দেখিয়েছেন সমাজের ঘুষখোড়, কালোবাজারী, দুর্নীতিবাজদের দখলে চলে যাওয়া ইসলামকে রক্ষার জন্য মেধাবীদের ঘুরে দাঁড়ানো কতটা জরুরী।

আমার মতে, এখন সময় মিথ্যে আর চাতুর্যের। শুধু মুখে মুখে নিরপেক্ষ বলে দাবী করলে হবে না। জানতে হবে ধর্মের স্বরূপ, আলোকিত দিক। 

ফলে, মুসলমান মঙ্গল’ পড়া প্রতিটি ধর্মের মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।  

 

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
শিক্ষক ও কলামিস্ট

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top