সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

র্ঝনাধারার সংগীত (র্পব বার) : সেলিনা হোসেন


প্রকাশিত:
৩১ মার্চ ২০২১ ২০:২০

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:১৪

 

- আগইে ভয় দেখিওনা দাদা। ভয় পেলে সাহস হারিয়ে যায়।

পুঞ্চন আঙুল তুলে শাসনের ভঙ্গিতে বলে, ভয় দেখালে মানুষের আনন্দ নষ্ট হয়। অন্যের আনন্দ এভাবে নষ্ট করা একদম উচিত না।

- পুঞ্চন ঠিক বলেছে। নানকিং সায় দেয়। ভয় দেখালে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে পাহাড়ে সময় কাটানোর আনন্দ নষ্ট হবে।

আশিকা নানকিং আর পুঞ্চনের ঘাড়ে নিজের দুহাত রেখে বলে, আমাদের বোনেরা ঘাস-লতা-গাছপালা-পুশুপাখির কাছ থেকে রাতদিন অনেক কিছু শেখে।

- হ্যাঁ, ঠিক পাহাড় আমাদের স্কুল। আমাদের ঘরের ভেতরের টেবিল-বেঞ্চের ক্লাশ লাগে না। আমরা ঘুরতে ঘুরতে অনেক কিছু শিখি। এখন আপনারা যান দিদিরা। আজ আর আপনাদের ঘর দেখা হলো না। আমাদের ঘর দেখার মতো কিছু না।

- এমন করে বললে আমি মানি না রে। ঘরের ভেতর অদৃশ্য অনেককিছু থাকে, তা চোখে দেখা যায় না। মনে দেখা যায়। তাকালে বুঝতে পারি কেমন সুন্দন জীবন-কাটানোর ছবি।

- অভাবের সংসারে কি সুন্দর ছবি থাকে?

- থাকে, থাকে, একশোবার থাকে।

আশিকা জোরের সঙ্গে বলে।

- আমরা দেখতে পাইনা। আপনাদের চোখ আমাদের চোখ আলাদা। দুই বেলা ভাত না খেলে চোখ বন্ধ হয়ে থাকে।

- থাক, আর কথা বলবনা। তোদেরকে দুঃখ দিতে চাইনা।

পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নেয় ওরা। নামতে থাকে পাহাড়ের ঢালু বেয়ে। আশেপাশে দেখা যায় বাচ্চা শূকরের পিঠে দুএকজন শিশুকে। সঙ্গে বড়রা কেউ আছে। শামুক খুঁজছে কিংবা শাকপাতা। ঘরে ফিরে রান্না হবে। বনমোরগ ছুটে যায় পাখা ছড়িয়ে। মুহূর্তে অপরূপ দৃশ্য ভরিয়ে দেয় চারপাশ। আশিকার বুকের ভেতরে উচ্ছসিত আবেগ তড়পায়। মনে হয় আনন্দের বঙ্গোপসাগর ও নিজের ভেতর ধারণ করেছে। ওর ভেতরে দুঃখের কোনো কল্লোল নেই। প্রকৃতির পটভ‚মিতে ভেসে ওঠে বাবার মুখ। মায়ের মুখ। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এভাবেই বাবা-মাকে ধারণ করে রাখবে। নিজের জীবনের সুখ-দুঃখ-হাসিকান্না সবটুকু থাকবে তাদের সঙ্গে। কখনো পাহাড়ের মতো আকাশছোঁয়া দিগন্তে। কখনো শৈলপ্রপাতের গড়িয়ে আসা কল্লোলিত ¯্রােতের শব্দে। কখনো নদীর মতো দুক‚ল ব্যাপী মগ্নতায়। কখনো আকাশের সাদা মেঘের ভেলায় অনাবিল আনন্দে। কখনো পাখির ডানায় আঁকা স্বপ্নের ছবিতে। কখনো ফুলের কুঁড়ির ফুটে ওঠার সত্যে। ওহ জীবন, আশ্চর্য বাক্সময় শিল্পকলার ধ্রæপদী ব্যঞ্জনায়। এতকিছু ভাবনার মাঝে আশিকা দেখতে পায় ভেসে আসা ঝর্ণার নহরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বড় বড় পাথরের পড়ে থাকার জায়গাজুড়ে বয়ে যাচ্ছে ঝর্ণার নহর। পার হতে হবে এই নহর। কেউ কেউ বলছে এগলো ছড়াখাল। আশিকা বাধা দিয়ে বলে, এগুলোকে খালি ছড়া বলবি না। ছড়ার সঙ্গে খাল যুক্ত করার দরকার কি। খালতো দেশের অন্য জায়গার প্রচলিত শব্দ। এদের শব্দ এদেরকে বলতে দিবি।

- ঠিক, ঠিক কথা।

আরেফিন জোরে জোরে সায় দেয়। অন্যরা ওর দিকে ঘুরে তাকায়। ভাবে এত জোরে সায় দেয়ার দরকার ছিল না। আশিকারও মনে হয় এত জোরে ওকে সাপোর্ট দিল কেন দলে যুক্ত হওয়া নতুন লোকটি? আরেফিন সবার দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারে এত জোরে সায় দিতে দেখে সবাই বিস্মিত হয়েছে। এবার গলা নামিয়ে বলে, সবার ভাষার মর্যাদা আমাদের রাখা উচিত। মাতৃভাষা প্রত্যের মানুষের মৌলিক অধিকার।

-ঠিকই বলেছিস। মানুষের মৌলিক অধিকারে হাত দেয়া উচিত না। আসিফও সায় দেয়।

- চলো আমরা ছড়ায় নেমে নিজেদের পা শীতল করি। ঝর্ণার নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভিজিয়ে শেষ করব পুরো শরীর।

- বাবা, তোমার দেখছি অনেক ইচ্ছা।

- থাকবে না কেন? ইচ্ছা উজাড় করে এই পাহাড়ি এলাকা ছেড়ে যাব। কোনো ইচ্ছাকে নিজের ভেতর গুমরে মরতে দেব না।

- তোমরা বেশ শক্তিশালী দল। তোমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমার বেশ ভালো লাগছে।

- তোমার ইচ্ছাও তাজা হয়ে উঠেছে দেখছি।

তুমুল হাসিতে মেতে উঠে সবাই। হাসিতে প্লাবিত হয়ে যায় জনপদ।

আশিকা হাসতে হাসতে বলে, পাহাড়ের সমতলে বয়ে যাচ্ছে আমাদের হাসির ছড়া। সামনের ছড়াটাই আমাদের হাসিতে পূর্ণ। চলো ছড়া পার হই।

গাইড নিধুয়া বলে, সবেতো ছড়া পার হওয়া শুরু হলো। সামনে আরও বাইশটা ছড়া আছে। সেগুলোও পার হতে হবে। আজতো বৃষ্টি নাই। বৃষ্টিি হলে ছড়াগুলোতে জল বেড়ে যায়। তখন পার হতে কষ্ট হয়। পার হওয়াই যায় না। জল কমার জন্য অপেক্ষা করতে হয়।

- তাই নাকি? কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়? ছড়ার ধারে বসে অপেক্ষা করাও আনন্দের। আমাদের কাছে নতুন দৃশ্য হবে।

- তাহলেতো অনেক জায়গা ঘোরাঘুরি করার সময় কমে যাবে।

- ও তাইতো। ঠিকই বলেছে নিধুয়া। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়? 

- বৃষ্টি বেশি হলে দুই-তিন ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়। ছড়া ডুবে গেলে গলা সমান জল জমে। বুঝে নেন যে গলা সমান জলের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে পারবনা। 

- তাতো পারবইনা। আমাদের ভাগ্য ভালো যে আজ বৃষ্টি নেই। বৃষ্টি হলে আমাদের ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ বরবাদ হয়ে যেত। এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখা বাদ দিয়ে পালাতে শুরু করতাম। 

- ঠিক বলেছিস রে। দেখতে পাচ্ছি আকাশও ক্লিয়ার। মেঘ নেই।

- ঠিক। বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা কম।

নিধুয়া সবাইকে তাড়া দিয়ে বলে, চলেন ছড়াটা পার হই। এরপর চারটা পাহাড় পার হতে হবে। মাঝখানে দুটো গ্রামও আছে। গ্রামে হেঁটে গেলে অনেকের সঙ্গে দেখা হবে। 

- বেশ লম্বা পথ? অনেকক্ষণ হাঁটতে হবে। 

- হ্যাঁ, চার ঘন্টাতো লাগবে যেতে।

- পথের ধারে বসে হাঁফ ছাড়তে চাইলে সময় আরও বেশি গড়াবে, না?

- তাতো গড়াবে। আপনারা নিজেরা ঠিক করবেন যে হেঁটে রাস্তা শেষ করবেন নাকি পাহাড়ের-

নিধুয়াকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আসিফ বলে, আমরা শুকনো খাবার নিয়ে এসেছি। হয়রান হয়ে গেলে কিছুক্ষণের জন্য রেস্ট নেব আমরা। তোরা কি বলিস রে?

- তোর কথাই আমাদের কথা। বেড়াতে এসে নিজেদের দু’পাকে গাধার খাটুনি খাটতে দেব না।

সুহাস চেঁচিয়ে বলে। অন্যরাও সায় দেয়। নিধুয়া প্রথমে আশিকাকে ছড়া পার করায়। আশিকা পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটার জন্য কেডস পরে এসেছে। কেডস খুলে হাতে নিয়ে ছড়ার মাঝে পড়ে থাকা বড় পাথরের উপর পা রাখে। সামান্য পিছলে যায় পা। নিধুয়ার হাত ধরে রাখার জন্য পড়ে যায় না। নিজেকে সামলায় আশিকা।

কাছে দাঁড়িয়ে থাকা আরেফিন হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, আমাকে ধরুন। পড়ার ভয় থাকবেনা। সার্পোট পাবেন।

- সামলে নিয়েছি। পড়ার আর ভয় নেই।

- তারপরও বলা যায় না। পাথরগুলোতে শ্যাওলা জমে আছে। সামান্যতেই বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।

- এত ভয় দেখাবে না আরেফিন। তুমি আমাদের নতুন বন্ধু। তোমাকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। তুমি আমাদের বন্ধু হয়ে থাক। শাসন করার জায়গা খুলবেনা।

আরেফিন মানসিকভাবে ধাক্কা খায়। কিন্তু কথায় তা প্রকাশ করেনা। 

শান্ত কন্ঠেই বলে, বন্ধু হয়েইতো হাত ধরতে চেয়েছি। বাইরের কেউ হয়ে নয়। তাছাড়া আপনাদের শাসন করার সাহস আমার নেই। 

- আয় আমরা হাত ধরে পার হই।

ইউসুফ হাত বাড়িয়ে দেয়। আরেফিন হাত ধরে বলে, বন্ধুত্ব বেঁচে থাকুক। জয় হোক বন্ধুত্বের।

সুহাসও একই সঙ্গে বলে, জয় হোক বন্ধুত্বের।

- আয় আমরা একসঙ্গে পার হই।

- আগে আমরা যাব। আশিকাতো অপর পারে চেলে গেছে। ওর পরে আমরা।

মঞ্জুরি আর সেঁজুতি একসঙ্গে কালো পাথরের উপর পা রেখে। লাফিয়ে পার হয় ছোট-খাটো পাথরের টুকরা। অনায়াসে চলে যায় অপর পারে।

আশিকা মুগ্ধ হয়ে বলে, তোরা বেশ অনায়াসে পার হয়ে এলি।

- নিজেরাইতো পারি। অন্যের সাহায্যের দরকার কি?

- দরকার নেই। ওটা সাহায্যও না। ওটা হাত ধরার বাহানা।

আসিফের কথা শুনে হাসতে হাসতে ছড়া পার হয় অন্যরা। শুধু আরেফিন গম্ভীর হয়ে থাকে। সুহাস ওকে ঠেলা দিয়ে বলে, কি রে বন্ধু, তুই গম্ভীর হয়ে আছিস কেন?

- আমি তোমাদের চেয়ে বয়সে বড়। কারণ আমি পাঁচ বছর আগে বিশ^বিদ্যালয় ছেড়েছি। এখন চাকরি করছি।

- এসব নিয়ে আমাদেরতো কোনো দ্বিধা নাই। আমরা বন্ধুর বয়স হিসাব করি না। আমাদের সামনে বন্ধুর বয়স নাই। বয়স থাকলে সে বড়ভাই হয়, বন্ধু হয় না।

আরেফিন ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে, ঠিক বলেছিস। আমি বন্ধুই থাকব। বড়ভাই হব না।

- তাহলে সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত মেলাও।

আরেফিন সবার হাত ধরে মৃদু চাপ দেয়। শুধু আশিকার মনে হয় আরেফিনের হাতের তালু ওর হাতে লেপ্টে গেছে। স্পর্শের গভীরতা দিয়ে ওর হাতের তালু ছুঁয়েছে আরেফিন। এর মধ্যে বন্ধুত্বের সরলতা নাই। উল্টো অন্য আকর্ষণের জায়গা তৈরি করে। আশিকা ভেতরে ফুঁসে ওঠে, কিন্তু চট করে প্রকাশ করার কথা ভাবে না। এমন মনোমুগ্ধকর পরিবেশ ব্যক্তিগত ঝড়ে বিচ্ছিন্ন হোক এটা ও চায় না। দূর পাহাড়ের মাথায় তাকায়।

মঞ্জুরি ওকে ঠেলা দিয়ে বলে, কি হলো রে?

- কই, কিছুতো হয়নি।

- তোর চেহারা অন্যকিছু ভাসিয়ে তুলেছে। তবে সুন্দর কিছু না।

- ধুত, রাখ এসব কথা। দেখ, নিধুয়া অনেক সামনে চলে গেছে। আমাদেরও যেতে হবে।

- ছেলেরা আরেফিনের সঙ্গে গুলতানিতে মেতেছে।

- মাতুক, আমাদের কি।

- ওই যে দূরে বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে। ওখানে যদি কোনো রে¯েঁÍারায় ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে তাহলে ভাত খাব। চল, নিধুয়াকে জিজ্ঞেস করি। ও জানবে নিশ্চয়। গাইডের কাজে তো ওকে প্রায়ই এদিকে আসতে হয়।

- শুধু কি তাই? এই জনপদ ওর আপন ভুবন। নিজস্ব মগ্নতায় এই ভুবন ওর চোখে আলোর ফুল।

- আশিকা, এবার ঢাকায় ফিরে তোকে কবিতা লিখে ছাপাতে হবে। আমরা তোকে ছাড়ব না। মনে রাখিস।

- আমারও মনে হচ্ছে এই অপূর্ব জায়গা দেখে ফিরে কবিতা লেখা উচিত হবে। নইলে নিজের সঙ্গে নিজের ধোঁকাবাজি হবে।

- ওই দেখ ছেলেরা পাহাড়ের উপরে উঠে আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। চল আমরা দৌড় দেই।

- সেঁজুতি পাগলামি করিস না।

আশিকা ওর হাত চেপে ধরে।

- দেখ আরেফিনকে কেমন হ্যান্ডসাম লাগছে। আমাদের অন্য ছেলে-বন্ধুদের চেয়ে ও বেশি সুন্দর।

- এভাবে কথা বলিস না মঞ্জুরি।

- আমরা নিজেরা বলছি আশিকা। ওদের সামনে বলব না।

- তাহলে পাগলামির সীমা থাকবে না।

- তুই আমাদেরকে ছোট্ট মেয়ে ভাবিসনা আশিকা।

- থাক, এত আর সাফাই গাইতে হবে না। আমরা ওদের কাছাকাছি চলে এসেছি। চুপ কর সবাই।

কেউ আর কথা বলে না। তিনজনে দ্রæতপায়ে পাহাড়ের উপর দিকে উঠতে থাকে। আশিকা একজায়গায় দাঁড়িয়ে বলে, দেখ রে কি সুন্দর বেগুনি রঙের ফুল ফুটে আছে। মনে হচ্ছে মুঠিভরে তুলে নেই।

- ওই ফুলের গায়ে হাত লাগলে ফুলটি বুঁজে যায়। তুই মুঠিভরে নিতে পারবি কুঁকড়ে যাওয়া ফুল।

- ও হ্যাঁ, তাইতো। এটাতো আমিও জানি। এই ফুলের নাম লজ্জাবতী।

- তাহলে বুঝে দেখ গা-ভরা কাঁটা নিয়েও এগুলো লজ্জাবতী লতা। কেউ ছিঁড়লে কাঁটা ফোটাতে পারে না।

আশিকা চুপ করে থাকে। ফুলের নাম লজ্জাবতী। ওর মাথার মধ্যে শব্দটি ঝিমিয়ে থাকে। আরেফিনের আচরণের ব্যাখা খুঁজতে থাকে। মনে মনে ভাবে, ব্যাখ্যার সূত্রতো একটি। সুযোগ পেলে জড়িয়ে ধরা। এটাই ওর চিন্তা। হাতের স্পর্শে সেটা প্রকাশ করেছে। 

- কি রে চুপ মেরে গেলি যে-

- বেশি কথা বলিস না মঞ্জুরি। লজ্জাবতী না হয়ে সাহসী নাম হলে তুই খুশি হতি?

- হ্যাঁ, হতাম। যে ওকে ছিঁড়বে তার হাতে কাঁটা ফুটিয়ে দিতো তাহলে আমরা বুঝতাম গাছের কাছ থেকে শেখার অনেক কিছু আছে। 

এগিয়ে আসে আসিফ। বলে, তোমরা এত কি কথা বলছ যে কথা ফুরোচ্ছে না? এক জায়গায় দাঁড়িয়েই আছ। 

সেঁজুতি চেঁচিয়ে বলে, খবরদার আমাদের কথায় ইন্টারফেয়ার করবি না।

- আমিতো শুধু কথার বিষয় জানতে চেয়েছি। জানতে পারলে আমরাও কথায় অংশ নেব।

- সব কথায় অংশ নিতে হবে কেন? এসব ভাবনা মনে পুষে রাখা উচিত না।

- বাব্বা, আমি এতকিছু চিন্তা করে কথা বলিনি। 

- চলেন, চলেন। বেলা বাড়ছে।

নিধুয়া সবাইকে থামিয়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। ও কথা থামানোর জন্য দুহাত উঁচু করেছিল। হাত আর নিচে নামায় না। দুহাত উঁচু করেই রাখে। আশিকা হাসতে হাসতে বলে, নিধুয়া তুমি কি পাখি ধরবে নাকি? নাকি ফুল ছিঁড়বে? হাত যে উঁচু করেই রাখলে?

- আমি এভাবে হাঁটতে ভালেবাসি। এটা আমার অভ্যাস।

- এতক্ষণতো হাত তোলনি? তাহলে?

- এত কথার উত্তর নাই। আমার খুশিমতো আমাকে হাঁটতে দেন। আপনারা আপনাদের মতো হাঁটেন। চারদিকে নজর রেখে হাঁটেন। বেশি কথা বলবেন না।

- বাব্বা, তুমি দেখছি স্বৈরাচারী শাসকের মতো হুকুম দিচ্ছ।

- আমি এই রকম মানুষ। আমার সঙ্গে যারা থাকবে তাদেরকে আমার হুকুম মানতে হবে। না হলে আমি কেমন গাইড?

- বাব্বা, সাবাস। আরেফিন চেঁচিয়ে বলে, বুঝতে পারছি ও নিজের কাজের প্রতি সৎ মানুষ।

সুহাস বিড়বিড়িয়ে বলে, ছাতু। আগাপাছতলা একটা ডিক্টেটর। শেষপর্যন্ত আমাদের সঙ্গে কি আচরণ করবে কে জানে।

- আমরা ওর সঙ্গে বেশি কথা বলব না। যে পথ দেখাবে সেই পথে শুধু হেঁটে যাব।

- ঠিক আছে, আমরা তাই করব।

নিধুয়া ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে, সামনে রে¯েঁÍারা আছে। আপনারা ভাত খাবেন?

- হ্যাঁ, খাব। আশিকা জোরেসোরে সায় দেয়। আরও বলে, তুমি এগিয়ে গিয়ে দেখ কি রান্না হয়েছে?

- ডাল আর আলু ভর্তা। এটাই ওরা করে। পাহাড়ে এর চেয়ে বেশি কিছু করা হয় না। এখানেতো রোজ বাজার বসে না।

- আচ্ছা ঠিক আছে। আমরা ডাল আর আলু ভর্তা দিয়েই ভাত খাব। সঙ্গে কাঁচা মরিচ থাকে যেন।

নিধুয়া দ্রæতপায়ে হেঁটে যায়।

রে¯েঁÍারায় গিয়ে দোকানির সঙ্গে খাবারের আয়োজন ঠিক করার জন্য হাত লাগায়। টিনের থালাগুলো ধুয়ে এক জায়গায় করে। ভাত ও ভর্তা পরিমাণমতো আছে কিনা তো চেক করে। বাটিভরা কাঁচামরিচ দেখে খুশি হয়। পানির গøাসে পানি ঢালে জগ থেকে। সবাই রে¯েঁÍারায় এসে আয়োজন দেখে বলে, বাহ বেশ তো গুছিয়ে ফেলেছো দেখছি।

আশিকা হাসতে হাসতে বলে, ওতো স্বঘোষিত ডিক্টেটর। এসব ওরই মানায়।

- এত কথা বলবেন না। আপনারা বসে পড়েন। থালায় ভাত দিয়েছি। খেতে শুরু করেন। 

- ভর্তা-ডাল আমরা নেব। তুমি নিজেও প্লেট নিয়ে বসে যাও নিধুয়া।

নিধুয়া ভাতের থালা নিয়ে পাহাড়ের ঢালের মাথায় গিয়ে বসে যায়। ঘাসের ভেতরে বসে থাকা নিধুয়ার দিকে তাকিয়ে আসিফ বলে, আমিও ওখানে গিয়ে বসব। ওকে ঘাসের পুত্র লাগছে আমার।

সবাই একসঙ্গে বলে ওঠে, আমরাও ওখানে বসে খাব। চলো সবাই।

- দারুণ। পাহাড়ের মাথায় বসে ভাত খাওয়া এ জীবনে দ্বিতীয়বার হবে কিনা কে জানে!

সবাই গিয়ে নিধুয়ার চারপাশে বসে পড়ে। অল্প সময়ে খাওয়া শেষ হয়ে যায় সবার। আরেফিন হাসতে হাসতে বলে, আমি ধন্য। এমন আয়োজনে একসঙ্গে খাওয়া এই জীবনে খাইনি।

- তাতো খাবেই না। আমরাতো এই জীবনে তোমার বন্ধু ছিলাম না।

- প্রথম বন্ধুত্বের আনন্দ পেলে। মনে রেখো আমাদেরকে।

- হ্যাঁ, শুধু মনে রাখব কেন? সারা জীবন তোমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বই থাকবে।

আশিকা ব্যঙ্গ করে বলে, সারা জীবন কে কোথায় থাকব তার কি ঠিক আছে?

- ঠিক থাকবে না তা ঠিক। তবে স্মৃতি হারাতে দেবনা। যার সঙ্গে দেখা হবে না তাকে স্মৃতিতে উজ্জ্বল করে রাখব।

- দারুণ বলেছিস বন্ধু।   

সুহাস আরেফিনের পিঠ চাপড়ে দেয়।

নিধুয়া থালা নিয়ে রেস্তোঁরায় রেখে এসে বলে, চলেন।

- আমরাতো গøাসের জল খেয়ে ফেলেছি। হাত ধোব কোথায়?

- এখানে হাত ধোওয়ার জল থাকে না। আপনারা গাছের পাতা দিয়ে হাত মুছে ফেলেন। তারপর ঝর্ণায় গিয়ে হাত ধুয়ে নেবেন।

- বাহ তাহলে এই পাহাড়ি এলাকায় গাছের পাতা আমাদের টিস্যু পেপার।

- তুমি আমাদেরকে ভালো একটা শিক্ষা দিলে গাইড ভাই।

নিধুয়া কোনো দিকে না তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে, চলেন সবাই।

চলবে

 

 

ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (প্রথম পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (দ্বিতীয় পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (তৃতীয় পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (চতুর্থ পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (পঞ্চম পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (ষষ্ঠ পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (সপ্তম পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত (অষ্টম পর্ব)
ঝর্ণাধারার সঙ্গীত ( নবম পর্ব)
র্ঝনাধারার সংগীত (দশম র্পব )
র্ঝনাধারার সংগীত (পর্ব এগার)

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top