সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব তের) : কাজী মাহমুদুর রহমান


প্রকাশিত:
২৪ এপ্রিল ২০২১ ২২:২৩

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ০১:০৮

 

অপেক্ষায় অপেক্ষায় চোখে একটু তন্দ্রার ভাব আসিয়াছিল। হঠাৎ ভয়াবহ শোরগোলে আমি চমকিয়া উঠিলাম। দরজা খুলিয়া দেখি প্রচন্ড চিৎকারে উলঙ্গ রবিউল তাহার রক্তস্নাত লিঙ্গস্থান চাপিয়া ধরিয়া উন্মাদের মতো নিচে ছুটিয়া আসিয়াছে। তাহার পশ্চাতে দুই পাহারাদের হাতে এলায়িত, রক্তাক্ত অচেতন সেই অঞ্জনা নামের মেয়েটি। অনুমান করিতে কষ্ট হইল না ধর্ষণকালে প্রমত্ত আবেগ ও অসাবধান মুহূর্তের  সুযোগ গ্রহণ করিয়া মেয়েটি ব্লেড দ্বারা রবিউলের লিঙ্গ কর্তন করিয়াছে এবং তারপর মেয়েটি নিজের হাতের শিরায় ও গলায় ব্লেডের গভীর পোঁচ দিয়াছে। ঘটনাটি মেয়েটির বন্দি কক্ষে ঘটে নাই। ঘটিয়াছে রবিউলের কক্ষে তাহারই শয্যায়। সমস্ত ঘর, সিঁড়ি, বারান্দা এখন উভয়ের রক্ত বন্যায় প্লাবিত। রবিউল অচেতন হইয়া পড়িয়া গেল। তাহাকে পাজাকোলা করিয়া আনসার মোল্লা তুলিয়া লইল। আমি সকলের বিহ্বলতার ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় পরিস্থিতিতে উচ্চকণ্ঠে নির্দেশ করিলাম, কুইক, কুইক। দের মাত করনা, আভি লে চলো হসপিটাল। বাহিরে জিপ ছিল, ড্রাইভার ছিল। সুতরাং অতিদ্রুত উভয়কে জিপের পিছনে দু’জন অস্ত্রধারী গার্ড, আনসারমোল্লাসহ ছুটিলাম হাসপাতাল অভিমুখে। হাসপাতালের ইমারজেন্সি বিভাগে দশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছাইয়া গেলাম। শুধু ইমারজেন্সি কক্ষ নয়, সমস্ত হাসপাতালেই যেন একটি আতঙ্কময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হইল। তবে স্বস্তি, যে এই দুঃসাহসিক কাজটি মুক্তিযোদ্ধারা করে নাই। করিয়াছে রবিউলের নিজ ভোগের বন্দিনী অঞ্জনা। ডাক্তার, নার্সের ভিড়ে, আর্মি অফিসারদের ভিড়ে ইমারজেন্সি কক্ষ পরিপূর্ণ। সংবাদ পাইয়া কর্ণেল শামসও এক গাড়ি আর্মিসহ হাসপাতালে পৌঁছাইলেন। উভয়ের অবস্থা দেখিয়া মাথা দোলাইলেন হতাশ ভঙ্গিতে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে উভয়েই বাঁচিবার সম্ভাবনা কম। ডাক্তারের নির্দেশে উভয়কে দ্রুত অপারেশন থিয়েটার প্রেরণ করা হইল।

সকলের উদ্বেগ ও ব্যস্ততার মধ্যে আমি সবার অগোচরে হাসপাতাল ত্যাগ করিলাম। আমার রচিত নাটকের যবনিকা পতন এইখানেই।

অন্ধকার নির্জন ভৈরব নদীর ঘাট হইতে একটি ছোট্ট জেলে নৌকা চুরি করিলাম। ভৈরব নদী দিয়া আমাকে যে করিয়াই হোক এই রাত্রেই খুলনা ত্যাগ করিতে হইবে। যে করিয়া পারি আপাতত পাইকগাছা পৌঁছাইতেই হইবে। আমি লগি হইতে দড়ি খুলিয়া বৈঠা হাতে নিয়া নৌকা বাহিবার উপক্রম করিতেই কেহ যেন কাদাময় ডাঙ্গা হইতে আমার নৌকার উপর লাফ দিয়া উঠিল। আমি চমকিয়া উঠিলাম। অন্ধকারে চিনিতে কষ্ট হইল না। লোকটি আনসার মোল্লা। সে এখন আমার জন্যে বিপজ্জনক, কারণ সে আমার সকল ষড়যন্ত্রের একমাত্র সাক্ষী। কিন্তু সে কি আমাকে ধরিতে  আসিয়াছে? না কি প্রাণভয়ে সেও পালাইতে চায় তাহা জানা দরকার। যদি তাহার কোনো দূরাভিসন্ধি থাকে তবে হাতের এই বৈঠা দ্বারাই তাহাকে হত্যা করিব। তাই চাপা অথচ হিংস্র কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম, আনসার মোল্লা তুমি এইখানে কেন? কী চাও।

আনসার মোল্লা বলল, হাসপাতালতেই আমি আপনারে ফলো করিছি। আমি জানে বাঁচিতি চাই?

- কিন্তু কাজটি তো তুমি করনি। করেছে মেয়েটি। তুমি জানের ভয়ে পালাবে কেন?

- সার, কাজডা তো আপনেও করেন নাই। আপনি জানের ভয়ে পলাতিছেন ক্যান? আমাগের কেরুরও তো সাক্ষী নেই, পরমান নেই।

- আনসার মোল্লা, প্রমান নেই, সাক্ষী নেই, তবুও পালাতে হবে। আর্মিরা মাটি খুঁড়ে প্রমাণ বের করবে। নির্যাতন করবে, গল্লামারির খালে লাশ ফেলে দেবে। কারণ আমরা বাঙালি।

 

আনসার মোল্লা বলিল, স্যার সেই জন্যিই আমি আপনার পালানোর সঙ্গি হতি চাই।

- কিন্তু তোমার পরিবার?

- বিকেলে আপনি যহন আমারে ওষুদ আনতি পাঠাইছিলেন তহন ওষুধির দোকানের চেনা একজনের মারফত টাকা আর সংবাদ পাঠায়ে দিয়ে কইছি, বউগো, মেয়েডারে আর মা জানরে নিয়ে ভিটেমাটি ছাড়ে যেইহানে পারো পালাও। বাঁচে থাকিল একদিন না একদিন দ্যাখা হবি।

আমি মাথা নাড়িয়া বলিলাম, ভালো করেছ। তুমি আসলে বোকা নও। অতি বুদ্ধিমান। তা, তুমি কি নৌকা বাইতে পারো?

- জে পারি।

- তাহলে চালাও। তুমি যখন ক্লান্ত হয়ে পড়বে তখন আমি বাইব।

- কনে যাব?

- জানি না। পালায়ে যতদূর যাওয়া যায়।

রাত্রিভর উভয়ে পালাক্রমে সর্বশক্তি দিয়া নৌকা চালাইয়া কতপথ অতিক্রম করিলাম তাহার হিসাব নেই। খুলনার বাহিরে আমরা কোথায়, পাইকগাছা আর কতদূর তাহা আমার জানা নেই। উভয়েই পরিশ্রান্ত। আনসার মোল্লা তাহার রক্তাক্ত ফতুয়া, গেঞ্জি সব খুলিয়া নদীর পানিতে ফেলিয়া দিয়াছে। এখন তাহার পরনে লুঙ্গি, কোমরে বাঁধা একটি গামছা মাত্র। আমার সালোয়ার, পাঞ্জাবিতে রক্তের দাগ না থাকিলেও আনসার মোল্লার মতো অর্দ্ধনগ্ন হইবার উপায় নাই। সাধারণ মানুষের কৌতূহল ও সন্দেহ এড়াইতে আমারও এখন গামছা, লুঙ্গি, শার্ট প্রয়োজন পলাতক জীবন যাপনে।

অমানিশার অবসানে অনেক আগেই ভোরের সূর্য উঠিয়াছে। আমি ক্লান্তিতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মধ্য রাত্রি হইতে আনসার মোল্লা একাই নৌকা বাহিয়াছে। সকালে ঘুম ভাঙিতেই আমি লজ্জিতভাবে আনসার মোল্লার হাত হইতে বৈঠা নিতে গেলাম। ও বলিল, স্যার, নৌকো বাতি হয় সোতের সঙ্গে তাল মিলোয়ে। তা আপনি জানেনও না, পারবেনও না। চুপ করে থাহে জামা কাপড় খুলে জাল নিয়ে বসে থাকেন যাতে মানষি য্যান টের না পায় আপনি ভদ্দরলোক।

আমি তাহাই করিলাম। গুটানো জাল হাতে জাল ফেলার ভঙ্গিতে বসিয়া রহিলাম অপটু অভিনেতা জেলের ভূমিকায়। আমার অবস্থা দেখিয়া আনসার মোল্লার মুখে মৃদু হাসি। তাহার কৃষ্ণবর্ণ শরীর দরদর করিয়া ঘামিতেছে। কিন্তু ক্লান্তি নাই। ক্রমান্বয়ে সূর্যের তেজ বাড়িতেছে। আমি গরম ও ঘামে জরজর। এক সময় আনসার মোল্লার শুধু গামছাটি নিয়া সালোয়ার খুলিয়া তাহা পরিলাম। তাহার পর নৌকা হইতে নদীতে ঝাঁপ দিলাম শরীর শীতল করিতে। চলতি নৌকার সাথেই কিছু সময় সাঁতার কাটিলাম নৌকার গতির সঙ্গে। তারপর আবার নৌকায় উঠিয়া বসিলাম স্নানসিক্ত দেহে। পরনের ভেজা গামছা আর পাল্টাইলাম না। এখন প্রচন্ড ক্ষুধা পাইয়াছে। কিন্তু কোনো লোকালয় দেখা যাইতেছে না যেখান হইতে কিছু খাদ্য সংগ্রহ করা যায়।

নদীপথে এখন আর এতটা নির্জনতা নাই। হানাদার বাহিনীর লঞ্চের টহলদারি আছে। তাহারা তল্লাশি চালায়, সন্দেহজনক কিছু মনে হইলেই পানসি বা জেলে নৌকাগুলিতে গুলি চালায়। তবুও পেটের দায়ে কিছু জেলেরা নৌকা নিয়া নদীতে নামে, মাছ ধরে।

আনসার মোল্লা এখন মূল নদীপথ এড়াইয়া কখনো শাখা নদী, কখনো খালপথে নৌকা চালাইয়া যাইতেছে। এইভাবে ক্ষুৎ-পিপাসা যখন প্রবল হইয়া উঠিল তখন আনসার মোল্লাকে বলিলাম, মোল্লা, এবার থামো। দেখে-শুনে কোনো নিরাপদ নির্জন স্থানে নৌকা বাঁধো। ডাঙায় উঠে এইসব ঝাড়-জঙ্গল পার হয়ে কোনো গ্রাম বা দোকান-পাট পাওয়া যায় কিনা একটু খোঁজ নিয়ে আসো। চিড়ে, মুড়ি, কলা যা পাওয়া যায় তাই নিয়ে আসো।

আমার নির্দেশ মতো আনসার মোল্লা জলা-জঙ্গল ঘেরা সরু একটি খাল তীরে লগি পুতিয়া নৌকা বাঁধিল। আমি তাহার হাতে পঞ্চাশ টাকা দিলাম। আনসার মোল্লা টাকাটা লুঙ্গির ট্যাকে গুঁজিয়া চলিয়া গেল। আমি গামছা পরা অবস্থায় প্রায় নগ্নদেহে বসিয়া রহিলাম। ঝাঁক ঝাঁক মশা যেন আমাকে ঘিরিয়া ধরিল। হানাদার বাহিনীর চাইতেও ইহারা যেন ভয়ঙ্কর।

এক ঘন্টা যায়, দুই ঘন্টা যায়, আনসার মোল্লা আর ফিরিয়া আসিল না। আমার মনে শংকা ও সন্দেহ জাগিল। আনসার মোল্লা কি পলাতক? নাকি বিপদে পড়িল?

আমার কাছে কোনো অস্ত্র নাই। পুনরায় সেই সব সালোয়ার কামিজ পরিলাম। মাথায় মুখে গামছা শক্ত করিয়া বাঁধলাম। তারপর বৈঠাটাকেই আত্মরক্ষার অস্ত্র হিসাবে হাতে নিয়া খালপাড়ের যে জঙ্গলের পথ ধরিয়া মোল্লা লোকালয়ের সন্ধানে গিয়াছে সেই পথেই আন্দাজে অগ্রসর হইলাম। জঙ্গল পার হইতেই জলাভূমি, ধানক্ষেত এবং বহুদূরে মানুষের ঘর বসতি পরিলক্ষিত হইল। সহসা চমকিত দৃষ্টিতে দেখিলাম, বহুদূর হইতে আলপথ দিয়া পিছমোড়া হাত বাঁধা অবস্থায় মোল্লা আসিতেছে। তাহার পিছনে লুঙ্গিপরা, খাকি শার্ট পরা দুইজন গ্রাম্য রাজাকার। সম্ভবত নৌকায় অপেক্ষমান আমাকেও ধরা তাহাদের উদ্দেশ্য। আমি বৈঠা হাতেই দ্রুত নৌকার কাছে ফিরিয়া আসিলাম। আমি আমার আত্মগোপন এবং ঐ রাজাকার দুইজনকে হঠাৎ আক্রমনের নিরাপদ স্থান খুঁজিয়া বাহির করিবার চেষ্টা করিলাম। আমার উদ্দেশ্য, মোল্লাকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা এবং রাজাকার দুইজনের জন্যে তাহাদের মৃত্যুদূতকে নদীর কাছে টানিয়া আনা। কাজটি দুঃসাধ্য কিন্তু প্রাণে বাঁচিতে এই দুঃসাধ্য সাধন করিতে আমাকে ঝুঁকি গ্রহণ করিতেই হইবে।

নৌকাটি পূর্বের স্থান হইতে আরো একটু জঙ্গলাকীর্ণ ছায়ায় টানিয়া আনিয়া লগি পুতিয়া দড়ি দিয়া বাঁধিলাম। আমার উদ্দেশ্য, মোল্লাকে বুঝিতে দেওয়া যে আমি রাজাকারদের উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিয়াছি এবং আমি এই স্থানে নৌকার আশেপাশেই আত্মগোপনে আছি। আমি খাল ও নৌকার কাছাকাছি একটি ঘন ঝোঁপের আড়ালে ডালপালা লতার ভিতরে বৈঠা হাতে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। ঘন জঙ্গল, সবুজ লতা-পাতা এবং আমার সবুজ সালোয়ার, কামিজ এই ওৎঁপাতা আত্মগোপনের এখন বড় সহায়ক।

বন্দি আনসার মোল্লাসহ রাজাকার দুইজন উদ্যত রাইফেল হাতে নৌকার কাছে আসিল। মোল্লা বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে চতুর্দিকে তাকাইল। বুঝিতে পারিল আমি আশেপাশেই কোথাও আছি। হয়তো সে শেষ মুহূর্তে প্রাণে বাঁচিলেও বাঁচিতে পারে।

রাজাকারদ্বয় কিছুটা সতর্কতার সাথে ইতস্তত আমাকে খুঁজিল। কিন্তু পাইল না। এই নির্জন স্থানে তাহারা কিছুটা ভীত। বেশিক্ষণ থাকিতে চায় না। সুতরাং তাহাদের সিদ্ধান্ত মোল্লা নামক এই লোকটিকে এইখানেই খতম করিয়া যথাসম্ভব দ্রুত তাহাদের ক্যাম্পে ফিরিয়া যাওয়া এবং আরো রাজাকার দলসহ তন্ন তন্ন করিয়া আমাকে খুঁজিয়া বাহির করা। একজন বলিল, পালিয়ে যাবি কতদূর? জঙ্গলে জাল ফেললিই সেই কাতলা ধরা পড়বি।

আনসার মোল্লাকে ওরা নদীমুখি অবস্থায় দাঁড় করাইয়া একজন রাজাকার তাহার পিঠে রাইফেলের নল ঠেকাইয়া গুলি করিতে উদ্যত। দ্বিতীয়জন রাইফেলের বাট মাটিতে ঠেকাইয়া সেনাপতির ভঙ্গিতে দাঁড়াইয়া রহিল। যেহেতু এই নির্জন স্থানে আর কেহ নাই সেই অনুমানেই তাহাদের দুজনের মধ্যেই সতর্কতা বিষয়ে কিছুটা শিথিলতা। আর অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। বাঘ যেমন গুটি গুটি পায়ে অগ্রসর হয় শিকার আক্রমনে আমিও তেমনি বৈঠা হাতে ক্ষিপ্ত, হিংস্র বাঘের মতোই ঝাপাইয়া পড়িলাম দ্বিতীয় রাজাকারের পশ্চাতে। বৈঠা দ্বারা তাহার মাথার পশ্চাতে প্রচ- আঘাত হানিলাম। ঐ একটিমাত্র আঘাতেই সে কাটা গাছের মতো মাটিতে লুটাইয়া পড়িল। কিন্তু ইতোমধ্যেই অন্য রাজাকারটি মোল্লার পিঠে তাহার রাইফেলের ট্রিগার টিপিয়া দিয়াছে। সঙ্গে সঙ্গেই আনসার মোল্লা কাদার মধ্যে মুখ গুঁজিয়া পড়িয়া গিয়াছে। হত্যাকারী রাজাকারটি রাইফেলের নল ঘুরাইয়া আমাকে গুলি করিবার চেষ্টা করিল। কিন্তু আমি বৈঠা হাতে তাহার এত ক্লোজ রেঞ্জে যে সে আমাকে গুলি করিবার সুযোগ পাইল না। ক্লোজ রেঞ্জে থ্রিনট থ্রির মতো মান্ধাতা আমলের রাইফেল দ্বারা গুলি করা সম্ভব নয়। সুতরাং সে চেষ্টা করিল হাতের রাইফেল দ্বারা আমাকে আঘাত করিতে। কিন্তু আমি মরীয়া। তাহাকে বিন্দুমাত্র সময় দিলাম না। হাতের বৈঠা দ্বারা প্রথমে প্রচন্ড আঘাত হানিলাম তার বাম বাহুতে। হাতের রাইফেল ছিটকাইয়া পড়িল। আর্ত চিৎকারে সে তার ভাঙ্গা হাত নিয়া পালাইতে চেষ্টা করিল। আমি শেষ আঘাত হানিলাম তাহার মাথায়। তাহার মাথা সশব্দে চৌচির হইবার শব্দ শুনিলাম। এখন রাজাকার দুইজন মৃত না অচেতন তাহা আর পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম না। কাদাজলে মুখ গুঁজিয়া পড়িয়া থাকা আনসার মোল্লাকে আমার কোলে তুলিয়া নিলাম। তাহাকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া ব্যাকুল কণ্ঠে ডাকিতে লাগিলাম, মোল্লা, মোল্লা ভাইরে আমার ...। কিন্তু সে আমার সেই আর্ত হাহাকার, আমার কান্নাভরা কণ্ঠের জবাব দিল না। প্রাণহীণ তাহার চোখের দৃষ্টি এখন আকাশের দিকে। তাহার আত্মা এখন আকাশের পাখিযে উড়িয়া উড়িয়া খুঁজিয়া বেড়াইবে তাহার স্ত্রী, তাহার পুত্র, তাহার সাড়ে তেরো বছর বয়সী কিশোরী কন্যাকে।

হায়, আমি এখন শহীদ আনসার মোল্লার মৃতদেহ নিয়া কি করিব? আমি দুই হাত তুলিয়া অদৃশ্য আল্লাহর কাছে মোল্লার আত্মার শান্তির জন্য মনে মনে প্রার্থনা করিলাম। কবর দিবার কোনো সুযোগ নেই। মোল্লার হাতের বাঁধন খুলিয়া তাহাকে আমার চোখের অথবা নদী জলে ভাসাইয়া দিলাম। এরপর মৃত রাজাকার দুইজনকে তল্লাশি করিলাম। তাহাদের পকেটে পাইলাম বেশ কিছু পরিমান লুন্ঠিত টাকা, তাহাদের পরিচয়পত্র এবং রাইফেলের কিছু গুলি। আমি তাহাদেরকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করিয়া শিয়াল কুকুরের  খাদ্য হিসাবে রাখিয়া দিলাম। একটি শূন্য রাইফেল ফেলিয়া দিলাম খালের জলে, অন্যটি গুলিসহ হাতে নিয়া যাত্রা শুরু করিলাম নিরুদ্দেশের পথে।

জানি না আমার পথের শেষ কোথায়?

(এরপর ডায়েরির পাতা ছেঁড়া, তারপর আবার শুরু এইভাবে)

 

বহুদিন কত পথ হাঁটিয়া হানাদার বাহিনী ও তাহাদের শ্যেন চক্ষু এড়াইয়া এক অপরাহ্নে উপস্থিত হইলাম আঠারোকাঠি নামক এক নদীর নির্জন শ্মশান ঘাটে। সেইখানেই দেখিলাম, নদী পাড়ে এক অষ্টাদশী শোকাভিভূত তরুণীর সাথে। অপরাহ্নের বিষণœ আলোয় সে তাহার নিহত পিতা-মাতার মরদেহের পাশে বোধশূন্য অবস্থায় বসিয়া ছিল। হিন্দু প্রথা অনুযায়ী দাহকার্যে সাহায্য করিবার কোনো লোক নাই, কাঠ নাই, আগুন নাই। আমাকে রাইফেল হাতে দেখিয়া সে চমকিত হইল না। আমি রাজাকার বা মুক্তিযোদ্ধা যাই হই না কেন এখন সে আর ভীত নয়। সর্বস্ব হারাইয়া সে এখন মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত। আমি তাহার পাশে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসিয়া রহিলাম।

এক সময় বলিলাম, আমি ফজলুল হাসান। তুমি?

আমি জয়ীতা।

এরপর ডায়েরির পাতা ছেঁড়া। ফজলুল হাসান আর বোধহয় কিছু লিখেন নাই অথবা লিখেছিলেন সেইসব কথার পাতা ডায়েরিতে নেই। পিতার অসমাপ্ত ডায়েরির সব কথা বালক তাইমুর কল্পনা করে। কলম ডায়েরির সাদা পাতায় লেখা শুরু করে।

‘জয়ীতা এখন হাসানের পথসঙ্গী। সাতক্ষীরা শহর এড়াইয়া, শত্রু সৈন্যের চক্ষু এড়াইয়া জীবনকে হাতের মুঠায় নিয়া জলা-জঙ্গলের ভিতর দিয়া তাহাদের অবিরাম পথ চলা। রাত্রি গভীর হইলে তাহারা কখনো কোনো সহৃদয় কৃষকের বাড়িতে, কখনো নির্জন বৃক্ষতলে আশ্রয় নেয়, ঘুম ঘুম চোখে রাত্রি পোহায়। এইভাবে পথ চলিতে চলিতে তাহাদের কতদিন যায়, রাত্রি যায়, শরীর হইতে কত ঘাম আর রক্ত ঝরে তাহার হিসাব তাহারা জানে না। এই সময়ের মধ্যে তাদের প্রণয় হইয়াছিল কিনা তাহা কেন লেখা নাই? এই দীর্ঘ বিপদ-সংকুল পথ যাত্রায় ছিন্ন-ভিন্ন পোশাকে, রোদে-বৃষ্টিতে, আলো-অন্ধকারে একে অপরের বুকে মাথা রাখিয়া ঘুমাইয়া ছিল কিনা তাহা ডায়েরির পাতায় কেন নাই! কৌতূহলী বালক তাইমুরের প্রশ্নের উত্তরে কলম বলিল, সেই ইতিহাস আমার কলমের কালিতে জমা নেই। কেননা আমি তো তখন সেই যুবকের হাতে ছিলাম না, তাহার শার্টের পকেটেও ছিলাম না। তাহার এক হাতে ছিল রাইফেল, অন্যহাতে জয়ীতার হাত। শুধু কল্পনায় এইটুকুই বলিতে পারি সাতক্ষীরার প্রান্তসীমায় ইছামতি নদী সাঁতরাইয়া পার হইয়া ভারতীয় বর্ডার গার্ডের হাতে রাইফেল সমর্পণ করার পর তাহাদের দুইজনেরই আশ্রয় জুটিয়াছিল ওপারের হাসনাবাদ শিবিরে।

গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় দুইজনকে হাসনাবাদ শরণার্থী শিবিরের চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রাথমিক সেবা শুশ্রুষা দানের পর সপ্তাহখানেক পর তাহাদের দুইজনকেই পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছিল বশিরহাট শরণার্থী শিবিরে। মোটামুটি সুস্থতা ও শারীরিক সক্ষমতা ফিরিয়া পাইবার পর শরণার্থী শিবিরের চিকিৎসা কেন্দ্রে জয়ীতা নার্স হিসাবে নিযুক্ত হইল এবং হাসান মুক্তিযোদ্ধা সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করিয়া চলিয়া গেল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করিতে।

 

বিদায় মুহূর্তে জয়ীতা জিজ্ঞাসা করিল, আমাদের আবার কি দেখা হবে না?

হাসান বলিল, জানি না।

জয়ীতা বলিল, আমি অপেক্ষায় থাকব।

হাসান বলিল, না থেকো না।

হাসান চলিয়া গেল। তাহারপর কতদিন, কতমাস চলিয়া গেল। কত আহত, মৃত মুক্তিযোদ্ধা ফিরিয়া আসিল। কিন্তু হাসানের কোনো খোঁজ নাই। পথের পানে তাকাইয়া থাকিতে থাকিতে জয়ীতার চোখে সীমাহীন ক্লান্তি। নিঃশব্দ কান্নায় ফিসফিস করিয়া বলে, হাসান তুমি কি সত্যিই ফিরে আসবে না? একবার ফিরে আসো। একবার চোখের দেখা দিয়ে যাও। আমি যে আমার প্রাণে তোমার জন্যে ভালোবাসার নৈবদ্য সাজিয়ে বসে আছি।

চলবে

 

লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব এক)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব দুই)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব তিন)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব চার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব পাঁচ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব ছয়)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব সাত)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব আট)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব নয়)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব দশ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব এগার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব বার)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top