সিডনী মঙ্গলবার, ১৯শে মার্চ ২০২৪, ৫ই চৈত্র ১৪৩০

এস বিস্কুট এবং মৃত মারফি রেডিও : কাজী মাহমুদুর রহমান


প্রকাশিত:
১৭ জুন ২০২১ ২০:৩০

আপডেট:
১৭ জুন ২০২১ ২০:৩১

ছবিঃ কাজী মাহমুদুর রহমান

 

চশমার ঘোলাটে কাঁচটা মুছতে গিয়ে ফ্রেম থেকে কাচঁটাই খুলে গেল। ফ্রেমের ডাণ্ডিটা খুউব নড়বড়ে। স্ক্রুটা খুলে পড়ে গেছে বোধহয়। এত ছোট্ট স্ক্রু কোথায় পড়ল? কোথায় খুঁজে পাই? টেবিলের উপর কত রকম বইপত্তর, পুরোনো ম্যাগাজিনের জঞ্জাল, ক্ষয়াটে পেপার ওয়েট, ঘরের জংপড়া তালাচাবি, আধ খাওয়া ওষুধের পাতা, শূন্য  পানির গ্লাস আর মান্ধাতা আমলের একটা মারফি রেডিও। মৃত রেডিওটার ডালা খুলে দেখতে চেয়েছিলাম কোথায় তার হৃৎপিণ্ড, জীবনের স্পন্দন? সার্জনের ছুরি-কাঁচির মতো আমার স্ক্রু ড্রাইভারের স্পর্শে ঐ যাদুর বাক্সে শব্দতরঙ্গের ঢেউ ওঠে কি না, আমাকে চমকে দিয়ে দেবদূতের মতো কেউ কথা কয়ে ওঠে কি না, অথবা বেজে ওঠে লালনের অলৌকিক সংগীত। কিন্তু স্ক্রু ড্রাইভারটা কোথায় রাখলাম? কোথায়? আজকাল কিছু হারালে তা আর খুঁজে পাই না, না নিজেকে, না অন্যকে।

নড়বড়ে চশমার একটা কাঁচ, একটা চোখ দিয়েই খুঁজতে থাকি স্ক্রু ড্রাইভারটা। তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকি টেবিলের সমস্ত জঞ্জাল, দেরাজ, ধুলোবালির মেঝে। বিছানার ছেঁড়া তোষকটা উল্টে দেখি-কতকাল আগের ময়লাটে ছেঁড়া বাজারের ফর্দ, বিদ্যুতের বিল, চিমসে-পড়া লন্ড্রির স্লিপ, আমার পাজামা-পাঞ্জাবি, বাবুর সাদা শার্ট, রাবেয়ার শাড়ি। কাপড়গুলো লন্ড্রি থেকে কি আনা হয়েছিল? রাবেয়াকে জিজ্ঞেস করলে বলতে পারত। রাবেয়া, বাবু এখন কোথায়?

চিটচিটে তোষকের তলায় আমাদের দুজনের সংসারের কত স্মৃতি, কত হিসেব, কত সুখ-দুঃখ চাপা পড়ে আছে। আমার ঘোলাটে চোখের মতো বাবু আর বাবুর সেই চিঠিটাও। লেখাগুলো ঝাপসা, জাবড়ানো, তবু পড়া যায় ‘বাবা তুমি আমার জন্যে এস বিস্কুট এনো।’

আমাদের স্বপ্নের শিশুকালে কেক-বিস্কুটের ফেরিওয়ালা চৌকোনা কাঁচের বাক্স মাথায় নিয়ে পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরত। বাক্সের মধ্যে হরেক রকম কেক, বিস্কুট থরেথরে সাজানো। অদ্ভুত সুরে হাঁক দিয়ে বলত, ‘পা ... ও ... রুউটি ... বি ... ই ... স্কু ... উ ... ট।’ আমরা তার সুর নকল করে হাঁক দিতাম, ‘কাছা খুলে দাও ছুট’। ফেরিওয়ালা হাসত। আরো বিচিত্র মোহনীয় সুরে হাঁক দিত ঠিক যেন হ্যামিলনের বংশীবাদক। আমরা শিশুর দল তাকে ঘিরে উল্লাসে লাফালাফি, হৈ চৈ, চিৎকার। ফেরিওয়ালা দামাল শিশুর দল সামলে মাথা থেকে বাক্স নামিয়ে ডালা খুলত। টাটকা কেক, বিস্কুটের ঘ্রাণে আমাদের চোখ তখন লোভাতুর ইদুঁর। আমার সবচাইতে প্রিয় ছিল বড়োসড়ো এস বিস্কুট --মুচমুচে মজাদার, যার স্পর্শ এখনও তৃষ্ণার্ত ঠোঁটে, দাঁতে, জিহ্বার দানায়-দানায়। সেইসব স্মৃতি  আমার আত্মায় সাদা-কালো কিংবা রঙিন ছবির মতো সাজানো,  যেমন সাজানো থাকে বায়োস্কোপের বাক্সে। আমি এক নবীন বায়োস্কোপওয়ালা গানের তালেতালে বাক্সের হাতল ঘুরাই, একে-একে ছবিগুলো আসে আর যায়, অবোধ চোখে মুগ্ধ বিস্ময় খেলা করে।

আমার সাত বছরের বাবু ভারি মজা পায়। আবদার ধরে আমাকেও ভাগ দাও তোমার শৈশবের। আমাকেও এনে দাও তোমার আনন্দের স্বাদ এস বিস্কুটের। আমি প্রতিশ্রুতি দিই। মণিরামপুরের বাজারে কত খুঁজি, যশোর টাউনের দড়াটানা রোড, বড় বাজার, চৌরাস্তায় কত খুঁজি। কিন্তু কোথাও এস বিস্কুট নেই। এস বিস্কুট হারিয়ে গেছে পৃথিবীর অন্যসব বিলুপ্ত প্রজাতির মতো।

 

একাত্তরের মার্চে আমি ঢাকায় ডিসি অফিসের কেরানি। চারিদিকে গণউত্তাল। মিছিল আর মিছিল। মণিরামপুর থেকে রাবেয়ার চিঠি এলো, ‘বাবুর খুব জ্বর, চারিদিকে ভীষণ গণ্ডগোল, জানি না কখন কী হয়! তুমি শিগগির এসো।’ চিঠির নিচে বাবুর হাতের এলোমেলো লেখা, ‘বাবা তুমি আমার জন্যে এস বিস্কুট এনো।’

আমি কত খুঁজি, সদরঘাট, চকবাজার, লালবাগের ছোটো বড়ো সব বেকারি, দোকানপাট। ওরা আমায় হাঁকিয়ে দিয়ে বলে, এস বিস্কুট নয়, এস এল আর, এস এম জি, সাবমেশিনগান কোথায় পাওয়া যায় তাই খুঁজুন। এখন এস বিস্কুট খাবার সময় নয়। এখন যুদ্ধে যাবার সময়। চলেন রেসকোর্স ময়দানে, মহান নেতা ভাষণ দেবেন, যুদ্ধের ঘোষণা দেবেন, ঘোষণা দেবেন স্বাধীনতার। কারো কণ্ঠে শ্লেষ, হ্যাঁ দেশটা স্বাধীন হলে সব মাঠ, পথ-ঘাট ভরে যাবে ফুলে ফসলে, বুড়িগঙ্গা উপচে পড়বে দুধের নহরে, আপনার এস বিস্কুট ঝুলবে বট-পাকুড়ের শাখায়-শাখায়।

স্বপ্নের খোয়ারি সকল যুবক, বৃদ্ধ, নারী ও শিশুর দল লাঠি হাতে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে চলে যায়। পদ্মা, মেঘনা, যমুনার উপচে-পড়া স্রোতের মতো অজস্র মিছিল চলে যায়। কিন্তু আমি দিক্ভ্রান্ত, উদভ্রান্ত। মিছিল থেকে ছিটকে পড়া এক মানুষ পাগলের মতো খুঁজে বেড়াই। ডুকরে  কেঁদে উঠি, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করি, হ্যাঁ আমিও স্বাধীনতা চাই, স্বপ্ন দেখার স্বাধীনতা, শৈশবের আনন্দ ফিরে পাবার স্বাাধীনতা, চাই আমার ক্ষুধার্ত জরতপ্ত বাবুর জন্যে দু-আনা দামের এস বিস্কুট।

আমার ‘চাই’  চিৎকার ... ... ... ‘সংগ্রাম-সংগ্রাম’ চিৎকারে চাপা পড়ে যায়। মিছিলের প্রবল স্রোতে আমি ছিটকে পড়ে যাই পথের নর্দমায়। আমার আর উঠতে ইচ্ছে হয় না। ক্লান্তি আর হতাশায় নোংরা নর্দমায় ঘুমিয়ে যাই। ঘুমের মধ্যে হ্যামিলনের বংশীবাদক সেই বিস্কুটওয়ালা দূরাগত স্বপ্নের ধ্বনিতে বারবার যেন আমাকে ডেকে যায়--  ‘এস বিস্কুট চাই’। আমি ছুটতে থাকি তার পিছুপিছু, কিছুতেই তার নাগাল পাই না।

আমার ঘুম আর স্বপ্ন ভাঙে ২৬ মার্চের মধ্যরাত্রে। চতুর্দিকে গোলাগুলি, দাউদাউ আগুন, পোড়া ধোঁয়ার মধ্যে আমি বিমূঢ় গৌতমবৃক্ষ হয়ে বসে থাকি। আমার শেকড়ে আগুন, পাতায় পাতায় জ্বলন্ত বাতাস, গরম ছাই, পুড়তে পুড়তে আমি মৃত্যুর মুখে উঠে দাঁড়াই। ছুটতে থাকি যশোরের পথে, নরকের পথে মণিরামপুরে। কিন্তু বারবার  পথ ভুল হয়ে যায়, ঠিকানা হারিয়ে যায়। একজন ভীতু কেরানি এস বিস্কুট ছাড়া যার আর কোনো স্বপ্ন ছিল না তার দগ্ধ হাতে কখন যেন উঠে আসে একটা এস এল আর। সেখানে শুধু ঘৃণা, প্রতিশোধের অগ্নুৎদগার। ধ্বংস, রক্ত আর আগুনের ভেতর দিয়ে আমি অবিরাম ছুটতে থাকি বন-বাদাড়, ধানক্ষেত, নদী আর ব্রিজের তলায়। ভুলে যাই প্রিয়তম রাবু আর বাবুর মুখ, বাবুর লেখা সেই চিঠি ‘বাবা তুমি আমার জন্যে এস বিস্কুট এনো।’

ন-মাস পর রক্তজল সাঁতরে আমি মণিরামপুর পৌঁছে যাই। যে মণিরামপুর ছিল নক্ষত্রের আলোয় ভরা রূপময় মাঠ, আমার মায়া-মমতার ঘর গেরস্থালি, তা এখন অগ্নিদগ্ধ পোড়া ছাই। কেউ জানে না আমার বাবুর সাত বছরের গুলিবিদ্ধ দেহটা কোন মাটিতে কোথায় মিশে আছে,  কেউ জানে না রাবেয়াকে  যে  হানাদার শত্রুর ক্যাম্প থেকে ফেরা। সম্পূর্ণ স্মৃতিশূন্য। চোখে তার দুঃখ নেই, আলো নেই, প্রশ্ন নেই, নেই কোনো স্মৃতিছায়া। দৃষ্টিতে ধূ ধূ শূন্যতা, না আমাকে চেনে, না আমি তাকে। আমি ভয় পাই ওকে। ও এখন  আমার সহ্যের অতীত।  ভীষণ ভয়ে ওকে পাবনার হেমায়েতপুরে রেখে আমি পালিয়ে যাই, পালিয়ে যাই, রাবুর শরীর ও ছায়া থেকে, সত্য থেকে, আলো থেকে। ফিরে আসি পুরোনো জিন্দাবাহার লেনের অন্ধকার ঘরে যেখানে রংচটা ধূসর দেয়ালে বাবুর অ, আ, আঁকিবুকির স্মৃতি, রাবেয়ার প্রথম সংসার, ভালোবাসার স্মৃতি এখন মাকড়সার জালে-জালে জড়ানো জীবন। পুরোনো গন্ধের শয্যায় ছেঁড়া মশারির ঘেরাটোপে আমি একা উদোম হয়ে শুয়ে থাকি। রাতের পর রাত জেগে থাকি, গলা দিয়ে ঝলকে-ঝলকে রক্ত উগরে দিই। বাইরে যখন সকালের শব্দ হয়, রোদ ওঠে, পাখি ডাকে, মেঘ ডাকে, ঝুমঝুম বৃষ্টি হয়, আমার মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে। চমকে উঠি যখন কোনো ফেরিওয়ালা ডাক দেয়-- ‘বেচবেন পুরোনো খবরের কাগজ, টিনের কৌটো, শিশি, বোতল।’ আমি ‘শুয়োরের বাচ্চা’ বলে গালি দিই  নিজেকে। পুরোনো খবরের কাগজ, ভাঙা টিনের কৌটো, বাতিল শিশি-বোতলেরও কত দাম। কিন্তু আমার দাম নেই এক কানাকড়িও। উঁইয়ে-খাওয়া বীর প্রতীক-এর সার্টিফিকেটটা টুকরো টুকরো করে বাতাসে উড়িয়ে দিই। যার কোনো স্বপ্ন নেই, রাবু নেই, বাবু নেই -- এসব জঞ্জাল অনাবশ্যক, অর্থহীন তার আয়ুষ্কাল, সকল পদক।

স্ক্রু ড্রাইভারটা আর কিছুতেই খুঁজে পাই না। চশমার স্ক্রুটাও না। আমি অন্ধচোখে অস্থির আক্রোশে মৃত মারফি রেডিওটা ঝাঁকাতে থাকি, ভাঙতে থাকি, ভাঙতে থাকি আকাশ-পাতাল। ভাঙনের শব্দের মধ্যে যদি শোনা যায় সেই হ্যামিলনের বংশীবাদক বিস্কুটওয়ালার ডাক, আমার শৈশবের ডাক, আমার বাবুর অলৌকিক কণ্ঠ, ‘বাবা, তুমি আমার জন্যে এস বিস্কুট এনো।’

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top