সিডনী মঙ্গলবার, ১৯শে মার্চ ২০২৪, ৫ই চৈত্র ১৪৩০

সুখের কুসুম : রঞ্জনা রায় 


প্রকাশিত:
২০ জুলাই ২০২১ ০৮:০১

আপডেট:
১৯ মার্চ ২০২৪ ১১:২৯

ছবিঃ : রঞ্জনা রায় 

 

সাড়ে পাঁচটায় অ্যালার্ম বাজতেই অদিতি উঠে পড়ল। অয়ন আর বিতান দুজনেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বিতানের মাথাটা ভাল করে বালিশে তুলে দিয়ে ছেলের কপালে একটা চুমু খেলো। পাশে অয়ন শুয়ে আছে। মানুষকে ঘুমালে বড় মায়াময় দেখতে লাগে।অয়নের এখন অফিস ছুটি ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছে। অদিতিকে আজ স্কুলে যেতে হবে কারণ আজ মিড ডে মিল দেবার দিন। মিড ডে মিলের সব দায়-দায়িত্ব অদিতির উপরে থাকে কারন ওর বাড়ি স্কুলের কাছাকাছি। অবশ্য হেডমিস্ট্রেস ও আসবেন। অদিতি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিয়ে কিচেনের দিকে ছুটলো চায়ের জল বসাতে এবং সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা টিফিন বানিয়ে নিতে হবে। কারণ লক্ষ্মী কখন আসবে তার জন্য আজ বসে থাকলে চলবে না। কিচেন এ ঢুকে গ্যাস অন করে একটা ওভেনে প্রেসার কুকারে ডিম আর আলু চড়িয়ে দেয় আর অপরটায় বসায় চায়ের জল। ডিম আর আলু দিয়ে কিছু স্যান্ডউইচ বানিয়ে নেবে কারণ ফ্রিজে পাউরুটি আছে। আর অয়ন  যদি আলাদা কিছু খেতে চায় তা হলে লক্ষী এসে সেটা পরে বানিয়ে দেবে। মোটামুটি নিজের ব্রেকফাস্ট রেডি করে যখন টেবিলের রেখেছে ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠল। লক্ষীর ফোন। এত সকালে লক্ষ্মীর ফোন কেন? অদিতি একটু চিন্তিত হয়ে ফোনটা ধরল।

"লক্ষ্মী কখন আসবে? আমি আজকে বেরোবো তোমাকে কালকে বলেছিলাম।"

"আজ আর বেশি কিছু রান্না করতে হবে না। একটু মাছের ঝোল আর ডাল ভাজা করে দিও। আমি ব্রেকফাস্টটা তৈরি করে রেখে যাচ্ছি।"

অদিতি কথা শেষ করল কিন্তু অপরদিক থেকে কোন সাড়া শব্দ পেল না। কেমন একটা সন্দেহ হল। বলল, "লক্ষ্মী কি হল কথা বলছো না কেন? কখন আসবে?"

: বৌদি আমার বোধহয় খুব বিপদ হয়ে গেছে। আমার বরের কাল রাত থেকে খুব জ্বর। এখন হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। আমি এখন যেতে পারবো না। বৌদি ডাক্তার বলেছে আগে টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট দেখে তার পরে সবকিছু হবে।"

অদিতির মাথায়তো আকাশ ভেঙে পড়ল।

অদিতির মাথায় তো আকাশ ভেঙে পড়ল। ভাবল, এখন যদি লক্ষ্মী না আসতে পারে তা হলে তার ওপরে বিরাট চাপ পড়বে ঘরের কাজ, অনলাইন ক্লাস নেয়া তা ছাড়া সে বাড়িতেও দুই একজন ছাত্রছাত্রীকে প্রাইভেট পড়ায়।

কিন্তু যা পরিস্থিতি উপায়ও নেই। লক্ষীকে সে বাড়িতে এখন কাজ করতে বলতে পারে না। যদি ওর স্বামীর কোভিদ্ হয় তা হলে তো অন্তত ও দু'মাস কাজে আসতে পারবে না।

যাক এখন তো আর ভাবার কিছু নেই। আধঘণ্টার মধ্যে রেডি হয়ে তাকে বেরোতে হবে। যাবার সময় অয়নকে বলে যাবে অনলাইনে অর্ডার করে আজকের দুপুরের খাবার আনিয়ে নেয়ার কথা। কারণ এখন আর রান্না করার সময় হাতে নেই। চা গরম করে ফ্লাক্সে ঢেলে রাখল আর স্যান্ডউইচগুলো গরম করে ক্যাসারোলের মধ্যে ভাল করে প্যাক করে রেখে দিল। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে অয়নকে ডাকতে গেল এবং লক্ষ্মীর বিষয়ে সব কথা জানাল। পাড়ার  রিকশাওয়ালা স্বপন ঠিক সাড়ে আটটার সময় চলে এসেছে। অদিতি স্কুলের দিকে রওনা দিল।

স্কুলে পৌঁছে অদিতি দেখল বেশ একটা জমজমাট ব্যাপার। তাদের হেডমিস্ট্রেস বাসন্তীদি অনেক আগেই চলে এসেছেন এ ছাড়া তার সহকর্মী আরও চার জন টিচার রিতা, কমলিকাদি, অনুশ্রী আর বেলা এরাও এসেছে। দু'জন দারোয়ান দাদা তো স্কুলেই থাকে আর আছে সুইপার শুকলাল। আর গার্জেনরা ও সবাই এসে গেছেন। সবাই একটু চা খেয়ে মিড-ডে-মিল দেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিল। হলঘরে সোশ্যাল ডিসটেন্স মেনে মিড-ডে-মিল দেওয়া শুরু হল। কিছুক্ষণ পরে একজন দারোয়ান দাদা এসে অদিতিকে বলল, বড়দি একবার অফিসে ডাকছেন তাকে এক্ষুনি যেতে হবে।

অদিতি অফিস ঘরে গিয়ে দেখল ঘরের এক কোণে মৌমিতা দাঁড়িয়ে আছে। এই মেয়েটি তার ক্লাসে পড়ে। এই মেয়েটি পড়াশোনায় বেশ ভাল কিন্তু খুবই দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছে। বাবার শ্যামবাজার মেট্রো স্টেশনের কাছে একটা ছোট্ট চায়ের দোকান আছে। সেই দোকানের আয়েই এই  সংসার চলে। মা বোধহয় বিভিন্ন বাড়িতে রান্নার কাজ করেন। মেয়েটি পড়াশোনায় ভাল এবং ধীর-স্থির স্বভাবের বলে অদিতির ওর প্রতি একটু সহানুভূতি আছে।

ছাত্রীরা নয় অদিতিদের স্কুলে অভিভাবকরাই মিড-ডে-মিল নিতে আসেন। গত এক বছর লকডাউন এর সময় মিড-ডে-মিল নিতে মৌমিতার বাবাই এসেছেন। ওদের পরিবারের অবস্থার কথা একদিন ওর বাবা অশোকবাবু তার কাছে জানিয়েছিলেন। কারণ লকডাউনের সময় তার চায়ের দোকান অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকে। তাই তিনি বাড়ি বাড়ি দুধ আর ফল বিক্রি করেন। অদিতির কোনও প্রয়োজন থাকলে তাকে জানানোর জন্য অনুরোধ করেছিলেন। আজ মৌমিতাকে অফিস রুমে দেখে অদিতি জিজ্ঞেস করল, "কি ব্যাপার মৌমিতা তুমি এসেছ কেন তোমার বাবা কোথায় গেছেন?"

উত্তরটা এল বড়দির থেকে। বড়দি বললেন "মৌমিতার বাবার খুব জ্বর। তিনি আসতে পারবেন না। ওর মা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে তাই মৌমিতা এসেছে মিড ডে মিলের জন্য। মিড ডে মিল ওদের এখন বিশেষ প্রয়োজন। তাই তুমি মৌমিতাকে সব কিছু ডাবল করে দিয়ে দাও।"

খবরটা শুনে অদিতি বিমর্ষ হয়ে পড়ল মৌমিতাকে বলল, "তুমি চিন্তা কোরো না। আমরা তোমার পাশে আছি। তুমি জানবে স্কুল তোমার পাশে আছে।"

"মৌমিতা তোমার ফোন নাম্বারটা একটু দাও আমি সেভ করে রাখি তোমাদের খবর নেব।" অদিতি বলল।

মৌমিতার নাম্বার সেভ করতে গিয়ে অদিতি দেখল এই নাম্বারটা আগে থেকেই ওর মোবাইলে আছে ভুরু দুটো কুঁচকে উঠল, মনে মনে একটু ধাক্কা খেলো কিন্তু বাইরে বুঝতে দিল না।

মৌমিতাকে সব জিনিসপত্র দিয়ে দরোয়ান দাদাকে ওর সঙ্গে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিতে বলল। মাথার মধ্যে একটা চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল কিন্তু বাইরে কোথাও প্রকাশ করল না।

সাত দিন পরে মৌমিতার ফোন এল, "ম্যাডাম আমার বাবার করোনা টেস্টের রিপোর্ট এসেছে।  বাবা করোনা পজিটিভ নয়। বাবার এমনি সর্দি জ্বর হয়েছিল। ডাক্তারবাবু ওষুধ দিয়েছেন এখন ভাল আছে। তবে ডাক্তার বাবু বলেছেন আরও সাত দিন বাদে আবার একটা টেস্ট করাতে হবে।"

অদিতি বলল, "যাক শুনে খুব ভাল লাগল তবে তোমরা খুব সাবধানে থেকো। আমি তোমাদের খবর নেব।"

এর দিন দশেক বাদে মৌমিতা ফোন করে জানাল যে ওর বাবা এখন অনেকটাই সুস্থ হয়ে গেছে এবং করোনার রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। অদিতি ওকে অনলাইন ক্লাসে যোগদান করতে বলল। মৌমিতা জানাল ওর নিজের স্মার্টফোন নেই তবে এক প্রতিবেশী দিদির ফোন নিয়ে ও এই অনলাইন ক্লাস করতে পারবে।

সেই দিনই বিকেলবেলা লক্ষ্মীর ফোন এল ও বলল, যে ওর স্বামী ভাল হয়ে গেছে। তাই কাজ করতে যেতে পারবে। কবে থেকে কাজ আরম্ভ করবে সেটা অদিতির কাছ থেকে জানতে চাইল। অদিতি ওকে আরো দু'সপ্তাহ পরে কাজে আসতে বলল।

 

  [২ ]

"লক্ষ্মী কিছু আম আর এই মিষ্টির প্যাকেট টেবিলে রাখলাম। কাজ শেষ করে যাবার সময় এটা তুমি বাড়ি নিয়ে যাবে।"

লক্ষ্মী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, "কেন বৌদি? এ সব আমায় কেন দিলেন?"

অদিতি বলল, "আম তোমার স্বামীকে দিও আর এই মিষ্টির প্যাকেটটা মৌমিতা আর তুমি দু'জনে মিলে খেয়ো।"

"কোনও দিনও তো জানাওনি যে, তোমার মেয়ে আমার স্কুলে আমারই ক্লাসে পড়ে। আমি এই করোনার সময় জানতে পারলাম যে তোমার মেয়ে মৌমিতা আর সে আমারই ছাত্রী।"

লক্ষী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তার পর আস্তে আস্তে বলে, "বৌদি ভয় পেয়েছিলাম তাই বলতে পারিনি। বৌদি আমরা খুবই গরিব লোক। অত বড়  স্কুলে মেয়েকে পড়ানোর সাধ্য আমাদের নেই। তবুও আমরা স্বামী-স্ত্রী মিলে প্রচুর কষ্ট স্বীকার করে মেয়েকে এত বড় স্কুলে দিয়েছিলাম। মনে মনে চাই যেন বড় হয়ে ও খুব ভাল একটা চাকরি করতে পারে। আমার মতো এত দুঃখ কষ্টের জীবন যেন ওর না হয়। ভেবেছিলাম আপনি জানতে পারলে হয়তো আমাকে চাকরি থেকে তাড়িয়ে দেবেন। কিন্তু বৌদি টাকাগুলো যে বড়ই দরকার। তাই ভয়ে ভয়ে আপনাকে কিছু বলতে পারিনি বৌদি আমার অপরাধ হয়ে গেছে আমি আপনার পা ধরে ক্ষমা চাইছি।" বলে, লক্ষ্মী অদিতির পা ধরতে আসে।

অদিতি এগিয়ে এসে লক্ষ্মীর হাত দুটো ধরে বলে, "শিক্ষার আকাশে সবাই সমান। সেখানে ধনী-দরিদ্র এর ভেদ নেই। লক্ষ্মী এ বার থেকে তোমাকে আর বাসন মাজা আর ঘর মোছার কাজ এখানে করতে হবে না। তুমি শুধু আমার রান্নাটুকু করে দেবে। ওই সব কাজের জন্য আমি একজন অন্য লোক ঠিক করেছি। মেয়ের জন্য তোমার এই পরিশ্রম যেন সফল হয়।"

লক্ষ্মী কিছু বলে না তার চোখ দিয়ে পরিতৃপ্তির অশ্রু ঝরে। মনে ভাবে পৃথিবীটা দুঃখের হলেও সেখানে সুখেরও কিছু কুসুম ফোটে।

 

রঞ্জনা রায় 
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top