সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

বাঙালির শারদীয়া পূজাবার্ষিকীর সেকাল একাল : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
১১ অক্টোবর ২০২১ ২৩:৫৪

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ০২:৪৩

 

বাঙালির অন্দরে-অন্তরে যেভাবে ঢুকে পড়েছিল শারদীয়া পুজোসংখ্যা, তার বর্ণময় ইতিহাসের অন্বেষণ করতে এই নিবন্ধ ভাবনা। সময়ের হাত ধরে পরিবর্তন এসেছে বাঙালির মনন জগতে। রুচির সাথে পরিবর্তন এসেছে সাংস্কৃতিক ভাবনার। পুজো সংখ্যা মানে অল্প টাকায় অনেকগুলো উপন্যাস, কবিতা, গল্প, আমাদের বাঙালির পুজো সংখ্যা কেনা মানে সারা বছরের অনেকটা খোরাক। তাই পারলে সব কটা পুজো সংখ্যা কিনে ফেলে।

এখন দুর্গাপূজার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে শারদীয়া বা পূজা সংখ্যা। একেবারে শুরুর দিকে কোনও একটি পত্রিকার সাধারণ সংখ্যার সঙ্গে শরৎকালে বিশেষ সাল্পিমেন্ট হিসাবেই ছাপা হতে থাকে পুজো সংখ্যা। সম্ভবত, কেশবচন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত ভারত সংস্কার সভার সাপ্তাহিক ‘সুলভ সমাচার’ বিশেষ সংস্করণ প্রকাশ করে ‘ছুটির সুলভ’ নামে। এক পয়সার সেই বিশেষ সংখ্যা বেরোয় ১২৮০-এর আশ্বিন মাসে। তারপর থেকে ‘ভারতবর্ষ’, ‘বঙ্গবাণী’ প্রভৃতি পত্রিকা পুজো সংখ্যা প্রকাশ শুরু করে। তখনকার দিনের নামী লেখকেরা যেমন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় প্রমুখ এতে লিখতেন। প্রথম শারদ উপন্যাস ছাপা হয় শারদীয় বসুমতীতে। ইংরেজি ১৯২৬ সালে প্রথম শারদীয় সংখ্যা বের করে আনন্দবাজার পত্রিকা। তার বেশ কিছু বছর পর তাতে প্রথম উপন্যাস ছাপা হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শহরতলী’। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত বড় গল্প ‘রবিবার’ প্রকাশিত হয় এখানেই, পরের বছরেই ‘ল্যাবরেটরি’।

দেশ পত্রিকার শারদ সংখ্যা প্রথম প্রকাশ পায় ১৩৪১ বঙ্গাব্দে আর সুবোধ ঘোষের ‘ত্রিযামা’ ছিল দেশ-এ প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস, যা বেরিয়েছিল ১৩৫৬ বঙ্গাব্দে।

এরপর ইংরেজি ষাটের দশক থেকে আমরা দেখতে পাই, একএকটি পুজোয় একাধিক পুজোর সংখ্যা বের হয়, এমনকি ছয়-সাতটি করে উপন্যাস ছাপা হয়। সমকালের বিখ্যাত লেখকেরা সেগুলি লিখতেন। যেমন পুরনো দেশ পত্রিকার সংখ্যা খুললেই দেখা যাবে প্রথমেই অবশ্যউপস্থিতিটি রবীন্দ্রনাথের, তাঁর অপ্রকাশিত লেখা বা চিঠিপত্রের সম্ভার। তারপরেই থাকত বিষয়ক রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধ। তারাশঙ্কর, মানিক, বিভূতি, সতীনাথদের যুগের পর তাঁদের ব্যাটন ধরেন সমরেশ বসু, রমাপদ চৌধুরী, বিমল কর, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার-রা। 

পূজার সময়ে নামী লেখকদের লেখা পাওয়ার জন্য পত্রপত্রিকার সম্পাদকেরা পূজার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই তোড়জোড় শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথের সময়েও এ ব্যাপার ছিল। নানা সম্পাদকের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথের কাছে তাঁদের পত্রপত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় লেখা দেওয়ার জন্য অনুরোধ আসত। যতদূর জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ‘পার্বণী’ নামের শারদীয় বার্ষিকীতেই প্রথম পূজার লেখা দেন। ‘পার্বণী’ হলো প্রথম বাংলা বার্ষিকী। প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩২৫ সালে। ‘পার্বণী’ সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। ‘পার্বণী’র প্রথম পূজাবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথ ‘শরতে আজ কোন অতিথি এল প্রাণের দ্বারে’ গানটি ‘শরতের গান’ নাম দিয়ে লিখেছিলেন। আর লিখেছিলেন ‘ইচ্ছাপূরণ’ গল্প ও ‘ঠাকুর্দ্দার ছুটি’ কবিতা। প্রথম শারদীয় বার্ষিকী হাতে পেয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘পার্বণী’র সম্পাদক নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে একটি চিঠি লিখেছিলেন:
“তোমার ‘পার্বণী’ পড়িয়া বিশেষ আনন্দ পাইয়াছি। ইহা ছেলে বুড়ো সকলেরই ভাল লাগিবে। তোমার পরিশ্রম সার্থক হইয়াছে। দেশের প্রায় সমস্ত বিখ্যাত লেখকদের ঝুলি হইতে বাংলাদেশের ছেলেদের জন্য এই যে পার্বণী আদায় করিয়াছ ইহা একদিকে যত বড়ই দুঃসাধ্য কাজ, অন্যদিকে তত বড়ই পুণ্য কর্ম। বস্তুত ইহার বৈচিত্র্য, সৌষ্ঠব ও সরসতা দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছি—অথচ ইহার মধ্যে পাঠকদের জানিবার, ভাবিবার, বুঝিবার কথাও অনেক আছে। তোমার এই সংগ্রহটি কেবলমাত্র ছুটির সময় পড়িয়া তাহার পরে পাতা ছিঁড়িয়া, ছবি কাটিয়া, কালি ও ধূলার ছাপ মারিয়া জঞ্জালের সামিল করিবার সামগ্রী নহে—ইহা আমাদের শিশুসাহিত্যের ভাণ্ডারে নিত্যব্যবহারের জন্যই রাখা হইবে। প্রথম খণ্ড ‘পার্বণী’তে যে আদর্শে ডালি সাজাইয়াছ, বৎসরে বৎসরে তাহা রক্ষা করিতে পারিলে মা ষষ্ঠী ও মা সরস্বতী উভয়েরই প্রসাদলাভ করিবে। আজকাল কাগজ প্রভৃতির দুর্মূল্যতার দিনে কেমন করিয়া দেড় টাকা দামে তুমি এই বই বাহির করিলে বুঝিতে পারিলাম না। বোধ করি সংগ্রহ করিবার উৎসাহে লাভলোকসান খতাইয়া দেখিবার সময়ও পাও নাই।
ইতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৯ই আশ্বিন, ১৩২৫।”

তখনকার পাঠক পরিসর আর এখনকার পাঠক পরিসর ভিন্ন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একটি সংবাদপত্রের সমীক্ষা অনুযায়ী, শুধু দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে সারা বিশ্বে বাংলা ভাষায় (ম্যাগাজিন ফরম্যাটে বা ই-ফরম্যাটে) প্রকাশিত পত্রপত্রিকার সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। এদের মধ্যে কিছু বাণিজ্যিক, কিছু অবাণিজ্যিক, কিছু ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রকাশিত।
বাঙালি চিরকাল মননশীল বলেই পরিচিত বিশ্বের দরবারে। দুর্গাপুজো ছাড়া, অন্য কোনও ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে সাহিত্য সৃষ্টি এবং প্রকাশের এমন নজির বিভাজিত দুই বঙ্গদেশ ছাড়া অন্য কোনও প্রদেশে নেই বললেই চলে। দুর্গাপুজোর সঙ্গে শারদীয়া বা পুজোসংখ্যা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গিয়েছে সম্ভবত ১২৭৯ বঙ্গাব্দ থেকে। কেশবচন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘সুলভ সমাচার’ ইংরেজি ১৮৭২-এ ‘ছুটির সুলভ’ নামে প্রথম শারদীয় সংখ্যা প্রকাশ করে। এক পয়সার এক বিশেষ সংখ্যা বেরোয় ১২৮০-এর আশ্বিন মাসে। তার পর থেকে ‘সাধনা’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘বঙ্গবাণী’, ‘আনন্দবাজার’ প্রভৃতি পত্রিকা পুজো সংখ্যা প্রকাশ শুরু করে। তখনকার দিনের নামী লেখকেরা যেমন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় প্রমুখ এত অকালবোধনের সঙ্গে সঙ্গে শারদ সাহিত্য মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার নেপথ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

সারা পুজোর ছুটি সংস্কৃতি প্রিয় বাঙালি শুধুই কি অবসরে কাটাবে?  ১২৯৮-এর অগ্রহায়ণ মাসে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘সাধনা’ পত্রিকা। ‘ছুটির সুলভ’ প্রথম শারদীয় সংখ্যা হতে পারে তবে, বাঙালি প্রথম বার শারদ তৃপ্তির রসদ পায় এই পত্রিকাতেই। ১২৯৯ সালে সাধনা পত্রিকার ভাদ্র-আশ্বিন যুগ্ম সংখ্যা শারদ সংখ্যা হিসেবেই প্রচারিত হয়েছিল। সে সংখ্যা বোধ হয় সেরা শারদ সংখ্যার একটি। কারণ, সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শারদ গল্পের লেখক ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।


‘‘আশ্বিন মাসে দুর্গোৎসব নিকটবর্তী হইল। চতুর্থীর দিন হইতে ঘাটে নৌকা আসিয়া লাগিতে লাগিল। প্রবাসীরা দেশে ফিরিয়া আসিতেছে… মেঘমুক্ত আকাশে শরতের সূর্যকিরণ উৎসবের হাস্যের মতো ব্যপ্ত হইয়া পড়িয়াছে, বর্ষাধৌত সতেজ তরুপল্লব নব শীতবায়ুতে শিরশির করিয়া উঠিতেছে।’’ এমন যদি শারদ সংখ্যার লেখনী হয়, তা তো শারদীয়া সংখ্যা সৃষ্টির, প্রকাশের, সম্পাদনার ইন্ধন জোগাবেই। সব সম্পাদকই রবীন্দ্রনাথের এক খণ্ড লেখা পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকতেন। কত যে সনির্বন্ধ অনুরোধ নিয়ে চিঠি আসত তাঁর কাছে, তা তিনিই জানেন। ১৩২৫ সালে রবীন্দ্রনাথের ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ‘পার্বতী’ পত্রিকার শারদীয়া বার্ষিকী সম্পাদনা করেন। এখানেই সম্ভবত প্রথম পুজোর গান রবীন্দ্রনাথ জমা দেন। গানটি ছিল ‘শরতে আজ কোন অতিথি এল প্রাণের দ্বারে…’।প্রথম শারদ উপন্যাস ছাপা হয় শারদীয় বসুমতীতে। ইংরেজি ১৯২৬ সালে প্রথম শারদীয় সংখ্যা বের করে আনন্দবাজার পত্রিকা। তার বেশ কিছু বছর পর তাতে প্রথম উপন্যাস ছাপা হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শহরতলী’, রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত বড় গল্প ‘রবিবার’ প্রকাশিত হয় এখানেই। পরের বছরেই উপন্যাস ‘ল্যাবরেটরি’।


দেশ পত্রিকার শারদ সংখ্যা প্রথম প্রকাশ পায় ১৩৪১ বঙ্গাব্দে আর সুবোধ ঘোষের ‘ত্রিযামা’ ছিল দেশ-এ প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস, যা বেরিয়েছিল ১৩৫৬ বঙ্গাব্দে। এর পর ইংরেজি ষাটের দশক থেকে পুজোর সংখ্যায় আমরা দেখতে পাই এক একটি পূজাবার্ষিকীতে একাধিক, এমনকি ছয়-সাতটি করে উপন্যাস। সমকালের বিখ্যাত লেখকেরা সেগুলি লিখতেন। যেমন পুরনো দেশ পত্রিকার সংখ্যা খুললেই দেখা যাবে প্রথমেই অবশ্য উপস্থিতি রবীন্দ্রনাথের, তাঁর অপ্রকাশিত লেখা বা চিঠিপত্রের সম্ভার। তার পরেই থাকত বিষয়ক রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক প্রবন্ধ নিবন্ধ। তারাশঙ্কর, মানিক, বিভূতি, সতীনাথদের যুগের পর তাঁদের ব্যাটন ধরেন সমরেশ বসু, রমাপদ চৌধুরী, বিমল কর, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, সুনীল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ মজুমদারেরা। সত্যজিতের হাত ধরে ফেলুদার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয় পুজো সংখ্যায়। অধিকাংশ কিশোর-কিশোরী কিকিরা, প্রফেসর শঙ্কু, গোগল, কর্নেল আর ম্যাজিশিয়ান-এর সঙ্গে পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা-তেই পরিচিত হয়েছে।
পুজোসংখ্যা। বাঙালির একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা। বাঙালির শারদীয়া ছুটি তখনই পরিপূর্ণ হয়, যখন হকারের হাত থেকে শারদ সংখ্যা হাতে আসে। কিন্তু শিউলি আঘ্রাণ মাখতে মাখতে শারদ সংখ্যা পড়ার অভিজ্ঞতা এ প্রজন্মের নেই এবং কথা উঠছে মানুষের পড়ার প্রবণতা কমছে। শারদ সাহিত্য বোধ হয় সে তথ্য ভুল প্রমাণ করে। সেকাল থেকে একাল দিনকে দিন শারদ সংখ্যা বাড়বাড়ন্ত। অগুন্তি বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রিকায়, ব্লকজিন, এমনকি ই-ম্যাগাজিনেও নতুন নতুন কলম পূজাবার্ষিকীকে সমৃদ্ধ করছে। এখন আর তখনকার সময় ও সাহিত্যে বিস্তর ফারাক থাকতেই পারে তবে হ্যাঁ, এখনও বহু সংখ্যক মানুষ উৎসবকে উপলক্ষ করে অক্ষর এবং ভাষার সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছেন বা জুড়ে থাকতে চাইছেন, এতে অন্বেষণের মৃদু আলো যদি আরও কিছুদিন টের পাওয়া যায়, মন্দ কী! 

শেষকথা- গত বছর বাঙালির দুর্গা পূজায় সাহিত্য তথা মননচর্চার তেমন প্রকাশ ঘটেনি। নমো  নমো করে দায়সারা গোছের কিছু পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। তবে ই- সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল বেশি করে। করোনার আবহে বাঙালির সাহিত্য চর্চায় কিন্তু গত বছর পুজোর সময় একেবারেই ভাঁটা পড়েনি। করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের মুখোমুখি আমরা সবাই। আনন্দের বিষয় তৃতীয় ঢেউ সেভাবে হয়তো প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না এ- বছর পুজোর সময়। তাই সাহিত্য পিপাসু বাঙালি লেগে পড়েছে বিভিন্ন শারদীয়া পত্রিকার প্রকাশে।

ইতিমধ্যেই আনন্দবাজার পত্রিকা, বর্তমান, আজকাল, দৈনিক, আনন্দমেলা, সুখবর, শুকতারা, প্রসাদ, দেশ, নবকল্লোল, প্রতিদিন, সেই সময়ের মতো লব্ধ প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্র প্রকাশ করে ফেলেছে শারদ অর্ঘ্য। সেই সঙ্গে বেশ কিছু পত্র-পত্রিকা গোষ্ঠী ভালো মানের পত্রিকা প্রকাশ করে ফেলেছে। একুশ শতক, কৃত্তিবাস, বাউলমন, অন্যমুখ। অনলাইনে বহু পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে। বহু ভ্রমণকাহিনী নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। কয়েকজন বিখ্যাত সাহিত্যিকের বিশেষ সংখ্যা এ -বছর পুজোর বড় প্রাপ্তি। যেমন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মহানায়ক উত্তম কুমার সংখ্যা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, বুদ্ধদেব গুহ সংখ্যা। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার কবি-লেখকদের লেখায় সমৃদ্ধ বহু পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে। বইওয়ালা বুক ক্যাফে শান্তিনিকেতন, এদের শারদীয়া "এখন শান্তিনিকেতন" পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যা প্রকাশ হতে চলেছে অক্সফোর্ড বুক স্টোর থেকে। উৎসব সংখ্যা নাম দিয়ে বিভিন্ন জেলা জুড়ে নানান ধরনের পত্রিকার প্রকাশের আয়োজনে খামতি নেই কবি-লেখকদের।

কলকাতার ও বিভিন্ন জেলা নামী বেশ কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশ করে ফেলেছে শারদ অর্ঘ্য হিসাবে। এদের মধ্যে অগ্রগণ্য - কোরক, উৎস মানুষ, আকাশ, সানন্দা, সাপ্তাহিক বর্তমান, প্রতিক্ষণ, এক্ষণে, এবং মশায়ের, আর্য, একুশ শতক, অন্তরীপ, সাগরকন্যা আন্দমান, কিশোরভারতী, বাঙালির ভ্রমণ, কৃত্তিবাস, সমতট, অনুবাদ পত্রিকা, হারিত, খেয়ালি, মানভূম, সুন্দরবন চর্চা, শুকাতারা, রাঢ়ভূমি, উত্তরবঙ্গ সংবাদ, নির্মুখোস, অরণ্যমন, বাঁকুড়া বার্তা, তথ্যকেন্দ্র, লেখাজোকা, বর্ণিক, বলাকা, সুকান্ত, অনুষ্টুপ, কলেজ স্ট্রিট, জলফড়িং, মায়াকানন, মেঘমুলুক, সহজিয়া, খুশির হাওয়া, এছাড়াও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিভিন্ন ই- পেপার শারদীয় সংখ্যা প্রকাশ করতে চলেছে, বাংলাদেশের ছাইলিপি, প্রথমআলো, গণকণ্ঠ, দেশপত্রিকা, দৈনিক সুপ্রভাত, উত্তরবঙ্গ, দৈনিক নোয়াখালী, সেই সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে প্রভাত ফেরী, কানাডা থেকে আশ্রম, ইংল্যান্ড থেকে ড্যাস, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন থেকে ও কলকাতা, কলকাতা থেকে প্রহর, মলাট, গল্পকুঠির। এছাড়া দুই বাংলার কবি-লেখকদের নিয়ে বেশ কিছু শারদীয় সংখ্যা প্রকাশ হতে চলেছে। সেই সঙ্গে প্রতিবেশি বেশ কিছু রাজ্য ও দেশ থেকে শারদীয় সংখ্যা প্রকাশ হতে চলেছে যেমন- শিলং, ভাগলপুর, ধানবাদ, দিল্লি, ত্রিপুরা, আসাম, ত্রিপুরা, জামশেদপুর, বাংলাদেশ।

 করোনার আবহে সাহিত্য চর্চা থেমে থাকতে পারে না। এ বছর করোনার ভয়াবহতা নিয়ে রচিত হয়েছে নানান ধরনের লেখা। বাঙালির লেখনী থেমে থাকেনি। বন্দি জীবনে নানান বর্ণময় রচনা সৃষ্টি করে চলেছে। এ বছরের শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে নানা ধরনের যে সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে অতিমারির কথা গুরুত্ব পেয়েছে। নবীন আর প্রবীণ নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকা সুখবর আজকাল, বর্তমান, উত্তরবঙ্গ, সেই সময়, প্রতিদিন পত্রিকা অসাধারণ শারদীয় সংখ্যা প্রকাশ করে ফেলেছে।  

 দু'বছর ধরে অতিমারির প্রভাব বিস্তার করে চলেছে জনজীবনে। তার প্রতিফলন ঘটতে চলেছে এবারের পুজো সংখ্যায়। মহামারি-অতিমারি নিয়ে নিদারুণ ভয়-শঙ্কা সত্ত্বেও দু 'বাংলার সাহত্যে যেমন তার ছায়া পড়েছে ঐতিহাসিক ভাবে, তেমনই সমকালের অতিমারিও দুঃখ-বেদনায়-কৌতূকে সাহিত্যের আয়নায় নিজের মুখশ্রী দর্শন করেছে। গোটা বিশ্ব করোনার ভয়াবহ দুর্যোগ অতিক্রম করে চলেছে। এক দুঃসহ হাড়হিম করা সময় পার করে চলেছে গোটা বিশ্ব। বিশ্বের মানবকুলের কাছে এই ধরণের অভিজ্ঞতা মনে হয় প্রথম। করোনা- আবহকালে পৃথিবীর মানুষ পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল অনেক খানি। বিশ্বের ইতিহাসে এই অতিমারি কোন  নজির নেই। মানব সভ্যতা অস্তিত্বের মুখোমুখি আজ, এই বিপর্যয়ের  বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছে গোটা বিশ্ব। নিজেদেরকে  রক্ষা করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। সাহিত্যের পাতায় পাতায় তাদের মানবিক প্রচেষ্টা হয়ত অমর হয়ে থাকবে, ভবিষ্যতের মানুষের জন্য। আজ করনায় আক্রান্ত কিংবা আক্রান্ত না হয়েও কোয়ারেন্টিনে থাকা সৃজনশীল মানুষজন নিভৃতে সৃষ্টি করে চলেছেন ভবিষ্যতের সাহিত্য। অনেকেই ভবিষ্যতেও সৃষ্টি করে যাবেন বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য, যা আগামী প্রজন্মের কাছে ঐতিহাসিক দলিল হয়ে উঠবে বলে আমার নিজস্ব বিশ্বাস। 

তথ্যসূত্র- নানা ধরনের পত্রিকা ও গ্রন্থ এবং মাসিক কৃত্তিবাস।

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
লোক গবেষক, প্রাবন্ধিক, অণুগল্প - ছোটগল্প, চিত্রনাট্য ও রম্যরচনা এবং ভ্রমণকাহিনীর লেখক
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top