সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

একা এবং একা (পর্ব দশ) : আহসান হাবীব


প্রকাশিত:
১৭ আগস্ট ২০২০ ২৩:১২

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:৪৮

 

(আহসান হাবীব মূলত একজন প্রফেশনাল কার্টুনিস্ট। তিনি পেশাগত কারণে সাধারনত কমিকস, গ্রাফিক নভেল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করেন। তিনি যখন লিখেন তখন তার মাথায় থাকে কমিকস বা গ্রাফিক নভেলের কনটেন্ট। তার গল্পের পিছনে থাকে স্টোরি বোর্ডের মত ছবির চিত্রকল্প। এই কারণেই তার লেখায় একটা সিনেমাটিক ড্রামা থাকে প্রায়শই। তিনি মনে করেন যেকোনো গ্যাজেটেই/ফরম্যাটেই হোক, স্ক্রিনে যে গল্প পাঠক পড়ছে, সেখানে তার সাব-কনসান্স মাইন্ড ছবি খুঁজে। আর তাই ‘প্রভাত-ফেরী’র পাঠকদের জন্য তার এই ধারাবাহিক ইন্ডি নভেল ‘একা এবং একা ’ )

পর্ব দশ
মজিদ স্যার কুদ্দুসকে ডেকে পাঠালেন।

-স্যার?
-কুদ্দুস ব্যাংকে যাও, স্যারদের বেতন দিতে হবে। টাকা তুলে নিয়ে আস। এই ব্যাগটায় করে এনো। ফুটি ফুটি দাগের চেন লাগানো একটা চামড়ার ব্যাগ এগিয়ে দেন মজিদ স্যার।
-জি স্যার।
-সাথে তৈয়বকে নিয়ে যেও এতগুলি টাকা।
-জি স্যার।
-আর স্যালারী স্লিপ গুলোতে স্যার-ম্যাডামদের  সাইন আগেই করিয়ে নিও। তারপর ব্যাংকে টাকা তুলতে যাও।  
-জি স্যার।

কুদ্দুসের মনে হল স্যারদের বেতন কি একটু বেশী আগে আগে দিয়ে ফেলা হচ্ছে না!

স্যালারী স্লিপে সাইন করতে গিয়ে মনিকা ম্যাডামেরও তাই মনে হল। বেতন কি একটু বেশী আগে দিয়ে ফেলছে না! এক মাসে দুবার বেতন স্লিপে সাইন হয়ে গেল নাকি? কিছু একটা ভজঘট হয়েছে বা হচ্ছে। এই সময় রহমান স্যার টিচার্সরুমে এক গাদা পেপার নিয়ে ঢুকলেন।

-ম্যাডাম আজকের কাগজ দেখছেন?
-না দেখিনি কি লিখেছে?
-এই দেখেন... ‘জোড়া খুনের প্রকৃত আসামী গ্রেফতার’। কত বড় হেডিং দিসে দেখেন। আপনাদের মারুফ স্যারের ছবিটাও ভাল আসছে, কি বলেন?

পত্রিকাটা হাতে নিয়ে মন খারাপ হয়ে যায় মনিকা ম্যাডামের। লোকটা কি সত্যিই দুজনকে খুন করেছে? তাই কি সম্ভব??

অন্যসব স্যার-ম্যাডামরাও টিচার্স রুমে এসে নতুন খুনী মারুফ স্যারকে নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। সবার ধারণা আবার পাল্টে গেল। মারুফ স্যারই যে এই কাজ করেছে ...এটা সবার নাকি আগেই সন্দেহ হয়েছিল। 

কুদ্দুস স্যার-ম্যাডামদের সব  স্যালারী স্লিপে সাইন করিয়ে, স্লিপগুলো অফিস ফাইলে রেখে রওনা দিল ব্যাংকে। সাথে বৃদ্ধ দারোয়ান তৈয়বউদ্দীনও চলল, মজিদ স্যার যেমনটা বলেছিলেন।

-কুদ্দুস পুরস্কারের ট্যাকা পাইস?
-না পাই নাই, তয় পায়া যামু
-তা পাইবা ওসি সাব যখন কইছে। এত টাকা কি করবা?

কুদ্দুস হাসে। ঠিকইতো হঠাৎ করে এতগুলো টাকা। বাড়ীতে একটা ঘর তোলা যেতে পারে। সামনের বৈশাখে রুমানাকে ঘরে না তুললেই নয়। রুমানা তার মামাতো বোন। ইন্টারপাশ, তার সাথে বিয়ের কথাবার্তা সব ফাইনাল। কুদ্দুস ব্যাংকের পথে হাঁটতে হাঁটতে নতুন জীবনের কথা ভাবে। তবে আজ একবার, এক ফাকে থানায় যাবে; ওসি সাহেবের কাছে পুরস্কারের  টাকার ব্যাপারটা বলবে। ওসি সাহেব আবার ভুলে না যায়।

একটা প্রিজন ভ্যান ছুটছিল ঢাকার উদ্দেশ্যে। ভ্যানের ভিতরে চারজন আসামী । রফিক স্যার, মারুফ এবং আরো দুজন অচেনা আসামী। রফিক স্যার ঝিমাতে ঝিমাতে বির বির করছিলেন। মারুফ ভাবছিল মনিকা ম্যাডমের কথা, ম্যাডাম ঠিক কি বলতে চাচ্ছিলেন তাকে? শোনা হল না। শুরুতে এই ম্যাডাম তার প্রতি বিরক্ত হলেও এখন বেশ নরম মনে হচ্ছিল কেন কে জানে। মারুফ একটা সিগারেট ধরাল।

-ভাই আমগো দুইটা সিগ্রেট দেন না।

মারুফ অচেনা আসামীদেরও দুটো সিগারেট দিল। মুহুর্তের মধ্যে ভ্যানের ভিতরটা সিগারেটের ধূয়ায় ধূয়াময় হয়ে উঠল। যদিও উপরের ফাকা জালি দিয়ে হু হু করে বাতাস ঢুকছিল ভ্যানের ভিতর। রফিক স্যার বির বির করে তখনও বলেই চলছিলেন মিসটেক মিসটেক... বিরাট মিসটেক...। এই শব্দটা তার মাথার কোথাও আটকে আছে বলে মনে হচ্ছে।     

 

থানার ওসি মোজাম্মেল হক খুবই বিরক্তি নিয়ে চা খাচ্ছিলেন, চা’টা বিস্বাদ, সিগারেটটাও মনে হচ্ছে দুই নম্বর, খুব সম্ভব নকল বেনসন । সেকেন্ড অফিসার  রকিবউদ্দীন মনোযোগ দিয়ে একটা এফআইআর লিখছে। ছেলেটাকে ওসি সাহেবের বেশ পছন্দ যেকোনো কাজই খুবই সিরিয়াসলি করে। পুলিশে এ ধরনের লোকজন এখন দরকার। এই সময় কনস্টেবল মিনহাজ উকি দিল-

-স্যার?
-বল
-সরযুবালা স্কুলের দপ্তরী কুদ্দুস আসছে
-কি চায়?
-ঐ যে আপনি পুরস্কারের কথা বলছিলেন
-হুম, ওরে ভিতরে পাঠাও

কুদ্দুস হাত কচলাতে কচলাতে ভিতরে এসে সালাম দিল।

-কি ব্যাপার কুদ্দুস?
-স্যার আসছিলাম...
-আসছিলা সেতো দেখতেই পাচ্ছি। কি ব্যাপার?
-স্যার বলছিলেন পুরস্কার দিবেন
-ও পুরস্কার! আচ্ছা পাইবা... তার আগে বলতো রাম দাওটা কই?
-কোন রামদাও স্যার?

ঐ যে চারদিকে বইলা বেড়াইতাছ তোমারে রফিক স্যার নাকি রামদাও দিয়া ঠেক দিয়ে মজিদ স্যারের বাড়িতে নিতে বলছে। আজকের পত্রিকাতেও দেখলাম আসছে। কই পত্রিকাটা কই? এইখানেইতো ছিল।

সেকেন্ড অফিসার রকিব একটা পত্রিকা এগিয়ে দিল ওসি সাহেবের দিকে। ওসি সাহেব অবশ্য পত্রিকাটার দিকে তাকালেন না। ঠান্ডা চোখে কুদ্দুসের দিকে তাকালেন। কুদ্দুস ঢোক গিলল।  

-রকিব? ওসি সাহেব সেকেন্ড অফিসারের দিকে তাকালেন।
-জি স্যার?
-কনস্টেবল মিনহাজকে একটু ডাকতো

ডাকা হল, কনস্টেবল মিনহাজ আসল।

-মিনহাজ?
-জি স্যার
-এই হারামজাদারে একটা চড় দাওতো, জোড়ে দিবা।

মিনহাজ দেরী করল না, চটাস করে কুদ্দুসকে একটা চড় দিল। কুদ্দুস তার জীবনে এত বিস্মিত বোধহয় এর আগে হয়নি, চড় খেয়ে সে ছিটকে গিয়ে পড়ল সেকেন্ড অফিসারের রকিবউদ্দীনের পায়ের কাছে, হতভম্ব কুদ্দুস পরেই রইল; কলার ধরে মিনহাজ তাকে দাঁড় করাল।

-এরে আরো দুইটা চড় দাও তারপর হাজত খানায় ঢুকাও। ঠান্ডা স্বরে বললেন ওসি সাহেব। দ্রুতই হুকুম তামিল করল কনস্টেবল মিনহাজ।

 

খুব ভোরেই প্রিজন ভ্যানটা ঢাকা পৌঁছে গেল। সেখান থেকেই রফিক স্যার আর মারুফ আলাদা হয়ে গেলেন। আলাদা করার সময় রফিক স্যার চেচাতে লাগলেন ‘এরা আমাকে কোথায় নেয়?... আমাকে কোথায় নেয়??’ মারুফের ভিষন মায়া হল, কিন্তু কিছু করার নেই তার বা রফিক স্যারের।

অবশেষে  নানান হাত ঘুরে সাত তলা বিল্ডিং এর পাঁচ তলায় একটা ছোট্ট ঘরে মারুফকে বসানো হল। আট ফিট বাই আট ফিট ছোট্ট ঘরটায় একটা চেয়ার একটা টেবিল। মারুফ বসে আছে একটা টুলে, মাথার উপর শেডহীন একটা কড়া পাওয়ারের লাইট জ্বলছে খামাকা। একটা ফ্যান ঘটাং ঘটাং শব্দ করে ঘুরছে, কোনো বাতাস নেই। বেশ ক্ষিধে লেগেছে। এরা কি কিছু খেতে টেতে দিবে না? হাতের হাতকড়াটা খুলে দিলেও একটু আরাম পাওয়া যেত...।

 

দশটা দশে একজন অফিসার ঢুকলেন। চোখে কালো সানগ্লাস। বেশ সুপুরুষ, স্মার্ট।

-হ্যালো মিঃ মারুফ?

মারুফ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।

-আমি স্পেশাল ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টর সারোয়ার খান। আপনার কেসটা আমি হ্যান্ডেল করব। আপনাকে এরা নাস্তা-ফাস্তা কিছু দিয়েছে?
-না
-দ্যাটস ব্যাড।

ইন্সপেক্টর হাত দিয়ে কাউকে কিছু ইশারা করলেন। একটু বাদেই দু কাপ চা এল। মারুফের চায়ের পাশে একটা টোস্ট বিস্কিট খুব অবহেলায় পড়ে আছে, এটাই বোধহয় এখানে সকালের নাস্তা। একজন এসে মারুফের হ্যান্ডকাফটা খুলে দিল। মারুফ খুব আগ্রহের সঙ্গে টোস্ট বিস্কুট আর চা’টা খেল। চা’টা ভাল।

-নিন সিগারেট ধরান। বলে মার্লবোরোর একটা প্যাকেট এগিয়ে দিল ইনসপেক্টর সারোয়ার।

মারুফ একটা সিগারেট ধরলো।

-তাহলে আমরা আলোচনা শুরু করতে পারি। কি বলেন?
-হ্যাঁ শুরু করুন

ইন্সপেক্টর সারোয়ার তার রেডিয়ামের ঘড়িটার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন-

-এখন বাজে সাড়ে দশটা। ঠিক এক ঘন্টা আমি আপনার সঙ্গে কথা বলব। আমার প্রশ্নের উত্তর আপনি চাইলে নাও দিতে পারেন। কিন্তু আমার প্রতিটা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে আপনাকে।  
-আচ্ছা শুনব। মারুফের লোকটাকে বেশ পছন্দ হল। কথা বলার স্টাইল ভঙ্গি সবই সিনেমার ডিটেকটিভদের মত।
-আপনার সম্পর্কে আমরা সব খোঁজ খবর নিয়েছি। সম্প্রতি দুটো মার্ডার করেছেন আপনি। একজন নবী নগরের মেয়র। আর দ্বিতীয়জন কোকেন সম্রাট মালেক। মেয়রের ব্যাপারে আমাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই কারণ লোকটা যে টাইপের আর যা করছিল তলে তলে, তাতে করে যে কেউ যেকোনো সময় ওকে মেরে ফেলতে পারত তাই হয়েছে, যাহোক আপনিই কাজটা করেছেন।
-আমি ওকে খুন করিনি।
-কিন্তু চায়নিজ কুড়াল দিয়ে কোপাতে গেলেন কেন? আপনার কাছে তো পিস্তল ছিল একটা, কোল্ট থার্টি টু? তাই না?
-আমি ওকে খুন করিনি।
-তাহলে কি আপনার কলিগ রফিক স্যার করেছে?
-আমার মনে হয় না
-মালেককে যে পিস্তল দিয়ে গুলি করে মারা হয়েছে। সেটাও কোল্ট থার্টি টু। এই পিস্তলটাইতো আপনার কাছেই ছিল। ঠিক ?
-তা কিছুদিন ছিল। কিন্তু মালেককে আমি খুন করি নি।
-তাহলে কে করেছে? তার শরীরের তিনটা বুলেট পাওয়া গেছে কোল্ট থার্টি টু পিস্তলের।
-তা আমি কিছু জানি না।
-আপনি কিছুই জানেন না কিন্তু আপনি নবী নগরে ঘুর ঘুর করছিলেন কেন? স্কুল থেকে তো আপনাকে বরখাস্ত করা হয়েছে, তারপরও আপনি কেন নবী নগরে?
-আসলে আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল একদল লোক...
-সেসব আমরা সব জানি। আপনি কিভাবে উদ্ধার পেলেন... তাও আমরা জানি। জরিনা, মবিন, শাহজাহান সবার কাহিনী আমরা জানি। আসলে পুরো ঘটনার একটা স্ক্রিপ্ট করলে বেশ একটা বাংলা সিনেমার কাহিনী দাঁড় করিয়ে ফেলা যায়... হা হা হা। মারুফ খেয়াল করল লোকটা হাসলে গালে টোল পড়ে। হাসিটাও সুন্দর, একটু যেন মেয়েলি কিন্তু সুন্দর।
-সবই যদি জানেন আপনারা তাহলে এটাও জানা উচিৎ খুনগুলো আমি করিনি। তাহলে আমাকে কেন ধরেছেন?
-মজাটা এখানেই। বিষয়টা যদি এমন হত জরিনা মেয়েটা আপনার পিস্তল চুরি করে মালেককে মেরেছে। কারণ সে দুই মাসের মত মালেকের খুব কাছাকাছি ছিল, তাকে আটকে রাখা হয়েছিল; সে ভাল করেই জানে কখন কোথায় মালেককে পাওয়া যাবে। তারপক্ষে মালেককে খুন করা সম্ভব হলেও হতে পারে, তার একটা ক্ষোভও আছে, থাকাই স্বাভাবিক। আর রফিক স্যারেরও ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক মেয়রকে খুন করার পিছনে, কারণ তার কারণেই তার চাকরী গেছে বদনাম হয়েছে। শোকে সে পাগল হয়ে এই কান্ড করে বসেছে। পাগলদের অনেক ধরনের অবসেসশন থাকে ... সহজ হিসাবে দুইয়ে দুইয়ে চার হয়েই আছে... কিন্তু এই গল্পটা আমার কাছে কেমন যেন ম্যালোড্রামা লাগছে। আমি গল্পটাকে আরো জটিল করতে চাই।
-মানে?? ভ্রু কুচকে যায় মারুফের!

ইন্সপেক্টর সারোয়ার হাসলেন, সেই মনমুগ্ধকর মেয়েলি হাসি। মারুফ টের পেল লোকটার এই মৃদু মেয়েলি হাসিটা আসলে বেশ ভীতিকর। তার হাসিটাই বলে দিচ্ছে সে ভিতরে ভিতরে খুব একটা ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা করেছে। লোকটা গলা নামিয়ে ফিস ফিস করল- ‘মারুফ সাহেব, আপনি যে দুটোর একটা খুনও করেন নি, সেটা আমি খুব ভাল করেই জানি। কিন্তু আপনার সাথে আমি একটা খেলা খেলতে চাই। এই খেলায় যদি জিততে পারেন তাহলে আপনি মুক্ত। আর না পারলে ...’ লোকটা উঠে দাড়ায়, ডান হাতে গলায় পোচ দেয়ার একটা ভঙ্গি করে। ঘড়িতে এক ঘন্টা হয়ে গেছে দশ মিনিট আগেই, এগারোটা চল্লিশ। 

-আপনার সাথে আবার কথা হবে, আজ এই পর্যন্ত । ইন্সপেক্টর সারোয়ার বের হয়ে গেলেন। মারুফ হতভম্ব হয়ে বসে রইল। মার্লবোরোর সিগারেটের প্যাকেটটা ফেলে গেছে ইন্সপেক্টর সারোয়ার খান।

    

কুদ্দুস হাজত খানায় বসে আছে আরো দুজন আসামীর সঙ্গে। অন্য আসামীরা বিড়ি টানছে তার বিকট গন্ধে কুদ্দুসের বমি পাচ্ছে। মনে হচ্ছে দুপুরের খাওয়া কাচকি মাছ, কচুর লতি আর বিরুই চালের লাল ভাত গলার কাছে এসে অপেক্ষা করছে কখন বেরুবে! কুদ্দুসের ইচ্ছে হল ওদের অনুরোধ করে আর বিড়ি না খেতে। ওরা কিসের আসামী কে জানে। দুজনের একজন হঠাৎ কুদ্দুসের দিকে তাকাল-

-ঐ মিয়া কি করছিলা চুরি না ছিনতাই?
-কি বলেন এইসব, আমি ভদ্রলোকের সন্তান।
-ভদ্রলোকের সন্তান হাজতে কি কর? বিড়ি খাইবা?
-না ঐসব খাইনা
-চুরি কর নাই ছিনতাই কর নাই... তাইলে কি খানকি পাড়ায় গেছিলা? ঐখান থাইকা ধরছে তোমারে?
-ছি ছি এরা এসব কি বলছে। কুদ্দুসের শরীর গুলিয়ে উঠে,  মাথাটা কেমন চক্কর দিচ্ছে ... হঠাৎ হর হর করে বমি করে দেয়  সে!

ওসি সাহেবের নির্দেশে কনস্টেবল মিনহাজ আরো দু চারটা চড় থাপ্পড় মেরে কুদ্দুসকে রাত সাড়ে বারটার দিকে ছেড়ে দিল। কুদ্দুস মেসে ফিরে এসে রাতটা কোনমতে কাটালো। পরদিন ভোরে ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দিল বাড়ীর দিকে। এই জাহান্নামের শহরে সে আর থাকবে না। এই চাকরীও তার দরকার নেই। এর চেয়ে গ্রামে গিয়ে কৃষি কাজ করা ভাল।

ভোর বেলা নাস্তা খেয়ে কুদ্দুস রওনা দিল বাড়ীর পথে। সকালের বাস বলেই কিনা কে জানে। মানুষ জন বেশী নেই।  দু চারজন বসে আছে, বাসও ঢিমে তালে চলছে, এই লাইনের বাসগুলি এরকমই। হঠাৎ কুদ্দুস চমকে উঠল। চাদর দিয়ে মাথা ঢেকে পিছনের সীটে বসে আছেন হেড স্যার মজিদ চাচা। কুদ্দুস উঠে এগিয়ে গেল।

-চাচা কই যান? মজিদ স্যার যেন ভুত দেখলেন।
-তু-তুমি কই যাও?
-আমি বাড়ী যাই। স্কুলের চারকী আর করমু না। আপনি কই যান চাচা?

  

মজিদ স্যার উত্তর দিলেন না, ঘোলা চোখে তাকালেন । কুদ্দুস খেয়াল করল মজিদ স্যারের হাতে সেই ফুটি ফুটি দাগের চামড়ার ব্যাগটা; যেখানে স্যার-ম্যাডামদের বেতনের আড়াই লক্ষ টাকা ভরে সে ব্যাংক থেকে ফিরেছিল। ব্যাগটা সেইরকম ভাবেই আছে, তবে এখন সেটা স্যারের হাতে। টাকা ভরার কারণে সেই রকমই ফুলে ফেপে আছে ব্যাগটা। টানা বারো ঘন্টা হাজত খেটে এসে কুদ্দুসের মনে হল সে এখন অনেক কিছু বুঝতে শুরু করেছে ...!

 

(চলবে) 

একা এবং একা - পর্ব এক
একা এবং একা - পর্ব দুই
একা এবং একা - পর্ব তিন
একা এবং একা - পর্ব চার
একা এবং একা - পর্ব পাঁচ
একা এবং একা - পর্ব ছয়
একা এবং একা - পর্ব সাত
একা এবং একা - পর্ব আট

একা এবং একা (পর্ব নয়)

 

লেখক: আহসান হাবীব
কার্টুনিস্ট/ সম্পাদক
উম্মাদ, স্যাটায়ার কার্টুন পত্রিকা
 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top