সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব সতের) : কাজী মাহমুদুর রহমান


প্রকাশিত:
১২ জুলাই ২০২১ ০৫:০৮

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৫:২৯

 

সেই আদর্শ বর্ণমালার অ য় অজগর আসছে তেড়ে, আ তে আমটি আমি খাব পেড়ে, ই তে ইঁদুর ছানা ভয়ে মরে, ঈ তে ঈগল ওড়ে আকাশ জুড়ে ... থেকে শুরু করে আমি আনন্দময়ী গার্লস স্কুলের এখন ক্লাস এইটের ছাত্রী। সকাল আটটা থেকে ক্লাস শুরু হয়। ছুটি হয় দুপুর আড়াইটায়। স্কুল থেকে আমাদের মাহুতটুলির বাড়িটা খুব কাছেই। সুতরাং হেঁটে স্কুলে আসা যাওয়া করতে কোনোদিন কোনো অসুবিধা হয়নি। হাসতে হাসতে স্কুলে গিয়েছি, ছুটি শেষে পাখির মতো কল-কাকলীতে বাসায় ফিরে এসেছি।

আজ অন্যান্যদিনের মতোই স্কুল ছুটি হতেই সহপাঠীদের সঙ্গে দল বেঁধে স্কুলের গেট পেরিয়ে সদর রাস্তায় পা দিতেই হঠাৎ  করে একটা লাল হোন্ডা ঘ্যাস করে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। হোন্ডাআরোহী ছেলেটার বয়স বোধহয় আঠারো হবে। মুখে সদ্য ওঠা দাড়ি, গোঁফ, মাথার চুলগুলি খাড়াখাড়া, গলায় সোনার চেন, হাতেও সরু নকশাদার রুপার চেন। দেখলেই বোঝায় যায় এই ছেলে সদ্য গজানো মার্কামারা মাস্তান। কোনো অভিজাত, ভদ্র পরিবারের ছেলে নয়।

ছেলেটি চোখ থেকে গগলস খুলে আমার দিকে অভদ্রভঙ্গিতে আঙুল নাচাল। নির্দেশের স্বরে বলল, এই মেয়ে এদিকে আয়।

আমি সহপাঠিনী বন্ধুদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে সবার কেমন যেন একটা ভীত চকিত চেহারা। কিন্তু আমি ভয় পেলাম না। বললাম, কেন? কী দরকার? যা বলার তোমার হোন্ডা থেকেই বল।

একজন সহপাঠিনী আমাকে ফিস ফিস করে বলল, শুনেছি ওর নাম বল্টু। নয়াবাজারের উঠতি মাস্তান।

আমার কথায় রাখঢাক নেই। বললাম, নয়াবাজার হোক আর পুরান বাজার হোক আমি কোনো মাস্তানকে ভয় পাই না। কেউ যদি আমাকে ত্যক্ত করে তাহলে আমার বাবা, আমার বড়দা তার হাড়গুড়ো করে দেবে।

আমার কথায় ছেলেটা হোন্ডা থেকে নেমে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়াল। গগলসটা চোখে পরল। সিনেম্যাটিক ভিলেনের পোঁজে হিংস্র কণ্ঠে বলল, আমার হাড় গুড়ো করবে তোর বাবা ঐ লেংচু মাস্টার হাসান? গুড়ো করবে তোর ভাই যে রং-তুলি নিয়ে রিকশার পেছনে নায়ক-নায়িকার ট্রাশ ছবি এঁকে বেড়ায়? হা হা হা।

আমি ভীষণ ক্ষেপে উঠলাম, ওর কথায়। তীক্ষ্ম চিৎকারে বললাম, এই নাট না বল্টু, সাবধানে কথা বলিস। ভালোই ভালোই চলে যা নইলে ...

 

বল্টুও উগ্র মেজাজে বলল, নইলে কী করবি রে ছাগীর  দল? পুলিশে খবর দিবি? জেনে রাখ আমার বাপ তোর বাপের মতো লেংচু নয়, সে এক সরকারি দলের নেতা, ওয়ার্ড কাউন্সিলার। সো পুলিশ আমার ইয়ে ছিঁড়বে। বরং আমি  তোর বাপের ঠ্যাং ফড়িং এর ঠ্যাংগের মতো ফরফর করে টেনে ছিঁড়ব। সে বুঝবে পরীক্ষার হল থেকে আমার খাতা কেড়ে নিয়ে আমাকে স্কুল থেকে বের করে দিলে কত ধানে কত চাল হয়। এই কথাটা তোর বাপকে জানিয়ে দিস। তারপরেও যদি তোর বাপ কথা না শোনে তাহলে তোকে আমি এই হোন্ডায় তুলে নিয়ে বেচে দেব সাঁচি বন্দরে। বুঝলি?

ওর কথায় আমাদের সহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। আমরা অতি দুঃসাহসে উন্মাদের মতো ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার উপক্রম করতেই ও আমার স্কুল ড্রেসের ওড়না আমার কাঁধ খামচে এক ঝাপটায় ছিনিয়ে নিল। আমার সব বইখাতা ছিটকে পড়ল রাস্তায়। সঙ্গী মেয়েরা সবাই চিৎকার করে কেঁদে উঠল। আশেপাশের মানুষ, পথচারীরা হৈ রৈ চিৎকারে ছুটে আসতে না আসতেই বল্টু আমার ওড়না নিয়ে দ্রুত বেগে হোন্ডা চালিয়ে উধাও হয়ে গেল। আমার বই, খাতা সব রাস্তার ওপর ছিটানো, ছড়ানো। অন্য মেয়েরা আতঙ্কে আর চিৎকারে কাঁদছে।

আমি ওদের মতো কাঁদলাম না। কারণ আমি তখন প্রচন্ড ক্ষোভ, অপমানের আগুনে পুড়ছি। রাস্তা থেকে বইখাতা কুড়িয়ে বুক ঢেকে সঙ্গীদেরসহ আবার প্রবেশ করলাম স্কুলের ভেতরে, হেড মিস্ট্রেসের কক্ষে। সবার কান্না ও চিৎকারের মধ্যে তিনি যা শুনলেন তাতে তারও মুখ যেন আগুনের মতো জ্বলে উঠল। দীর্ঘকাল ধরে তিনি এই স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। এ ধরণের ন্যাক্কারজনক ঘটনা অতীতে তার স্কুলের সামনে কখনোই ঘটেনি। নষ্ট রাজনীতি আর চরিত্রহীন রাজনীতিকদের কারণেই তাদের ছেলেরা শক্তির দাপটে গোল্লায় যেতে বসেছে। বল্টুর পরিচয় তিনি জানলেন। সে কারপুত্র, কোন স্কুলের ছাত্র সব জেনে নিয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আগে তিনি আরমানিটোলা হাইস্কুলের হেডমাস্টারের কাছে গিয়ে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানাবেন এবং বল্টুর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাবেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ অপারগ হলে তিনি স্কুলের সমস্ত শিক্ষক, ছাত্রীদের নিয়ে এই আরমানিটোলা, নয়াবাজারের ঐ ওয়ার্ড কমিশনারের বাড়ি ঘেরাও করবেন। তিনি বুঝিয়ে দেবেন ঐতিহ্যবাহী আনন্দময়ী স্কুল আর আনন্দের বিদ্যাপীঠ নয়, সে স্কুল এখন অগ্নিপীঠ।

আরমানিটোলা স্কুল আনন্দময়ী গার্ল স্কুলের সন্নিকটেই রাস্তা ও মাঠের অপর প্রান্তে। হেডমিস্ট্রেস একটা ঝড়ো আগুনের মতো কিছু শিক্ষকসহ আমাকে আর আমার সঙ্গীদের নিয়ে প্রায় ছুটেই গেলেন স্কুলের হেডমাস্টারের কাছে। বল্টু ওরফে এরফান খান এই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। পরপর দু’বছর ফেল করেও সে এই স্কুলের ছাত্রত্ব বহাল রেখেছে তার পিতার জোরে। আজ হাফ ইয়ারলি অঙ্ক পরীক্ষা ছিল। বল্টু বেপরোয়া ভাবে নকল করতে গিয়ে শিক্ষক ফজলুল হাসানের কাছে ধরা খেয়েছে। ফজলুল হাসান তার খাতা কেড়ে নিয়ে হেডমাস্টারের অনুমতি নিয়ে তাকে বের করে দিয়েছেন। অপমানিত বল্টু স্কুল থেকে বেরিয়ে সে ফজলুল হাসানের কন্যা নাজনিনকে টার্গেট করেছে প্রতিশোধ স্পৃহায়।

আনন্দময়ী স্কুলের হেডমিস্ট্রেস তার সমস্ত ক্রোধ উগরে দিলেন আরমানিটোলা স্কুলের হেডমাস্টারের সামনে। বললেন, ঐ বদমাশ ছেলের বিরুদ্ধে যদি এক্ষুণি ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাহলে আগামীকাল সকাল থেকে আনন্দময়ী স্কুলের সব ছাত্রী, শিক্ষক, শিক্ষিকা নিয়ে এই স্কুলসহ পুরো আরমানিটোলায় অবরোধ কর্মসূচি পালন করবেন এবং এলাকার রাস্তাঘাট সব বন্ধ করে দেবেন।

 

হেডমাস্টার অত্যন্ত বিচক্ষণ, ধীরস্থির স্বভাবের মানুষ। তিনি টেলিফোনে স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটির সব সদস্যদের আসতে অনুরোধ জানালেন। থানার ওসিকে ঘটনা জানিয়ে তাকে অনুরোধ করলেন বল্টুকে অ্যারেস্ট করতে। বল্টুর বাবাকে টেলিফোন করে বল্টুর এই দুষ্কর্মের বিবরণ জানালেন এবং তাকে এক্ষুণি স্কুলে উপস্থিত হতে অনুরোধ করলেন। বল্টুর বাবা ফোরফান খান সাফ জানিয়ে দিলেন, জরুরি রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে তিনি এখন মহাব্যস্ত। সন্তান বল্টুরে নিয়ে তিনি নিজেই সমস্যায় আছেন। সে এখন কোথায় তাও তিনি জানেন না। যদি তারে খুঁইজা পান তা হইলে তিনি তারে দুইটা চড় থাপ্পড় দিয়া ভালোমতন সমঝাইতে চেষ্টা করবেন আর মেয়েটার কাছে ক্ষমা চাইতে বলবেন। মেয়েটা চাইলে তারে কান ধরিয়া উঠবোস করাইতেও পারে। এখন স্কুল কমিটি যদি বল্টুরে একটা স্ট্রং ওয়ার্নিং দিয়া ছাইড়া দেয় তাহলে মন্দের ভালো। এখন স্কুল কমিটি কী ব্যবস্থা নিবে সেটাই তাদের মর্জি।

হেডমাস্টার বুঝতে পারলেন বল্টুর বাবা তার ছেলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেবেন না বা তাকে পুলিশ কাস্টডিতে পাঠাবেন না।

আমাদের হেডমিস্ট্রেস টেলিফোন টেনে নিয়ে সরাসরি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবকে বললেন, ঐ দুর্বৃত্ত ছেলের পিতা একজন প্রভাবশালী নেতা, ওয়ার্ড কাউন্সিলর। সে তার সন্তানের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশনই নিতে রাজি নয়। সুতরাং অ্যাকশন যা নেবার আমাদেরই নিতে হবে এবং এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। পুরো আরমানিটোলা জুড়ে কাল আগুন জ্বলবে। সচিব এক মিনিট হেডমাস্টারের সঙ্গে কথা বললেন। বললেন, টেক ড্রাসটিক অ্যাকশন এগেইনেস্ট দিস কালপ্রিট।

স্কুলে হেডমাস্টারের সভাকক্ষে স্কুলের শিক্ষক ও ম্যানেজমেন্ট কমিটির সকল সদস্যদের উপস্থিতিতে তাদের আলোচনা এবং সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র এরফান খান বল্টুকে তার অতীত ও বর্তমানের সকল দুষ্কর্মের বিবরণ, শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও আনন্দময়ী গার্লস স্কুলের ছাত্রী নাজনিন হাসানের শ্লীলতাহানীর অপচেষ্টার কারণে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হল। জনসমক্ষে বলপূর্বক নাজনিন হাসানের শ্লীলতাহানীর অপচেষ্টার কারণে বল্টুকে পুলিশ কর্তৃপক্ষের প্রতি তাকে অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হল।

বহিষ্কারের এই সিদ্ধান্ত তৎক্ষণাৎ টাইপ করে স্কুলের হেডমাস্টার ও ম্যানেজমেন্ট কমিটির সচিবের যুগ্ম-স্বাক্ষরে নয়াটোলায় বল্টুর পিতার ঠিকানায়, এডুকেশন বোর্ডে ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ও থানায় প্রেরণের ব্যবস্থা করা হল।

বাবা আর আমি এই সভা, সিদ্ধান্তের নীরব দর্শকমাত্র। বাবা সারাক্ষণ আমাকে জড়িয়ে ছিলেন। তিনি একটি কথাও বলেননি, কোনো উচ্চবাচ্চ করেননি।

সভার সমাপ্তি শেষে বাবার সাথে আমি বাসায় ফিরে এলাম। জয়ী মা ঘটনাটি ঘটবার পরপরই স্কুলের একটি মেয়ের মারফত সবকিছু জানতে পেয়েছিলেন। তিনি উদ্বেগ আর অস্থিরতা নিয়ে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। বাবা আমাকে নিয়ে বাসায় ফিরতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন।

ছোটনের মুখ থমথমে গম্ভীর। আমাকে বলল, কাঁদিসনে নাজু। বড়দা আসুক। আকাশ পাতাল চিরে ঐ বদমাশটাকে আমরা ধরব।

রাত্রে বড়দা বাসায় ফিরে সব ঘটনা শুনল। গম্ভীর স্বরে বলল, স্কুল কমিটি ঐ বল্টুর বিরুদ্ধে যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে তা-ই যথেষ্ট। এ নিয়ে আমাদের আর বাড়াবাড়ি করার দরকার নেই।

পরদিন সকালে বল্টুর বাবা ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফোরকান আলী খান সদলবলে গাড়িতে এলেন আমাদের বাড়িতে। বড়দাও তখন বাড়িতে। ফোরকান আলী বাইরে বাবার ঘরে বসে বললেন, মাস্টার সাব, শুনছি আপনে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাগো আমি বহুত ইজ্জত করি বইলাই আমি নিজে আপনের কাছে আসছি আপনের কাছে ক্ষমা চাইতে। বল্টু আমার একমাত্র পুত্র। নয়াবাজারে আমার পুরাতন লোহা-লক্কর, যন্তরপাতি ব্যাচাকিনার দোকানপাট, ব্যবসাপাতি আছে। মানষের পাল্লায় পইড়া আমি রাজনীতিতে ঢুকছি, ওয়ার্ড কাউন্সিলরও হইছি। আল্লার রহমতে আর মানষের ভালোবাসায় আমার অভাব কিছু নাই। অভাব হইল একটা সুসন্তানের। বল্টু নাবালক পোলা। ও ভুল কইরা একটা আকাম কইরা ফেলছে।

বাবা বললেন, একটা আকাম নয়, দুটো চরম দুষ্কর্ম করেছে। ও পরীক্ষায় নকল করছিল। আমি শান্তি হিসাবে নকলসহ ওর খাতা কেড়ে নিয়েছিলাম। দ্বিতীয় দুষ্কর্ম, ও আমার মেয়েকে স্কুলের সামনে অশ্রাব্য গালি দিয়েছে এবং তার ওড়না টেনে নিয়ে শ্লীলতাহানি করার চেষ্টা করেছে।

ফোরকান আলী মাথা নাড়লেন, হ, আমিও স্বীকার করি বল্টু মাথা গরম কইরা এই দুইটা ভুল করছে। তাই আমি নিজেই আপনার কাছে, আপনার কন্যার কাছে ক্ষমা চাইতে আসছি। আপনারা ক্ষমা করলেই বল্টুর ভবিষ্যৎ বাঁচে, আমারও মান-ইজ্জত রক্ষা হয়। আপনেরা যদি চান আমি বল্টুরে কান ধইরা এইখানে টাইনা আনবার পারি এবং আপনার কন্যারে দিয়া সর্বসমক্ষে তারে জুতাপিটা করাইতে পারি। আপোষ, মিমাংসার জন্যে ক্ষতিপূরণ হিসাবে দুইলক্ষ টাকা দিতে পারি।

বাবা বললেন, দেখুন ফোরকান সাহেব, বল্টুর বিরুদ্ধে যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা আমার সিদ্ধান্ত নয়, সেটা স্কুল কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত। এখানে আমার করার কিছুই নেই। তবে ইচ্ছে করলে আপনি আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। সরকারি দলের নেতা হিসাবে আপনাদের হাত অনেক উঁচু।

ফোরকান আলী গম্ভীর স্বরে বললেন, আমি কী করুম না করুম, কোন হাতে কারে থাবা দিমু তা এখনো ঠিক করি নাই। তবে এখনো আপোষ, সমঝোতার পথে আছি। আমি আপনারে পাঁচ লক্ষ টাকা দিতে প্রস্তুত।

বাবা হাসলেন। বললেন, আপনারা এই সাতসকালে আমার বাসার সম্মানিত অতিথি। টাকার লোভ দেখিয়ে আপনি যদি নিজেকে অসম্মানিত করবেন না। এখন আপনাদের যদি আমি চা খাওয়াতে পারি সেটাই হবে আমার আনন্দ। চা দিতে বলি? আমার কন্যা কাউকে জুতা পেটা করতে অভ্যস্ত নয়। ও সুন্দর করে চা বানাতে পারে। ওর হাতের চা খাবেন? চা দিতে বলি?

ফোরকান আলী কয়েক মুহূর্ত বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ওঠে সদলবলে চলে গেলেন।

ওরা চলে যেতেই বড়দা হা হা করে হেসে উঠল। আমাকে ডাকল, নাজু সুন্দর করে চা বানা দেখি। আজ বাবাসহ আমরা সবাই একসাথে বসে চা খাব। তারপর পাঁচলক্ষ টাকার ভাগ বাটোয়ারা হবে।

আমি বললাম, বড়দা, পুরো পাঁচলক্ষ টাকাই আমার চাই। পাঁচ লক্ষ টাকার ছেঁড়া জুতো কিনব, গুনে গুনে ঐ বল্টুকে দশ লক্ষবার জুতের বাড়ি মারব।

বল্টুর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে আরমানিটোলাতে আর আগুন জ্বলেনি। শান্ত পরিস্থিতিতে স্কুল চলছে আগের মতোই। বল্টুকে পুলিশ গ্রেপ্তার করল কি না করল সে বিষয়েও বাবা বা বড়দা কোনো খোঁজ বা আগ্রহ দেখায়নি। সবারই জানা আছে বল্টু প্রভাবশালী ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ছেলে, সরকারি দলের ও পুলিশের ছত্রছায়ায় তার অবস্থান। সুতরাং পুলিশকে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে কর্তৃপক্ষ বলবে অপরাধী পলাতক। তাকে ধরার চেষ্টা চলছে। অপরাধী যে দলেরই হোক সে রেহাই পাবে না। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।

আইন নিজস্ব গতিতে চলছে। আমি আগের মতোই স্কুলে আসা যাওয়া করছি। স্কুলের সামনে পুলিশ পাহারা রয়েছে। আর বল্টুও বোধহয় সবার নাকের ডগার ওপর দিয়েই ঝড়ের বেগে তার লাল হোন্ডা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অন্য কোথাও।

বাবা আগের মতোই স্কুলে আসা যাওয়া করছেন। ক্লাস নিচ্ছেন। ছোটন সারাদিন ঘরেই শুয়ে বসে দিন কাটায়। নানা ধরণের বইপত্র-পত্রিকা পড়ে সময় কাটায়। মাঝে মধ্যে আফসোস করে আমাদের কাছে, আহারে শামুদি কেন অনেকদিন আসছে না? তার লুচি, তরকারিটা ভারি মজার ছিল। বড়দাকে বলে, বড়দা, এরপর লালবাগের কবিরাজ বাড়িতে আমার ওষুধ আনতে গেলে বাবা নয়, তুমি যাবে। শামুদিকে বলবে কবরেজি ওষুধ নয়, শামুদির হাতের লুচি, তরকারি খেলেই আমার অসুখ ভালো হয়ে যাবে। বড়দা হাসে। বলে, তোর শামুদির লুচি তরকারি খেলেই যদি তোর অসুখ ভালো হয়ে যায় তাহলে তাকে তাই বলব। বলব কবরেজি পাঁচনের বদলে তোকে লুচি, তরকারি বানিয়ে দিতে।

ছোটন বলে, শুধু বানিয়ে দিলে হবে না। শামুদিকে রোজ এখানে এসে আমাকে নিজে হাতে খাইয়ে দিতে হবে।

বড়দা বলে, এ রকম চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থায় তোর শামুদি কি রাজি হবে?

ছোটন বলে, তার রাজি হওয়া বা না হওয়াটা তো তোর উপরেই নির্ভর করছে বড়দা।

বড়দা বলে, তোর লুচি, তরকারির শামুদি আমার শামুদি নয়, সে শ্যামশ্রী। সে আমার রিকশায় ওমর আলীর কবিতা হয়েই থাক।

ছোটন কৃত্রিম হতাশ সুরে যেন শ্যামশ্রীর উদ্দেশে বলে, শামুদি তুমি এই গৃহে নও, বড়দার ইচ্ছায় নও, তুমি কবিতা হয়ে বড়দার রিকশার পেছনেই ঘুমিয়ে থাকো।

জয়ী মা নকশি কাঁথায় সুঁই আর রঙিন সুতোয় ফুল তুলতে তুলতে যেন আনমনেই বলেন, মেয়েটি মুসলমান হলে রিকশার ছবি নয়, ওকে আমার ঘরের জীবন্ত ছবি করেই তুলে আনতাম।

আনন্দময়ী গার্লস স্কুলের সামনে সেই ভয়াবহ দিনটির কথা ভুলে এই রকম নানা খুনসুটির ভেতর দিয়ে আমাদের দিনগুলি কাটতে থাকে।

 

প্রতিমাসেই প্যারিসের সেই জুলিয়াঁর প্রেমপত্র আসতে থাকে বড়দার কাছে। তার নিত্য তাগাদায় বড়দা তেলরঙে, জলরঙে, পেনসিল স্কেচে নানা ভাবনার ছবি এঁকে এঁকে প্যারিসের, লন্ডনের বিভিন্ন আর্ট স্কুলে, একাডেমিতে পাঠাতে থাকে। জুলিয়াঁর তাগাদায় এই ছবি আঁকা আর পাঠানো যেন বড়দার একটা স্বপ্নঘোর বা নেশায় জুয়াখেলার মতো হয়ে ওঠে। বাজির দান তাকে জিততেই হবে এই রকম একটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা তার।

ছোটনের দৈহিক অবস্থার কোনো স্থিরতা নেই। সে যখন যন্ত্রণায় ছটফট করে অথবা বিষঘুমে ঘুমোয় তখন আমাদের বুকের ভেতর কাঁপতে থাকে আশংকায়। আবার সে যখন জেগে থাকে আমাদের শব্দের ভেতর, কথা বলে, হাসে, গান গায় তখন মনে হয় তার মতো সুস্থ, সুখী আর কেউ নেই।

একদিন বিকেলে বড়দা তার ঘরে কাঠের স্ট্যান্ডে একটা ক্যানভাসে ছবি আঁকছিল। ছোটন শুয়ে শুয়ে তা দেখছিল। আমিও ছোটনের পাশে বসে। কালো রং এর তুলির আঁচড়ে মাত্র কয়েকটি রেখা, সিঁড়ির ওপর পড়ে থাকা একটি চশমার ভাঙা কাচ, সেই ভাঙা, চির খাওয়া কাচের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে একজন মৃত মানুষের মুখের অস্পষ্ট একাংশ। মানুষটির বন্ধ চোখ, নাকের নিচে ঘন গোঁফের সামান্য আভাস। ঠোঁটে কোনো যন্ত্রণার চিহ্ন নেই। আছে সামান্য বিস্ময়।

মাত্র কয়েকটি আঁচড়ে ছবিটা এভাবেই আঁকা হলে বড়দা তুলি হাতে ভাবতে থাকে চশমার ভাঙা কাচের ভেতর দিয়েই এই সদ্যমৃত মানুষটির মুখের ছবি সে কীভাবে প্রস্ফুটিত করবে, সম্পূর্ণতা দান করবে? ভাঙা কাচের ভেতর দিয়ে ছবিটা দেখলে মানুষটির মুখের একাংশের যতটুকু দেখা যাবে তাওতো হবে ভাঙা-চোরা। ছবিটা কি রিয়েলিস্টিক ফর্মে নাকি অ্যাবস্ট্রাক্ট ফর্মে তার ভাবনাটাকে ফুটিয়ে তুলবে? নানা দ্বিধা ও ভাবনা চিন্তায় কোনো সিদ্ধান্তেই পৌঁছুতে পারছে না তখন ছোটন হঠাৎ করেই বলে উঠল, বড়দা আমার দৃষ্টিতে আমি ঐ চশমার ভাঙা কাচের ভেতর দিয়ে বঙ্গবন্ধুর মুখের আভাস পাচ্ছি। মানুষটার জীবন ছিল অসমাপ্ত। তার ছবিটাতে ঐভাবে অসমাপ্তই থাকতে দাও। তোমার চিন্তা সম্পূর্ণ কোরোনা। বরং মানুষকে ভাবতে দাও এই মুখ কোন শহীদের মুখ? কার অসমাপ্ত ইতিহাস?

বড়দা ছোটনের কথা শুনে গভীর দৃষ্টিতে ছোটনের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হাতের তুলি রেখে ছোটনের কাছে এগিয়ে ওর মাথাটা বুকের মধ্যে নিয়ে আবেগমন্থিত কণ্ঠে বলল, ছোটন, তুই ঠিক বলেছিস। যে মানুষটি অসমাপ্ত জীবন নিয়ে চলে গেছে চশমার ভাঙা কাচের ভিতর দিয়ে যাকে আমরা এখন দেখছি, স্মৃতিচারণ করছি, তার ছবিটা অসমাপ্তই থাক।

ছোটন মৃদু হাসল। বলল, বড়দা ছবিটার ক্যাপশন দিয়োনো ক্যাপশন ফর দিস মারটায়ার। শিরোনামহীন শহীদের মুখ।

 

 

 

 

 

রাত প্রায় ন’টা বাজে। একটা টিউশনি সেরে আরমানিটোলার মাঠের ভেতর দিয়ে হ্যান্ডক্রাচে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে আসছিলেন ফজলুল হাসান। হঠাৎ করেই তার চোখের সামনে অন্ধকারে অপেক্ষমান একটি মোটর সাইকেলের হেড লাইটের আলো জ্বলে উঠল। ফজলুল হাসানের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। তিনি এই হঠাৎ আলোর ঝলকানি সামলে নিতে চোখ বন্ধ করলেন। সেই আলোর তীব্রতার মাঝে কেউ যেন তাকে ডাকল, আব্বাজান?

ফজলুল হাসান এই কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝতে পারলেন এই কণ্ঠস্বর বল্টুর। বল্টুর ব্যঙ্গ ‘আব্বাজান’ ডাকে তার মেরুদ-ের ভেতর দিয়ে যেন একটা অগ্নিস্রোত বয়ে গেল। তবু তিনি নিজেকে সংবরণ করে প্রশ্ন করলেন, বল্টু?

বল্টু যেন অতি বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দিল, জি, আব্বাজান।

- তুই আমাকে আব্বাজান বলে ডাকলি কেন?

- জে, শ্বশুরকে তো আব্বাজানই বলে ডাকতে হয়।

- আমি তোর শ্বশুর?

- হবু শ্বশুর। যদিও আমি রাগের মাথায় আপনার কন্যার ওড়না কেড়ে নিছিলাম, তারে অসম্মান করছিলাম, তার জন্য আই অ্যাম ভেরি ভেরি স্যরি আব্বাজান। এখন আমি তারে সম্মানের সাথে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে চাই। আব্বাজান, কন কবুল?

ফজলুল হাসানের অগ্নিক্রোধ এখন তার শিরদাঁড়ার নয়, তার মাথায়। তিনি তার হ্যান্ডক্রাচ দিয়ে প্রচন্ড আঘাত হানলেন বল্টুর মোটর সাইকেলের হেডলাইটে। আলো নিভে হেড লাইটের কাচ ঝন ঝন শব্দে চুরমার হয়ে গেল। ফজলুল হাসান যেন বহুকাল পরে একটা খুনের নেশায় তার হ্যান্ডক্রাচটা তুললেন বল্টুর হেলমেট পরা মাথাটা চুরমার করে ভাঙতে। কিন্তু পারলেন না।

হ্যান্ডক্রাচটা দ্বিতীয়বার আঘাত হানবার আগেই বল্টু অত্যন্ত ক্ষীপ্রগতিতে লাফিয়ে উঠল, উদ্যত ক্রাচ সমেত তাকে ধরে মাঠের মধ্যে আছড়ে ফেলল এবং স্ক্র্যাচটা দিয়েই ফজলুল হাসানের যুদ্ধাহত পায়ে সজোরে কয়েকটা আঘাত হানল। ক্রাচটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শ্লেষ মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,

একাত্তরে যে-ই পা গুল্লি খাইয়া ভাঙছিলেন সে-ই পা টাই দিলাম আবার নুলা কইরা। স্যরি আব্বাজান, এখন যদি জানে বাঁচেন তয় বিছানায় শুইয়া তজবি টিপবেন আর মনস্থির করবেন আমার লগে আপনার কন্যার বিবাহ দিবেন কি না? যদি দ্যান তয় কসম কইরা কইতাছি পঁচিশ লক্ষ টাকা দেনমোহর, আর সিঙ্গাপুরে আপনারে নিয়া আপনার ভাঙা পায়ের বদলে নতুন পা রিপ্লেসমেন্টের যাবতীয় খরচা আমার বাপজান ফোরকান খানের। আব্বাজান, ইয়ে হ্যায় মেরে আখেরি বাত।

কথাগুলো বলে বল্টু তার মোটর সাইকেল নিয়ে দ্রুত গতিতে চলে গেল। অন্ধকার মাঠে অচেতন অবস্থায় পড়ে রইলেন ফজলুল হাসান।

রাত্র দশটার দিকে আমাদের মাহুতটুলির এক প্রতিবেশি প্রায় দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এসে জয়ী মা আর আমাকে খবর দিল কে বা কারা যেন আমার বাবাকে পা ভেঙে আরমানিটোলার মাঠে ফেলে রেখেছিল। খবর পেয়ে বড়দা আর খলিল চাচাসহ অন্যান্যরা তাকে অচেতন অবস্থায় সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেছে।

জয়ী মা আর আমি আর্তস্বরে কেঁদে উঠলাম। ছোটন বিছানায় শুয়েছিল। আমাদের কান্না শুনে সেও ছুটে এল। ওর ক্লান্ত চোখ দুটো জ্বলে উঠল হিংস্র শ্বাপদের মতো। ও তক্ষুণি ছুটে যেতে চায় হাসপাতালে। কিন্তু ওর শরীর বেশ দুর্বল। আমি আর জয়ী মা বাধা দিলাম। ছোটনকে বাসায় একা রেখেই আমি আর জয়ী মা রিকশা করে ছুটলাম হাসপাতালের উদ্দেশে।

হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের সামনে দেখা হল উদ্বিগ্ন চেহারার বড়দার সঙ্গে। জয়ী মা তার বুকের ভেতরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আমিও কাঁদছি। খলিল চাচাসহ স্কুলের হেড মাস্টার ও অন্যান্যরা আমাদের সান্তনা দিতে লাগলেন। সবার ধারণা এটা বল্টুর হিংসাপ্রসূত দুষ্কর্ম।

বাবার অপারেশন শেষ হল রাত প্রায় সাড়ে এগারোটায়। সার্জন অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে আসতেই সবাই তাকে ঘিরে ধরল। সার্জন জানালেন লাঠির আঘাতে হাঁটুর নিচের হাড় দু টুকরো হয়ে গেছে। ভাঙা হাড়ের কিছু কুচি অপসারণ করে ভাঙা হাড়ের মূল অংশগুলো স্টিল প্লেটে আর স্ক্রু দিয়ে আটকে সেট করা হয়েছে। তবে বৃদ্ধ বয়সে ভাঙা হাড়  জোড়া লাগা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ইনফেকশন না হলে এবং শরীরের অবস্থা দু তিন সপ্তাহের মধ্যে কিছুটা স্থিতিশীল হলে আরো দুটো অপারেশন করতে হবে। এখন অচেতন অবস্থায় পোস্ট অপারেটিভ রুমে আছেন। আশা করা যায় দু’এক ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরে আসবে তখন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ক্লোজ অবজারভেশনে রাখা হবে।

সার্জন যখন আমাদের এইসব কথা বলছেন তখন সারা হাসপাতাল যেন হৈ রৈ শব্দে কেঁপে উঠল। ইমারজেন্সি ইউনিটের ট্রলিম্যানরা দ্রুত বেগে দু’টি ট্রলিতে দুটি রক্তাক্ত দেহ নিয়ে ছুটে এল অপারেশন থিয়েটারের সামনে। পেছনে কাউন্সিলার ফোরকান খান এবং তার দলবল ও পুলিশ। অচেতন দু’টি মুখের একজন ফোরকান খানের পুত্র বল্টু। বুকে লম্বা ছুরি বিদ্ধ। অন্যজনের মুখ ছোটনের মুখ, বুকে গুলিবিদ্ধ।

মা ছোটনের মুখ দেখে অচেতন হয়ে পড়ে গেলেন হাসপাতালের করিডোরেই।

ফোরকান খানের পুত্র শোকের চাইতে হিংস্র হুমকি, চিৎকার বেশি। তার দলের লোকজনের বুক চাপড়ে সমানতালে উন্মত্ত আহাজারি। এদিকে আরমানিটোলা, বংশাল, মাহুতটুলির অসংখ্য মানুষ বন্যার প্রবল স্রোতের মতো উপচে পড়ছে হাসপাতালের প্রাঙ্গণে। মুহুর্মুহু শ্লোগান চলছে পক্ষে-বিপক্ষে। পুলিশ এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করছে যাতে কেনো দাঙ্গা-হাঙ্গামা না ঘটে হাসপাতালের প্রাঙ্গণে।

অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে ডাক্তাররা দু’জনকেই মৃত ঘোষণা করলেন। সবার শোকার্ত আর্তনাদের মধ্যে জানা গেল লাশ দুটি যার যার আত্মীয় ।

বাইরের এত কা-, এত উম্মত্ত চিৎকার এসবের কিছুই জানলেন না আমাদের বাবা ফজলুল হাসান। তিনি তখনও অচেতন।

 

আমরা রাতভর হাসপাতালের করিডোরে অপেক্ষায়। আমাদের এখন বুকের ভেতর কান্না নেই। বুকের ভেতর পাথর। চেখে পানি নেই। চোখ পাথর।

একটা বোধশূন্যতার মধ্যেও আমরা যেন একটা অলৌকিক স্বপ্ন দেখছি, বাবা স্মিতমুখে হেঁটে আসছেন, তার হাতের আঙুল ধরে আমাদের ছোট্ট ছোটন অবিরাম কথা বলছে, হাসছে, কখনো বাবার হাত ছেড়ে ছুটে যাচ্ছে মাঠের ওপর সবুজ ঘাস ফড়িং ধরতে। বাবা উচ্চকণ্ঠে যেন ডাকছেন ছোটন, বেশি দূরে যাসনে বাবা।

ছোটনের হাতে ঘাস ফড়িং। ছোটন অনেক দূরে দূর থেকে দূরে ও হাসছে। বাবার চিৎকার ছোটন তুই ফিরে আয় ...

ময়না তদন্ত শেষে পরদিন দুপুরে ছোটনের লাশ আমাদের ফেরত দেওয়া হল। বাবা হাসপাতালেই পড়ে রইলেন চেতন-অচেতনতার মধ্যখানে। জয়ী মা হাসপাতালেই একটা পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলেন বাবার শয্যাপাশে।

বড়দা, আমি, খলিল চাচা আর আরমানিটোলার স্কুলের হেড মাস্টার, জগন্নাথ কলেজের  প্রিন্সিপাল ও শিক্ষকসহ সকল ছাত্র-ছাত্রী ছোটনের লাশ নিয়ে ফিরে এলাম আরমানিটোলার মাঠে। ছোটনের অন্তিম স্নান শেষে অজস্র লোকের সমাবেশে তার জানাজা, আজিমপুর গোরস্তানে তার দাফন সবকিছুই সম্পন্ন হয়ে গেল বিকেলের মধ্যেই। ছোটনের দাফন কাফনে কেউ আমাদের কিছু করতে দেয়নি। এলাকার ও স্কুল, কলেজের সবাই মিলে স্বউদ্যোগে সবকিছু সম্পন্ন করেছে। আমি আর বড়দা নীরব দর্শকমাত্র। আমাদের চোখের মধ্যে কুয়াশা আর হৃদয়ের মধ্যে অনুচ্চারিত আর্তনাদ।

সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলাম আমি আর বড়দা। স্নান সেরে হাসপাতালে যাব। বড়দা হাসপাতালে বাবার কাছে থাকবে। আমি জয়ী মা’কে নিয়ে বাসায় ফিরে আসব এটাই উদ্দেশ্য। জয়ী মা’কে বিশ্রাম দেওয়া দরকার। তাকে কাঁদতে দেওয়া দরকার, দরকার ছোটনের জন্যে প্রার্থনার।

বড়দা ঘরে ঢুকেই তার টেবিলের ওপর পেপারওয়েট দিয়ে চাপা দেওয়া ছোটনের একটা শেষ চিঠি-

‘ও আমার প্রিয় বাবা, জয়ী মা, বড়দা আর নাজু, এই দুঃসহ অর্থহীন জীবনের ভার আমি আর বইতে পারছি না। জানি আমাকে মরতেই হবে। তবে বিছানায় শুয়ে বসে একটা স্বপ্নহীন কাপুরুষের মতো আমি মরতে চাইনে। লোকে যেন না বলে ছোটন ক্যানসারে ভুগে মরেছে। তাই আমি এখন এমন একটা নাম চাই যাতে লোকে বলতে পারে হ্যাঁ ছোটন ছেলেটা দারুন সাহসী ছিল যে বল্টুর মতো এক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে এবং সব চেনা-অচেনা মানুষের ভালোবাসা নিয়ে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে।

আমার প্রিয় বাবা, জয়ী মা, বড়দা আর নাজু। আমি তোমাদের সবাইকে খুব বেশি ভালোবাসি বলেই আমার এই চলে যাওয়া। আমার চলে যাওয়াতে তোমরা কেঁদো না, শোকার্ত চিৎকার কোরো না। আমি অন্ধকারে নয়, যাচ্ছি আলোতে। আমি বেঁচে থাকব তোমাদের ভালোবাসায়, তোমাদের প্রার্থনায়। বিদায়’

ছোটন আমাদের কাঁদতে নিষেধ করেছে। তবু আমরা দুই ভাই-বোন ছোটনের চিঠিটা বুকের ভেতর নিয়ে অনেক অনেক কাঁদলাম।

চলবে

 

লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব এক)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব দুই)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব তিন)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব চার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব পাঁচ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব ছয়)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব সাত)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব আট)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব নয়)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব দশ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব এগার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব বার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব তের)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব চৌদ্দ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব পনের)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব ষোল)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top