সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২৮) : সেলিনা হোসেন


প্রকাশিত:
১১ জানুয়ারী ২০২৩ ০৩:২৪

আপডেট:
১১ জানুয়ারী ২০২৩ ০৩:২৭

 

কয়েক মাস পরই চৌগাছায় যুদ্ধ শুরু হয়। অঞ্জন দ্রুত চৌগাছায় পৌঁছে যায়। ওর সঙ্গে মুজফফর আর লুৎফাও আসে। অঞ্জন ওদেরকে বলে, আমাদেরতো অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নাই। তাই আমরা আহতদের চিকিৎসা করব। সুস্থ করব সবাইকে। কানো যদি মৃত্যু হয় তাহলে কবর দেব তাকে। কেউ কোথাও পড়ে থাকবেনা।
লুৎফা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। বলে, আমিও আপনার সঙ্গে সবার সেবা করব। কবর দেয়ার আগে দোয়া পড়ব। জানাজাতো হবে না।
- ঠিক বলেছেন ভাবী।
অঞ্জন লুৎফার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। লুৎফা আবার বলে, আমরা একটা বড় গর্ত করব। যার যাব ধর্ম তার থাকবে, কিন্তু সবাইকে এক গর্তে রেখে মাটি টেনে দেব।
- বাব্বা, আপনি তো বেশ-
- আমরা হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃষ্টান খুঁজব না। সবাই আমাদের সামনে স্বাধীনতার শহীদ। আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশ হবে।
- তাতো হতেই হবে। শরণার্থী শিবিরে এসে আমরা এই সত্য গভীরভাবে বুঝতে পারছি। ধর্ম যার যার দেশ সবার। শরণার্থী শিবিরে আমরা একসঙ্গে দিন কাটাচ্ছি। এখানে ধর্ম নিয়ে আমাদের কোনো বাড়াবাড়ি নাই। এখানে আমরা একটি স্বপ্ন পূরণের জায়গায় জড়ো হয়েছি। সবাই আমরা এক স্বপ্ন দেখার মানুষ। এর বাইরে আমরা আর কিছু চিন্তা করিনা।
অঞ্জনের কথা শুনে লুৎফা উৎফুল্ল হয়ে বলে, ঠিক বলেছেন দাদা। খুব সুন্দর করে বলেছেন। এমন কথা শুনলে আমার মাথা ভরে যায়। শরণার্থী শিবিরে থাকার সব কষ্ট বুলে যাই। বেঁচে থাকা ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। ফুলের গন্ধে শ্বাস টানি।
চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই শব্দ করে হাসে। হাসতে হাসতে সিরাজ বলে, ভাবী নতুন করে কথা বলে।
মাসুম হাসতে হাসতে বলে, বুঝতে পারছি ভাবী ঢাকায় থাকলে কবিতা লিখতেন।
সবাই একসঙ্গে বলে, ঠিক ঠিক।
কারো মুখ থেকে হাসি বন্ধ হয়না। কিছুক্ষণ হারিস স্রোত বয়ে যায়। লুৎফা চুপ করে থেকে সবার মুখের দিকে তাকায়। অঞ্জন বলে, আমি আপনাকে কাগজ কলম দেব। আপনি স্বাধীনতা নিয়ে এক লাইন কবিতা লিখবেন।
- না, না, আমি পারবনা। আমিতো কখনো কবিতা পড়ি নাই।
- পারবেন, পারবেন। আপনার চিন্তা সুন্দর।
- এখন থাক। এখন এসব ভাবব না। আগে যুদ্ধে জিতব আমরা। আমার সামনে যুদ্ধ এখন কবিতা। কঠিন কবিতা। যেটা লেখা সহজ না। এটা লিখতে জীবন দিতে হয়।
মুজফফর লুৎফার পিঠে হাত রেখে বলে, এখন থাম গো। এতকথা বলার দরকার নাই।
- না, আর কথা বলবনা। থামলাম।
পাশে দাঁড়ানো সবাই হাততালি দেয়। জোরে জোরে বলে, যুদ্ধ আমাদের কবিতা। কবিতা দিয়ে স্বাধীনতা আনব।
লুৎফা কথা বলে না। মুজফফর সীমান্তের ওপারে তাকিয়ে থাকে। দেখতে পায় পাকিস্তানি বাহিনী ভারতের সীমান্ত গ্রাম বয়ড়ার দিকে এগিয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পরই তীব্র আক্রমণ চালায়। বয়ড়া গ্রামের ঢোকার চেষ্টা করছে। চৌগাছায় মুক্তিবাহিনী প্রতিরোধ করে। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। মুজফফর লুৎফার হাত ধরে বলে, আমরা যুদ্ধের পেছনের শক্তি হয়ে থাকব। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যা কিছু করা দরকার তা করব। আমরা আড়াল হয়ে থাকবনা।
অঞ্জন বলে, চলো ওই পাশে যাই। ওখঅনে গিয়ে দাঁড়ালে যুদ্ধের পরিস্থিতি ভালোভাবে বোঝা যাবে।
মুজফফর কড়কড় শব্দে চেঁচিয়ে বলে, পাকিস্তানি সেনারা ষোলটা ট্যাংক নিয়ে এগিয়েছে। আমি গুনেছি।
- আমিও গুনেছি। আমাদের মুক্তিবাহিনীও সমান ট্যাঙ্ক আর ভারী কামান নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করেছে।
- চলো, কতজন পাকিস্ততানি সৈন্য আছে আমরা গুনে দেখি।
- গোনার কি দরকার?
- এজন্য গুনব যে কতজনের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হচ্ছে তা দেখব।
মুজফফর বলে, আমরা ওই দিকে দাঁড়িয়ে গুনতে পারব। চলো। গুনে ফেলি।
লুৎফা চেঁচিয়ে বলে, যুদ্ধের সময় এটা তোমাদের একটা খেলা হবে। তখন প্রবল গুলির শব্দে মুক্তিযোদ্ধা সালাম মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। অঞ্জন একদৌড়ে কাছে গিয়ে বসে পড়ে। দেখতে পায় বুকে গুলি লেগেছে। মুজাফফর কাছে এসে বলে, আপনি আর আমি ওনাকে নিয়ে ওপাশে যাই। আপনি মাথা ধরেন, আমি পায়ের দিক ধরছি। ওখানে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করব। দুজনে সালামকে তুলে নিয়ে চলে যায়। লুৎফা নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে গড়িয়ে পড়া রক্তের ধারা মুছতে থাকে। সালামকে ঘাসের ওপর শুইয়ে দিলে অঞ্জন ওর কাছে রাখা যে ওষুধ আছে তা দিয়ে পরিচর্যা শুরু করে। বুকে গুলি লেগে জ্ঞান হারিয়েছে সালাম। অঞ্জন বুঝতে পারে ওকে বাঁচানো যাবেনা। যতক্ষণ বেঁচে থাকবে এইটুকুই ওর যুদ্ধের সময়। ও কাউকে কিছু বলেনা। কিন্তু নিজে সরে যায় না। নানাভাবে পরিচর্যা করতে থাকে। একসময় লুৎফা এসে ওর কাছাকাছি বসে। বলে, এখনও জ্ঞান ফিরল না? আমার ভয় করছে? আমি কোনো সেবা করতে পারি?
- না, কিছু করতে পারবেনা। আমি যা করছি এটাই ঠিক আছে।
লুৎফা কথা বলেনা। সালামের কপালে হাত রাখে। বলে, জ্ঞান ফিরলে আমি প্রথম কথা বলব। আপনি বলবেন না।
- আপনি চুপচাপ বসে থাকেন। কথা বলার দরকার নাই।
- আমি আস্তে আস্তে ওনার জন্য দোয়া পড়ব।
- পড়েন। আল্লাহতালা ওকে বাঁচিয়ে দেবে। আমাদের সামনে একজন মুক্তিযোদ্ধা মরে যাবে এটা আমরা ভাবতে পারি না।
লুৎফা মৃদু স্বরে দোয়া পড়ে। ওর কন্ঠস্বর চারদিকে ছড়িয়ে যায়। সবাই খুব স্বস্তি বোধ করে। আহত মুক্তিযোদ্ধাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সবাই অঞ্জনের বুক শীতল হয়ে আসে। বুঝতে পারে সালামকে বাঁচানো যাবে না। ওর শরীর শীতল হয়ে আসছে। জ্ঞান ফিরবে বলে মনে হচ্ছেনা।
একটুপরে মুজফফর এসে বলে, পাকিস্তানি সেনারা পাঁচশ জন আছে।
লুৎফা দাঁড়িয়ে উঠে বলে, ওরা আমাদের মুক্তিযোদ্ধার বুকে গুলি মেরেছে। ওদের সবগুলোকে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা শেষ করবে।
দাঁড়িয়ে থাকা সবাই লুৎফার দিকে তাকিয়ে থাকে। কেউ কোনো কথা বলে না। চারদিকে গোলাগুলির শব্দ প্রবল হয়ে ওঠে। দূর থেকে দেখা যায় বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে। দূরে দাঁড়িয়ে শরণার্থীরা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। সবাই মিলে ¯েøাগান দেয়, জয় বাংলা - জয় বাংলা।
অঞ্জন দেখতে পায় মরে গেলে মুক্তিযোদ্ধা সালাম। উপুড় হয়ে ওর বুকের ওপর মাথা রাখে অঞ্জন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই এসে সালামকে ঘিরে বসে।
লুৎফা বলে, আমাদের মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সালাম - জয় বাংলা।
কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে কাঁদতে শুরু করে। অন্যরাও কেঁদে বুক ভাসায়। সালাম সবার পরিচিত। মুজফফর বলে, সালামকে কবর দেব আমরা। যাই কবর খুঁড়ে নেই। সবাই চলো আমার সঙ্গে। গর্ত খোঁড়া হলে আমরা এসে শহীদ সালামকে নিয়ে যাব।
সবাই দূরে হেঁটে যেতে থাকে। খালেক নিজের বাড়িতে গিয়ে একটি কোদাল নিয়ে আসে। ধানক্ষেতের াশে এক জায়গায় গর্ত করে শহীদ সালামের লাশ নামানো হয়। সবাই মিলে দোয়া পড়ে। লুৎফা খানিকটা দূরে বসে চিৎকার করে কাঁদে। যখন মাটি চাপা দিয়ে গর্ত ভরানো হয় তখন লুৎফা কবরের পাশে বসে জোরে জোরে দোয়া পড়ে। কবরের উপরের মাটি সমান করে গোছাতে থাকে। সবাই মিলে লুৎফার সঙ্গে দোয়া পড়ে, মাটি গুছিয়ে একসময় বলে, চলেন ভাবী। আমরা আবার আসব।
- আমি এখন যাবনা। শুনতে পাননা যুদ্ধ তুমুল হয়ে উঠেছে।
- আমরা দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি পাকিস্তান বাহিনীর ষোলটি ট্যাঙ্কের মধ্যে তেরোটি ধ্বংস করেছে মুক্তিযোদ্ধারা। অনেক সৈন্যের লাশ মাটিতে পড়ে আছে।
- যুদ্ধ এখনই থেমে যাবে বলে মনে হয় না।
- হ্যাঁ, আমরাও তাই মনে করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের ধ্বংস করে ছাড়বে।
- চলো আমরা এখান থেকে সরে যাই। মুজফফর সবার দিকে চোখ বড় করে তাকায়, এখানে থাকা কোনো কাজে আসছেনা। তবে থাকতে হবে কেন?
লুৎফা চেঁচিয়ে বলে, আমি মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ দেখব। আমি যাবনা। এই গাছের আড়ালে বসে থাকব। দরকার মতো ওদের সেবা করব।
অঞ্জন বলে, আমিও যাবনা। যে আহত হবে তাকে সুস্থ করতে হবে। আমরাতো কাজের দায়িত্ব নিয়ে এসেছি। চলে যাব কেন?
- আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে সবাই থাকি।
- শুধু থাকিনা, সবাই যুদ্ধে আছি। যুদ্ধের যা কিছু দরকার হবে আমরা মিলিতভাবে করব।
- এই দেখ মুক্তিযোদ্ধারা ষোলটি ট্যাংকের মধ্যে তেরোটি ধ্বংস করে বাকি তিনটি দখল করেছে। পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটছে।
- আমরা যুদ্ধে জিতেছি।
- হ্যাঁ, জিতেছি, জিতেছি, জিতেছি। চেঁচিয়ে ওঠে সবাই, জয় বাংলা।
- প্রায় একশজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছে।
- যুদ্ধ থামেনি। মনে হচ্ছে আরও অনেকক্ষণ চলবে।
- চলুক। যতক্ষণ দরকার ততক্ষণ তো চলতে হবে। বিজয় নিয়ে আমরা তাঁবুতে ফিরব।
অনেকক্ষণ একজায়গায় বসে থাকার পরে সন্ধ্যা হয়ে যায়। মুজফফর লুৎফাকে হাত ধরে টেনে বলে চলে আমরা যাই।
- হ্যাঁ, চলো। অঞ্জন ভাই যাবেন না?
- না, আমি যাবনা। মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ যদি আহত হয় তাকে আমার দেখতে হবে।
- ও হ্যাঁ, তাইতো, তাইতো।
- অঞ্জন দাদার সঙ্গে আমরা কয়জন থাকব। দাদা একা থাকলে হবে না।
- হ্যাঁ, ঠিক বলেছো, থাক। অঞ্জন ভাই একা সেবা করতে পারবেনা।
- আপনারা যান।
- ঠিক আছে আমরা যাচ্ছি।
মুজফফর আর লুৎফা এগিয়ে যেতে থাকে। দুকানে ধারণ করে গোলাগুলির শব্দ। মাথা ভরে যায় সেই শব্দে। লুৎফা গুণগুণিয়ে বলে, আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের স্বাধীনতা -
মুজফফর নিজেও গুণগুণিয়ে গানের মতো গাইতে থাকে আমাদের স্বাধীনতা- আমাদের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা পূর্ণ করবে আমাদের শরণার্থী শিবির। নিজ দেশের ঘরৈ ফেরার সময় গাইব - আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি -
- গানটা তোমার মুখস্ত নাই-
- পুরোটা নাই। দুই লাইন মুখস্ত আছে। দুই লাইনই গাইব।
লুৎফা উচ্ছ¡সিত হয়ে বলে, আমাদের চারপাশে যারা থাকবে তাদের সবাইকে গাইতে বলব।
- হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।
দুজনে গুণগুন করে গাইতে গাইতে নিজেদের তাঁবুতে গিয়ে ঢোকে। কুপি জ¦ালায় লুৎফা। মুজফফর কলসি থেকে পানি ঢেলে খায়। তারপর এক গøাস পানি লুৎফার দিকে এগিয়ে দেয়। লুৎফা, নিজেও একটানে গøাসের পানি শেষ করে। বুঝতে পারে বুকের ভেতর পানির টান প্রবল ছিল। পানি খেয়ে বলে, হাঁড়িতে দুপুরের ভাত-তরকারি কিছু আছে। ওইটুকু খেয়ে আমরা শুয়ে যাই। হবে না?
- হ্যাঁ, হবে হবে। তোমাকে এখন আর রান্নার ঝামেলায় যেতে হবে না।
- আমি সকালে রান্না করব। চট করে খেয়ে নিয়ে চৌগাছায় যাব। যুদ্ধের অবস্থা দেখব।
- ঠিকই বলেছ। হাতমুখ ধুয়ে নেই। ভাত খেয়ে শুয়ে পড়ব।
লুৎফা দ্রুত থালায় ভাত-তরকারি দিয়ে মুজফফরকে দেয়। মুজফফর থালা হাতে নিয়ে বলে, তোমার থালা কই? ভাত আছেতো? আমাকে শুধু খাইও না।
- আছে আমার জন্য। তুমি তোমার মতো খাও। আমি থালায় ভাত নিচ্ছি। অল্প সময়ের মধ্যে দুজনে খেয়ে শুয়ে পড়ে। চৌগাছায় দেখা যুদ্ধ দুজনকেই তন্ময় করে রাখে। ঘুম আসেনা। ঘুমাতে অনেক রাত হয়ে যায়। লুৎফা ভাবে, শরণার্থী শিবিরের এখানে চৌগাছায় যুদ্ধ হচ্ছে। গোলাগুলির শব্দ রাতের অন্ধকার কাঁপিয়ে তুলেছে। ঘুম আসছেনা। মুজফফর ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন ও ভাবে কেন যুদ্ধের এমন চিন্তা ওকে কাহিল করে ফেলেছে। কেন ওর ঘুম আসছে না। বালিশে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে লুৎফা। মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, তখন মাথা কাত করতে হয়। প্রবলভাবে নিঃশ্বাস টানে। ঘুম জড়ানো কন্ঠে মুজফফর বলে, তোমার কি হয়েছে?
- ঘুম আসছেনা।
- আমার বুকে মাথা রাখ। আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
লুৎফা ঘুরে শুয়ে মুজফফরকে জড়িয়ে ঘরে। মুজফফর ওর মাথা বুকের সঙ্গে গভীর মমতায় জড়িয়ে ধরে গুণগুণ করে গাইতে থাকে - আমরা যুদ্ধে জিতব - স্বাধীন দেশে যাব। লুৎফাও মুজফফরের সঙ্গে কন্ঠ মিলায়। গুণগুণ করতে করতে দুচোখের পাতা বুঁজে আসে। দুজনে একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালে যখন ঘুম ভাঙে তখন যুদ্ধের গোলাগুলির শব্দ একইভাবে শুনতে পায়। লুৎফা ধড়মড়িয়ে উড়ে বসে বলে, আমি একটুপরে চৌগাছা যাব। তুমিও যাবে আমার সঙ্গে। যাবে তো?
- হ্যাঁ, যাবই। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ সোজা কথা না।
মুজফফর উঠে তাঁবুর বাইরে যায়। একপাশে দাঁড়িয়ে চারদিকের পরিস্থিতি দেখে। লুৎফা দ্রুতহাতে কয়েকটি রুটি বানায় আর আলু ভাজি করে। দুজনে নিজেদের মতো করে পরিস্থিতি সামলায়। লুৎফার কাজ শেষে দ্রুত আলু ভাজি দিয়ে রুটি খায়। বেশ অনেকগুলো রুটি দেখে মুজফফর বলে, এত রুটি বানালে কেন?
- চৌগাছায় নিয়ে যাব। যদি কারো দরকার হয়ে তাকে খেতে দেব।
- ভালোই করেছো। গুছিয়ে নাও। চলে যাই। কেউ না খেতে চাইলে ক্ষতি নেই। আমরা খাব। তুমি সাধাসাধি করে কাউকে খাওয়াতে চেওনা।
- আমার মাথা এত খারাপ হবেনা। কেউ খেতে না চাইলে বুঝব তাদের খাওয়ার ইচ্ছা নাই।
মুজফফর শব্দ করে হাসে। হাসতে হাসতে বলে, তুমি যে এতকিছু বোঝ এতে আমি অবাক হই।
- অবাক হবে কেন? তুমি কি ভাব যে আমি হাড়গিলা। কিছু বুঝিনা।
- না, না, আমি এসব ভাবিনা। তুমি দারুণ মেধাবী। এটা আমি মেনে নেই।
- তাহলে অবাক হও কেন?
- এটা একটা কথা কথা। এমনি বললাম। মাথা সবসময় ঠিকঠাক চিন্তা করে কথা বলেনা। এটা সবার ক্ষেত্রে হয়।
- থাক, এত কথা আর বলতে হবেনা।
- চলো যাই। মনে হয় যুদ্ধ শুরু হয়েছে। গোলা-বারুদের গন্ধ পাচ্ছি। তোমাকে বলিনি।
- আমাদের সাবধানে যেতে হবে।
- এতকিছু ভেবোনা। চল দেখেশুনে এগোই।

 

চলবে

 

শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ১)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ২)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৩)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৪)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৫)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৬)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৭)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৮)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৯)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ১০)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১১)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১২)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৩)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৪)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৫)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৬)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৭)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৮)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ১৯)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২০)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২১)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২২)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২৩)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২৪)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২৫)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২৬)
শরণার্থীর সূবর্ণরেখা (পর্ব- ২৭)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top