সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১

ধ্রুবপুত্র (পর্ব পনের) : অমর মিত্র


প্রকাশিত:
১১ জানুয়ারী ২০২১ ২২:৫২

আপডেট:
১১ জানুয়ারী ২০২১ ২২:৫২

ছবিঃ অমর মিত্র

 

রাজা হাঁটছিলেন দেবপথ ধরে। এই পথে এখন তাঁকে একা যেতে হয়। আগে কখনো তা হয়নি। ভানুমতীই তাঁকে টেনে নিয়ে গেছেন গভীর রাত্রে মহাকালের দিকে। গন্ধবতী নদীর কুলে, আকাশের নীচে, পরম জ্যোৎস্নাময়ী রাত্রিতে। শিপ্রার তীরেও গেছেন তাঁরা এই পথে। কিন্তু তা কবে? শেষ বর্ষার আগে। শেষ বর্ষা কবে এসেছিল? গেল আষাঢ়,  শ্রাবণের আগের আষাঢ়, আগের শ্রাবণ তার আগের বছর। তার আগে বৈশাখ, সেই বৈশাখী রাত্রিতে গভীর নির্জন অন্ধকারে দুইজনে হাত ধরে হয়ত গেছেন মহাকালে, নতুবা শিপ্রার ধারে। নদীতীরে, আকাশের নীচে, তারার আলোয় পরস্পর পরস্পরকে গভীরভাবে চিনেছেন। কতদিন মিলিত হয়েছেন দুজনে সেই অতুল নৈঃশব্দের ভিতরে। শরীর ছুঁয়েছে যখন শরীরকে, সেই ধ্বনিও যেন শুনতে পেয়েছেন তাঁরা। সেই ধ্বনি কী মধুময়! প্রতি অঙ্গ ছুঁয়ে যায় প্রতি অঙ্গ তার। তারপরই তো বর্ষা এল। কতবার বর্ষা এসেছে, গত হয়েছে বসন্ত, গ্রীষ্ম। কতবার বর্ষার পরে শীত এসেছে, শীতের আগে হেমন্তের সন্ধ্যা। হেমন্তের আগে শরতের সকাল। কী মায়াময় ছিল সেই পৃথিবী। বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত।

ভর্তৃহরি টের পাচ্ছেন, সেই বর্ষার স্মৃতিও ধূসর এখন। সেই বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, চৈত্র, ফাল্গুন মাস বসন্ত ও গ্রীষ্মের স্মৃতিও অলীক হয়ে গেছে, যেমন অলীক হয়ে গেছে শরৎ, হেমন্তের স্বপ্ন। কতকাল আগের কথা সেসব? কোন জন্মের? দেবপথ থেকে আকাশের নীচে উঠে এসেছেন অবন্তীরাজ। দীপটি ওই পথেই রেখে দিলেন একটি পাথরের আড়ালে। এবার তিনি তারার আলোয় পথ চলবেন। শুক্লা অষ্টমীর চাঁদের আলোয় পথ চিনে নেবেন। জ্যোৎস্না এখন কুয়াশায় জড়িয়ে ঘোলাটে করে তুলেছে চরাচর। মাথাটি পশম বস্ত্রে মুড়ে রাজা দ্রুত হেঁটে যাচ্ছেন এই আশ্চর্য পৃথিবীতে যেখানে আর কোনও  মানুষ জেগে আছে কিনা ধরা যায় না। ওই যে দেখা যায় কণকশৃঙ্গ। মহাকাল শীর্ষেই এখন চন্দ্রের অবস্থান। রাজা দাঁড়িয়ে সেই বিরল দৃশ্যটি দেখলেন। প্রণাম করলেন মাথা নত করে। আবার হনহন করে হাঁটতে লাগলেন। দ্রুত। যেন গোপন অভিসারে চলেছেন তিনি। এইভাবেই তো আত্মগোপন করে যায় নগরীর প্রেমিক-প্রেমিকারা। এদিক ওদিক চকিত দৃষ্টি ফেলে গন্ধবতীর তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে তিনি মহাকাল মন্দিরের গোপন প্রবেশপথে এসে দাঁড়ালেন। শত্রু আক্রমণে, বিপদে এইপথেই নিষ্ক্রান্ত হওয়া বিধেয়। স্তিমিত পায়ে সেই সুড়ঙ্গ পথে অন্ধকারে প্রবেশ করলেন রাজা। অতি সন্তর্পণে, হাত ও পায়ের স্পর্শে স্পর্শে পথ বুঝে নিয়ে শেষ পর্যন্ত এসে উঠলেন মন্দিরের পশ্চাত দিকে। এগিয়ে এসে অলিন্দে পা রাখলেন। অপ্রশস্ত অনুচ্চ অলিন্দ ধরে এগোতে লাগলেন। এই দীর্ঘ অলিন্দটি তাঁর চেনা, এই মন্দিরের প্রতিটি কোণ তাঁর চেনা। অন্ধকারে কোনও অসুবিধে হয় না। অবন্তী দেশটিও তিনি চেনেন যতটা পারেন। অন্ধকারে তিনি হেঁটে যেতে পারেন অবন্তীর পথে পথে। উজ্জয়িনী নগরটি তো তাঁর নখদর্পণে। চোখ বুঁজলেই উজ্জয়িনীর কখন কোথায়, কোন পথের উপর ছায়া পড়ে, কোথায় কখন সেই ছায়া কত দীর্ঘ হয়, তা মনে পড়ে তাঁর। পূর্ণিমা রাতে কোন পথ কতটা জ্যোৎস্নায়  ভিজে থাকে তা তিনি জানেন। এই যে দীর্ঘ অলিন্দ, এর কোথায়, কোন কোন বিন্দুতে সকালের প্রথম রোদটি এসে পড়ে তা তিনি জানেন এই অলিন্দেরই অন্যভাগের কোনো বিন্দু থেকে শীতের রোদটি নিঃশেষ হয়ে যায় অপরাহ্ন বেলায় তা তিনি জানেন। জানেন সেই রোদ বৈশাখের অপরাহ্নে শুয়ে থাকে কোন জায়গাটিতে।

অলিন্দ প্রায় পার করে এলেন রাজা ভর্তৃহরি। একটি দীপের আলো তাঁর লক্ষ্য ছিল। দীপটি অন্ধকারে একটি নিঃসঙ্গ তারার মতো জ্বলছিল। তেল কমে আসায় দীপশিখা চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। দীপের স্থান ছিল দেওয়ালের ক্ষুদ্র কুলুঙ্গিতে। দীপের নীচে যে অন্ধকার সেখানে শয্যা বিছিয়ে শুয়েছিল দেবদাসী ললিতা। শয্যাটি পশুরোমের, কিন্তু খুবই কর্কশ, নিম্নমানের পশমবস্ত্র। সর্বাঙ্গে বিদ্ধ হয় রোমের অগ্রভাগ।

অদূরেই প্রবীণ পুরোহিতের ঘর। দেবদাসী যেন পাহারা দেয় তাঁর নিদ্রাকে। প্রধান পুরোহিতের নিদ্রা খুব অভিমানী। এমনও রাত যায় যে বারবার তাঁকে উঠতে হয়। প্রধান পুরোহিত বয়সজনিত নানা পীড়ায় ভোগেন, ফলে তাঁর নিদ্রা গভীর হয় না। সেই নিদ্রাকে যে কোনও উপায়ে অচঞ্চল রাখার দায়িত্ব দেবদাসী ললিতার। প্রধান পুরোহিত জেগে আছেন আর সে ঘুমিয়ে, এমন কখনো হয় না। হতে পারে না। তার উপরে সেই আদেশ নেই। দ্বিজদেব তো মহাকালের প্রতিনিধি। তাঁর ইচ্ছাই মহাকালের ইচ্ছা। দ্বিজদেবের নিদ্রার সময়টুকুতেই সে নিদ্রা যেতে পারে। সেই অভ্যাস হয়েছে তার। অন্যথা হয় না, হলে প্রধান পুরোহিতের সেবাকার্যের অধিকারচ্যুত হবে সে। দ্বিজদেব রুষ্ট হলে এই মহাকাল মন্দিরে তার স্থান হবে না। মহাকাল যদি তাকে পরিত্যাগ করেন তার স্থান কোথায় হবে তা ভাবতেও পারে না সে। ভয় করে। 

দেবদাসী ললিতার তন্দ্রা এসেছিল। সেই তন্দ্রার ঘোরে সে যেন স্বপ্ন দেখছিল মহাকাল অন্য বেশে তার সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন। সে স্পষ্ট দেখছিল গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে দীর্ঘ অলিন্দ ধরে ভগবান মহাকালেশ্বর হেঁটে আসছেন তার দিকে। কী রূপবান পুরুষ! কী তেজময় তিনি! হায় মহাকাল! তোমার চরণেই তো আশ্রিত আমি। তোমাতেই নিবেদন করেছি আমি আমার সর্বস্ব।

তন্দ্রাচ্ছন্নতা আচমকা ভেঙে যায় রাজার পায়ের শব্দে, যদিও সেই শব্দ এতই অস্পষ্ট যে তা প্রায় নৈঃশব্দেরই নামান্তর। কিন্তু ললিতার নিদ্রা অথবা তন্দ্রা তাতে ভাঙবেই। দ্বিজদেব তাঁর শয্যায় পাশ ফিরলেও তা টের পায় ললিতা। রাজার নিঃশব্দ পদধ্বনি না হোক, সে হয়ত বা ভূমির কম্পন টের পেয়েছিল যেভাবে টের পায় সতর্ক সরীসৃপ। তার আতঙ্ক এমনই। ভীতমুখে উঠে বসেছে সে শতচ্ছিন্ন পশম বস্ত্রে গা ঢেকে। শীতে কাঁপছিল সে, অথবা সম্মুখে একটি মানুষের উপস্থিতি তাকে ভয়ার্ত  করে তুলেছিল। মানুষটির দীর্ঘ অবয়বে সে টের পেয়েছে ইনি দ্বিজদের নন। তিনি খর্বকায় মানুষ। এ জন অন্য মানুষ। অন্য কেউ। কিন্তু কে? ভয় বিস্ময় তাকে ক্রমশ অনঢ় করে দিচ্ছিল। ধীরে ধীরে কম্পন থেমে আসছিল। সে অবাক হয়ে দেখছিল আগন্তুকের মাথার আবরণ সরে যাচ্ছে। সে আবার কাঁপতে শুরু করল। ইনি কে? যে স্বপ্নের ভিতর আচ্ছন্ন ছিল সে, সেই স্বপ্ন যেন কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। রাজার মুখখানি তাঁকে বিস্ময়ে বিহ্বল করে তোলে। ভর্তৃহরির মুখে দীপের আলো পড়েছিল। সেই নরম হলুদ আলোয় মুখের প্রসন্নভাব আরও গভীর হয়েছিল। রাজা জিজ্ঞেস করলেন নিম্নস্বরে, দ্বিজদেব ঘুমিয়ে?

দেবদাসী নুয়ে পড়েছে। রাজাকে সে চিনতে পারেনি। একবার তো দূর থেকে দেখেছিল। একবারই। রাজা-রানী যখন আসেন মহাকালে সকল দেবদাসীর তো অধিকার থাকে না তাঁদের নিকটবর্তী হওয়ার। সে মিলিয়ে নিচ্ছিল তন্দ্রার ঘোরে দেখা স্বপ্নের চিহ্নগুলিকে। নুয়ে যাচ্ছিল আরও। যুক্ত করে হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছে সে রাজার মুখোমুখি। অস্ফূট স্বরে কেঁদে উঠে, হায় মহাকাল!

রাজার পায়ে মাথা নত করল দেবদাসী ললিতা। দেবদাসী নিঃশব্দে অশ্রুপাত করছিল রাজার পায়ে। রাজা কয়েক দণ্ড পরে সরে দাঁড়ালেন। তাঁর কানে আসছিল দেবদাসীর বিলাপ ধ্বনি। ‘মহাকাল’ নামটি স্পষ্ট ধরতে পারছিলেন, বাকিটা গোঙানো শব্দ। সরে দাঁড়িয়ে ভর্তৃহরি বললেন, রোদন থামাও, দ্বিজদেবকে জাগাতে হবে।

ললিতা দাসী থরথর করে কাঁপছিল। কান্না সম্বরণ করতে চাইছিল না আবেগ-সর্বস্ব নারী। সে ধরেই নিয়েছে মহাকালের পায়ে মাথা ছোঁয়াতে পেরেছে। সে জেনেই গেছে স্বপ্নের পথ ধরে মহাকালেশ্বর শিব তার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছেন। এ জন্মে এই ঘটনা ঘটবে কে ভেবেছিল? এই মন্দির অলিন্দের পাথরে মাথা ঠুকে যৌবন ক্ষয় করতেই না তার এখানে আসা। সেইভাবেই তো যৌবন ক্ষয় করে কতজন চলে গেছে নগরীর বাইরে বারাঙ্গনা পল্লীর ক্লেদে। কতজন হয়ে গেছে নিরুদ্দেশ। কিন্তু যে পেয়েছে মহাকালের দর্শন, তার জীবন গেছে বদলে। কে পেয়েছে এই ভগবানের দেখা তা জানে না ললিতাদাসী, কিন্তু এটি জানে প্রবীণ পুরোহিত দ্বিজদেব সাক্ষাৎমানুষ হলেও মহাকাল ভগবানের প্রতিনিধি। মহাকাল ভগবানের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। মহাকালের নির্দেশ তাঁর মাধ্যমেই প্রেরিত হয়। তিনি পুণ্যবান মানুষ। ক্ষমতাবান মানুষ। ঐশ্বর্যবান মানুষ। মণিরত্ন অলঙ্কার তার সঞ্চয়ে অঢেল। এই নগরেই আছে তাঁর প্রাসাদোপম অট্টালিকা। তাঁর মতো সুখী মানুষ উজ্জয়িনী নগরে কে আছে?

ললিতাদাসী অস্ফূটস্বরে বলছিল, হায় মহাকাল, প্রসন্ন হও, কৃপা কর, অভাগিনী বড় দুঃখী।

রাজা ভর্তৃহরি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছিলেন। যুবতীর কপাল আবার তাঁর পদতল স্পর্শ করছিল। তিনি সরে দাঁড়ালেন। তখন ললিতা মাথা তুলে দুই হাতে রাজার দু’টি পা জড়িয়ে ধরেছে, বিনবিনে কান্নায় চূর্ণ হতে হতে রাজার দুটি পা বুকে ধারণ করেছে, কাঁদছে, অভাগিনী বড় দুঃখী, হে ভগবান তুমি সব দ্যাখো, কোনও কিছুই তোমার অজানা নয়, হতভাগিনী এখন দ্বিজদেবের সেবাদাসী, কৃপা কর, প্রসন্ন হও, দ্বিজদেবকে আমি সর্বস্ব দিয়ে সেবা করি হে প্রভু, এই জীবন এই যৌবন তাঁরই প্রতি নিবেদিত, তিনি তৃপ্ত হলে তুমিও তৃপ্ত হবে তা আমি শুনি, কিন্তু মন সায় দেয় না।

কাঁদতে কাঁদতে ললিতাদাসী অনুভব করছিল নীলকণ্ঠ শিবের প্রস্তরমূর্তি এখন আর প্রস্তরের নেই। রক্তমাংসের হয়ে গেছে। রক্তমাংসময় মানুষের রূপ ধরে মহাকাল ভগবান তার সম্মুখে। সে শিহরিত হলো। আর বক্ষদেশ দৃঢ় হয়ে উঠেছিল। শরীরময় রক্ত চলাচল দ্রুত হচ্ছিল। ভগবানের প্রতিনিধি, ভগবানের আর একরূপ হল প্রধান পুরোহিত, প্রৌঢ় দ্বিজদেব। তাঁকে তো এই শরীর দিয়ে সেবা করেত হয় ললিতাকে। কিন্তু সেই সেবার ভিতরে থাকে ভয়, নিয়মপালন। প্রৌঢ় দ্বিজদেবের দেহ যখন তাকে অধিকার করতে থাকে অষ্টপদীর মতো, তখন  শরীরের রক্তও  যেন জমে যেতে চায়, এ দেহে কোনও ঢেউ ওঠে না। মনে হয় ক্লেদে পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে তার কুসুম কোমল দেহখানি, যা শুধু মহাকাল ভগবানের প্রতি নিবেদিত। অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে সে। প্রৌঢ় প্রধান পুরোহিতের মুখ নিঃসৃত লালা যখন তার দুই স্তন আবৃত করে ফেলে, শরীর কুঁকড়ে যেতে থাকে। সে যেন শিথিল চর্মের বিগতা যৌবনা কোনও বৃদ্ধাতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। তার কোনও সাড় থাকে না। সেই সাড়হীন শরীরেই বিচরণ করে দ্বিজদেবের শিথিল শরীর। নিঃসাড় যুবতীদেহ নিয়ে যখন মত্ত হন প্রৌঢ় প্রবীণ পুরোহিত, মনে হয় গণিকালয়ের বীট অথবা ওই শ্রেণীর মানুষের রুচিও তাঁর চেয়ে সুন্দর। প্রবীণ পুরোহিত মানুষটি অত্যন্ত কামুক। বিকৃতচারী। ভোগ্যাকে পীড়ন করে, দলিত করেই সুখ আহরণ করতে ভালবাসেন। আর তাঁর কাম চরিতার্থ হয়ে গেলে ভোগ্যা দেবদাসীটিকে পদাঘাতে শয্যা থেকে সরিয়ে দেন ।

এইসব মনে পড়ছিল দেবদাসী ললিতার। তার যুবতী শরীরে মহাকালরূপী রাজার পা দু’খানি পিষ্ট হচ্ছিল। দুই বুক ছুঁয়েছিল রাজার পা দু’খানি। সেই ছোঁয়ায় সে জেগে উঠছিল বহুদিন বাদে। তাঁর যুবতী দেহ মন এভাবে জাগে না এখানে। জাগাতে পারে না। মহাকালের আশ্রয়ে থেকে শরীর কখনোই সজাগ হয়ে উঠতে পারে না। প্রৌঢ় পুরোহিতের পীড়ন তাকে কষ্ট দেয়। সে কাঁপছিল। তার দেহের কোষে কোষে অচিন্ত্যনীয় এক উন্মাদনার জন্ম হচ্ছিল। সে দেবদাসী। দেবতার প্রতি নিবেদিতা। তার প্রতিটি অঙ্গ দেবতার নিকট উৎসর্গ করেছে যেন মনে মনে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। দেবতা তাকে কখনোই জাগান না। দেবতার কথা ভেবে কখনোই তার শরীর জাগে  না। পাথর! পাথর! একদিন গর্ভগৃহে নীলকণ্ঠ শিব মহাকালের লিঙ্গমূর্তি স্পর্শ করেছিল সে সকলের অজ্ঞাতে। স্পর্শের আগে সে নিজে হয়ে উঠেছিল চঞ্চল। কিন্তু সেই পাথরের পুরুষাঙ্গ কী শীতল! বরফের মতো প্রায়। কোনও সাড় নেই। যেন সাড় পাওয়ার আশায় সে স্পর্শ করেছিল তা। আতঙ্কে সে গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে এসেছিল। ধরা পড়ে গিয়েছিল প্রবীণ পুরোহিত দ্বিজদেবের কাছে। পাথরের দেবমূর্তির শীতলতা তার শরীর অসাড় করে দিয়েছিল যেন। প্রবীণ পুরোহিত তাকে আসতে বলেছিলেন তাঁর ঘরে। গর্ভগৃহের সেবাকর্মের অবসান হল সেইদিন। কিন্তু প্রধান পুরোহিত তাকে গ্রহণ করলেন দেবতার পরবর্তে। তিনি দেবতার প্রতিনিধি। মহাকালেশ্বর নাকি তাঁর ভিতরে ভর করেন। প্রধান পুরোহিতের বিকৃত কামের কথা ভাবলে সবই তো মিথ্যা মনে  হয় ললিতা দাসীর।

আবেগে, কামনায়, অলৌকিক আনন্দে দেবদাসী ললিতা যেন অন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। ভগবান মহাকাল রক্তমাংসময় মানুষ হয়ে তার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। এতদিনে ভগবান তার প্রতি প্রসন্ন হয়েছেন। অন্ধ দেবদাসী তার কামনা বিহ্বল, আবেগ বিহ্বল, ভক্তি বিহ্বল শরীর নিয়ে উত্থিত হতে থাকে। হে মহাকাল, তুমি আমাকে গ্রহণ কর প্রভু! আমার ডাকে সাড়া দিয়েছ হে প্রভু, সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করো প্রভু...। 

উত্থিত যুবতী শরীর আকর্ষণ করছিল রাজা ভর্তৃহরিকে! দীপটি প্রায় নিভে এল যেন। রাজা শুনতে পাচ্ছিলেন, অস্ফূট ধ্বনি ‘মহাকাল’ উচ্চারণ করে যাচ্ছে ক্রমাগত। রাজা অনুভব করছিলেন এই দেবদাসীর শরীর অতি উত্তম। পরম যুবতী এই নারী তাঁর পরিচয় জানে না। বিভ্রম পড়ে গেছে। দেবদাসীর বিভ্রমে তিনি আর অবন্তীর অধিপতি নন এই মুহূর্তে। যে সম্বোধন তাঁর কানে আসছে, তাতে রাজা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছেন, কিন্তু নিজের পরিচয় উন্মোচন করতেও পারছেন না। দেবদাসী তার নবযৌবন নিয়ে জেগে উঠছে মহাকালের সামনে। তিনিই মহাকাল।মহাকালেশ্বর শিব! তিনিই লিঙ্গমূর্তি দেবতা। নীলকণ্ঠ। দেবদাসীর অস্ফূট উচ্চারণে শিহরিত হচ্ছেন রাজা। যুবতী তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে ধীরে ধীরে। দেবদাসীর ছোঁয়ায় রাজা যেন উজ্জীবিত হয়ে উঠছেন। তাঁর মনে পড়ল কতদিন তিনি বঞ্চিত হয়ে আছেন। এমন যুবতী শরীরের স্পর্শ তিনি কতদিন পাননি। কতদিন ধরে বিমুখ হয়ে আছেন রানী ভানুমতী। তাঁর নরম কণ্ঠস্বর ফুটল অন্ধকারে, দ্বিজদেব জেগে উঠবেন!

হে মহাকাল! সবই তো তোমার ইচ্ছা, দ্বিজদেব জাগবেন কি না জাগবেন সবই তোমার ইচ্ছা হে প্রভু, আমি কতদিন তোমার জন্য বসে আছি আমার সর্বস্ব নিয়ে, হে প্রভু, কতদিন তোমাকে দর্শন করতে পারিনি, তোমার পায়ে মাথা ছোঁয়াতে পারিনি।

রাজা বিহ্বল হয়ে পড়েছেন। কামনায় উত্তাল হয়ে উঠেছে তাঁর শরীর। আর যুবতীও বিস্মৃত হচ্ছে সবকিছু। যুবতীর প্রতিটি প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছে। রাজা বিস্মৃত হলেন তাঁর আত্মপরিচয়। যুবতী শরীরের স্পর্শে রাজা বিস্ফোরিত হয়ে যাবেন যেন। ভানুমতীর মুখখানি এক মুহূর্তের জন্য মনে পড়ল তাঁর। তারপর বিপুল অন্ধকারে কোথায় যে ভেসে গেল অবন্তীর রানী। রাজা সাড়া দিতে লাগলেন দেবদাসীর আলিঙ্গনে। সাড়া দিতে দিতে তাঁর আবার মনে পড়ছিল ভানুমতীর নিদারুণ প্রত্যাখ্যানের মুহূর্তগুলি। তিনি ভাবছিলেন তাঁর তো যাওয়ার কথা ছিল মঙ্গলনাথে, চলে এলেন মহাকাল মন্দিরে। তাঁর সঙ্গে আসার কথা ছিল রানীর। সেই ইচ্ছাতেই তো ডেকেছিলেন ভানুমতীকে। ভানুমতী আসেননি। এসব কি মহাকালের অভিপ্রায়? না হলে মহাকাল মন্দিরের এই অলিন্দে এই সুযুবতী দেবদাসী বিভ্রমে পড়ে কেন এই মধ্যরাত্রিতে? মহাকালের ইচ্ছা ব্যতীত এমন হয় না। হওয়ার কথা নয়। দেবদাসীর এমন সাহস হয় কী করে যে রাজার শরীর প্রার্থনা করে সে নিজের শরীর শান্ত করতে। সে তো নারী। নারীই।

দেবদাসী ললিতা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এই জগৎ-সংসার, এই অবন্তীদেশ, উজ্জয়িনী, রাজসিংহাসন, রানী ভানুমতী, বহুদিনের বৃষ্টিহীনতা, শিপ্রা, গন্ধবতী দুই নদী, জলহীন সপ্ত সাগর, মহাকাল মন্দির, অবন্তীর আকাশ, আকাশের গ্রহতারা, সব ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছিল রাজার কাছ থেকে। রাজা ভর্তৃহরি অলিন্দর কঠিন প্রস্তরময় ভূমিতে মিলনে মগ্ন হচ্ছেন এমন এক যুবতীর সঙ্গে যার মুখ তিনি দ্যাখেননি। দেখতে পাচ্ছেন না। কুলুঙ্গির দীপটি নিভে গেছে এর ভিতরেই।

যুবতী দেবদাসী কৃতজ্ঞতায় গলে পড়ছিল। বিভ্রমের অন্ধকারে সে দেবতা আর মানুষের তফাৎ করতে পারেনি।  পারছিল না। যুবতী তার আরাধ্য দেবতার সঙ্গে মিলিত হচ্ছে এই কথা ভাবতেই শিহরিত হচ্ছেন রাজা। প্রস্তরময়, শীতল, কঠিন, নিঃসাড় লিঙ্গমূর্তি যে উষ্ণ রক্তমাংসময় হয়ে উঠেছে সেই কল্পনায় যুবতী শিহরিত হচ্ছিল, ক্রমাগত, ফিসফিস করছিল, হে প্রভু, এ আমার কী ভাগ্য, কোন পুণ্য, হে মহাকাল তুমিই আমার শয়নে থাকো, স্বপনে থাকো, আমাকে গ্রহণ করো হে মহাকাল।

রাত্রি উষ্ণ হয়ে উঠতে থাকে। অন্ধরাত্রির শত শত চক্ষু  খুলে যায়। যেতে থাকে। মিলন সম্পূর্ণ হয়। রাজা উঠে দাঁড়ালেন অনেকক্ষণ বাদে। দেবদাসী ললিতা পাথুরে কঠিন ভূমিতে রতিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে ঘুম-নির্ঘুমের ভিতরে পরিভ্রমণ করছিল। সাড় ছিল না তার। মিলনে এত নিবিড়তা, এত সম্পূর্ণতা সে আর পায়নি এ জীবনে। মিলন অভিজ্ঞতাই যেন হয়নি তার, অথচ সে দিনের পর দিন ধর্ষিতা হয়েছে। নিঃসাড় হয়ে, মৃতের মতো হয়ে শরীর মেলে ধরেছে প্রৌঢ় পুরোহিতের কাছে। ধর্ষণের কালে সে যন্ত্রণাদীর্ণ হতে হতে মনের ভিতর মহাকালকে ধরে রাখত। স্মরণ করত মহাকালকে। ওই অপমান, অসম্মান থেকে, ব্যথাতুর জীবন থেকে তাকে উদ্ধার করবেন মহাকাল। সে মহাকালের চরণাশ্রিত, তিনি ব্যতীত তার অন্য কোনও আশ্রয় নেই। দেবদাসী ললিতা, রতিশ্রমে শারীরিক তৃপ্তি ও তন্দ্রার ঘোরে দেখতে পাচ্ছিল প্রবল পৌরুষ নিয়ে মহাকাল সরে যাচ্ছেন যেন। আহা কী স্নিগ্ধতা মহাকালের স্পর্শে।

দেবদাসী ডাকে, হে প্রভু!

রাজা ভর্তৃহরি ঘুরে দাঁড়ান। তিনি এবার প্রাসাদে ফিরবেন। যে ঘটনাটি ঘটে গেল তা অভাবনীয়। তাঁর জীবনে এই প্রথম। হয়ত এই প্রথমই  তিনি একটি যুবতীর আকাঙ্ক্ষায় সাড়া দিয়েছন। এর আগের সব মিলনেই তো তাঁর ইচ্ছা প্রধান হয়ে উঠত। উঠেছে সব  সময়। এখানে তিনি নিজের কামনা পূরণে আসেননি। এসেছিলেন প্রবীণ পুরোহিতের সঙ্গে কথা বলতে। অথচ একটি কামজর্জর যুবতীর সঙ্গে রতিক্রিয়া সমাপন করে ফিরে যাচ্ছেন প্রাসাদে। যুবতীই তাঁকে বাধ্য করেছে। তিনি যুবতীকে জাগাননি, যুবতীই তার শরীর জাগিয়েছে। এভাবে তাঁকে কেউ এর আগে জাগায়নি, জাগাতে পারেনি। না, সেরা সুন্দরী, উজ্জয়িনীর রানী ভানুমতীও নয়। রাজা অত্যন্ত তৃপ্ত বোধ করছিলেন। তিনি বাধ্য হয়েছেন রতিলীলায়। কিন্তু সেই বাধ্যতা তাঁকে বিভোর করেছে। এমন সম্পূর্ণ করে নারী শরীর পাওয়া এর আগে কখনো ঘটেনি। কখনো কোনও নারী এভাবে উজাড় করে নিজেকে নিবেদন করেনি তাঁর কাছে। এ এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা ভানুমতী তাঁকে দেয়নি। দেয়নি মানে  ভানুমতীর ভালোবাসা নিখাদ নয় যেমন নিখাদ এই দেবদাসীর আত্ম সমর্পণ মহাকালের প্রতি। পাথরের দেবতা, তাঁর প্রতি এই যে আকূল আহ্বান, তাতে পাথরের দেবতাও রক্তমাংসের মানুষ হয়ে এল ওর কাছে। ভর্তৃহরি নিচু হয়ে বসলেন দেবদাসীর শায়িত শরীরের পাশে। নিজের কণ্ঠহারটি খুলে দেবদাসীর বুকের উপর রেখে দিলেন। অন্ধকারে ললিতা টের পেয়েছে তা।

রাজা উঠলেন। দেবদাসী আবার তাঁকে অধিকার করতে হাত বাড়িয়েছিল। রাজা আর দাঁড়ালেন না। তাঁর কাছে আবার উজ্জয়িনী, অবন্তীদেশ, রাজসিংহাসন, শিপ্রা, গন্ধবতী দুই নদী, অনাবৃষ্টি, আকাশের নতুন নক্ষত্রের উদয়, সব ফিরে আসতে লাগল। তিনি যে উজ্জয়িনীর রাজা তা মনে পড়ল। দ্রুত পায়ে মহাকাল মন্দির থেকে বেরিয়ে হাঁটতে লাগলেন রাজা। কেমন এলোমেলো পায়ে, দিকহারা পাখির মতো ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে যেন চলেছেন রাজা ভর্তৃহরি। চলতে চলতে দাঁড়ালেন। ওই যে কণকশৃঙ্গ মহাকাল। ওর শীর্ষ থেকে চাঁদ ঢলে গেছে পশ্চিমে। রাজা নত হলেন। মাটিতে মাথা ছোঁয়ালেন। ধুলোমাটিতে কপাল ছুঁয়ে গেল। ধুলোয় উড়ছিল সামান্য। রাজা ডাকলেন মহাকালকে, হে প্রভু! হে প্রভু আমাকে ওই শক্তি দাও, আমি যেন তোমাকে রক্তমাংসের করে পাওয়ার মতোই উজ্জয়িনীর মাটিতে বৃষ্টি নামাতে পারি। 

রাজা কত সময় ধুলোমাটিতে মাথা ঠেকিয়ে আছেন তা তাঁরও ঠাহর হয় না। রাত গড়াতে থাকে সকালের দিকে।

চলবে

ধ্রুবপুত্র (পর্ব এক)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দুই)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তিন)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পাঁচ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ছয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সাত)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব আট)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব নয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব এগার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব বারো)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তের)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চৌদ্দ)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top