সিডনী মঙ্গলবার, ২৩শে এপ্রিল ২০২৪, ১০ই বৈশাখ ১৪৩১

ধ্রুবপুত্র (পর্ব বারো) : অমর মিত্র


প্রকাশিত:
৩১ ডিসেম্বর ২০২০ ২০:৩৭

আপডেট:
২৩ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:১৬

ছবিঃ অমর মিত্র

 

উজ্জয়িনীর সপ্তসাগর যেন অবন্তী লক্ষ্মীর গলায় সপ্তলহরীর মুক্তোহার। কথাটা কে বলেছিল? না, ধ্রুবপুত্র। সে আসত এই রত্নাকর সাগরতীরে বসা বৃদ্ধ সৈনিক পরাশরের কাছে। বৃদ্ধর জীবনে ধ্রুবপুত্রের আগমন এক মস্ত প্রাপ্তি। কোন মহাজ্ঞানী ক্ষত্রিয় শূদ্রের কাছে এসে বসে? তার জীবনের গল্প শোনে, শীতের বেলায়, গ্রীষ্মের সন্ধ্যায়, হেমন্তের অপরাহ্নে। শূদ্র পল্লীর সকলে চিনত সেই দেবতার মতো রূপবান যুবককে।

উজ্জয়িনীর সপ্ত সরোবর যেন সাতটি তিথি। দুবার প্রদক্ষিণ করলেই চতুর্দশী, তারপর পৌর্ণমাসী রাত্রি। জ্যোৎস্নায় সপ্ত-সাগরে ফোটা অফুরান পদ্মফুল সপ্ত-কোটি চাঁদের শোভা ধারণ করে প্রোষ্টপদ থেকে অঘ্রান মাস পর্যন্ত। নগরের পূর্বে এই রত্নাকর সাগর, পশ্চিমে মহাকাল মন্দির সংলগ্ন রুদ্রসাগর। আর পাঁচটি সরোবর নগরে ছড়ানো। পুষ্কর সাগর রাজপ্রাসাদের দক্ষিণে, রাজঅন্তঃপুর সংলগ্ন ক্ষীরসাগর, উত্তরে গোবর্দ্ধন সাগর, আরো উত্তরে পুরষোত্তম সাগর, বিষ্ণুসাগর। 

সাত সাগরের নাম উচ্চারণ করছিল বৃদ্ধ সৈনিক পরাশর। রত্নাকর সাগর-এর দক্ষিণ দিয়ে পশ্চিমে রাজপ্রসাদ যাওয়ার পথে। পথের ধারে সবুজ তৃণভূমি, তারপর শূদ্র বসতি। সরোবরের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ বলছিল, রাজা গন্ধর্ব সেনের কথা। তাঁর রাজত্বের প্রথম দিকে নাকি এইরূপ ঘটেছিল। অনেকদিন বৃষ্টি না হওয়ায় সরোবর প্রায় জলশূন্য হয়ে গিয়েছিল। সেবারও পদ্মফুলের আকাল হয়েছিল।

কত কাল আগে? এক যুবক জিজ্ঞেস করল।

সে হিসেব নেই, মনে হয় সেবার পদ্ম ফোটেইনি। বুড়ো বিড় বিড় করে, তারপর তো আকাশে মেঘ এল আচমকা, জলে থৈ থৈ করতে লাগল সাত সাগর।

এই রত্নাকর সাগর শূদ্র পল্লীর জন্য। এ জলে ব্রাহ্মণ, বৈশ্য কিংবা ক্ষত্রিয় কোনো অধিকার দাবি করে না। শূদ্র সরোবর রত্নাকর সাগর শুকিয়ে গেছে প্রায়, যে জল আছে তা ব্যবহারের অনুপযোগী, কর্দমাক্ত হয়ে গেছে। জলের দিকে তাকিয়ে পূর্ণ সরোবরের স্মৃতি জেগে উঠছিল বৃদ্ধের মনে। বয়স তার অনেক। কত বয়স তা সে নিজেই জানে না।

বৃদ্ধ বলে কত যুদ্ধে কত দেশে গেছে সে রাজা গন্ধর্ব সেনের সৈন্য হয়ে। রাজা ছিলেন দিগ্বিজয়ী।  একবার সেনাবাহিনী দক্ষিণে রেবা নদী, তাপ্তি নদী, গোদাবরী পার হয়ে আরো দক্ষিণ দেশে কাবেরী নদীর কুলে গিয়ে থামল। আহা কী সেই দেশ! সেই দেশেই অগস্ত্য নক্ষত্র উদিত হন। চারদিকে নারকেল আর সুপারির বন। চন্দনবৃক্ষ সেই দেশেই জন্মায়। মলয় পর্বতের সানুদেশে সেনাবাহিনী পৌঁছে গেল। আহা মলয় পর্বতের কোলে সেই রাত্রি যাপন! সে যেন ইহ জনমের কথা নয়। কী আশ্চর্য ছিল সেইসব তারা ভরা রাত্রি, চন্দন গন্ধে ভরা বাতাস! সে যেন দেবতাদের বাসভূমি। সেখানে ছিল চির বসন্ত। অগ্রহায়ণেও শীতের কোনো চিহ্ন ছিল না। সমস্ত রাত্রি আকাশের তলে শুয়ে থাকা, ছায়াপথে স্বপ্নের ভিতরে হেঁটে যাওয়া। মলয় পর্বত কী বিপুল! মেঘের মতো ছড়িয়ে গেছে যেন দশ দিগন্তে। বৃষ্টির মেঘ দেখলে এখনো যে তার মনে পড়ে মলয়চন্দন পাহাড়ের কথা। সেই দেশের রমণীরাই বা ছিল কত সুন্দর, মমতায় ভরা বুক তাদের। পান ভোজনে অসুস্থ সৈনিককে  ফেলে সেনাবাহিনী রওনা দিলে এক রমনী মায়ের মমতা দিয়ে সেবা করে তাকে সুস্থ করে তুলেছিল...।

বৃদ্ধ বলে যাচ্ছিল নানা কথা। আকাশে বহুকাল মেঘের চিহ্ন নেই, তাই মলয় পর্বতের কথা এল। মেঘের জন্মভূমিও বুঝি সেই দেশ,অগস্ত্য যখন উদিত হন মেঘও জন্মায় নিশ্চিত।

তার জীবন বর্ণময়। ঝুলিতে কম গল্প নেই। সেই গল্পে রামধনুর রঙ। সেই গল্পে বিন্ধ্য, সাতপুরা মলয় পর্বতশ্রেণীর রঙের মতো মেঘের ঢাল। অতি বৃষ্টি দেখেছে সে। দেখেছে এমন অনাবৃষ্টিও। সরোবর খটখটে, শিপ্রা, গন্ধবতীর  বালুকাময় বুক খুঁড়ে খুঁড়ে জল সংগ্রহ, কত স্মৃতি তার। নদীর অন্তঃস্থল কখনো শুকোয় না। নদী হলো মা। আর এই নগর তো উজ্জয়িনী। মহাকালেশ্বর শিবের লীলাক্ষেত্র। এখানে মহাকাল শঙ্কর ত্রিপুরাসুরকে বধ করেছিলেন। সেই পুরাণ তাকে শুনিয়ে গেছে ধ্রুবপুত্র। বিনিময়ে সে শুনে গেছে দক্ষিণ দেশের চন্দন বন, চন্দনগন্ধী বাতাস, মলয় পর্বত, রাতভর সেই পর্বতের উপত্যকায় বসে গাওয়া গান, জ্যোৎস্নাময়ী রাত্রি, নারিকেল ও গুবাকের বন, রেবা, তাপ্তি, কাবেরী, গোদাবরী, নদী, নারিকেল রসের সুরা, যেতে যেতে সাতপুরা পর্বত শ্রেণী, পঞ্চপাণ্ডবের অজ্ঞাতবাসের গুহা... কত কথাই না! বুড়োর কানে যেন এখনো ধ্রুবপুত্রের কণ্ঠস্বর আচমকা বেজে ওঠে। এই সামান্য জীবনে অমন সুন্দর একটি মানুষের দেখা সে আর  পায়নি। এই যে এখন সে বলছে, মহাকালেশ্বর মহাদেব শঙ্করের বিজয়রথ তৈরি হয়েছিল কত কিছু না দিয়ে! এই পৃথিবী, মন্দারপর্বত, দিগবিদিগ, নক্ষত্রমণ্ডল, সপ্তর্ষিমণ্ডল, বাসুকী, হিমালয়, বিন্ধ্যপর্বত, সিন্ধু, গঙ্গা, সরস্বতী নদী, দিনরাত্রি, শুক্ল ও কৃষ্ণপক্ষের অংশ দিয়ে তৈরি হয়েছিল সেই রথ। চাঁদ ও সূর্য ছিল মহাদেবের রথচক্র। ইন্দ্র, বরুণ, যম ও কুবের দেবতা হয়েছিলেন তাঁর রথের ঘোড়া। সেই রথের ধ্বজা দণ্ড ছিল সুমেরু পর্বত।  আকাশের বিদ্যুৎরেখায় ভারী মেঘ হয়েছিল তার পতাকা...।  বলতে বলতে থামে পরাশর। শ্রোতারা সবাই মধ্যবয়সী, নবীন বয়সী, বালকও আছে তার ভিতরে। সকলে গভীর তন্ময় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে গ্রামবৃদ্ধের দিকে। যতটা বলে থেমেছে পরাশর, তারপরের অংশটি বলতে পারে কিন্তু কেমন অবোধ্য ঠেকে তার কাছে। সংবৎসর মানে ছয় ঋতু নিয়ে এক বর্ষকাল। তা কী করে মহাদেবের  ধনুক হবে আর কালরাত্রিই বা কী করে সেই ধনুকের জ্যা হবে? ধ্রুবপুত্রের কাছে এর অর্থ জেনে নেবে ভেবেছিল বুড়ো। কিন্তু সে তো অবন্তী দেশ থেকেই চলে গেছে। দীর্ঘশ্বাস পড়ে তার।

শ্রোতাদের একজন জিজ্ঞেস করে, চাঁদ সূর্য রথের চাকা, বুড়ো বলো তো আবার প্রথম থেকে, কী দিয়ে তৈরি হয়েছিল সেই রথ, কত জোরে ছুটত তা?

বলতে আরম্ভ করবে বুড়ো পরাশর, তখনই তার কানে এল রথচক্রের ঘর্ঘর শব্দ। পশ্চিম থেকেই আসছে। পশ্চিমে রাজার বাড়ি, নগরের শ্রেষ্ঠ মানুষরা থাকেন সেদিকে, পশ্চিমেই শিপ্রা আর গন্ধবতী নদী, পশ্চিমেই মহাকালেশ্বর-এর অধিষ্ঠান। ওই, ওই যে আসছে রথ। আকাশে ধুলো উড়ছে। মেঘের মতো ধুলোয় ঢেকে গেছে পশ্চিম দিগন্ত। চট করে উঠে দাঁড়াল বুড়ো পরাশর। মেঘ উঠল নাকি পশ্চিমে? ওকি মেঘের গুড়গুড় শব্দ! বৃষ্টি আসবে নাকি! কিন্তু এই সময় তো পশ্চিম থেকে মেঘ আসে না। শীতের যে বৃষ্টি, সেই বৃষ্টির মেঘ,হাওয়া আসে উত্তর থেকে, উত্তর-পূর্বের মেঘ চলে যায় পশ্চিমে অপরা সাগরের দিকে। যদি আসে তাহলে? রথই তো! রথ! বুক ছম ছম করে ওঠে বুড়ো পরাশরের। সে যে এতক্ষণ রথের কথাই বলছিল, মহাকালেশ্বর মহাদেব শঙ্করের বিজয় রথ! উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল রথচক্রের ঘর্ঘর। তাহলে কি মহাকালেশ্বরই ছুটে আসছেন এদিকে। ক্রুদ্ধ, দিগবিদিগহীন মহাকাল তার রথ ছুটিয়ে আসছেন এই পথে? বিরূপ হলেন তিনি? মহাকাল বিরূপ হলে এই পৃথিবী শেষ! তাই তো জেনেছে বৃদ্ধ এতকাল ধরে। আসছেন তিনিই। মহাকালেশ্বরের রথের কথা বলতে বলতে যে ঘোর জেগেছে বুড়ো পরাশরের মনে, সেই ঘোর থেকেই সে টের পেল ওই আসেন তিনি। তাই ধুলোয় ঢেকে যায় পৃথিবী। ও তো ধুলো নয়, মেঘ, বিদ্যুৎ, মহাকালের রথের পতাকা। সে শূদ্র হয়ে মহাকালেশ্বর শিবের মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেনি কখনো। সেই অধিকারই নেই। দ্যাখেনি কেমন সে মূর্তি। যা শুনেছিল, সবই সেই ধ্রুবপুত্রের কাছে। শূদ্রের মুখে দেবতার নাম উচ্চারণও কি পাপ? ভীত পরাশর চিৎকার করে উঠল পালাও, যে পালাবে সে বাঁচবে, হায়, এ আমি কী করলাম, মহাকাল শিব তাঁর বিজয়রথ নিয়ে আসছেন এদিকে। বুড়ো মাথাটি মাটিতে ঠেকিয়ে ভীমাকার এক পাথর খণ্ডের মতো নিশ্চল হয়ে চোখ দুটি বন্ধ করে ফেলে।

চারিদিক কয়েক দণ্ডের মধ্যেই জনশূন্য। একা পরাশর মাঠের ভিতরে নিশ্চল, অন্ধকার। যারা ছিল তারা গেল কোথায়? কোন গর্তে,  কোন বটবৃক্ষের আড়ালে, গাছের ডালে পাতার অন্ধকার ভীত পক্ষীর মতো লুকিয়ে গেছে সবাই। রথের ঘর্ঘর শব্দ ক্রমশ বেড়ে উঠছিল।

রথ আসছিল। নির্জন শীতের দুপুরে রথ আসছিল রত্নাকর সাগরের দিকে, শূদ্র পল্লীর কাছে। কাম্বোজদেশীয় শাদা ঘোড়ার খুরে, রথচক্রে ধুলো উড়ছিল খুব। ঘোড়া দুটি পা আছড়াতে আছড়াতে থামল। কী স্বাস্থ্যবান ঘোড়া! রথের চালকটিই বা কেমন? সে উত্তরদেশীয় কৈলাশ পর্বতেরই মানুষ। রথটি ছিল রত্নখচিত। এটি যুদ্ধের রথ নয়, পরিযানিক, কিন্তু অতীব সুসজ্জিত। পীতবর্ণের রেশমি চাঁদোয়া, ঝালর, ধ্বজাটি আরো একটু উঁচু হলে বলা যেত এটি রাজার রথ। পতাকাটি অতি শুভ্র, রাজহংসের পালকের মতো তার বর্ণের উজ্জ্বলতা। দশ পুরুষ উচ্চ এবং বার পুরুষ বিস্তৃত রথের ভিতরে নিশ্চল বসে আছেন এক মধ্যবয়সী। রত্নখচিত রেশমি পোশাক, তার উপরে অপরূপ  সূচীকার্যে গড়ে ওঠা নানান নকশায় সমৃদ্ধ মদ্রদেশীয় পশম চাদর, তাও দুধ সাদা। মাথায় ছিল গোলাপি শিরস্ত্রাণ, তা হাতে নিয়ে রথাসীন মানুষটি গম্ভীর গলায় বলল, হে উতঙ্ক, মানুষগুলি সব গেল কোথায়?

উতঙ্ক অর্থাৎ রথের চালক বলল, ভয়ে পালিয়েছে।

উতঙ্ক তুই হাঁক দে।

হাঁক দিতে হলো না। উতঙ্ক নামটি যে সবার জানা। তাহলে উতঙ্কের রথ আসছিল। মানে শ্রেষ্ঠীর রথ। অমন রুষ্ট যোদ্ধার মতো রথ উড়িয়ে এলেন শ্রেষ্ঠী সুভগ দত্ত। চোখ খুলল পরাশর। আচমকা উঠে দাঁড়াল। সে উঠে দাঁড়াতেই উতঙ্ক হা হা হাসিতে ফেটে পড়ল, প্রভু ওই যে একজন, পাথর মানুষ হয়ে গেল।

থাম। সুভগ দত্ত ভর্ৎসনা করে উতঙ্কের হাসি থামালেন। উতঙ্ক কেমন ন্যুব্জ হয়ে গেল রথে দাঁড়িয়েই। বুড়ো পরাশর রথটিকে দেখছিল। রথের মানুষদের দেখছিল। তার তো ভাবাই উচিত ছিল এ হতে পারে উতঙ্কের রথ। উতঙ্কের রথ এমনিই ছোটে। নগরের পথে যখন  বেরোয় এই রথ, পথের মানুষ দুই ধারে সরে যায়। সব কিছুকে নস্যাৎ করে ছোটে রথ। রথে নিশ্চল বসে নগরের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিটি শুধু মাত্র মস্তক সঞ্চালন করে দু’পাশ দ্যাখেন। এই রথ বিপজ্জনক তো নিশ্চয়। ভয়ের। বছর দুই আগে গাঁ-এর একটি যুবক এই রথের সামনে পড়ে ঘোড়ার পদাঘাতে, চক্রের ঘষটানিতে নুলো হয়ে গেছে। তাকে অবশ্য বণিক সুভগ দত্ত কিছু অর্থ সাহায্য করেছিলেন, তিন শত পনের মতো পেয়েছিল সেই নুলো হয়ে যাওয়া যুবক। তাকে তো আর দেখা যায় না এই পথে।

সুভগ দত্তকে রথ থেকে নামাল উতঙ্ক। রথচালক যুবকটি এক দর্শনীয় পুরুষ বটে। শ্রেষ্ঠী সুভগ দত্তর শখ মনোমত দাস সংগ্রহ করা। তার গৃহে নানা দেশ থেকে আনা দাস আছে। এই উতঙ্ক হলো উত্তর-পূর্ব দেশীয়। বালক উতঙ্ককে কত দিন আগে সেই শীতপ্রধান পাহাড়ি দেশ থেকে উজ্জয়িনীতে নিয়ে এসেছিলেন সুভগ দত্ত। তাকে খাইয়ে-দাইয়ে পুষ্ট একটি সবল মানুষ করে তুলেছেন। উতঙ্কের দিকে তাকালে কখনো বিস্ময় জাগে, কখনো ভয় তৈরি হয় মনের ভিতরে। চক্ষুদুটি ক্ষুদ্র, ভ্রু যুগল প্রায় বিলীন, গাত্র ত্বক মসৃণ, উজ্জ্বল গৌরবর্ণের, নাসিকা প্রায় মিশে গেছে মুখমণ্ডলে। ‘উতঙ্ক’ নামটি সুভগ দত্তর দেওয়া। বৈদিক ঋষি আয়োদধ্যোমর শিষ্য বেদমুনি। বেদমুনির শিষ্য উতঙ্ক। প্রভু ভক্তিতে তার জুড়ি মেলা ভার। তার কাছে নারী থেকে ধনসম্পদ সবই নিরাপদ, নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন প্রভু সুভগ দত্ত যেমন ছিলেন বেদমুনি।

রথ থেকে এগিয়ে ধীর পায়ে সরোবরের তীরে দাঁড়ালেন শ্রেষ্ঠী। বুড়ো পরাশর সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে এসে উতঙ্ককে দেখছিল। ভাবলেশহীন মুখ। নিশ্চল প্রস্তরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে সুভগ দত্তর দাস। বুড়ো পরাশর আরো সাহস সঞ্চয় করে সুভগ দত্তকে অনুসরণ করে। বিস্মিত চোখে সে দেখছিল শ্রেষ্ঠীকে। সুভগ দত্ত তার দিকে ফিরলেন, নিম্নস্বরে, জিজ্ঞেস করলেন, রত্নাকর, সাগর এমন হয়ে গেল, জল নেই! কবে হলো?

বৃদ্ধ জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যেন রত্নাকর সাগরের জলহীনতার জন্য দায়ী সে-ই। সুভগ দত্ত দক্ষিণ তীর ধরে হাঁটতে পশ্চিম-মুখী কিছুটা এগিয়ে সরোবরের পশ্চিম তীরে পা রাখলেন। তাঁকে অনুসরণ করছে বৃদ্ধ সৈনিক।  সুগভ দত্ত আবার ঘুরে তাকিয়েছেন। এই লোকটিকে তিনি চেনেন। রাজার বাহিনীতে ছিল বহুকাল আগে। এই শূদ্র পল্লীর সব যুবকই তো সেনাবাহিনীর প্রয়োজনে অস্ত্র ধরে। এই যোদ্ধারাই তো অবন্তীরাজের শক্তি। বৃদ্ধকে নিরীক্ষণ করছেন সুভগ দত্ত। নগ্নপদ, মলিন বেশ, গায়ের বস্ত্রটি বহু পুরাতন তুরগাস্তরণের ন্যায় শতছিন্ন। চোখ দুটিতে ভয়ের ভাব। জোড়হাতে দাঁড়িয়ে আছে বৃদ্ধ। সুভগ দত্ত আচমকা জিজ্ঞেস করলেন, পদ্ম কোথায়, নেই?

এ সময় তো থাকে না। বৃদ্ধের গলা ঘড়ঘড় করে, বিড়বিড়িয়ে বলে, ক্ষীর সাগরে, রাজবাড়ির গায়ে যে সরোবর সেখানে সম্বৎসর নাকি ফোটে, শুনেছি তাই।

এখানেও তো ফুটত? সুভগ দত্তর গলা উঠল।

বৃদ্ধ অবাক হয়ে শ্রেষ্ঠীকে দেখছে। নগরের শ্রেষ্ঠ ধনাঢ্য ব্যক্তির এই অকিঞ্চিৎকর জিজ্ঞাসায় সে বিব্রত। সে নিজে জানে প্রোষ্টোপদ থেকে অঘ্রান, এই ক’মাসই পদ্মের সময়, এই রত্নাকর সাগর ওই সময়েই পদ্মে পরিপূর্ণ থাকে।

সুভগ দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, পৌষ মাসে পদ্ম থাকে না?

আজ্ঞে? বৃদ্ধ হতভম্ব হয়ে কী জবাব দেবে বুঝতে পারে না। পৌষ মাসে যে পদ্ম থাকে না এ আর নতুন কথা কী? শ্রেষ্ঠীর কথায় মনে হচ্ছে এই সময়ে পদ্ম থাকা উচিত ছিল। এ কেমন কথা? শ্রেষ্ঠী কি জানেন না কখন পদ্ম ফোটে।

সুভগ দত্ত এবার নিম্নস্বরে বললেন, সাত সরোবরেই সম্বৎসর পদ্ম ফুটে থাকত এক-কালে, তা কি তুমি দ্যাখোনি?

বৃদ্ধ এবার টের পায় শ্রেষ্ঠী আসল কী বলতে চাইছেন। সে মাথা দুলিয়ে সমর্থন জানায় নীরবে। শ্রেষ্ঠী এই নগরের অনেক ক্ষমতাবান মানুষ। শ্রেষ্ঠী হলেন প্রভু। শূদ্র জাতি তাঁর দাস। তিনি তাঁদের লালন না করলেও শূদ্ররা তাঁর দাসানুদাস। প্রভু যা বলেন তা কখনো মিথ্যে হতে পারে না। প্রভুকে সমর্থন জানালে শূদ্রের মঙ্গল হবে। সম্বৎসর অন্ন আসবে ঘরে, শ্রেষ্ঠীর কৃপায় মানুষ সুখে থাকবে। তাঁর কথা মিথ্যে হতে পারে না, সুতরাং এই রত্নাকর সাগরে সম্বৎসর ফুল ফুটতই। বৃদ্ধ নিজে হয়ত  দ্যাখেনি, সে দ্যাখেনি বলে শ্রেষ্ঠীর কথা মিথ্যা হতে পারে না।

সুভগ দত্ত বললেন, কয়েক বৎসর যাবৎ দেখা যাচ্ছে পদ্ম শেষ হয়ে যাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি, সরোবর যদি পদ্মহীন হয়ে থাকে, উজ্জয়িনীর থাকল কী?

হতে পারে তা। বৃদ্ধ বলল।

তুমি জান না?

জানি প্রভু।

পদ্ম যে নেই তা তোমরা রাজাকে জানিয়েছ?

না প্রভু।

কেন পদ্ম নেই সে খোঁজ রাখো?

বৃদ্ধ আর দ্বিধা করে না, বলল, আজ্ঞে, অনেকদিন তো জল নেই, দেখুন আঁজ্ঞে।

জল নেই কেন?

আকাশে জল নেই তাই স্থলেও নেই।

এই সরোবর, উজ্জয়িনীর সপ্ত-সাগর কি আকাশের জলে পুষ্ট হয়?

বৃদ্ধ এবার নিশ্চুপ। সে তো জানে আকাশের জলেই নদী, সাগর, সরোবর সবই পুষ্ট হয়। আকাশে জল নেই তাই শিপ্রা, গন্ধবতীও কেমন শীর্ণ হয়ে গেছে। মাটি পাথর হয়ে যাচ্ছে। গো-ধূম চাষ হল না প্রায়। জোয়ার ওঠেনি। গাছাগাছালি, বন, হাওয়া সব কেমন তপ্ত হয়ে আছে। এই শীতেও পাথর কেমন তেতে যাচ্ছে মধ্য দুপুরে। বৃষ্টি হলে এমন হয় না। মাটিতে রস নেই, গাছেও নেই। ইক্ষুতে তেমন রস হলোই না এই শীতে। সে তার অভিজ্ঞতায় দেখেছে বৃষ্টিপাত স্বাভাবিক হলে পৃথিবী থাকে স্বাভাবিক। মানুষের দিন যাপনে থাকে ছন্দ।

বৃদ্ধকে নিশ্চুপ দেখে সুভগ দত্ত আবার বললেন, আমি তো কখনো এমন দেখিনি বৃষ্টি না হলে সরোবর শুকিয়ে যায়, তুমি দেখেছো?

পরাশর কী বলবে ধরতে পারছে না। তার স্মৃতিতে বেশ কয়েকবার জলহীন সরোবর আছে। আবার বৃষ্টি হয়েছে, সরোবর পরিপূর্ণ হয়েছে। কিন্তু শ্রেষ্ঠী বলছেন অন্য কথা। কোমরে ঝোলান রেশম পেটিকা নাচান সুভগ দত্ত, স্বর্ণমুদ্রার শব্দ চেনে পরাশর। শিহরিত হয়। শ্রেষ্ঠী আবার কোমরে ঝোলালেন তাঁর পেটিকা। গ্রামবৃদ্ধ পরাশর বলে আজ্ঞে, এমন দেখিনি কখনো।

সম্বৎসর পদ্ম ফুটে থাকত বলেই তো এই নগর কুমুদবতী, কুমুদ হলো পদ্ম, চাঁদ।

হ্যাঁ আজ্ঞে।

এমনকি কখনো হতো যে এই কুমুদবতী নগর কুমুদশূন্য?

একই প্রশ্ন। হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে বুড়ো। এখন সে মাথা তুলে দেখছে শ্রেষ্ঠীকে। মাথা দোলাচ্ছে। সুভগ দত্তর ঠোঁটের কোণে আবছা হাসি জেগে ওঠে। হাসি লুকিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন চোখে আকাশে তাকান, আকাশ থেকে সরোবরের দিকে। মাথা নাড়াতে থাকেন। চিন্তামগ্ন হয়ে বুড়োর দিকে তাকান, কী হবে বলো দেখি?

পরাশর নিশ্চুপ। সুভগ দত্ত দেখছেন তাঁর রথের ধারে কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে। রথকে ঘুরে ঘুরে দেখছে। তারপর কী মনে করে তারা সরোবরের দিকে রওনা হলো। সারিবদ্ধভাবে পরপর আসছে সরোবরের দিকে। ওরা আছে সরোবরের দক্ষিণ দিকে।  পশ্চিম তীরে দাঁড়ানো শ্রেষ্ঠীর কাছে সরাসরি না এসে দক্ষিণ থেকে পূর্ব তীরের দিকে রওনা হলো। সরোবরটিকে প্রদক্ষিণ করেই ওরা যেন শ্রেষ্ঠীর কাছে পৌঁছবে। সুভগ দত্ত অবাক হয়ে দেখছেন দীর্ঘকায়, খর্বকায়, শীর্ণ, স্থুলকায়, নানারকমের নানা বয়সের মানুষগুলি ধীরে ধীরে  প্রদক্ষিণ করছে জলহীন রত্নাকর সাগর।

সুভগ দত্ত তাকালেন বৃদ্ধের দিকে, সরোবর যে জলহীন, এ কি মঙ্গলচিহ্ন?

না আঁজ্ঞে।

আকাশ যে জলহীন, তাও কি মঙ্গল চিহ্ন?

না আঁজ্ঞে।

পৌষেই এই অবস্থা, সামনে ভয়ঙ্কর গ্রীষ্ম!

হ্যাঁ, আঁজ্ঞে।

এবার কি বসন্ত আসবে?

হ্যাঁ আজ্ঞে।

সুভগ দত্ত চিন্তাকূল হয়ে বললেন, শীতের পর বসন্তই আসে, এতদিনে তার নানা চিহ্ন ফুটে ওঠে, দেখতে পাচ্ছো কি তা?

বৃদ্ধ বিড়বিড় করে, আমার চেয়ে আপনিই বেশি বোঝেন প্রভু।

সুভগ দত্ত পায়চারি করছেন, এবার বসন্ত আসবে না, শীতের পরই গ্রীষ্ম।

কী ভীষণ হবে তা! বৃদ্ধের মুখে ভয়ের চিহ্ন ফোটে।

এমন কি কখনো হয়েছে সরোবর জলহীন, বৃষ্টি নেই, অবন্তী দেশ নিরন্তর পুড়ছে।

বৃদ্ধ মাথা নাড়ে, না প্রভু।

মানুষগুলির সরোবর প্রদক্ষিণ শেষ। সুভগ দত্তর সামনে এসে ধীরে ধীরে সকলে দাঁড়িয়ে যায় মাথা নীচু করে। সুভগ দত্ত বললেন, তোমরা দেখেছ?

কী! সকলে মাথা তুলল এক সঙ্গে।

অবন্তী দেশ থেকে বরুণদেব চলে গেছেন।

না প্রভু। সকলে চিৎকার করে ওঠে।

আর অবন্তীতে বৃষ্টি হবে না, সরোবর জলহীন, আকাশও তাই, তোমরা কি জানো মাথার আকাশ হলো আর এক সাগর, কত জল সেখানে জলভরা মেঘে!

হ্যাঁ প্রভু।

তোমরা এই স্বর্ণমুদ্রার পেটিকা নাও, কিন্তু সরোবর যে মড়ার মতো পড়ে আছে, এর কী উপায়?

বৃষ্টি চাই। সকলে সমস্বরে বলে ওঠে।

বৃষ্টি আর হবে না। বলতে বলতে সুভগ দত্ত স্বর্ণমুদ্রার পেটিকা বুড়ো পরাশরের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, অবন্তী দেশের জন্য তোমরা কতবার যুদ্ধ করেছ, তোমাদের দিলাম, কিন্তু সম্বৎসর যে সরোবরে পদ্ম থাকত, তা কেন থাকে না সেই খোঁজটি করো, কেন মেঘ নেই কেন বসন্ত আসবে না...। বলতে বলতে সুভগ দত্ত রথের দিকে ফিরতে লাগলেন। ফিরতে ফিরতে শুনলেন শূদ্রকূল তাঁর জয়ধ্বনি করছে। শুধু বৃদ্ধ সৈনিকটি অবাক হয়ে শ্রেষ্ঠীকে দেখতে লাগল। তিনি রথের দিকে হাঁটছেন। তিনি যা বলে গেলেন তার কোনোটাই হয়ত সত্যি নয়, কিন্তু প্রভু কি মিথ্যে বলেন? বৃদ্ধ এবার সরোবরের ভিতর কর্দমাক্ত জলে নেমে যেতে থাকে। আশ্চর্য! সে তো কখনোই দ্যাখেনি সম্বৎসর এই সরোবরে পদ্ম থাকত, অথচ শ্রেষ্ঠী বলে গেলেন। বলে গেলেন যখন তা সত্যিই। তিনি মিথ্যা বলেন না, মিথ্যায় ভয় পায় বুড়ো পরাশরও। মিথ্যার শাস্তি অনেক। শেষ জীবনটুকু নিশ্চিন্তে কাটাতে চায় সে। বিড়বিড় করতে থাকে পরাশর, ভাদ্র থেকে শ্রাবণ, বারো মাসেই পদ্ম ফুটে থাকত এখানে, শ্রেষ্ঠীর কথা মিথ্যে হতে পারে না।

চলবে

 

ধ্রুবপুত্র (পর্ব এক)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দুই)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তিন)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পাঁচ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ছয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সাত)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব আট)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব নয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব এগার)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top