সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব উনিশ) : কাজী মাহমুদুর রহমান


প্রকাশিত:
৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৮:৫৪

আপডেট:
৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৯:১৭

 

অনেক পরে জেনেছিলাম, জুলিয়াঁ বিয়ে করেছে তার দেশি এক যুবকের সাথে। সে যুবকটি চিত্রকর নয়, একজন ফ্রিলান্সার ফটোগ্রাফার। বিভিন্ন বিনোদনমূলক পত্র-পত্রিকার ফটো জার্নালিস্ট হিসাবে সুপরিচিত।
আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তাকে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছিলাম। জুলিয়াঁ আমার সে অভিনন্দনবার্তারও প্রত্যুত্তর দেয়নি। জানি না সেটা তার রাগ না অভিমান!

[নাজনিনের বাসায় বর্তমান দিনকাল]

রাতটায় অদৃশ্য আততায়ীর মতো নির্ঘুমের কালো বিড়ালগুলি প্রায়ই হানা দেয়। আমাকে ঘুমোতে দেয় না। আমি ঘুমের ওষুধ একটার বদলে দুটো তিনটে খাই। তবুও ঘুমটা সহজে আসে না। শুয়ে শুয়ে বই পড়ি, কখনো বেহালা বাজাই, কখনো পিয়ানোতে স্মৃতি থেকে পুরোনো গানের সুর তুলতে চেষ্টা করি। আজও মধ্যরাতে পিয়ানোর সামনে বসে সাদা-কালো রিড টিপছিলাম একটা গানের সুর স্মৃতি থেকে স্মরণে আনতে, ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না ...’। রবীন্দ্রনাথের এই কথাগুলো আমার জীবনের সাথে অদ্ভুতভাবে মিলে যায়। কথা মিলে যায়, কিন্তু সুর মেলে না। বারবার ভুল হয়ে যায়।
এর মধ্যেই আমার ঘরের ভেজানো দরজায় করাঘাত, নাজুর উদ্বেগ, ব্যাকুল কণ্ঠ, বড়দা তুমি কি জেগে?
আমি বললাম, হ্যারে জেগে। শুনছিস না আমি পিয়ানো বাজাচ্ছি? কিছু বলবি? আয় ভেতরে আয়।
নাজু এবং রাজিব দুজনেই আমার ঘরে প্রবেশ করল। দুজনেরই উদভ্রান্ত চেহারা।
আমার বিস্মিত প্রশ্ন, কীরে কী হয়েছে?
নাজু কান্না কান্না কণ্ঠে বলল, বড়দা, লিসার দেবর আরমান এইমাত্র টেলিফোন করেছিল লিসা আর ওর হাজব্যান্ড ইমরান দুজনেই নাকি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ... ও আল্লাহ। দে ওয়ানটেড টু কমিট সুইসাইড। ওদের দুজনকেই অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। স্টমাক ওয়াশ করার চেষ্টা চলছে, ডাক্তাররা আপ্রাণ চেষ্টা করছে। বড়দা আমি জানি না ওদের কী হবে? বড়দা আমরা হাসপাতালে যাচ্ছি। প্লিজ তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আমরা যাই।
বলে নাজু আর রাজিব প্রায় ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল হাসপাতালের উদ্দেশে।
ওরা চলে যাবার পর আমি কতক্ষণ যে স্থানুর মতো বসেছিলাম জানি না। আমার ভেতরেও নিস্যন্দ যন্ত্রনা। আমি হতভাগ্য ইমরানকে দেখিনি। কিন্তু লিসার যন্ত্রণা ও কান্নার ভেতর থেকে সেই অক্ষম, যন্ত্রণাবিদ্ধ মানুষটাকে অনুভব করতে পেরেছি। আর লিসা তার দুঃখ ভুলতে কত আশা করে আমার কাছে এসেছিল তার একটা তৈলচিত্র এঁকে দেবার অনুরোধ নিয়ে। কিন্তু আমি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি। সেই রূপবতী নারী এখন মোনালিসা নয়- সে এখন একটা স্বপ্নহীন সময়ের বীভৎস বিমূর্ত চিত্র।

ভোরবেলাতেই ফিরে এল নাজু আর রাজিব। আমি বাগানে অস্থিরভাবে পায়চারি করছিলাম। গাড়ি থেকে নেমে নাজু আমার কাছে প্রায় ছুটে এল। চেহারায় রাতজাগা ক্লান্তির ছাপ। আমি কিছু প্রশ্ন করার আগেই বলল, স্টমাক ওয়াশ করা হয়েছে বটে কিন্তু দুজনেই অচেতন। জীবন রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। বাঁচবে কি মরবে তা আল্লাহ জানেন।
নাজু আর রাজিব স্বল্প সময়ের জন্যে বাসায় এসেছে প্রাতঃকৃত সম্পন্নের জন্যে। রাকা আর পাশাকে আজ স্কুলে না পাঠাতে। প্রাতঃকৃত সম্পন্ন শেষে পোশাক পাল্টে কোনোক্রমে চা-বিস্কুট মুখে দিয়ে আবার চলে গেল হাসপাতালে। ওদের ব্যস্ততার ফাঁকে চায়ের টেবিলে বসে লিসা আর ইমরানের আত্মহত্যা প্রচেষ্টার যে অদ্ভুত টুুকরো টুকরো ঘটনা শুনলাম মনে হল এ যেন একটা মহাকাব্যের বেদনাময় শেষ দৃশ্য।
শোনা টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো আমি সাজালাম আমার মতো।
পাঁচ বছর আগে সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর থেকেই লিসা আর তার স্বামী ইমরানের বেশিরভাগ সময় কেটেছে দেশ আর বিদেশের বিভিন্ন অর্থোপেডিক্স আর সাইক্রিয়াটিক ক্লিনিকে কিংবা হসপিটালে। যখন কিছুটা সুস্থ হয়েছে, শরীর কিছুটা কর্মক্ষম হয়েছে তারা দুজনেই চেষ্টা করেছে পরষ্পরের দু:খ-শোকের অংশীদার হতে, একত্রে একই ঘরে, একই শয্যায় জীবন যাপন করতে। কিন্তু দেহের ভাঙা হাড় জোড়া লাগলেও তাদের মন আর জোড়া লাগেনি। একমাত্র কিশোরপুত্র ফয়সালকে হারানোর রক্তাপ্লুত যন্ত্রণা, তাদের হৃদয়,তাদের সম্পর্কের হাড়-পাঁজর ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। শরীরের সব আগুন, সব রতিবাসনা নিভে গেছে। আস্তে আস্তে তারা সরে গেছে পরষ্পরের মন থেকে, শয্যা থেকে, ঘর থেকে। গুলশানের বিশাল বাড়িটার দুপ্রান্তের দুটি ঘরে তাদের নিঃসঙ্গ রাত্রি যাপন, জীবন যাপন। শুধু সকাল বেলাটায় একটা ছোট্ট ডাইনিং রুমে ব্রেকফাস্ট টেবিলে তাদের দেখা হয়। এটাই তাদের পরষ্পরকে দেখার, টুকটাক দু’একটা কথা বলার সংযোগ সেতু।
ইমরান আগে হুইল চেয়ারে চলাফেরা করত। দেশে বিদেশে নানা চিকিৎসা আর নিয়মিত ফিজিওথেরাপির পর এখন আর হুইল চেয়ার নয়, একটা ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটা চলা করে। তার কোমরসন্ধিতে আর মেরুদ-ে আরো কিছু অস্ত্রোপচার প্রয়োজন যা অত্যন্ত জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ। ইমরান সেই ঝুঁকিতে যায়নি। লিসার সঙ্গে তার দাম্পত্য জীবনের অক্ষমতা নিয়ে তার কষ্ট যতটা নয়-তার চেয়ে বেশি কষ্ট একমাত্র পুত্র ফয়সালের অকাল মৃত্যু। এই বিশাল বাড়ি এখন যেন প্রেতপুরি। ফয়সালের জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি বারোটি বছর তার হাসি-কান্না, দুষ্টুমির সব স্মৃতি বুকে ধারণ করে একটি পুরুষ, একটি নারী দুটি নিষ্প্রাণ পাথর খ-ের মতো রোজ সকালে ডাইনিং টেবিলের দুপ্রান্তে দুজন বসে থাকে। কখনো দু এক টুকরো রুটি বা ফল মুখে দেয়। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে টুকটাক দু একটা কথা হয়।
- তুমি আজ কেমন আছো?
- ভালো।
- রাত্রের ঘুম হয়েছিল?
- বুঝি না।
- ঘুমের ওষুধ খাও?
- খাই। মাঝে মধ্যে।
- তোমার ঘুম হয়?
- বুঝি না। জাগতে জাগতে ঘুমোই অথবা ঘুমের মধ্যে জেগে থাকি।
- আমিও তাই।
- যদি মন চায় তাহলে কোথাও যাও। সুইজারল্যান্ড, হাওয়াই কিংবা আন্দামান-এনি হয়ার, এনি প্লেস?
- না। আমরা তো আন্দামনেই আছি। আগের আন্দামনে নয়, সাজানো গুছানো একটা প্রাণহীন আন্দামানে।
- আমি শুধু এখন ফয়সালের কাছে যাবার অপেক্ষায়। ও বড় একলা পড়ে আছে।

ইমরান চায়ের কাপটাতে শেষ চুমুক দিয়ে বলে, হ্যাঁ ও বড় একলা পড়ে আছে। ওর একজন সঙ্গী দরকার। উঠি। কাল সকালে আশা করি দেখা হবে আমাদের।
বলে আস্তে আস্তে উঠে ক্রাচটাতে ভর দিয়ে বিষন্ন নিঃসঙ্গ মানুষটা চলে যায়।
লিসা একাই বসে থাকে ডাইনিং টেবিলের প্রান্তে। সে তাকিয়ে থাকে দেয়ালের দিকে স্মৃতিখ-ের মতো ঝুলে থাকা একটা ছবির দিকে-যে ছবিতে পাঁচ বছর বয়সী ফয়সাল খুব দুষ্টুমি আর আনন্দের ভঙ্গিতে একটা লাল আপেলে কামড় দিচ্ছে। ছবিটা ইমরান তার মোবাইলের ক্যামেরায় চট করে তুলেছিল আর তা পরে বিশালাকারে বড় ও বাঁধাই করে ডাইনিং রুমের এই দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছিল। লিসার দুচোখে এখন আর পানি নেই। সেখানে শুধু সাহারার মতো পোড়া শূন্যতা। লিসা ফিস ফিস করে ফয়সালকে যেন জিজ্ঞেস করে, সোনাবাবু, বেটা, তুই যেখানে আছিস সেখানে কি আপেল, আঙুর আছে? ক্যাডবেরি, চকলেট বার যা তুই ভীষণ ভালোবাসতিস? আমি যখন তোর কাছে আসব সব নিয়ে আসব ... সব।
রাত প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। লিসা শিশুপুত্র ফয়সালকে নিয়ে বিছানায় ঘুম পাড়াচ্ছে এমন একটা ছবির সামনে বসে ফয়সালের প্রিয় গিটারটা নিয়ে টুংটাং করে বাজায় আর মৃদুস্বরে ঘুমপাড়ানি গান গায়।
গানের মধ্যেই ইন্টারকম বেজে উঠল। গিটার রেখে লিসা ফোনসেটের বাটন অন করল। বলল, বলো। অন্যপ্রান্ত থেকে ইমরানের কণ্ঠ, আমি কি আসতে পারি তোমার রুমে?
হঠাৎ! কেন?
খুব ইচ্ছে হচ্ছে কফি খেতে খেতে তোমার সঙ্গে দু একটা বিশেষ কথা বলি। আমি বেশি সময় নেব না বা তুমি বিরক্ত হবে এমন কোনো কথাও বলব না। তুমি কি অনুমতি দেবে আমাকে আসতে?
অনেক কাল ধরেই রাত্রে ইমরান লিসার ঘরে আসে না। আজ হঠাৎ করে ইমরানের এই অনুরোধ কেন? লিসা আশ্চর্য হলেও বলল, এসো।
ইমরান যেন স্বস্তির স্বরে বলল, ধন্যবাদ। আমরা কফি খেতে খেতে কথা বলব। আমি আমার কফি মগ নিয়ে আসছি। তুমি তোমার কফিটা বানিয়ে নাও। দুজনে এক সাথেই খাব।
লিসা গিটারটা রেখে অটো কফি মগে নিজের কফিটা তৈরি করল। একটু পরেই ইমরান তার এক হাতে কফি মগ অন্য হাতে ক্রাচে ভর দিয়ে লিসার কক্ষে প্রবেশ করল। ওর মুখ ভাব বেশ আনন্দ উজ্জ্বল। ইমরান চেয়ারে বসল না। ক্রাচটা দূরে সরিয়ে রেখে লিসাকে অবাক করে দিয়েই লিসার বিছানায় বসে পড়ল। লিসাও বসল বিছানার অন্যপ্রান্তে কিছু দূরত্ব রেখে। সে অবাক দৃষ্টিতে ইমরানকে লক্ষ করতে থাকল। ইমরান কিছুটা হাসি হাসি মুখে লিসার দিকে নিজের কফি মগ বাড়িয়ে দিল যেমন পানপাত্র ঠোকাঠুকি করে কোনো পানোৎসবের শুরুতে। বলল, চিয়ার্স।
লিসা ইমরানের মগের সাথে নিজের মগ ঠোকাঠুকি করল না। ভ্রু ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল, কফি পানে ঘটা করে চিয়ার্স কেন?
ইমরানের মুখে তেমনি হাসিটাই অম্লান। বলল, আজ ছিল আমাদের সতেরোতম বিবাহ বার্ষিকী।
লিসার নিরুত্তাপ কণ্ঠ, তা হবে হয়তো। আমার কিছুই মনে নেই।
ইমরান শান্ত কণ্ঠেই বলল, হ্যাঁ আমারও মনে থাকে না কবে আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল, কথা হয়েছিল, বৃষ্টিতে ভেজা হয়েছিল, ভালোবাসা হয়েছিল, সমুদ্রে সাঁতার কাটা হয়েছিল, সমুদ্রের সন্ধ্যার বেলাভূমিতে হাত ধরাধরি করে হাঁটতে হাঁটতে জীবনে কত স্বপ্নের কথা বলাবলি হয়েছিল। সেই স্বপ্নের বিয়েটা আজকের রাতটাতেই হয়েছিল ... একটা বছর পর আমাদের বুক জুড়ে ফয়সাল এসেছিল, তার হাসি, আনন্দে আমাদের ঘর বাড়ি জীবনের প্রতিটা দিন কেমন করে যে ভরে তুলেছিল কিছুই আর এখন মনে পড়ে না। ওর মৃত্যুটাই আমাদের জীবন থেকে সব দিন, তারিখ, স্মৃতি সবকিছুই মুছে দিয়েছে।
এই আক্ষেপ আর যন্ত্রণার কথা তো লিসারও। বুকের ভেতর অবিরাম রোদনধ্বনি তীক্ষ্মধার করাতের মতো হৃদপি- কুচিকুচি করে কাটে, হাড়-পাঁজর পুড়িয়ে দেয়। ইমরানের এইসব স্মৃতিকথার পুনারাবৃত্তিতে লিসার তো নতুন করে কিছু বলার নেই। গত পাঁচ বছর ধরে ইমরান সেইসব ভালোবাসার দিন যা তাদের বিয়েবার্ষিক নিয়ে একটি কথাও উচ্চারণ করেনি, উদযাপনও করেনি। আজ হঠাৎ ওর এমন কী হল যে কফির মগ হাতে বিয়ের রাতটির কথা ঘটা করে বলতে এসেছে?
কফি মগে চুমুক দিতে দিতে ইমরান বলল, লিসা, তুমিতো কফির মগে একবারও চুমুক দাওনি? আমার কফি তো প্রায় শেষ হয়ে এল।
লিসা বলল, আমি রাত্রে ঘুমোবার আগে কফি খাই না। তবুও তুমি যখন বলছ আমি পান করব ফর দ্য সেক অব আওয়ার ওল্ড মেমোরি, চিয়ার্স ফর ইউ।
বলে লিসা তার কফি মগে একটা ছোট্ট চুমুক দিল।
ইমরান মৃদু হেসে বলল, থ্যাংক ইউ লিসা।
লিসা বলল, তোমার কি আরো কিছু বলার আছে?
ইমরান বলল, হ্যাঁ আছে একটা সবশেষ কথা, একটা অসাধারণ স্বপ্নের কথা। কাল রাতে আমি একটা চমৎকার স্বপ্ন দেখেছি। একটা জোছনা আলোকিত নীল জল নদীর ও প্রান্তে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে ফয়সাল আমাকে ডাকছে, বাবা, তুমি কি সাঁতার জানো না? এত দেরি করছ কেন? শিগগির এই নদীটা সাঁতরে আমার কাছে চলে আসো। এপারে কী চমৎকার সব পাহাড়, পর্বত, সবুজ উপত্যকা, কত যে গোলাপ, চেরি ফুল ..., কত যে রঙিন পাখিদের উড়োউড়ি ..., সাদা সাদা মেঘগুলোও ফুলের মতো, নরম তুলোর মতো ... হাতের মুঠি ভরে নিয়ে ছোঁড়াছুড়ি খেলা করা যায়। বাবা আমি একা একা কত খেলব? বাবা তুমি এসো। আমরা দুজনে পাল্লা দিয়ে মাঠে দৌঁড়াব, নদী জলে সাঁতার কাটব ..., রূপোলি ঝর্ণার প্রবল জলোধারার গান শুনব ... আমরা ফায়ার ক্যাম্পের আগুন ঘিরে ঘিরে নাচব, গাইব ... তারপর ঘুমিয়ে যাব ... বাবা, তুমি এসো ...। লিসা, ফয়সাল আমাকে ডাকছে, আমি ওর কাছে যাচ্ছি। যাবার আগে আমি শুধু পুরোনো ভালোবাসার স্মৃতিতে তোমার কোলে মাথা রেখে গভীর ঘুমের মধ্যে ফয়সালের কাছে চলে যেতে চাই।
লিসা ওর এইসব কাব্যিক কথায় চিৎকার করে উঠল, কী যা তা বলছ তুমি? আজ তুমি কী পরিমাণ মদ গিলেছ?
ইমরান হেসে উঠল। হাতের কফি মগটা দুলিয়ে বলল, মদ নয় হে আমার প্রিয় মোনালিসা। আমি কফি পান করেছি।
আমার পানপাত্রে হেমলকের বিষ। কফির সঙ্গে আশিটা ঘুমের ওষুধ। আমার পান শেষ। এখন আমার ফয়সালের কাছে যাবার সময়।
লিসা ভয়াবহ আতঙ্কে ইমরানের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কেঁদে উঠল আর্ত চিৎকারে , ইমু তুমি এ কী করলে? বলো, এ সত্যি নয়, এ মিথ্যে ... ইমু, প্লিজ চোখ খুলে তাকাও আমার দিকে ... ইমু?
ইমরান এখন কিছুটা চেতনা-অচেতনার সন্ধিক্ষণে। ঘোলাটে চোখে লিসার দিকে তাকাল। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা। আনন্দ জড়িত কণ্ঠে বলল, কতকাল পরে যেন তোমার স্পর্শ পেলাম। মনে হচ্ছে পুরোনো হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসাটা আবার ফিরে পেলাম। সেই কবিতার কথার মতো, সেই কবেকার হারানো প্রিয় পুরাতন উষ্ণ চাদরের মতো...। ফয়সালকে বলব, সোনা বাবু, আমি একটা শূন্য হাতে আসিনি। এই দ্যাখ আমার বুক ভর্তি তোর মায়ের ভালোবাসাকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছি।
লিসা ইমরানের মাথাটা বুকের ভেতর প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে হাহাকার করে কেঁদে উঠল, উন্মাদিনীর মতো চিৎকার করে বলে উঠল, তুমি একাই যাবে আমার সোনা বাবুর কাছে আমাকে একলা ফেলে? নো, নেভার। ফয়সাল আমার সন্তান। ওকে আমি নয় মাস পেটে ধরেছি। ওকে এই পৃথিবীর আলো বাতাস দেখিয়েছি। ওকে নিয়ে কত ঘুমপাড়ানি গান গেয়েছি। ও আমাকে ছেড়ে এক মুহূর্তও থাকেনি। স্বপ্নের ভেতর ফয়সাল তোমাকে ডাকল বলেই তুমি একাই রওনা দিয়ে দিলে? তুমি ফয়সালের কাছে একা কিছুতেই যেতে পারবে না। আমিও যাব, আমিও যেতে জানি।

চিৎকার করে কথাগুলো বলতে বলতে অর্দ্ধচেতন ইমরানকে বিছানায় ফেলেই ও তার অস্থির কাঁপা-কাঁপা হাতে বেড সাইডের টেবিলের দেরাজ হাতড়ে একগাদা ওষুধ বের করল। হাতড়ে হাতড়ে যে কয় পাতা ঘুমের ওষুধ পেল তার সবগুলো গ্লাসে রাখা পানি দিয়ে ঢক ঢক করে গিলে ফেলল। বলল, ইমু, তুমি কি শুনতে পাচ্ছ আমার কথা? আমিও যাচ্ছি তোমার সঙ্গেই-আমাদের সোনা বাবুর কাছে। ঐ যে একটা নদীর কথা বললে না ... ওটা সাঁতরে পাড়ি দেব দুজনেই ...। বলতে বলতে সে মোবাইলে কল দিল ইমরানের ছোট ভাই আরমানকে। হ্যালো, আরমান তোমার ভাইয়া আর আমি দুজনেই যাচ্ছি আমাদের বাবু সোনা ফয়সালের কাছে। চমকে উঠো না। তোমার ভাইয়া বোধহয় একগাদা ঘুমের বড়ি কফির সাথে মিশিয়ে আমার সামনেই হাসতে হাসতে ... না আমি বুঝিনি ... কিচ্ছু জানি না। আরমান, ছোট্ট ভাইটি আমার, আমি তো ওকে ছেড়ে একা থাকতে পারব না। বাপ বেটায় মিলে দুজনে ওপারে মজা মারবে আর আমি এই পৃথিবীতে একলা পাখির মতো শোক গান গাইতে থাকব এ তো হতে পারে না? ... আমি ক’টা খেয়েছি? তা জেনে তোমার কী লাভ? যতগুলোই খাই না কেন মরলেই তো হল। আরমান আমরা দুজনেই এখন একই শয্যায় ... শেষ যাত্রায় ... বাই, আরমান, বাই ...
মোবাইল ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে লিসা অচেতন ইমরানের ঠোঁটে গভীর চুমু দিল। তারপর ইমরানের মাথাটা প্রথম যৌবনের ভালোবাসার মতো নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে শুয়ে থাকল শয্যায়, অনন্ত ঘুমের প্রতীক্ষায়্ ঘুম না আসা পর্যন্ত সে গুন গুন করে গাইতে থাকল, স্লিপ বেবি স্লিপ ... দাই ফাদার ওয়াচেস দ্য শিপ ... দাই মাদার ইজ শেকিং দ্য ড্রিমল্যান্ড ট্রি ... স্লিপ বেবি স্লিপ ...।
‘যেতে আমি দিব না তোমায়।
তবুও সময় হল শেষ, তবু হায়
যেতে দিতে হয়।’
ডাক্তারদের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও ইমরান আর লিসা চলে গেল সেই নীলঘন নদীর ওপারে তাদের বাবু সোনা ফয়সালের সঙ্গে খেলতে।
“কী গভীর দুঃখে মগ্ন সমস্ত আকাশ,
সমস্ত পৃথিবী। চলিতেছে যতদূর
শুনিতেছি এক মর্মান্তিক সুর ...
‘যেতে আমি দেব না।’
এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত ছেয়ে
সবচেয়ে পুরাতন কথা, সবচেয়ে
গভীর ক্রন্দন যেতে নাহি দিব। হায়,
তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।”

আমি বিকেলের পড়ন্ত আলোর বারান্দায় একা বসে থাকি। ভাবি, লিসা আর ইমরানের এইভাবে চলে যাওয়াটা কি শুধুই পুত্রশোক থেকে নাকি দুজনের মধ্যে পাঁচটি বছর ধরে যে গভীর ফাটল তৈরি হয়েছিল সেই ফাটলের অন্ধকার থেকে মুক্তি পাবার জন্যেই ওরা এভাবে অভিমানে চলে গেল? আবার ভাবি, আচ্ছা এমনটাও তো হতে পারত, হাসপাতালে শেষ মুহূর্তে ওরা অলৌকিকভাবে বেঁচে উঠল। দুজন দুজনকেই জীবিত দেখে আনন্দে কেঁদে উঠল যেন সদ্যোজাত শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পরেই কেঁদে ওঠে! মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা সদ্যোজাত শিশুর মতো দুটি নরনারী ঠিক তেমনি কান্নায় একে অপরের বুকের মধ্যে পরমানন্দে আবদ্ধ। এখন আর ওদের মধ্যে দূরত্ব নেই, অভিমান নেই। ওরা এখন বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষায় পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে শুয়ে থাকে, জেগে থাকে, ভালোবাসার কথা বলতে বলতে, শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যায়। কেউ কাউকে চোখের আড়াল হতে দেয় না। কিন্তু বাস্তব জীবন চিত্র তো চলচ্চিত্রের কল্পিত চিত্রনাট্য নয় যে নাট্যকার ঈশ্বরের মতোই ইচ্ছে করলেই ঘটনার মোড় ঘুরিড়ে দেবেন, দর্শকদের চমকে দেবেন নায়ক-নায়িকার অভাবিত মিলনে, তারপর দর্শকদের হাততালিতে মুখরিত হয়ে উঠবে সমস্ত প্রেক্ষাগৃহ।
লিসা আর ইমরানের এভাবে চলে যাওয়াটা ছিল তাদের নিয়তি, তাদের অনেক দিনের সুপ্ত ইচ্ছের পরিণতি। সেই জন্যেই ওদের পুত্র ফয়সাল ওদের চেতন, অবচেতন মনে স্বপ্নের মতন বারবার এসেছে, ডাক দিয়েছে, কাম অন পাপা, কাম অন মম, ক্রস দ্য ব্লুরিভার, কাম টু মি। আ অ্যাম অ্যালোন হিয়ার, কাম টু মি।
সেই ডাকে ওরা শেষ পর্যন্ত চলে গেছে।
আমি বারান্দায় বসে থাকা অবস্থাতেই নাজু আমার সামনে এসে বসে। লিসা আর ইমরানের এই স্বাপ্নিক মৃত্যু সে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি, সহ্য করতে পারেনি। গত সাতদিন ধরে তার শুধু কান্না-কেন ওরা এভাবে চলে গেল? কাঁদতে কাঁদতে ওর চোখ দুটো এখনও ফোলা।
রাশা আর পাশা প্রাচীর বেষ্টিত ছোট্ট সবুজ মাঠটায় ক্রিকেট খেলছে। পালাক্রমে একজন বল করছে, আর একজন ব্যাটিং করছে। ওদের গৃহকর্মী বালক আবুল মাঠ দৌড়ে দৌড়ে বল কুড়িয়ে আনাতে ব্যস্ত। আমি আর নাজু ওদের খেলা দেখতে থাকি, ওদের চিৎকার শুনতে থাকি। আউট, নট আউটের তর্ক-বিতর্ক শুনতে থাকি।
নাজু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, বড়দা, আমি যদি মরে যাই আমার রাশা, পাশার কী হবে? ওরা কি আমার শোকে কাঁদবে?
আমি নিষ্করুণ কণ্ঠে বলি, না কাঁদবে না। ওদের এখন কাঁদার সময় নয়। আনন্দের সময়।
নাজু বিস্মিত কণ্ঠে বলে, একী বলছ বড়দা?
- বলছি কারণ, সারাক্ষণ এই মরা-মরা চিন্তা আমার ভালো লাগে না। তুই যদি মরতেই চাস তাহলে মরার আগে রাশা, পাশার এই খেলার মাঠটা বড় করে দিয়ে যা।
- তাতে কী হবে? জীবনটা যে বড় ছোট।
- জীবন যত ছোটই হোক ওদের জীবনের চারদিকে নিরাপত্তার নামে তোদের যত নিয়ম, শাসনের দেয়াল তুলে রেখেছিস সেই দেয়াল ভেঙে ওদের মাঠ আরো বড় করে দে। লেট দেম এনজয় দেয়ার চাইল্ডহুড, দেয়ার লাইফ। গিভ দেম সাম লিবার্টি। বিপুল আনন্দে বাঁচতে দে ওদের জীবনের খোলা মাঠে।
পাশা এখন বল করছে। রাশা ব্যাটিং এ। পাশা সজোরে একটা বল ছুঁড়ে দেয় উইকেট লক্ষ্য করে। রাশা এগিয়ে আরো জোরে সে বলে ব্যাট হাকায়। উড়ন্ত বল ছুটে এসে বাড়ির জানালায় আছড়ে পড়ে। জানালার কাচ ভাঙার ঝনঝন শব্দ হয়।
রাশা, পাশা দুজনেই ভীত দৃষ্টিতে বারান্দায় বসে থাকা আমাদের দুজনের দিকে তাকায়। নাজু উঠে দাঁড়িয়ে ওদেরকে কিছু বলবার উপক্রম করতেই আমি বাধা দেই। ওদের উদ্দেশে চিৎকার করে বলি, নো প্রবলেম, নো ফিয়ার মাই ডিয়ার ফ্রেন্ডস। বন্ধ জানালার কাচ যত ভাঙে ভাঙুক। ছক্কা চাই, আরো ছক্কা।
লিসা আর ইমরানের অভাবিত আত্মহননের পর একটা বিষন্ন সময়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে নাজনিন আর রাজিব। আমিও সেই বিষন্ন জ্বরে আক্রান্ত। আমি একা ঘরে শুয়ে থাকি, বসে থাকি, বই পড়ি, গান শুনি, কখনো পায়চারি করি ঘর বারান্দায় অথবা বাগানে। আমার দেখ-ভাল নাজু ঠিক আগের মতো করতে পারছে না। অবশ্য নার্স লতিফা সর্ব সময়েই আমার সেবা যতেœ তৎপর। আমাকে সঙ্গ দিতে না পারার অপরাধবোধেই নাজু কিছু আর্ট খাতা আর আর্ট পেন্সিল কিনে এনে দিয়েছে। বলেছে,. স্যরি বড়দা, তোমাকে আমরা তেমন একটা সঙ্গ দিতে পারছি না। তোমাকে একা একা সময় কাটাতে হচ্ছে। এই আর্ট খাতা, পেন্সিল রইল। রাশা,পাশার জন্যে যা ইচ্ছে তা-ই এঁকে দিয়ো। ওরা ভীষণ খুশি হবে।

হ্যাঁ, এখন এই স্কেচ করেই আমার সময় কাটছে নানা রকম মজার কার্টুন আঁকা-আঁকি করে। রাশা, পাশা দারুণ কৌতূহল নিয়ে সেই ছবি আঁকা দেখছে, ভারি মজা পাচ্ছে ওরা। মধুর লোভে যেমন মাছি আসে তেমনি রাশা, পাশা প্রায়ই উড়ে উড়ে আসছে আমার ঘরে, আমার কাছে। আমার একঘেয়েমী কিছুটা কাটছে ওদের সঙ্গ আর হাসি-খুশিতে।
আজ সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে নাজু বলল,
- বড়দা, আমি একটু বাইরে যাব। জয়ী-হাসান রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার নামে আমার যে একটা প্রতিষ্ঠান আছে ওখানে বেশ কিছু জরুরি কাজ জমে আছে। ওগুলো ক্লিয়ার করে আমি দুপুরের মধ্যেই ফিরে আসব রাশা আর পাশাকে স্কুল থেকে নিয়ে।
আমি মৃদু হেসে বললাম, এ সব তো তোর নিত্যদিনের কাজ। এ আর নতুন করে বলার কী আছে!
নাজু বলল, কারণ আছে। বেলা দশটার দিকে আমার অফিসের গাড়িতেই একটা মেয়ে আসবে তোমার সাথে দেখা করতে।
আমি অসম্মতির ভঙ্গিতে বললাম, না না। ছবি এঁকে দেবার বাহানা নিয়ে আসবে আমি এমন কোনো মেয়ের সাথে দেখা করতে চাই না। আমি আর কাউকে দুঃখ দিতে চাই না লিসার মতো।
নাজু অনুনয়ের স্বরে বলল, না বড়দা, না। যে মেয়েটি তোমার সাথে দেখা করতে আসবে সে ছবি এঁকে দেবার বাহানা নিয়ে আসবে না। যে আসবে তাকে আমি খুব স্নেহ করি। ও শুধু তোমাকে দেখবে, তোমার সঙ্গে দু একটা কথা বলেই চলে যাবে। আই প্রমিজ ইউ, শি উইল বি ইয়োর লাস্ট গেস্ট।
আমার কৌতূহলী প্রশ্ন, মেয়েটি কে?
নাজু কী যেন ভাবল। চাপা দীর্ঘশ্বাসে বলল, মেয়েটার নাম দুঃখ।
আমি অবাক কণ্ঠে বললাম, কোনো মেয়ের নাম কি দুঃখ হয়?
- হয় বড়দা হয়। সত্যিকারের দুঃখী মেয়ের নাম দুঃখই হয়।
- তা ঐ দুঃখ দুঃখী মেয়েটার আমার সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্য কী?
- তোমাকে দেখে, তোমার কথা শুনে সুখি হওয়া।
বলে নাজু উঠে গেল।
আমি ঘরে বসে ড্রইংখাতায় হঠাৎ করেই আমার স্মৃতি থেকে ফিরে আসা একটা রিকশার পেন্সিল ড্রইং করছিলাম। একটি যুবক উদ্দাম গতিতে শূন্য পথে রিকশা চালাচ্ছে, বাতাসে তার চুল উড়ছে, তার এক হাত রিকশার হ্যান্ডেলে, অন্য হাত উঁচু করে আনন্দের ভঙ্গিতে। রিকশার সিটে এখনো কোনো আরোহী নেই। যদি আরোহী হয় তার সে কে হবে তা আমি এখনো ভেবে ঠিক করিনি। আমার দ্রুত স্কেচ ও অস্পষ্ট ভাবনা-চিন্তার মধ্যেই নার্স লতিফা এসে বলল, ম্যাডাম যে মেয়েটির কথা আপনাকে বলে গেছেন তিনি এসেছেন। আমি তাকে ড্রইংরুমে বসিয়ে রেখে এসেছি।
আমি খাতা, পেন্সিল রেখে বললাম, যাও তুমি। বল আসছি।
আমি একটু পরেই ড্রইং রুমে এসে অপেক্ষারত মেয়েটিকে দেখে অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলাম। মেয়েটির বয়স এখন অনুমান করা কঠিন। হয়তো একুশ বা বাইশ হবে। মুখটার একাংশ পোড়া, চোখ দুটোর মনি নেই। পরনে সাদা সালোয়ার, কামিজ, হাতে সাদা ছড়ি।
মেয়েটি বোধহয় আমার অস্ফুট আর্তনাদ শুনতে পেরেছিল। হাতের ছোট্ট ব্যাগ থেকে কালো চশমাটা পরল। তারপর প্রশ্ন করল, আপনি কি আমাকে দেখে চমকে উঠেছেন স্যার?
আমি নিরুত্তর। মেয়েটি আবার প্রশ্ন করল, স্যার, আপনি আমার এই পোড়ামুখ দেখে ভয় পাচ্ছেন?
আমি কোনোক্রমে বললাম, ভয় নয়, ভীষণ কষ্ট। তুমিই কি সেই দুঃখ নামের মেয়েটি যার কথা নাজনিন আমাকে বলেছিল?
মেয়েটি ম্লান হাসল। বলল, হ্যাঁ আমিই সেই দুঃখ, লজ্জা, ঘৃণা, ভয়।
আমি শুধু বললাম, ওসব কিছু নয়। আমি শুধু কষ্ট পাচ্ছি।
- শিল্পীরা, কবিরা তাহলে কষ্ট পায়?
- হ্যাঁ পায়। কারণ তারাও তো মানুষ। তাদের দুঃখ-কষ্টের ভেতর দিয়েই তো শিল্পের সৃষ্টি।
মেয়েটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, যখন চোখ ছিল তখন কার যেন একটা কবিতা পড়েছিলাম, যদি পারো দুঃখ দাও ... আমি দুঃখ পেতে ভালোবাসি।
আমি বললাম, তাই তোমার নাম দুঃখ?
মেয়েটি বলল, হ্যাঁ।
আমি বললাম, এই মেয়ে তুমি কি আমার কাছে দুঃখ পেতে এসেছ?
মেয়েটি বলল, না।
- তা হলে?
- আমার নাম দুঃখ হলেও আপনার কণ্ঠস্বর শুনে ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে বাইরের চোখ দিয়ে দেখতে না পেলেও আমার ভেতরের চোখ দিয়ে আপনাকে দেখতে পাচ্ছি। একদিন অনেক অনেক কল্পনা করেছি আপনাকে ... দেখা হবে ... কথা হবে।
এই পর্যন্ত বলেই মেয়েটি সহসা থমকে গেল। তারপর সুরেলা কণ্ঠে গেয়ে উঠল, চোখের আলোয় দেখেছিলাম মনের বাহিরে ...।
মেয়েটির চেহারাটি বিকৃত। কণ্ঠটি বিকৃত নয়। সুরেলা অত্যন্ত পরিশীলিত। কিন্তু মেয়েটিকে এভাবে অগ্নিদগ্ধ করল কে, কেন? প্রশ্নটাও করলাম।
- স্যার কার কথা বলব? রাস্তার বখাটে ছেলে হোক, বাসের ড্রাইভার হোক, পলিটিক্যাল লিডার হোক, তাদের ক্যাডার হোক, মুখোসধারী ভদ্র মানুষ হোক সবারই একই চরিত্র। কেউ কারো থেকে কম নয়। সবার কাছেই আমরা মেয়েরা ধর্ষণ পণ্য। এ নিয়ে আর কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। গত তিন বছর ধরে হাজার প্রশ্নে আমি জর্জরিত। তোতা পাখির মতো উত্তর দিতে যাচ্ছি তো যাচ্ছিই। কিন্তু যা ঘটবার তাতো ঘটেই গেছে।
- কিন্তু তোমাকে যারা এভাবে পুড়িয়েছে তারা কি ধরা পড়েনি?
- না।
- কেন?
- জানি না। শুধু জানি সাগর, রুনি, তনুর মতো মেয়েদের হত্যাকা-ের আসামীরা যেমন আজও ধরা পড়েনি তেমনি আমার ও আমার মায়ের অ্যাসিড সন্ত্রাসীরা কখনোই ধরা পড়বে না।
আমি বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করলাম, তোমার মাও কি তোমার মতোই দগ্ধ? তিনি কি ...
- আমার মা মরে বেঁচেছেন আমি বেঁচে মরে আছি।
- এমন কেন হল আমাকে বলবে কি?
আমার প্রশ্নে দুঃখ নামের মেয়েটি তার স্মৃতিতে চলে গেল অন্ধ চোখেই। আস্তে আস্তে বলতে লাগল তার বিপন্ন অতীতের কথা-আমাদের একটা বাড়ি ছিল, আড়াই কাঠা জমির ওপর একটা পুরেনো দোতালা বাড়ি। আমাদের বাড়ি সংলগ্ন প্রতিবেশী ছিলেন ঐ মহল্লার খুব দাপটের মানুষ, পলিটিকাল লিডার। তিনি অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করবেন কিন্তু তার নিজের জায়গা জমিতে কুলোচ্ছিল না। আমার মা’র কাছে আমাদের বাড়ি, জমি, কেনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ভবিষ্যতে একটা অ্যাপার্টমেন্ট দেবারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু মা কিছুতেই রাজি হননি। ফলে যা হবার তাই হল। একদিন রাতে সন্ত্রাসীরা গ্রিল কেটে আমাদের বাসায় খুব নিঃশব্দে ডাকাতি করল। দে রেপড আস লাইক এ ডগ। অ্যান্ড আফটার দ্যাট দে ওয়ান্টেড টু কিল আস। এসিড ছুঁড়ে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল। আমরা দুজনেই পুড়লাম। মা মরল, আর আমি ...
মেয়েটির কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেল। যার চোখ নেই। তার চোখেও তো পানি নেই। সব অশ্রু কান্না হয়ে জমে থাকে কণ্ঠে, কিংবা বুকের ভেতর।
আমি কয়েক মুহূর্ত নীরবতার পর প্রশ্ন করলাম, প্রতিবেশী যে দাপুটে মানুষটি এই কা- ঘটাল তাকে পুলিশে ধরেনি?
- না।
- কেন?
যখন এই সন্ত্রাসী হামলা ঘটেছিল তার পনেরো দিন আগে থেকেই তিনি ছিলেন ওমরাতে। এই ঘটনার সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার কোনো সাক্ষ-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আমি মৃতপ্রায় অবস্থায় ছিলাম হাসপাতালে। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করাও আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সেই দুঃসময়ে একমাত্র নাজনিন আন্টিই ছিলেন আমার পাশে। তিনিই আমাকে দ্বিতীয় জন্ম, দ্বিতীয় জীবন দিয়েছেন। আমি বাল্যবয়সে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জীবন কথা পড়েছি। কিন্তু নাজু আন্টি আমার দ্বিতীয় ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল।
দুঃখ নাম মেয়েটির ভয়াবহ স্মৃতির বর্ণনায় আমার বুকের ভেতরের হৃদপি-, হাড়-পাঁজর সবকিছু যেন পুড়তে শুরু করল। কোনোক্রমে বললাম,
- দুঃখ, তোমার বাবা নেই?
মেয়েটি হাসল। বলল, দুঃখদের কি বাবা থাকে? দুঃখদের ভেতরেই দুঃখরা জন্ম নেয়। হয়তো আমার বাবা কেউ ছিলেন, তিনি বোধহয় আমার জন্মের আগেই মৃত।
‘কেউ ছিলেন বোধ হয়।’ এই দুটি শব্দ আমার কানে কেমন যেন কাচভাঙ্গা শব্দের মতো মনে হল। আমি শুধু বললাম, দুঃখিত।
এই দুঃখিত শব্দটা ছাড়া আমি মেয়েটিকে আর কি-ই-বা সান্ত¦না দিতে পারি? এই বীভৎস পোড়ামুখ নিয়ে, অন্ধত্ব নিয়ে একটি মেয়ের বেঁচে থাকা যে কী ভয়ঙ্কর তা আমি বা অন্য কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না। এমন জীবন নিয়ে ওর বেঁচে থাকাটাই অভিশাপ।
কিছু নিঃশব্দ মুহূর্ত বাতাসে উড়ে যাবার পর আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি আমার কাছে কেন এসেছ মেয়ে? বলো, আমি তোমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি? এনি মনিটারি হেলপ ইউ নিড?
- না। নাজু আন্টি হেলপড মি এ লট। তিনি আমার চিকিৎসার সব খরচ বহন করেছেন। কসমেটিক সার্জারি করিয়েছেন। আমি কিছুটা সুস্থ হবার পর উনার রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে আমার আশ্রয় ও চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ওখানে আমি কিছু হাতের কাজ করি, ছেলেমেয়েদের গান শেখাই। আমার দিন চলে যায়। সব নাজু আন্টির ভালোবাসা।
আমি বললাম, নাজু আমার বোন। শি ইজ ভেরি কাইন্ড হার্টেড। অথচ হাস্যকর ব্যাপারটা কি জানো? ওর ভাই হয়ে আমি ভীষণ স্বার্থপর, নিষ্ঠুর। আমার এই চরিত্রের কথা নাজু তোমাকে বলেনি?
- না। উনি কখনো কারো সম্পর্কেই কিছু বলেন না।

আমি আক্ষেপ ভরা কণ্ঠে বললাম, বলা উচিত ছিল অন্তত আমার সম্পর্কে বলা। ও যদি না বলে থাকে তাহলে আমিই বলি। আমি মাত্র একুশ দিনের কথা বলে প্যারিস চলে গিয়েছিলাম। আর ফিরে আসিনি। আমার বাবা অসুস্থ হয়ে অসহায় শিশুর মতো বিছানায় শুয়ে শুয়ে কেঁদেছেন, আমি তার চোখের পানি মুছে দিতে আসিনি। তার মৃত্যুর সংবাদ পেয়েও আসিনি। তোমার নাজু আন্টির বিয়ের সময় যা কিনা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়, তার শত অনুনয় সত্ত্বেও তাকে আশীর্বাদ জানাতে আসিনি। কেন শুনবে? আমার ছিল অন্য জগত, স্বপ্নের জগত। স্বপ্নের সাথে বসবাস আর ব্যবসা করতে গেলে পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া যায় না। কোনো ভালোবাসার বন্ধনে বন্দি হওয়া যায় না। আর দশজনের মতো সাধারণ গৃহস্থি হওয়া যায় না।
- যায় না বলেই আপনি বড় শিল্পী। আপনার অনেক সুনাম শুনেছি। আমার মা আপনার কথা প্রায়ই বলত। বলত আপনি একজন নামী দামি শিল্পী। প্যারিসে থাকেন।
আমি বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম, তোমার মা কি আমাকে চিনতেন?
- হ্যাঁ। আপনার কথা বলতে গিয়ে তার চোখও যেন স্বপ্নমেদুর হয়ে উঠত। মাঝে মধ্যে বলত, জানিস আমার চেনা একটা মানুষ মোনালিসার দেশে থাকে। খু-উ-ব বড় শিল্পী। সে একবার যদি দেশে ফিরে আসত তাহলে তাকে বলতাম, আমার এই মিষ্টি মেয়েটার একটা ছবি এঁকে দাও না শিল্পী। মোনালিসা নয়, সুচিত্রা নয়, আমার মেয়ে যেমনটি আছে ঠিক তেমনটি এঁকে দাও।
কথাগুলো বলে মেয়েটি জলতরঙ্গের মতো হেসে উঠল। আমি বললাম, তুমি কি তোমার মায়ের স্বপ্ন পূরণের জন্যেই আমার কাছে এসেছ?
মেয়েটি হাসতে হাসতেই বলল, আমার মুখ পড়েছে, মন পুড়েছে কিন্তু বুদ্ধি বিবেচনা তো পোড়েনি। আমি পোড়ামুখি মেয়েটার ছবি আঁকার আবদার নিয়ে আপনার কাছে আসব?
আমি আস্তে আস্তে বললাম, শিল্পীরা ইচ্ছে করলেই সবকিছু আঁকতে পারে। সুন্দরের ছবি যেমন আঁকতে পারে তেমনি কুৎসিত, বীভৎসতার ছবি, ডার্টি ছবিও আঁকতে পারে। লিসা নামে এক অপরূপ রূপবতী একদিন আমার কাছে এসেছিল মোনালিসা হতে। আমি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। সে এখন আর নেই। বড় দুঃখ নিয়ে সে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। আমার খুব কষ্ট হয় তার জন্যে। তুমি যদি চাও তোমাকে আমি ফেরাব না। বল, তুমি তোমার ছবি আঁকতে চাও?
- না।
- তাহলে?
- আমি যখন কলেজে পড়তাম তখন মা’র সাথে স্টুডিয়োতে গিয়ে খুব সখ করে দুজনে একটা ছবি তুলেছিলাম। মা’র গলা জড়িয়ে ধরে আমি। আমরা যেন ভোরের নরম রোদের আলোয় ফুল ফোটার আনন্দে হাসছি। ছবিটা আমি সযতেœ এতকাল আগলে রেখেছি। সেই ছবিটাই আমি আপনাকে দিতে এসেছি। নেবেন ছবিটা? একবার দেখবেন কি এই কুৎসিত পোড়া মুখের অন্তরালে আমার আসল চেহারা কেমন ছিল? তার অন্ধ চোখের আড়ালে আকাশ আর পৃথিবীর কত আলো ছিল?
মেয়েটি তার হাতের ছোট্ট ব্যাগ হাতড়ে একটা এনভেলাপের ভেতর থেকে ছবিটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। আমি উঠে ওর হাত থেকে ছবিটা নিলাম। ছবিটা দেখে নিজের অজান্তেই আমি অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলাম।
মেয়েটি বোধহয় সে আর্তনাদ শুনতে পেল। বলল, শিল্পী, আপনি কি ভয় পেলেন? আমি কি খুব অসুন্দর ছিলাম? আমার মা?

মেয়েটি আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই উঠে দাঁড়াল। দূরাগত সংগীত ধ্বনির মতো বলল, আমি প্রশ্নের উত্তর চাইনে। যার জীবন থেকে সবকিছুই হারিয়ে গেছে তা ফিরে পেতে এখন আর উত্তর খুঁজে লাভ কি? আমি এসেছিলাম আমার মা এর শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করতে। এখন যাই।
আমি ছবিটা হাতে নিশ্চুপ। মেয়েটি তার সাদা ছড়িটা বের করে আমার কাছে এগিয়ে এল। অনুনয়ের স্বরে বলল, আমি আর কোনো কিছুই চাইনে। শুধু আপনার হাতটা দিয়ে আমার হাত, আমার সাদা ছড়িটা একটু স্পর্শ করুন। আমার মাথায় হাতটা ছুঁয়ে দিয়ে আশীর্বাদ করুন। আপনার স্পর্শ, আপনার ছোঁয়া নিয়ে আমি চলে যাব। যে কটা দিন বেঁচে থাকব সে ক’টা দিন আপনার এই স্পর্শের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকব।
আমি শব্দ বোধহীন মূর্তির মতো কাঁপা কাঁপা হাতে ওর হাতটা ধরলাম। আমার স্পর্শে ও যেন মর্মস্পর্শী আবেগে থর থর করে কেঁপে উঠল। ওর পোড়া মুখে, অন্ধ চোখের কালো চশমাটায় যেন একটা উজ্জ্বল আভা ছড়িয়ে পড়ল। আমি আস্তে আস্তে প্রশ্ন করলাম, দুঃখ তোমার আসল নামটা কি আমাকে বলবে?
- আমি শুভশ্রী। আমার মা শ্যামশ্রী।
বজ্রপাত ... বজ্রপাত ... শুভশ্রী ... শুভশ্রী ...
শ্যামশ্রী ... শ্যামশ্রী ... প্রতিটি নাম আদিগন্ত সমুদ্রের এক একটি ঢেউয়ের মতো প্রচ- শব্দে আমার হৃদপি-ে আছড়ে পড়তে লাগল। তারপর অস্পষ্ট, ঝাঁপসা চোখে আমি দেখতে পেলাম আমার হাত থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে শুভশ্রী নামের মেয়েটি তার সাদা ছড়ি হাতে এগিয়ে যাচ্ছে বাইরে দরোজার দিকে।
আমি প্রাণপণে ওকে ডাকতে চাইলাম। বলতে চাইলাম শুভশ্রী, চলে যেও না ... ফিরে এসো শুভশ্রী ... শোনো ... আমি তোমার ...
কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না।

চলবে

লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব এক)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব দুই)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব তিন)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব চার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব পাঁচ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব ছয়)
লাইফ অব এ রিকশা পেইন্টার (পর্ব সাত)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব আট)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব নয়)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব দশ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব এগার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব বার)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব তের)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব চৌদ্দ)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব পনের)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব ষোল)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব সতের)
লাইফ অব এ রিক্শ পেইন্টার (পর্ব আঠারো)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top