সিডনী মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৭ই বৈশাখ ১৪৩১


প্রবাসী তো পরবাসী: সাইফুল আলম তালুকদার


প্রকাশিত:
১৬ এপ্রিল ২০২০ ২৩:২৪

আপডেট:
১৭ এপ্রিল ২০২০ ০১:০৪

 

জীবনযুদ্ধে নেমে জীবিকার তাগিদে অনেক মানুষই বাধ্য হয় দেশান্তরী হতে ! আর এই দেশান্তরী হওয়া মানুষ গুলোর সুন্দর একটি নাম দেওয়া হয়েছে " প্রবাসী " আবার অনেকে বলেন " পরবাসী " কেউ বলেন " যাযাবর  "। প্রবাসীদের রখমফের আছে । এই রখমফের অবশ্য  অঞ্চল ভিত্তিক। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবাসীদের যাত্রা ভিন্ন ভিন্ন কারনে । সবাই আসছে অর্থ উপার্জনের জন্য। এদের অনেকেই দক্ষ আবার বেশীর ভাগই অদক্ষ । কেউ আসছে উচ্চশিক্ষার্থে । এদের কেউ দীর্ঘমেয়াদি ।আবার কেউ স্বল্প সময়ের জন্য । উদ্দেশ্য যাই হউক না কেন এদের সবাই প্রবাসী । সবাই চলছে সেই সোনার হরিণের পেছনেই ।  স্বজনদের নিয়ে যদি কিছুটা ভাল থাকা যায় । হউক না দক্ষ কিংবা অদক্ষ , স্হায়ী কিংবা অস্হায়ী , অথবা কোন বিশেষ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। আমরা প্রবাসীরা সবাই তো বাঙ্গালী । বিদেশে আমাদের একমাত্র পরিচয় আমরা বাঙালী । প্রবাস জীবন শিখিয়েছ কিভাবে, কেমন করে আশপাশে ঘটে যাওয়া অনেক কিছুকেই এড়িয়ে জীবন যুদ্ধে এগিয়ে যাওয়া । আজ আমি প্রবাস জীবনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলব  প্রথমটি হচ্ছে প্রবাস জীবনের অবিচ্ছেদ্য পর্ব " অর্থনৈতিক জীবন  " পরেরটি হচ্ছে  " রাজনৈতিক জীবন " এবং তৃতীয়টি হচ্ছে " সামাজিক জীবন "। এই তিনটি পর্ব বা এই তিন কর্মকান্ড নিয়েই প্রবাসীদের ব্যস্ত জীবন অতিবাহিত হচ্ছে।

 

 অর্থনৈতিক জীবনঃ-

বিদেশি ডিগ্রি আর উন্নত জীবনের স্বপ্নে প্রতিবছর ভিনদেশে পাড়ি জমায় হাজার হাজার বাংলাদেশি। খণ্ডকালীন কাজ না পেয়ে শুরুতেই ধাক্কা খায় অনেকে । টিউশন ফি জোগাড় না করতে পেরে পড়াশোনা বন্ধের জোগাড় হয় কারো কারো । স্বপ্নের দেশে পড়তে গিয়ে দুঃস্বপ্নে রাত কাটছে এমন আরো অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর। পর্যাপ্ত খণ্ডকালীন কাজের সুযোগ নেই। অনেকে খণ্ডকালীন কাজ পেলেও আয়ের টাকায় টিউশন    ফি তো দূরের কথা, থাকা-খাওয়ার খরচও জোটে না । আবার ভর্তি হওয়ার পর অনেকে জানতে পারেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি মানসম্মত নয়। কখনো কখনো ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানটি বন্ধও হয়ে যায়। ফলে পড়াশোনা ছেড়ে নাম লেখাতে হয় শ্রমিকের খাতায়। তাদের অনেকেরই আবার নাম ওঠে অবৈধ অভিবাসীর তালিকায়। শিক্ষার্থী ছাড়া অন্যান্য ভিসায় যারা আসেন তাদের অনেকের একটাই সমস্যা হয় সেটা হল ভাষাগত সমস্যা । এই সমস্যার কারনে অনেকেই ভাল কোন কাজ পায়না , তখন একমাত্র উপায় বাংগালিদের পরিচালনায় বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট , ক্লিনিং ব্যবসায় কাজ খোজা । এইসব অসহায় মানুষদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ট্রেনিং এর নামে দুই সপ্তাহ থেকে চার সপ্তাহ পর্যন্ত পারিশ্রমিক ছাড়া কাজ করায় , এর পর প্রতি  ঘন্টায় নাম মাত্র পাঁচ থেকে দশ ডলার পারিশ্রমিক দেয় তার উপর দশ থেকে চৌদ্দ ঘন্টা কাজ করতে হয় , এর পর সময় মত বেতন দেয়না , উপায় না থাকায় বাধ্য হয়ে অমানুষিক অমানবিক পরিশ্রম করতে হয় । বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্নে -বিভোর জায়গা-জমি বেচে নিশ্বঃ হয়ে ফিরে যাওয়ার জায়গা আর থাকেনা । এতো গেল একদিকের গল্প দুঃখ কষ্ট বেদনা , কোনটা চোখের জল আর কোনটা ঘামের জল ভোক্তভোগী ও বলতে পারবেনা । অন্যদিকে যারা প্রাথমিক ধাক্কা সামলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন তারা নিজেদেরকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করেন , এবং মোটামোটি ভালই আছেন । প্রিয় পাঠক একটু লক্ষ করুণ , তাঁদের পায়ের নিচে মাতৃভূমি নেই ঠিকই, কিন্তু সবাই বুকের ভেতর একটা ছোট মাতৃভূমি নিয়ে ঘুরে বেড়ান। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক , নিরাপত্তাজনিত, এমনকি একান্ত ব্যক্তিগত কত বিচিত্র কারণে দেশ ত্যাগ করেন মানুষ। দেশ ত্যাগ করেন ঠিকই, কিন্তু প্রবাসে পুরোপুরি এসে পৌঁছান না। তাঁদের শরীর এসে পৌঁছায় নতুন দেশে, কিন্তু মনের ভেতর থাকে এক টুকরা বাংলাদেশ। অভিবাসীদের যাওয়া আছে, পৌঁছানো নেই। সব কিছু হারিয়ে নতুন করে শুরু করা জীবন থেকে প্রতিদিন একবেলা খেয়ে , নাখেয়ে একটু একটু করে টাকা জমিয়ে প্রতি মাসে দেশে পাঠাতে হয় । সদ্য বিদায়ী বছরে ( ২০১৮ ) বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৩০ হাজার ৫৫৪ কোটি ডলার (১৫.৫৪ বিলিয়ন) পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে পাঠানো এই রেমিটেন্সের পরিমাণ বাংলাদেশি মুদ্রায় এক লাখ ৩০ হাজার ৫৪১ কোটি টাকারও বেশি। ২০১৭ সালে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৩৫৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এই হিসাবে ২০১৭ সালের চেয়ে ২০১৮ সালে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ রেমিটেন্স বেশি এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। এত প্রতিদান দেওয়ার পরও এই মানুষ গুলি যখন দেশে যান কেউ স্বপরিবারে আবার কেউ একা বিমান থেকেই শুরু হয় অবজ্ঞা লাঞ্ছনা  অপমান ! বিমান থেকে নামার পর শুরু হয় আরেক ধরনের মানসিক নির্যাতন ব্যাগ নিয়ে টানাটানি , পাসপোর্ট আটকিয়ে রাখা । রিয়াল, দিনার , পাউন্ড , ডলার নাদিলে বিমান বন্দরের  কর্মকর্তা থেকে নিরাপত্তা রক্ষী থেকেও নাজেহাল হতে হয় । এই ডাকাতদের হাত থেকে বাঁচার কি কোন উপায় নেই ? এই অপকর্ম দেখারও কি কেউ নেই ?

 

সামাজিক জীবন :-

জীবন-জীবিকার টানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রবাসীরা সব সময়ই মাতৃভূমির কল্যাণে এগিয়ে আসেন। প্রবাসে থেকেও তারা দেশের রাজনীতি ও সামাজিক কর্মকান্ডে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ প্রবাসীরা সর্বদা সম্পৃক্ত ও সোচ্চার থাকেন। মহান মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের ঐতিহাসিক সকল অর্জনেই প্রবাসীরা বিশেষ অবদান রেখেছেন। তারা সবসময়ই দেশের উন্নয়ন, শান্তি ও কল্যাণ এবং বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের সুনাম ও মর্যাদা বৃদ্ধির প্রত্যাশা করেন। এমনটাই বুকে লালন করে সবসময় সোচ্চার থাকেন প্রবাসীরা।

অনেকেরই ধারণা প্রবাসে থাকা মানে না 'বিদেশী' না 'বাঙালী' হয়ে বেঁচে থাকা। প্রবাস মানে কী একগুয়েমি জীবন ? প্রবাসী মানে কী সাংস্কৃতিক আত্নপরিচয় ভুলে যাওয়া ? নাকি এই একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গ জীবনেও প্রবাসীরা আকড়ে ধরে থাকে দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ? একটি সময় হয়তো ছিল প্রবাস মানে না 'বাঙালি' না 'বিদেশী' হয়ে বেঁচে থাকা। কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই। ওই ধারণার পুরোটাই পাল্টে গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রবাসীরা নিজকে ষোলআনা বাঙালীয়ানায় দেখতে না পেলেও বাঙালি জীবনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও সাফল্য এখন অনেক ব্যপ্তি লাভ করছে। পিঠা উৎসব , একুশে ফেব্রুয়ারী পালন, বিজয় ও স্বাধীনতা দিবস উদযাপন, বৈশাখী মেলার জমকালো আয়োজনসহ হরেকরকম সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে প্রবাসী-অভিবাসী বাঙালীরা জাগিয়ে রাখছে নিজ দেশের শিল্প সংস্কৃতি এই প্রবাসেও ।

এত উৎসাহ , উদ্দীপনায় জমকালো আয়োজনের প্রয়াস যখন প্রশ্নবিদ্ধ হয় , কি কারনে - নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের বাঙালী সংস্কৃতিতে অংশ গ্রহণে অনিহা ?

প্রবাসে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশি নতুন প্রজন্মের মধ্যে দেশীয় সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। বাঙালি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ৫-২০ বছর বয়সীদের সাধারণত অভিভাবকেরা নিজেদের সঙ্গে নিয়ে যান। এর চেয়ে বেশি বয়সীদের অনুষ্ঠানস্থলে নেওয়াটা বেশ কঠিন। আর যারা যায়, তারাও দেখা যায় অধিকাংশ সময় বিভিন্ন গ্যাজেটেই মুখ বুজে পড়ে থাকে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিবিমুখ নতুন প্রজন্মকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন অভিভাবকেরা।�প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটির বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন জাতীয় দিবস ছাড়াও রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী বেশ বড় পরিসরে উদ্‌যাপন করা হয়। দেশের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দিতে প্রবাসীরা তাঁদের সন্তানদের অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে আসেন। এসব অনুষ্ঠানে ২০ বছরের কম বয়সীরা মা-বাবার হাত ধরে অনুষ্ঠানে এলেও তাদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো উৎসাহ কাজ করে না। আর এর চেয়ে বেশি বয়সীদের অনুষ্ঠানে নেওয়াটাই বেশ কঠিন। অনেকেই মা-বাবাকে সাফ জানিয়ে দেয়, ‘আমি অনুষ্ঠানে যাব না’। বাংলাদেশি অভিভাবকদের অনেকের প্রশ্ন , বাঙালি অনুষ্ঠানে বাচ্চাদের কেন আগ্রহ নেই ? কেউ কেউ এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে পেয়েছেন, ভাষার ব্যবধান, শিকড় থেকে দীর্ঘদিন ধরে বিচ্ছিন্ন থাকা, বাবা মা কাজে ব্যস্ত , পারিবারিক অশান্তি , থাকাসহ আরও নানা কারণ। পরবাসীদের মধ্যে আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করা যায় সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পালাক্রমে দাওয়াত খাওয়া , এই আন্তরিকতার সুফল থেকে কুফলই বেশী দেখা যায় কারন এতে পরনিন্দা পরচর্চাটাই বেশী হয় আর এর কুপ্রভাব ছোট বাচ্চাদের উপর পড়ে !

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে এখানকার অভিভাবকদের আন্তরিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তবে প্রশ্ন আছে উপায় নিয়ে। অধিকাংশ অভিভাবকই বাইরের অনুষ্ঠানকেই দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সন্তানদের পরিচয়ের মূল ক্ষেত্র বলে চিহ্নিত করেন। এখানেই ভুল। এই কাজটি হতে হবে ঘরে। পরিবারের মধ্যে সবার সঙ্গে বাংলা ভাষায় বাংলাদেশের সংস্কৃতি নিয়ে নিয়মিত চর্চা হলে সন্তানরা আর এই ক্ষেত্রটি থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে করবে না। তাদের মনে একটি যোগসূত্র তৈরি হবে, যা বাইরের বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিয়ে আরও দৃঢ় হবে।

 

রাজনৈতিক কর্মকান্ডঃ---

প্রবাসী দুই ধরনের। একশ্রেণীর প্রবাসী বিদেশী নাগরিকত্ব অর্জনের মাধ্যমে বিদেশে বসবাস করছেন। আরেক শ্রেণীর প্রবাসী জীবিকা নির্বাহের তাগিদে অস্থায়ীভাবে বিদেশে বসবাস করছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী প্রবাসীদের মধ্যে শেষোক্ত শ্রেণীর প্রবাসীর সংখ্যাই বেশি। ধারণা করা হয়, বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উভয় শ্রেণীর প্রবাসীর সংখ্যা ১ কোটির অধিক অতিক্রম করে গেছে। সংখ্যাটি বাংলাদেশের সামগ্রিক জনসংখ্যার ৫ শতাংশের ঊর্ধ্বে। বর্তমানে বাংলাদেশের এমন কিছু প্রবাসী যুক্তরাষ্ট্র , কানাডা , যুক্তরাজ্যে , ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছেন, যাদের প্রজন্ম দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ অবধি বিস্তৃত হয়েছে। সাধারণত দেখা যায়, কোনো দেশে অবস্থানরত দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রবাসীরা চালচলন ও কথাবার্তায় সম্পূর্ণরূপে নিজেদের ওইসব দেশের উপযোগী করে তোলে। কিন্তু বাঙালিদের ক্ষেত্রে নাড়ির টান অধিক হওয়ায় দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ প্রজন্মের প্রবাসীরা যতই নিজেদের ভিনদেশী কৃষ্টি ও সভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করুক না কেন, তারা নিজ দেশের পূর্বপুরুষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রেও সচেষ্ট। এদিক থেকে আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতের একই শ্রেণীর প্রবাসীদের দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা প্রবাসী হিসেবে যে দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে, নিজেদের সম্পূর্ণরূপে সে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে ফেলেছেন। এ ধরনের ভারতীয় প্রবাসীরা ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কী ঘটছে তা নিয়ে মোটেও উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত নন। এমনকি ভারতের যেসব প্রবাসী অস্থায়ীভাবে জীবিকার উদ্দেশ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন, তারাও যে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বিষয়ে খুব বেশি তৎপর— এমনটি পরিলক্ষিত হয় না। কিন্তু এক্ষেত্রে বাংলাদেশের উভয় শ্রেণীর প্রবাসীদের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন।

প্রবাসে দেশের রাজনীতি নিয়ে মাতামাতি কি প্রবাসী বাংলাদেশীদের কোন কল্যাণে আসছে? এ প্রশ্নের জবাব স্পষ্টত একটাই। তা হলো, না। বরঞ্চ দেশের রাজনীতি নিয়ে এই বিদেশের মাটিতে নিজেদের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদের কারণে বাংলাদেশীরা বিরক্ত, ক্ষুব্ধ। তাদের মধ্যে যে কথাটি ব্যাপক উচ্চারিত, যে অভিমত প্রবাসী বাংলাদেশীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সর্বদাই ব্যক্ত করছেন তা হচ্ছে এখানে দেশের রাজনীতি করা অহেতুক।�তাদের এই মনোভাবেরই জোরালো প্রতিধ্বনি ঘটালেন বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা তার সাম্প্রতিক এক বক্তৃতায়। তিনি বললেন, প্রবাসে দেশের রাজনীতি করার কোন মানে নেই, কোন অর্থও নেই। প্রবাসী বাংলাদেশীদের এদেশীয় রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার ওপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছেন।�নিউইয়র্কে দীর্ঘ দিন অবস্থানের অভিজ্ঞতা থেকে সাদেক হোসেন খোকার এ উপলব্ধি অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, বিদেশের মাটিতে বসে বিএনপি-আওয়ামী লীগ, ছাত্রদল-ছাত্রলীগ করার কোন অর্থ হয় না। প্রবাসে দেশের রাজনীতি নিয়ে হানাহানি, দ্বিধাবিভক্তি দেশের জন্য সম্মানজনক নয়। এসব বিভক্তি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তিনি বাংলাদেশিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।�এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে একটি সহজ সত্যকে তুলে ধরেছেন জনাব খোকা। দেশীয় রাজনীতির দ্বন্দ্ব কোন্দলে লিপ্ত এই প্রবাসের বাংলাদেশীরা বাস্তবিকই আজ তীব্র অনৈক্যের শিকার। এ অনৈক্য আজ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সমস্বার্থ সংশ্লিষ্ট এদেশীয় কোন জাতীয় ইস্যুতেও আজ তারা এক হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। তাইতো শুনি ঐক্যবদ্ধ না থাকায় বাংলাদেশী কম্যুনিটি এদেশের অনেক সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

আমাদের দেশ থেকে বড় দুটি দলের নেতৃস্থানীয়রা যখন বিদেশ সফরে যান তখন উভয় দলের বিদেশের সংগঠন তাদেরকে উপলক্ষ করে সভা ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আর যখন দুটি দলের প্রধানের আগমন ঘটে তখন দেখা যায় বিমানবন্দরে তাদের আগমন ও প্রস্থানের সময় বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি। তাছাড়া বিদেশে তারা যে হোটেলে অবস্থান করেন, সেখানকার লবিতে দেখা যায় সার্বক্ষণিক নেতাকর্মীর সরব উপস্থিতি। আমাদের বড় দুটি দলের নেত্রীদ্বয়ের তিনবার ও চারবার  করে দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ ঘটেছে। এ দুটি দলের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যখনই বিদেশে সফরে গেছেন দেখা গেছে, প্রতিদ্বন্দ্বী দলের নেতাকর্মীরা কালো পতাকা সহকারে বিমানবন্দর ও তাদের সম্ভাব্য আলোচনার স্থানগুলোয় উপস্থিত হয়ে আপত্তিকর স্লোগানের মাধ্যমে আগমনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিদেশীদের সামনে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন। এ ধরনের একাধিক ঘটনায় উভয় দলের নেতাকর্মীর মধ্যে হাতাহাতি ও মারামারির উপক্রম হলে পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এ ধারা এখনো অব্যাহত আছে।

দেশের বাইরে কি রাজনৈতিক দলগুলোর শাখা খোলার কোনো আইন আছে?

সেটা যেন রাজনৈতিক দলগুলো করতে না পারে, এ দায়িত্ব সংসদের। সংসদে ক্ষমতাসীন দল তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এ আইন প্রণয়ন করতে পারে। আরো মজার বিষয় হলো, এ বিষয়ে উভয় দল একমত। বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো বিদেশে থাকা প্রবাসী রাজনৈতিক শাখা বন্ধ করতে চায় না। আমরা যখন বলেছি, বিদেশে রাজনৈতিক শাখা খোলা যাবে না, তখন তারা সে দেশে আলাদাভাবে রেজিস্ট্রেশন করে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে চেয়েছে। বিষয়টির গুরুত্ব দলীয়ভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাদের বুঝতে হবে, প্রবাসী রাজনীতি কোনোভাবেই তাদের উপকারে আসছে না। তা-ই যদি আসত, তাহলে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল কংগ্রেস বিশ্বব্যাপী তাদের শাখা খুলত। বলা হয়ে থাকে, বিশ্বের প্রতি পাঁচজন লোকের একজন ভারতীয়। সেক্ষেত্রে তারা উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারত। কিন্তু তারা সেটি করছে না।

রাজনৈতিকভাবে কোনো উপকার না হলেও ফান্ড তো আসছে। সেখানে তাদের অনেক বড় লভ্যাংশ আছে। প্রচুর আয় হচ্ছে। এছাড়া অনেক নেতাই সেখানে গিয়ে দিনের পর দিন থাকছেন, তাদের ভরণ-পোষণের তো একটা ব্যাপার আছে! বড় বড় নেতা সে সুযোগ নিচ্ছেন, তা কিন্তু নয়। এ সুযোগ বিভিন্ন স্তরের ক্ষুদ্র নেতারাও নিচ্ছেন।

পরিশেষে কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের কিছু উক্তি উল্লেখ করছিঃ প্রবাসে স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে যেসব বাংলাদেশী বসবাস করছেন, তারা কেন নিজ দেশ থেকে সুদূর বিদেশে অবস্থানের পরও নিজেদেরকে স্বদেশের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখছেন, এর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, রাজনৈতিক ক্ষমতাকে অবলম্বন করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার মানসে তাদের এ প্রয়াস। তাছাড়া  আরেক শ্রেনীর প্রবাসী আছেন যারা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে ইউরোপ , আমেরিকা , ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় এসে দশ / পনের বছর পরিশ্রম করে কেউ কেউ বাড়ী গাড়ীর মালিক হয়ে গেছেন , এখন তাদের নামের দরকার তারা চায় সবাই তাদেরকে চিনুক , এই মানসিকতার প্রেক্ষিতে টাকা কড়ি খরচ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতৃস্থানীয়দের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে এসব প্রবাসী যখন দেশে আসেন, তখন স্থানীয়রা এদের যোগাযোগের পরিধি দেখে এদেরকে অনেকটা সমীহ করে চলে। স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে বিদেশে বসবাসরত যেসব বাংলাদেশী ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় দেশে সরকারি দলের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা দেশ ও বিদেশ উভয় স্থানে ব্যবসার উৎকর্ষ সাধনে সহায়ক।

দেশ ও বিদেশে প্রবাসীদের অবদান ম্লান হয়ে যায় তখনই, যখন দেখা যায় এরা নিজ দেশের সরকারি ও বিরোধী দলের নেতৃস্থানীয়দের বিদেশে সম্মান জানানোর পরিবর্তে কালো পতাকা প্রদর্শন, আপত্তিকর স্লোগান দিয়ে অসম্মান ও অশ্রদ্ধা করছেন। এ ধরনের অসম্মান ও অশ্রদ্ধা তাদের ও দেশের মর্যাদার জন্য হানিকর। তাই আর যাহোক, স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে বসবাসরত প্রবাসীদের রাজনৈতিক ভাবনা যেন সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির আবদ্ধতায় দেশের মর্যাদার হানি না ঘটায়— এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।

প্রবাস এক মিশ্র অভিজ্ঞতার জাদুর বাক্স। প্রবাসজীবনের এই বাক্সে যেমন আছে প্রচুর অর্জনের আনন্দ, তেমনি আছে বিস্তর হারানোর বেদনাও। অর্জন আর হারানোর এই দাঁড়িপাল্লা নাগরদোলার মতো দোলায় প্রবাসীদের। কখনো মনে হয় অর্জনের পাল্লা বুঝি ভারী, কখনো হারানোর। এই দোলাচলে কেটে যায় দিন। অনেকেই দেশে গিয়ে মনের ভেতরের এই চড়াই-উতরাইয়ের কথা জানান না কাউকে, যাঁরা বিদেশে আসেননি তাঁদের মনে বিদেশ নিয়ে যে রূপকথার গল্পের মায়া আছে, সে মায়া ভাঙাতে চান না তাঁরা। অনেকে দেশের বিশৃঙ্খলা, নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদির কথা বিবেচনা করে নিজের প্রবাসজীবনকে পরম সৌভাগ্য হিসেবেই দেখেন। কেউ আবার দেশ থেকে ফিরে এসে উচাটন হয়ে ওঠেন। তর্ক জুড়ে দেন হোক নিজের দেশ দরিদ্র, বিশৃঙ্খল, তবু ওখানেই মনের যা কিছু স্বস্তি। মনে মনে হিসাব কষেন, একদিন ফিরে যাবেন দেশে। তার মন তখন অনেকটা ছোটবেলায় শোনা সেই ছড়াটির মতো, যেখানে এক মেয়ে তার ভাঙা পুতুলটি হাতে নিয়ে বলছে ‘ভেঙে গেছে হাত পা গুলো চুলগুলো নেই কালো/ তবু সেটা আমার কাছে সবার চেয়ে ভালো’। যারা জীবনের একটি সিংহভাগ দেশে কাটিয়ে বিদেশে এসেছেন, সেই প্রথম প্রজন্মের প্রবাসী বাংলাদেশিদের বুকে বরাবরই একটি দূরপাল্লার দেশপ্রেমের মোমবাতি জ্বলে। যে মোমের আগুনে একটু একটু করে পোড়ে তাঁদের হূৎপিণ্ড। রাতে বিছানায় শুয়ে দ্বিতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশের শিশু মেয়েটি যখন টগবগে তুখোড় ইংরেজিতে তার মায়ের কাছে গল্প করে স্কুলে বন্ধু জুডিথ আর ক্লারা কী করেছে, তখন মা সেই গল্প শুনতে শুনতে গোপনে চোখ মুছে মেয়ের গালে চুমু খেয়ে বলে, ‘মা রে, তুই কি কোনো দিন একবার একটু শোনাবি না, “আতা গাছে তোতা পাখি ডালিম গাছে মৌ” ?

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top