সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০


হেদায়েতের ব্যবসা : সাইফুল আলম তালুকদার


প্রকাশিত:
২২ এপ্রিল ২০২০ ২১:২০

আপডেট:
২২ এপ্রিল ২০২০ ২১:২৫

 

ক্রমশ মৌলিকত্ব এবং ধর্মীয় আবেদন হারাচ্ছে বাংলাদেশের ‘ইসলামিক জলসাগুলো’। স্থানীয়ভাবে ‘ওয়াজ মাহফিল’ নামে পরিচিত এসব সমাবেশে ইসলামিক ধর্মোপদেশ দেয়া হলেও ফিঁকে হয়ে আসছে আগের ‘ধর্মীয় চেতনা ও ভাবগাম্ভীর্য’। জাতীয়-আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রসঙ্গও আসছে না আগের মতো। সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে হাস্য-রস। কোন কোন ক্ষেত্রে খিস্তি-খেউড়ও। ফলে ইসলামি দাওয়াত ও আমল-আখলাকের শিক্ষা পৌঁছানোর ঐতিহাসিক স্বীকৃত এ মাধ্যমটি ক্রমশ যেন রূপ নিচ্ছে ‘তামাশার আসরে’। নানা অঞ্চলের নানা বয়সের বিভিন্ন ধারা ও মতাদর্শের আলেম-ওলামার সস্তা-সরল উদাহরণ-উপমা, অঙ্গ-ভঙ্গী ও বয়ানেই ঘটছে এ অবনতি।
বাংলাদেশে ওয়াজ মাহফিলের মৌলিক চরিত্র ও চিন্তায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ইসলাম ধর্ম প্রচারে বিশেষ এই আয়োজনে লেগেছে প্রযুক্তির স্পর্শ। ১৯৭১ সালে গৌরবময় স্বাধীনতার পর ওয়াজ মাহফিলের চরিত্র ও কাঠামোতে এসেছে নতুনত্ব। অর্থনৈতিক-সামাজিকভাবে মাহফিলের ভূমিকা অনেক বিস্তৃত হয়েছে বলে মনে করেন দেশের আলেম ও সংশ্লিষ্টরা ।জ্যেষ্ঠ আলেমরা বলছেন, ১৯৭৫ সালের পর ওয়াজ মাহফিলের ধরন বদলে গেছে। আশির দশক থেকে বাংলাদেশে ব্যাপক হারে ওয়াজ মাহফিলের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে এখানে ওয়াজ মাহফিল বিভিন্ন ধারা ও উপধারায় বিশেষভাবে পাঁচ ধারায় বিভক্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন, কওমি বা দেওবন্দি ধারা, আলিয়া মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ধারা, ওরস ও মাজারকেন্দ্রিক ধারা, জামায়াত বা মওদুদীবাদের ধারা এবং আহলে হাদিস বা সালাফী মতবাদের অনুসারীদের ধারা। শেষের এই ধারাটি কোনো মাজহাব মানে না বলে তাদেরকে ‘লা মাজহাবী’ও বলা হয়ে থাকে। পরিবর্তনের ছোঁয়ায় আর্থিক জীবনের নিশ্চয়তা পেয়েছেন দেশের বেশিরভাগ বক্তা (যারা ওয়াজ করেন)। বাংলা অঞ্চলে ওয়াজের সূচনার সময় এই ‘নিশ্চয়তা’ অনেকাংশে অনুপস্থিত ছিল। যদিও এখন মাহফিলেই বক্তারা শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরেন নিজেদের বাড়ি-গাড়ির কথা। ওয়াজ থেকে প্রাপ্ত সম্মানীর মাধ্যমে কোনও কোনও বক্তার মাদ্রাসা পরিচালিত হয়। ওয়াজ ও নসিহতের ধারা রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনের যুগ অতিক্রম করে বর্তমান যুগ পর্যন্ত আলেমদের মাধ্যমে অব্যাহত রয়েছে। যদিও সময়ের পরিবর্তনে মাহফিলে ব্যবস্থাপনাগত কিছু বৈচিত্র্য এসেছে। তবে বর্তমান অবধি তা অব্যাহত আছে ও এটি থাকা অপরিহার্য।’

 


প্রায় ৫০ বছরে বাংলাদেশের ওয়াজ মাহফিলে পরিবেশ ও কাঠামোতে নানান পরিবর্তন এসেছে। মাহফিলের সাজসজ্জায় নিত্য সৌন্দর্যবর্ধন চলছে। আলোকসজ্জা হচ্ছে মঞ্চে। বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে থাকছে ধর্মভিত্তিক সংগীতানুষ্ঠান। আলেমরা বলছেন, ‘এসব পরিবর্তন অনেক ক্ষেত্রে নেতিবাচক হওয়ায় ধর্মীয় এই প্রচার-পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কয়েক বছর ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, বিশেষ করে ফেসবুক ও ইউটিউবের সহজলভ্যতার কারণে খুব অল্প সময়ে খ্যাতি লাভের একটা প্রবণতা অনেক তরুণ আলেমের মধ্যে দেখা দিয়েছে। এসব কারণে ওয়াজ মাহফিলের আলোচক হওয়ার হিড়িক পড়েছে। যাদের কণ্ঠ ভালো তাদের অনেকেই বক্তা হয়ে যাচ্ছেন। মাহফিল আয়োজকরা বক্তাকে সম্মানজনক হাদিয়া প্রদান করেন। অল্প বয়সী বক্তাদের মধ্যে অল্প সময়ে খ্যাতির পাশাপাশি অর্থোপার্জনের একটা মনোবৃত্তিও কাজ করতে পারে। কিন্তু এটা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই যে, তারা জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবে ওয়াজ মাহফিলকে পেশা বানিয়েছেন কিনা।’
ওয়াজ-মাহফিল ধর্মপ্রাণ মুসলমানের একটি ঐতিহ্যগত ধর্মীয় আচার। ফেসবুক ও ইউটিউবের কল্যাণে ওয়াজ-মাহফিল কেবল ময়দানে সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা শোনা যাচ্ছে বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে; কিন্তু বর্তমানে যে পরিমাণ বক্তার বাম্পার ফলন হয়েছে তা রীতিমতো দেশের সচেতন মহলকে ভাবিয়ে তুলছে। অধিকাংশ বক্তা ভিত্তিহীন ধর্মীয় আবেগপ্রবণ বক্তব্য রেখে সমাজে অবান্তর উত্তেজনার সৃষ্টি করছেন। একজন বক্তা আরেকজন বক্তার বক্তব্যকে ভুল ও বিভ্রান্তিকর আখ্যা দিয়ে একে অন্যের সঙ্গে কাদা ছোড়াছুড়িতে জড়িয়ে পড়েছেন। আবার অনেক বক্তাকে নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নের বিরোধিতা করে নারীবিদ্বেষী বিভিন্ন কুরুচিশীল বক্তব্য দিতে দেখা যায়। যার ফলে নারী শিক্ষা নিয়ে জনমনে বিভক্তির সৃষ্টি হচ্ছে। কথিত ধর্মীয় বক্তা বিভিন্ন অপপ্রচার ও সম্পূর্ণ বানোয়াট তথ্য-উপাত্তহীন উসকানিমূলক কথা বলে মাহফিলকে সরকারবিরোধী মঞ্চে পরিণত করছেন। ওয়াজ-মাহফিলের মূল উদ্দেশ্য হল মানুষকে ধর্মের বাণী শোনানো, ইসলামের পথে আহ্বান, সৎ পথে আদেশ এবং অসৎ পথে নিষেধ; যা আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসূলরা করে গেছেন। কিন্তু বর্তমানে বক্তাদের একে অপরের প্রতি উপহাসমূলক বক্তব্যে যেন গিবত ও বিষোদগার বেশি হচ্ছে। এক বক্তা আরেক বক্তাকে কাফের বলা, মুনাফিক-বিদআতি, ইসলামচ্যুত ইত্যাদি নামে কটূক্তি করছেন। আবার ইসলামের মূল বিষয়গুলোকে একপাশে রেখে সামান্য বিষয়গুলোকে নিজের মনগড়া ব্যাখা করে সমাজে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি নষ্ট করছেন। প্রায় সব বক্তা নিজের মতাদর্শকে প্রাধান্য দিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন এবং মতাদর্শগত বিরোধ নিয়ে চড়াও হচ্ছে। নামাজে হাত বাঁধা, লজ্জা স্থানের উপরে নাকি বুকে পেটে , সূরা ফাতিহার পর জোরে আমিন বলা, না কি মনে মনে বলা ( মনে মনে বলা আর না বলা একই কথা ) হাত তুলে মোনাজাত করা বা না করা, রাসূল (সা.) নূরের নাকি মাটির তৈরি, কবরে বেঁচে আছেন কিনা মারা গেছেন , মিলাদ , শবেবরাত , পনের শত বছর প্রায় হয়ে গেল ইসলামের বয়স এখনও প্রতি বছর আলোচনা করতে হয় রোজার নিয়ত নিয়ে , তারাবির নামাজ ৮ নাকি ২০ রাকাত , চাঁদ দেখা গেল কি না এসব বিষয় নিয়ে মুসলমান সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি করে যাচ্ছেন। কখনও কখনও এসব বিভক্তি থেকে সংঘর্ষের সৃষ্টি হচ্ছে।

 


চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে, অত্যধিক শব্দে মাইক ব্যবহার মানবদেহে বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। ৫০ ডেসিবলের বেশি শব্দ হলে কানের সেলের ক্ষতি হয়, রক্তচাপ বাড়ে। এটি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। মাহফিলের সামাজিক গুরুত্ব বিবেচনা করে উচ্চ শব্দে মাইক ব্যবহারের বিকল্প খোঁজা জরুরি। কারণ উচ্চ শব্দে গভীর রাত পর্যন্ত মাইক ব্যবহারের ফলে শিশু-বৃদ্ধদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। সমাজের অসুস্থ ব্যক্তি, শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা, পড়ার কোনো উপায় থাকে না। মাহফিল যেহেতু একটি নির্দিষ্ট মাঠে হয়, সেখানে সাউন্ড বক্সের ব্যবহার সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমাতে পারে।
হারাম হালালের দোটানায় পড়ে আলেম সমাজ দীর্ঘদিন ধরে অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এড়িয়ে চলেছেন। কিন্তু বেশিদিন এড়িয়ে যেতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত তারা ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটারসহ অন্যান্য মাধ্যমে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে বাধ্য হন। কেবল সম্পৃক্ততা নয়, বরং তারা বেশ সক্রিয়ও বটে। এখন ইউটিউব ও ফেসবুকে ওয়াজ মাহফিলের হাজার হাজার ভিডিও। এসব ভিডিওতে চলে অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ, ধর্মহীনদের প্রতি সহিংসতার আহবান। আরো চলে আলেমদের বিভিন্ন গ্রুপের মাঝে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য। মাঠ ঘাট থেকে কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনে উঠে আসা এসব ওয়াজ মাহফিল নিয়ে গ্রামের শহরের তরুণ যুবক বৃদ্ধ সব ধরনের  মানুষের  মাঝে চলে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, আলোচনা-সমালোচনা।  তাদের সবার প্রশ্ন এ সব কি হচ্ছে ইসলামকে নিয়ে ? এক কোরআন , এক হাদিস থাকা সত্বেও ইসলামকে নিয়ে এত বিভ্রান্তি কেন ? হাজার হাজার  বছর ধরে ক্ষমতা , ব্যবসা , নারী ভোগ যত অসামাজিক অন্যায় অবিচার অত্যাচার চলছে সবই ধর্মকে ব্যবহার করে চলে আসছে এখন সে যে ধর্মই হউক, যা কোন দিন কেউ প্রতিকার করতে পারেনি আর কোন দিন পারবেও না কারন এটা এমন এক মাদক দ্রব্য যা মন্ত্রের মত কাজ করে এবং যে কোন সাধারন মানুষের ধরাছোঁয়ার বাহিরে ! অনেকেই মনে করেন এই তথাকথিত ধর্ম ব্যবসার পিছনে সরকারি প্রশাসন যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছেনা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় প্রশাসনের সবাই যেন এই ধর্ম ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top