সিডনী শনিবার, ৪ঠা মে ২০২৪, ২০শে বৈশাখ ১৪৩১


বোধ: আবুল কালাম আজাদ


প্রকাশিত:
২৩ এপ্রিল ২০২০ ০০:১০

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২০ ১৯:২৮

আবুল কালাম আজাদ


তৃণার কিছু ভালো লাগছিল না।
তৃণা খুব মন খারাপ নিয়ে ঘরে বসে আছে। অন্য সবাইও তো ঘরে বসে আছে। সবারই কি ওর মতো মন খারাপ হচ্ছে?
শুধু ঘরে বসে থাকার কারণে যে মন খারাপ তাও নয়। লম্বা ছুটি তৃণা জীবনে কম কাটায়নি। সেসব ছুটি অফুরন্ত আনন্দের উৎস হয়েই এসছে। ভাই-বোনদের সাথে গল্প, আড্ডাবাজি করেছে, ছবি এঁকেছে, কবিতা লিখেছে, বই পড়েছে, সিনেমা দেখেছে। ছুটির দিনগুলো উড়ে গেছে প্রজাপতির রঙিন পাখায় ভর করে।
কিন্তু এখন সময় ভিন্ন। শরীরে কাঁটা দিয়ে থাকা সময় এখন। এখন ছবি আঁকতে বসতে ইচ্ছা করছে না। জোর করে বসলে যা আঁকা হবে তাতে তৃপ্তির বদলে অতৃপ্তির পাল্লাটাই ভারি হবে। কবিতার কোনো ভ্রুণ মগজে অঙ্কুরিত হচ্ছে না। নাটক-সিনেমা দেখায়ও মন বসছে না। টিভির খবর শুনতে গেলে ব্লাড প্রেসার বেড়ে যায়। ভাই-বোনের সাথে গল্প করবে কি, তারাও কেমন দূরবর্তী কেউ। যে যার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে থাকে। সবাই যেন অচেনা মানুষ।
অজানা এক ভয়, শঙ্কা বিষাক্ত সাপের মতো পেঁচিয়ে থাকে তৃণাকে। মনের ভেতর বুদ্বুদ্ করে প্রশ্ন জেগে ওঠে, শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাওয়া যাবে তো?
দৃশ্যমান শত্রুর সাথে লড়াই করা সহজ। কিন্তু এ তো দৃশ্যমান নয়। কোথা থেকে কিভাবে ভেতরে ঢুকে বাসা বানাবে তা কে জানে। জ্বর, কাশি, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট। যদি শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা শত্রুটার সাথে পেরে ওঠে তো বাঁচা যাবে, নাহলে মরে যাওয়া। অসুস্থ হয়ে মরার ভেতরেও একরকম শান্তি আছে। আপনজন, আত্মীয়-পরিজন সবাই সেবার হাত বাড়ায়, বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু এক্ষেত্রে যে সে শান্তিটুকুও নেই। কভিড-১৯ নামক শয়তানটা ভেতরে ঢুকেছে এমন প্রমাণ পাওয়া মাত্র সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হবে। কেউ কাছে আসতে পারবে না। এমনকি মরে মনে যাবার পরও কেউ কাছে আসতে চাইবে না, শরীর ছুঁয়ে শেষ কান্নাটুকু কাঁদতে পারবে না।
যে মানব জাতি ১৯৬৯ সালে চাঁদের বুকে হেঁটেছে, সেই মানব জাতি আজ কি চরম অসহায়। কারণ বোধহয় এটাই-মানুষের শুভবোধ কমে গিয়ে হিংসা-দ্বেষ, লোভ-লালসা, পরস্পরকে টপকে যাওয়ার নেশা, সাম্প্রদায়িক অন্ধত্ব বেড়ে যাওয়া। গোটা বিশ্বে মরণাস্ত্রের পেছনে যে মেধা, শ্রম ও অর্থ ব্যয় হয়েছে, মানব জাতির মঙ্গলের জন্য তার সিকিভাগও হয়নি।
তৃণার পাখি হয়ে উড়ে যেতে ইচ্ছা হয়। কিছুদিন ইচ্ছামতো ওড়াওড়ি করবে। কভিড-১৯ নামের ভাইরাসটা একদিন না একদিন পরাস্ত হবেই। মানুষের শুভবোধ জাগ্রত হয়েছে, ভুল বুঝতে পেরেছে, প্রচেষ্টা চলছে। মানুষের কাছে পরাস্ত হতে বাধ্য। অতীতে প্লেগ, গুটিবসন্ত, যক্ষা, স্পেনিশ ফ্লু আরও কত কত ক্ষতিকারক ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া পরাজিত হয়েছে মানুষের কাছে। মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নাহি কিছু মহিয়ান। কভিড-১৯ পরাজিত হবার পর তৃণা আবার ঘরে ফিরে আসবে।

এলোমেলো ভাবনা রেখে তৃণা এক কাপ চা বানালো। এক কাপ ঠিক না। এক মগ। বড় এক মগ ভরে চা, তাতে অর্ধেকটা লেবু চিপড়ে রস বের করে দিল। ভিটামিন সি নাকি করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শক্তি যোগায়। এখন সময়টা এমন যে, যে যা বলে তাই মানতে ইচ্ছা হয়।
মগ ভরে চা নিয়ে তৃণা বসল বারান্দায়। চার তলার বারান্দাটায় বসলে মনটা হাফ ছেড়ে বাঁচে। সামনে বিস্তৃত খোলা অঞ্চল। বড় আকাশ।
কিন্তু নিচে তাকালে বুকটা ধরাস করে উঠে। রিকশা নেই কোনো, ঠুনঠুন শব্দও নেই। গাড়ি নেই, গাড়ির হর্নও নেই। সব দোকানপাট বন্ধ। চায়ের দোকানের সামনে নেই মানুষের জটলা। এক সময় চায়ের দোকানের জটলা তৃণাকে মাঝে মাঝে বিরক্ত করতো। লোকগুলোর কি কোনো কাজ নাই? কি এত গালগল্প? অলসতার তো একটা সীমা থাকে!
কিন্তু এখন তাদের জন্য মনটা কেমন করছে। সবাই ভালো আছে তো? সবকিছু ঠিক হয়ে গেলে আবার তারা এখানে এসে জটলা করবে তো?
শুধু এইসব মানুষ নয়, তৃণার মনে পড়ে সেইসব কুকুরগুলোকে। অনেকগুলো কুকুর-ছোট, বড়, মাঝারি, মোটা, শুকনা, লেজকাটা, খোড়া এরকম নানা রকমের কুকুর চায়ের দোকানের চারপাশে ঘোরাঘুরি করতো, শুয়ে থাকতো, ঝগড়া করতো। ডাস্টবিনগুলো ঢাকা পড়ে যাবার পর চায়ের দোকান, রাস্তার পাশে নিম্ন মানের রেস্তোরাই ছিল ওদের প্রিয় জায়গা। এসব জায়গা থেকেই বেঁচে থাকার খাবার জুটতো। এখন ওরা কোথায় গেছে? রাস্তায় যেভাবে জীবানুনাশক ছিটাচ্ছে তাতে পিঁপড়া, চিকা, ইঁদুর ইত্যাদি ক্ষুদ্র প্রানীগুলোও বেঁচে থাকতে পারছে না। কাকেরাও আছে ভীষণ খাদ্য সমস্যায়। খুব ডাকাডাকি করে। ডাকাডাকি নয়, বলতে হবে কান্না করে।
সব কিছু ঠিক হয়ে গেলে সেই পা ভাঙা রোগা কুকুরটাকে আবার কি দেখা যাবে? সেই বাঘের মতো তাগড়া লাল কুকুরটা কি আবার আসবে? সেই লেজকাটা কুকরীটা? গত শীতেও ও চারটে বাচ্চা দিয়েছিল। বাচ্চাগুলো হয়েছিল নাদুস-নুদুস। বাচ্চাগুলো ছিল খুব মা-নেওটে।
এলোমেলো ভাবনার মাঝে তৃণা চা খেতে খেতে তুহিনকে ফোন করলো।
: কেমন আছো তুহিন?
: আল্লাহর রহমতে ভালোই আছি।
: কতদিন দেখা হয় না আমাদের তা কি হিসাব করেছো?
: আঠাশ দিন।
: আমি জানতাম, তুমি ঠিক ঠিক হিসাব রাখবে। তিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে আঠাশ বছর।
: হু।
: আমাকে তোমার দেখতে ইচ্ছা করছে না?
: তা তো করছেই।
: শোনো তুহিন, বাসা থেকে থেকে বের হবে না একদম।
: না না, নামাজ পড়া ছাড়া বাসা থেকে বের হই না।
: নামাজ পড়া মানে?
: মানে পাঁচবার শুধু মসজিদে যাই।
: তুমি এসব কী বলছো তুহিন!
: অমন বিস্ময় দেখাচ্ছো কেন?
: তুমি পাঁচবার মসজিদে যাচ্ছো, পাঁচবার অনেকগুলো মানুষের সাথে মিশছো, আর আমি বিস্মিত হবো না?
: শোনো, মসজিদ আল্লাহর ঘর। সেখানে কোনো বিপদ যাবে না। সেখানে গিয়ে কেউ ভাইরাস আক্রান্ত হবে না।
: তুহিন, তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তুমি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করছো।
: বিশ্ববিদ্যাদলে পড়ছি বলে, ইংরেজি সাহিত্য পড়ছি বলে নাস্তিক হয়ে যেতে হবে?
: তোমাকে নাস্তিক হতে হবে না, কিন্তু তোমাকে আধুনিক মানুষ হতে হবে। মধ্যযুগীয় চিন্তা-ভাবনা ধারণ করে থাকলে চলবে না, গোড়া ধর্মান্ধ হলে চলবে না। রোগ-শোক, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার বিষয়গুলো বোঝার জন্য খুব বেশি জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। প্রথম থেকেই এই করোনা-১৯ ভাইরাস নিয়ে এ দেশের গোড়া ধর্মান্ধ মুসলিমরা নানারকম অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে চীনের ব্যাপারে বলেছিল, গজব। তারপর ইরানের ব্যাপারে বলেছিল, ওরা শিয়া মসুলমান, ওরা আসল মসুলমান না। সৌদী আরব, পাকিস্তান, বাংলাদেশ আক্রান্ত হলে বলছে মসজিদে ভাইরাস যাবে না।
: শোনো তৃণা, কয়েকটা দোয়া আছে, তোমার ইনবক্সে আমি দিয়ে দিবো। সেই দোয়াগুলো নিয়মিত পাঠ করলে করোনা ভাইরাস থেকে দূরে থাকা যাবে।
: তুহিন, তোমাকে আমি ভালোবাসি। তোমার শান্ত-নম্্র ব্যবহার, সুন্দর কথাবার্তা আমাকে মুগ্ধ করেছে প্রথমেই। আমি নিজে ধর্মকর্ম সেভাবে না করলেও তোমার ধর্মে অনুরক্ততা আমার ভালো লেগেছে। ধার্মিকদের সম্পর্কে আমার যে গতানুগতিক ধারণা ছিল, তোমার সংস্পর্শে এসে তা ভেঙে যেতে শুরু করেছিল। এখন দেখছি, যাহা লাউ, তাহাই কদু। সবই এক গোহালের গরু। তুমি যে এমন পশ্চাৎপদ চিন্তাভাবনা লালন করবে, ধর্ম ব্যবসায়ীদের মতো কথা বলবে তা কখনোই ভাবি নাই।
: তুমি কী বলতে চাও?
: তুমি জানো যে, সৌদী আরবে অনেক আগেই মসজিদে নামাজ পড়া বন্ধ করা হয়েছে। মক্কা-মদীনায় চলছে চব্বিশ ঘন্টা কারফিউ।
: আমাদেরও সেরকম করতে হবে?
: ঘরে নামাজ পড়া যায় তুহিন। ধর্মটা অন্তরের বিষয়। দুর্যোগের কারণে তুমি জামাতে নামাজ পড়তে পারছো না সেটা বোঝার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তার আছে। রোগব্যাধি সম্পর্কে ডাক্তারদের কথা, বিজ্ঞানের কথা মানতেই হবে। যে সব ধর্মব্যবসায়ী ফুঁ দিয়ে সব রোগ সারিয়ে ফেলে, নিজেদের অসুখ হলে তারা প্রথমেই ছোটে বড় বড় ডাক্তারের কাছে, তারপর বিদেশে।
: তৃণা, আমাকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। আমার ঈমানের শক্তি আছে। তোমার কথাবার্তা আমার অসহ্য লাগছে।
: তুহিন, আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, তুমি ঘরে নামাজ পড়ো। আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভালোবাসি বলেই তোমাকে অনুরোধ করার অধিকার আমার আছে। আমি তো তোমাকে নামাজ থেকে বিরত থাকতে বলছি না।
: দুঃখিত তৃণা, তোমার এই অনুরোধ আমি রাখতে পারবো না।
: তোমাকে খুব বেশিদিন মসজিদে নামাজ পড়া থেকে বিরত থাকতে হবে না। আশাকরি, অল্প দিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। বিজ্ঞানীরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সারা পৃথিবীতে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান দিন-রাত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। অদূরেই ভ্যাকসিন, এবং ওষুধ আবিষ্কার করতে সক্ষম হবেন। আমাদের দেশেও ওষুধ আবিষ্কারের জন্য গবেষণা হচ্ছে।
: তুমি মানুষকেই সবার চেয়ে ক্ষমতাবান বলে প্রকাশ করছো। তোমার এই ব্যাপারটা আমার কাছে অসহ্য লাগছে। আমাদের ধর্মগ্রন্থের চেয়ে বড় কোনো বিজ্ঞান নেই।
: সব ধর্মের অন্ধ ভক্তরাই তাদের ধর্মগ্রন্থকে বিরাট বিজ্ঞান মনে করে। কিন্তু বাস্তব সত্যি কথা হলো, ধর্মগ্রন্থ হলো শুধুই ধর্মগ্রন্থ। এতে যার যার ধর্মের আদেশ, নিষেধ এবং নিজস্ব ধর্ম অনুসারে জীবন চলার বিধান থাকে। ধর্মগ্রন্থ যদি বিজ্ঞান হতো তাহলে বিজ্ঞানের ক্লাশে ধর্মগ্রন্থগুলোই পড়ানো হতো। ধর্মগ্রন্থ দিয়ে যদি রোগ সারানো যেত তাহলে চিকিৎসা বিজ্ঞান, ডাক্তার, হাসপাতাল এসবের কোনো দরকারই হতো না।
: তুমি এমন মানসিকতার মেয়ে এটা প্রথমে জানলে তোমার সাথে আমি প্রেমই করতাম না। আমার সামনে দাঁড়িয়ে তুমি এই বক্তৃতা ঝারলে আমি তোমাকে গলা টিপে খুন করতাম।


রাগারাগি হয়ে যাবার পর দিন পনেরো কেটে গেছে। তুহিন একবারও ফোন করেনি তৃণাকে। তৃণার তুহিনকে প্রতি ক্ষণেই মনে পড়ে। নিজেকে কিছুটা অপরাধীও ভাবছে। তুহিনকে এভাবে উপদেশ দিতে গিয়ে রাগানোটা হয়তো উচিত হয়নি। জগতে সবাই তো একরকম হয় না। কেউ কেউ ধর্মের মধ্যে নিজেকে বিলীন করে দেয়, অথবা ধর্ম তাকে গ্রাস করে নেয়। ধর্মটা একরকমের নেশার মতো। যে এর ভেতর ঢোকে না, সে ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারবে না।
তুহিনকে একযোগে অতো কথা না বলে অল্প কিছু বললেই হতো। অতোটা তর্ক করা ঠিক হয়নি।
এসব ভাবতে ভাবতেই তৃণার তুহিনের জন্য মন কেঁদে উঠল। নিখাদ ভালোবাসার ক্ষেত্রে যা হয়। তৃণা নিজেকে নিবৃত রাখতে পারলো না। সে তুহিনকে ফোন করলো।
: কেমন আছো তুহিন?
ওপার থেকে খুশখুশ কাশির শব্দ। জোরে জোরে শ্বাস টানার শব্দ। তৃণা বলল: তুহিন, তুমি কি অসুস্থ?
: একটু কাশি......ইহঃ উহঃ...
: কাশি! জ¦র আসে?
: হু, গতকাল খুব বেশি ছিল।
: তুমি কি করোনা টেস্টের জন্য যোগাযোগ করেছো?
: সেররকম কিছু না। সিজনাল..... ইহঃ উহঃ...।
: তোমার শ্বাস টানার শব্দ পাচ্ছি। কাশি, জ¦র। প্লিজ তুমি জরুরি ভিত্তিতে আইইডিআর এর ওখানে যোগাযোগ করো।
: তুমি খামোখা ভাবছো।
: তারপর জ¦র, ঠান্ডার ওষুধ খাও। মাল্টিভিটামিন, ভিটামিন সি, ডি খাও। এজিসথ্রোমাইসিন এবং ম্যালেরিয়ার একটা ওষুধ নাকি করোনায় বেশ কাজে দিচ্ছে। দেখো, যোগার করে খেতে পারো কি না।
: তুমি উপদেশ দেয়ায় খুব ওস্তাদ হয়ে গেছো।
: আমার উপদেশ অমূলক নয়। তোমার পরিবারে করোনা আক্রান্ত দেশ থেকে কেউ আসেনি। তোমার একমাত্র বোন সুইজারল্যান্ড থাকে। তিনি ফেরেননি তোমাদের কথা ভেবেই। তোমার বৃদ্ধ বাবা-মা ঘরের বাইরে যান না। তাহলে তুমি এই ভাইরাস কোথায় পেল? তখন যদি আমার উপদেশ শুনতে.....।
: তুমি শতভাগ নিশ্চিত হচ্ছো যে, আমি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছি?
: সিমটম তাই বলছে।
: দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে... ইহঃ উহঃ...।
: তাই যেন হয়।
***
তার সাত দিন পর।
তুহিনের নাম্বারে ফোন করলে তার ফোন বন্ধ। তৃণা সারাদিন ফোন করলো। ফলাফল একই।
কীভাবে তুহিনের সাথে যোগাযোগ করা যায়? সবার অগোচরে বের হয়ে তুহিনদের বাসায় একবার কি যাবে? না, সেটা সম্ভব না। এই মুহূর্তে বাসা থেকে বের হওয়া কঠিন। রাস্তায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী লোকদের জেরার মুখেও পড়তে হতে পারে। তারা হ্যান্ড মাইক নিয়ে অনরবত বলে যাচ্ছে, ঘরে অবস্থান করতে।
তৃণার ঝট করে মনে পড়ে গেল যে, তুহিনের বাবার নাম্বার আছে ওর কাছে। ও তুহিনের বাবার নাম্বারে ফোন করল।
: কেমন আছেন আঙ্কেল?
: তেমন ভালো না মা।
: তুহিনের নাম্বার তো বন্ধ।
: ও তো করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে।
: বলেন কি! এ কয়দিন তো আপনারাও ওর সংস্পর্শে ছিলেন।
: তা তো ছিলামই। পুলিশ আমাদের এলাকা লকডাইন করে দিয়েছে। আমরা বাসার বাইরে বের হতে পারছি না।
: আপনাদের টেস্ট নেয়নি?
: স্যাম্পল নিয়ে গেছে।
: ওফ...!
তারও দুদিন পর।
তুহিনের বাবার নাম্বারেও আর যোগাযোগ সম্ভব হয় না। তুহিনের এবং ওর বাবার দু’টি নাম্বারই বন্ধ।
***
বাইরে ঝিকমিক হলুদ রোদ। সেলফোনের স্ক্রিনে আবহাওয়ার তাপমাত্রা জানার এ্যাপস বলছে তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
মানুষ ঘরবন্দি হয়ে আছে অনেক দিন। করোনার প্রকোপ কমেছে। একটা সময়ে যেরকম ক্ষতির আশঙ্কা করা হয়েছিল সেরকম হয়নি। ইউরোপ-আমেরিকার পর্যায়ে যেতে পারেনি। এর পেছনে অনেক কারণই থাকতে পারে। আমাদের জনগণের ইমিউনিটি ক্ষমতা বেশি, আমাদের তাপমাত্রা, আমাদের খাদ্যাভ্যাস আরও অনেক কিছুই এর পেছনে কাজ করেছে। কাজ করেছে কিছু ওষুধও। এক পর্যায়ে এসে জনগণও খুব সচেতন হয়ে উঠেছিল। যুব সমাজ সর্বাত্মকভাবে কাজ করেছে। ডাক্তাররাও জীবন পণ করেছেন।
সরকার ঘোষণা দিয়েছে, খুব শীঘ্রই লকডাইন তুলে নেবে। আজ টিভিতে আইইডিআর এর পরিচালক মিরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার মুখটা খুব উজ্জ্বল ছিল। তিনি হাসি হাসি মুখে বলেছেন, করোনা আক্রান্ত রোগির সংখ্যা প্রায় শূন্যে চলে এসেছে। গত চব্বিশ ঘন্টার ১২০০০ টেস্টের মধ্যে আমরা মাত্র ৫জন পেয়েছি করোনা পজিটিভ।
তৃণা মনে মনে ভাবল, লকডাইন তুলে নিলে কয়েকদিন বাঁধন ছেড়া ঘুরে বেড়াবে। প্রথমেই যাবে তুহিনের বাসায়।
এরকম ভাবনার মাঝে তৃণার ফোন বেজে উঠল। তৃণা স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে তুহিন ফোন করেছে। এক আনন্দের হিল্লোল বয়ে গেল তৃণার অস্তিত্ত জুড়ে। তৃণা ফোন রিসিভ করলো। ভেতরে এক রকমের শঙ্কা ছিল কে না কে কথা বলবে। কি না কি খবর দেবে। কিস্তু না। তুহিনই কথা বললো। স্পষ্ট তুহিনের কন্ঠ-
: কেমন আছো তৃণা?
: ভালো। তুমি কেমন আছো?
: আমি ভালো আছি।
: চাচা-চাচী কেমন আছেন?
ওদিক থেকে আর কোনো জবাব আসে না। তৃণা আবারও প্রশ্ন করলো। আবারও। আবারও। নীরবতা। দুঃসহ এক নীরবতা।
একটু পর নীরবতা ভেঙে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ।
তৃণা বলল: তুমি কাঁদছো কেন তুহিন?
: আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমি এতিম হয়ে গেছি। আমি নিজে করোনা ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে আসতে পারলেও আমার বাবা-মা পারেননি।
তৃণা স্তব্ধ। চোখের কোণ বেয়ে নেমে এল জলের ধারা। তুহিন বলল: তৃণা, আমিই সর্বনাশা ভাইরাসটাকে বয়ে এনেছিলাম বাসায়। শেষ পর্যন্ত সরকারও তো সব উপাশনালয় বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিল। আমার গোয়ার্তুমিই আমার বাবা-মা’র মৃত্যুর জন্য দায়ি। আমি আমার বাবা-মাকে খুন করেছি। আমি খুনি।
তৃণা ফোনে কান পেতে তুহিনের আর্তচিৎকার শুনছে, কিন্তু কিছু বলার ভাষা ওর নেই।
এক পর্যায়ে তুহিন শান্ত হলো। শান্ত কন্ঠে বলল: তৃণা, আমি একটা সিদ্ধান্ত ফাইনাল করেছি।
: কী সিদ্ধান্ত?
: বাবা তো মোটামোটি বিশাল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রেখে গেছেন। আমার বোন তার ভাগ নেবে না বলে আগেই জানিয়েছে। সে সুইজারল্যান্ডে সেটল হয়ে গেছে। পুরো সম্পত্তিটাই আমার। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাবার রেখে যাওয়া সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির সমূদয় অর্থ দিয়ে আমি একটি সর্বাধুনিক হাসপাতাল আর আর চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য একটা গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করবো।
: তোমাকে অভিবাদন তুহিন। আমি তোমার সহায়ক শক্তি হয়ে তোমার পাশে থাকবো। আমার বিশ্বাস করোনা পরবর্তী বিশ্ব অনেক পাল্টে যাবে।
: কীরকম?
: পৃথিবীটা অনেক মানবিক হবে। হয়তো মারনাস্ত্র প্রতিযোগিতা আর পরিববেশ দূষণ কমে যাবে। মানুষ কল্যাণকামী চিন্তা ও কাজে আরও বেশি আত্মনিয়োগ করবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে আরও বেশি কল্যাণমুখী করে তুলবে।
: তাই যেন হয়। তৃণা.....।
: বলো।
: তুমি তো চমৎকার গাইতে পারো। একটা গান শোনাবে, রবীন্দ্র সংগীত?
তৃণা গাইলো-জীবন যখন শুকায়ে আসে করুনা ধারায় এসো......।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top