সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১


মৃত্যুভয় : পার্থ তালুকদার


প্রকাশিত:
২৭ এপ্রিল ২০২০ ২২:০৪

আপডেট:
১১ জুলাই ২০২০ ২১:৪০

 

নির্জন রাতে বাবার রুম থেকে কবিতা পাঠের শব্দ আমার রুমের জানালা দিয়ে তরতর করে ভেসে আসছে। ঘুমকাতর চোখে মোবাইলটা অন করে দেখি রাত চারটা বেজে আট মিনিট। পাশে শোয়া রিতশ্রীর মায়াবী চোখে গভীর ঘুম। রুমে জ্বলছে নীলাভ ডীমলাইট। জানালার পুরো গ্লাস খুলতেই বাবার কন্ঠ আমার দু’কানে যেন বাঁধভাঙ্গা জলের ন্যায় জোরেশোরে উপছে পড়ল। বাবা পড়ে চলছেন জীবনানন্দের কবিতা-

যেদিন সরিয়া যাব তোমাদের কাছ থেকে- দূর কুয়াশায়
চ’লে যাব, সেদিন মরণ এসে অন্ধকারে আমার শরীর
ভিক্ষা ক’রে লয়ে যাবে,-

এ কি তাঁর মৃত্যুভয় নাকি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার আহ্বান। বাবা তো মৃত্যুকে কখনো ভয় করেন নি। আমাদের কখনো শেখাননি যে মৃত্যুর কাছে নিজেকে বিলীয়ে দিতে হবে। আমাদের শিখিয়েছেন বিপদে কিভাবে নিজেকে শক্ত রাখতে হয়, মনোবল কিভাবে দৃঢ় রাখতে হয়। অথচ বাবা যেন আজ ঝরের তান্ডবে উপড়ে পড়া এক বৃদ্ধ বটবৃক্ষ।

 

জানি বাবার মনটা ভীষণ খারাপ। শুধু বাবা নয়, আমাদের পরিবারের সবার। পাঁচ দিন হলো আমেরিকা নিবাসী আমার একমাত্র বড়ভাই নীলাদ্রি মারা গেছে। এই খবর পাওয়া মাত্র আমার আটাত্তর বছরের বাবা যেন নব্বইয়ের দুয়ারে প্রবেশ করলেন। কেমন জানি তাঁর ভাবলেশহীন আচরণ আবার কখনোসখনো ছোট্ট শিশুর মতন অবুঝ বায়না ধরার প্রবণতা আমাকে ক্ষণে ক্ষণে ভাবিয়ে তুলছে।
আমি দরজা খুলে নিঃশব্দে বাবার পেছনে গিয়ে দাঁড়াই। বাবা তাঁর রুমের বারান্দায় বসে জীবনানন্দ পড়েই যাচ্ছেন---

তোমার বুকের থেকে একদিন চ’লে যাবে তোমার সন্তান
বাংলার বুক ছেড়ে চ’লে যাবে;

রাতের নিকষকালো আধার শেষে পৃথিবীর বুকে আলো ফুঁটতে শুরু করল। যদিও পাখিদের কিচিরমিচির ডাক তখনো পৃথিবীকে কোলাহলমুক্ত রেখেছে। পাড়ার দুরন্ত ছেলেরা এখনো সাইকেলের টায়ারকে গাড়ি বানিয়ে ছুটতে শুরু করেনি। তবে পাশের বাসার হিজল গাছের ডালে বসা একটা লক্ষীপেঁচা আমাদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি বাবাকে বললাল- বাবা, তোমার ঘুম আসছে না ? বাবা যেন একটু চমকে উঠলেন। না, ঘুম আসছে না। পুরো রাতটাই জেগে ছিলাম। তুইও ঘুমাস নি তাহলে ?
- না বাবা, তোমার কবিতা পড়ার শব্দে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল।
- অহ ... আচ্ছা ঠিক আছে এবার ঘুমিয়ে পড়।
- না বাবা, কথা বলো, তোমার সাথে এখন কথা বলতেই ভালো লাগছে। তুমি কি চা খাবে? তোমার বৌমাকে চা দিতে বলবো ?
- না না না... বৌমা ঘুমাচ্ছে, তাকে আর ডিস্টার্ব করার দরকার নেই। আচ্ছা নীলকন্ঠ, ডাক্তাররা বললো যে এই ভাইরাসটা শুধু বৃদ্ধ মানুষকেই ঘায়েল করে। তাহলে আমার নীলাদ্রির কেনো এমন হলো। ও এভাবে মারা গেল কেনো? আচ্ছা আমার বড় বৌমার সাথে এ ব্যাপারে তোর কথা হয়েছে ?
- না বাবা, বৌদির সাথে আর কথা হয়নি। শুনলাম ওদেরকে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে।

 

আমি খেয়াল করলাম বাবার চোখজোড়া জলে ছলছল করছে। আমারও চোখদুটি ভারী হয়ে আসছে। আমি বাবার শরীর ঘেঁষে দাঁড়ালাম। তাঁর কপালে হাত দিয়ে দেখি কপালটা বেশ গরম। মনে হল শরীরটা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। ঘনঘন কাশি দিচ্ছেন। আমি ভয় পেয়ে গেলাম।করোনা নয়তো আবার! বাবা এবার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। মৃদু পায়ে তাঁর আলমারির সামনে গিয়ে কাঁপাকাঁপা হাতে আলমারির দরজাটা খুললেন তিনি। একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে আবার আমার কাছে ফিরে এলেন।
- নীলকন্ঠ, ব্যাগটা তোর কাছে রেখে দিস।
- এটাতে কী আছে বাবা ?
- তেমন কিছু না। এই জমির কয়েকটা দলিলপত্র, ব্যাংকের কিছু কাগজপত্র এইসব। আর শোন, আমার সকল ব্যাংক একাউন্টে তোকে নমিনী করা হয়েছিল। আমার কিছু একটা হয়েগেলে তুই পুরো টাকাটা পাবি।

আমি আৎকে উঠি। বলি, এসব কী হচ্ছে বাবা ! তুমি না বলতে জন্ম যদি সত্য হয় তবে মৃত্যু চিরন্তন সত্য। তাহলে তুমি এভাবে ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন।
- দেখ নীলকন্ঠ, আমি কখনো মৃত্যুকে এতটা কাছ থেকে দেখিনি। এতটা ভয় পাইনি। তবে যেদিন নীলাদ্রি মারা যাওয়ার খবরটা পেলাম তখনই আমি আমার হিসেব পেয়েগেছি। যে কখনো অগ্নিকুন্ডকে পরোয়া করেনি সে-ই এখন দিয়াশলাইয়ের কাঠিতে ভীতগ্রস্ত।

হঠাৎ বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কাঁদতে থাকেন। আমি আর বাঁচব না রে নীলকন্ঠ, আমি আর বাঁচব না। এই করোনা ভাইরাস আমার নীলাদ্রিকে আমার বুকের পিঞ্জর থেকে কেড়ে নিয়েছে। আমি নিশ্চিত আমাকেও রেহাই দিবে না।

আমার মনে পড়ে সেই ছোট্টবেলার কথা। বাবা অফিস থেকে ফিরে এলে আমি যেভাবে তাকে জড়িয়ে ধরে একটা চকলেটের জন্য বায়না ধরতাম, ঠিক সেভাবেই বাবা আমাকে আজ জড়িয়ে ধরেছেন। আমার দুটি চোখ টলটল করছে। আমি বাবাকে আরো জোরে বুকের মাঝে চেপে ধরি। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি আমি আর আমার বাবা।

ভোরের মায়াবী আলো ধীরে ধীরে পৃথিবীতে আরো তীর্যক হয়ে ধরা দেয়। বাবার গায়ের শ্বেতশুভ্র পাঞ্জাবি আরো ধবধবে হয়ে ওঠে। একসময় আমরা দুজন দেয়ালে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে থাকি। হিজলগাছের লক্ষীপেঁচাটা সাই করে উড়াল দেয়। এবার পাখিদের কিচিরমিচির পৃথিবীটাকে চঞ্চল করে তুলে। আমরা দুজন নিশ্চল হয়ে বসে থাকি।

‘এই তুমি কোথায়, তুমি কোথায়’ বলতে বলতে রিতশ্রী আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি বিহ্বল চোখে তাকে বলি , কেন ? কী হয়েছে ?
‘একটা সুসংবাদ আছে, দারুণ সুসংবাদ আছে! করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়েছে। এসো এসো টিভির সামনে এসো।’

আমি বাবার হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে টিভির দিকে ছুটি । সংবাদ পাঠিকা বলে যাচ্ছেন- ‘করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যেই বিশ্বের সবকটা দেশে তা পাওয়া যাবে।’

আমি বাবার হাত আরো জোরে চেপে ধরি। বাবা দৃঢ় পায়ে পাথরের মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁর চোয়াল কাঁপছে। তিনি কিছু একটা বলতে চাচ্ছেন অথচ শব্দ বেরুচ্ছে না। দুচোখ দিয়ে গড়গড় করে পানি পড়ছে শুধু। সম্বিত ফিরে পেয়ে বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘কয়েকটা দিন আগে যদি ওষুধটা বের হতো তাহলে আমার নীলাদ্রিটা বেঁচে যেত বাবা।’

পুব আকাশে লাল টুকটুকে সুর্য উঁকি দেয়ার সাথে সাথে কাক, শালিখ, দোয়েল পাখিদের কোলাহল শুরু হয়ে গেল। রিতশ্রী তখন বাবার পাশে এসে দাঁড়ায়। আমরা তিনজন টিভির সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। সবারই পা কাঁপছে যেন। সৃষ্টিসুখের উল্লাসে এই আগত ভোরে মনে হলো পুরো বিশ্বটাই কেঁপে উঠছে! বাবা আবার বিড়বিড় করে কবিতা আবৃত্তি করতে থাকেন।

আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে- এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে,
হয়তো ভোরের কাক হ'য়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে..

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top