সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১


চাউল চোর  : মনসুর আহমেদ 


প্রকাশিত:
২৯ এপ্রিল ২০২০ ০১:০৪

আপডেট:
২৭ জুন ২০২০ ২১:৪৫

 

সোলাইমান বেপারী। আনন্দনগর ইউনিয়ন পরিষদের ৪ বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। সাধারণ কর্মী থেকে রাজনৈতিক নেতা, পরে চেয়ারম্যান। মন্ত্রী এমপিদের সাথে তার বেশ খাতির । টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, চোরাকারবারি সব তার আয়ত্তের ভিতরে। প্রশাসন, মন্ত্রী, এমপি তার পকেটে। অনেক জনপ্রতিনিধিদের যেখানে ডানবাম ম্যানেজ করা কঠিন, তার কাছে সুজাসাপটা। 'টাকা দিয়ে বাঘের চোখও কিনা যায়'। কিন্তু সোলাইমান বেপারীর মত অন্যরা কিনতে পারেনা। বুদ্ধির কারবারি সোলাইমান বেপারীর হাটে বুদ্ধি বিক্রি করতে পারেন। খরিদ করা কঠিন। নিজের মত করে আশপাশে বিশাল বাহিনী তৈরি থাকে সবসময়। আর এদের লালনপালন করতে বেপারীর মাসে বড় দাগের টাকা খরচ করতে হয়। তবুও ক্ষমতা, চেয়ারম্যানি টিকিয়ে রাখতে এই নিয়মের বাহিরে যাবেনা বেপারী। 

বন্যা, খড়া, মহামারি, প্রাকৃতিক দূর্যোগে যেখানে মানুষ ও প্রাণীকুলের জন্য অভিশাপ। আর বেপারি অপেক্ষায় থাকে কখন আসবে এইসব দূর্যোগ। বিগত ২০ বছরের বেশকিছু বন্যার সম্মুখীন হয়েছে ইউনিয়নবাসী। রাস্তা - ঘাট, ঘর - বাড়ি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দূর্ভোগ স্বচক্ষে দেখে উপজেলা প্রশাসন সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু মানুষ মানুষের অধিকার থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত। লক্ষ লক্ষ টাকার ত্রাণসামগ্রী ও বন্যা পরবর্তী কৃষি সামগ্রী বিতরণ কার্যক্রম লোকদেখানো মাত্র। নিজস্ব কিছু লোকজন অল্প পরিমাণের সহযোগিতা পেলেও অধিকাংশই বেপারির গুদামে। যা সে ইচ্ছে মত বিক্রি করছে খোলাবাজারে। সোলাইমান বেপারীর দূর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে ইউনিয়নের বেশকিছু প্রতিবাদী যুবক বিভিন্ন সময় প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করলেও কাজ হয়নি। কিসের যেন একটা নিরবতা। একবার ইউনিয়নে পারিবারিক কলহের জের ধরে  একটি খুন হয়। আর এই খুনের আসামি হয়ে দীর্ঘদিন জেল কাটে তার কুকর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া কয়েকজন যুবক। তার প্রভাব প্রতিপত্তির কাছে হার মানে সভ্যতা। ইচ্ছে মত কানধরে ঘুরাচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদের সাধারণ মানুষকে। 

সোলাইমান বেপারী বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগের সাথে ঘনঘটা সখ্যতা থাকলেও কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস সাথে প্রথম পরিচিত। সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমের শিরোনামে প্রাধান্য বিস্তার করেছে এই ভাইরাস। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এই ভাইরাস। বাংলাদেশেও এই ভাইরাস মহামারি আকারে বিস্তার লাভ করেছে। পৃথিবীর বিলাসবহুল দেশের মত বাংলাদেশেও লকডাউন চলছে। সবকিছু বন্ধ থাকায় মধ্যবিত্ত, শ্রমজীবী, সুবিধাবঞ্চিত মানুষ কর্মহীন হয়ে পরেছে। মানুষের এই হাহাকার দেখে সরকার তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। চেয়ারম্যান মেম্বারদের মাধ্যমে চাউল - ডাল পৌঁছে দিচ্ছে অসহায় মানুষের মাঝে। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে বেপারি চেয়ারম্যান। সরকারের নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে লোকদেখানো কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করে। সরকারি নির্দেশনা যেখানে ১০ কেজি চাউল দিতে হবে বঞ্চিতদের, সেখানে দিচ্ছে ৫ কেজি করে। দুই একজন মেম্বার প্রতিবাদ করলেও তারা নির্যাতনের স্বীকার হন। এই খবর মূহুর্তে ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। আর এই কাজটি করে 'আনন্দনগর সচেতন যুব সংঘ'।

সালমা বেগম। বেপারি চেয়ারম্যানের স্ত্রী,আল্লাওয়ালা মহিলা। ধর্ম - কর্ম, নামাজ - রোজা নিয়মিত করেন। বেপারি চেয়ারম্যানের এইসব অনৈতিক কর্মকান্ড সে মোটেও পছন্দ করেনা। আর এই সব বিষয়আশয় নিয়ে প্রায়ই জামাই বউয়ের মাঝে ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকে। সালমা বেগম তার ফেসবুক পাতায় নিয়মিত ইসলামের আলোকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখালেখি করে থাকেন। 

আজও একটি পোস্ট দিলেন  "আত্মসাৎ করা মারাত্মক গুনাহ ও জঘন্য অপরাধ। মালিক ক্ষমা না করলে এ গুনাহ আদৌ ক্ষমা হবে না। তাকে অবশ্যই জাহান্নামের অনলে জ্বলতে হবে"। (তিরমিজি, মিশকাত, পৃ. ২৪২) 

চেয়ারম্যান অফিস রুমে বসে চেচামেচি করছে এবং ফোনে হুমকি দিচ্ছে কাকে জানি। বিরাট হুমকি, সামনে পেলে চিবিয়ে খাবে এমন মনে হচ্ছে। এমন সময় বেশকয়জন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক অফিস রুমের দরজায় দাঁড়ানো। একসাথে সবাইকে দেখে হতভম্ব সোলাইমান বেপারি।  বেপারি দু-একজন কে চিনলেও সবাইকে চিনতে পারছেনা। এর একটা বড় কারণ-ও আছে। আনন্দপুর ইউনিয়নে সাংবাদিক নিষিদ্ধ। লোকমুখে শোনা যায়, ইতিপূর্বে বেপারি চেয়ারম্যানের লোকজনের হাতেই  সাংবাদিক সাইফুল বিপ্লব খুন হন। আজও ঝুলে আছে মামলা। এমনকি তদন্ত রিপোর্টের কোন হদিসও নেই। ম্যানেজের মধ্যেই ম্যানেজ করা বেপারির সহজ কাজ। বেপারি চেয়ারম্যান কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই   সাংবাদিকরা চাউল চুরির বিষয়টি জানতে বিভিন্ন প্রশ্ন শুরু করতেই বেপারি চেয়ার ছেড়ে ক্ষেপে উঠলেন। জেলা শহর থেকে আগত সিনিয়র সাংবাদিক বেপারি কে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমরা আপনার রাগ গোসা আর চোখ রাঙানো দেখতে আসেনি। আপনার চাউল চুরি সহ বিগত দিনের অনিয়ম ও দূর্নীতির প্রতিবেদন তৈরি করতে বিশেষ এসাইনমেন্টে এখানে এসেছি। আপনি সহযোগিতা না করলেও আমাদের কাজ থেমে থাকবেনা। মৃদু হেসে ওঠে বেপারি চেয়ারম্যান অনর্গল উল্টোপাল্টা বকবক করে বললেন, দ্যাখেন সাংবাদিক সাহেবরা, ইতিপূর্বে বহু প্রতিবেদন করেছেন একদম খামাখা। আপনাদের  অফিস পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেও ছাপা কাগজে বা টিভিতে পৌঁছাতে পারেনি। আপনাদের সম্পাদকদের এই সাহস নেই। আর কোনদিন হবেও না। তাই অযথা বিভ্রান্তি না করে চা নাস্তা খেয়ে চলে যান। এই যে অফিসের সামনে আমার দুইটি গাড়ি দাড়ানো আছে, প্রয়োজনে আপনাদের পৌঁছে দিবে। এই বলেই চেয়ারম্যান সাহেব বেশকয়টি বিশেষ কালারের খাম বাহির করলেন। সবাইকে দিতে গিয়ে আবার ব্যর্থ হলেন। 

রাত দশটা। খাবারদাবার সেরে বেপারি চেয়ারম্যান টিভি চ্যানেল ঘুরাচ্ছেন। হঠাৎ টিভি পর্দায় নিজেকে আবিষ্কার করলেন। তার চাউল চুরি ঘটনা সহ বিগতদিনের কর্মকাণ্ডের প্রতিবেদন দেখে নিজের-ই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। এই প্রথম টিভির ভিতরে বেপারি চেয়ারম্যান। সাথে সাথেই স্থানীয় কয়েকটি পত্রিকার সম্পাদক কে ফোন দিলেন। যারা সবসময় বেপারি চেয়ারম্যানের ফোনের অপেক্ষায় থাকেন, তারা আজ বেপারির ফোন রিসিভ করলেন না। যা হবার রীতিমত তাই হয়ে গেল। ভোরের সূর্যের আলোর সাথে মিশে গেলেন বেপারি চেয়ারম্যান। জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার লিড নিউজ 'দুর্ধর্ষ চেয়ারম্যান সোলাইম বেপারী চাউল চোর'। 

সরকার প্রধানের কড়া নির্দেশ। বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস কে পুঁজি করে কেউ চাউল চুরি বা কোন অনিয়ম করলে ছাড় দেওয়া হবেনা। এমনকি দলীয় লোকজন হলেও রক্ষা নেই। সকাল ৯ টা বাজে। বেপারি চেয়ারম্যান সকালের নাস্তা খেয়ে রেডি হচ্ছে আর চিন্তা করছে কি ভাবে কি ম্যানেজ করতে হবে। এই মুহূর্তেই থানার ওসি সাহেব দুই গাড়ি পুলিশ নিয়ে হাজির। বেপারি ওসি সাহেব কে নাস্তা পানি খেতে বললেও আজ ওসি সাহেব এর মুড অন্যরকম। মন গলছে না। ওসি সাহেব বেপারি চেয়ারম্যান বললেন, আপনাকে নিতে এসেছি, থানায় যেতে হবে। উপরের নির্দেশ আছে। 

বেপারি ওসি সাহেব এর কথা শোনে রাগে দাঁতে দাঁত চেপে ধরছে। সে যেতে চাচ্ছে না, অনেক তালবাহানা করছে। হঠাৎ রাগে ক্ষেপে উঠলেন বেপারি। বললেন, মন্ত্রী মহোদয় এর সাথে কথা বলতে হবে। ওসি সাহেব জানালেন, আজ মন্ত্রী মহোদয় এর সাথে কথা বলে কাজ হবেনা। আরও উপরের নির্দেশ আছে। 

সহজে যেতে না চাইলে বেপারি চেয়ারম্যান কে হাতকড়া পরিয়ে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আনন্দপুর ইউনিয়নবাসীর আজ আনন্দের শেষ নেই। যুবসমাজ উল্লাস করছে, অতিউৎসাহী কয়েকজন বেপারি চেয়ারম্যান কে জুতা নিক্ষেপ করছে। এতদিন যারা টুঁ শব্দও করেনি, তাদের অনেকেই আবার থুথু দিচ্ছে। চাউল চোর বেপারি চেয়ারম্যান এর দীর্ঘ প্রভাব প্রতিপত্তির মূলোৎপাটন হলো করোনা ভাইরাস কাছে।

 

মনসুর আহমেদ 
সম্পাদক, ত্রৈমাসিক শব্দকথা
রামকৃষ্ণ মিশন রোড, হবিগঞ্জ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top