সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০


শোধ : শেখ মোহাম্মদ হাসানূর কবীর


প্রকাশিত:
৭ মে ২০২০ ২০:১০

আপডেট:
২৫ জুন ২০২০ ২১:৫৭

 

এক চৈত্রসংক্রান্তিতে লতিবপুর হাট থেকে বাড়ি ফেরার পথে নরসুন্দা নদী পার হওয়ার সময় বজ্রপাতে রাবেয়ার স্বামী কবজ শেখ মারা গেল। কবজ শেখের আর্থিক অবস্থা সংগতিপন্ন ছিল না। সুতরাং কবজ শেখের মৃত্যুতে রাবেয়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।  
রাবেয়া তখন মধ্যবয়সী যুবতী; সুঠাম নিভাঁজ শরীর আর দুধেআলতা গায়ের রঙ। অভাবের সংসারে মাদকতাভরা এই পড়ন্ত যৌবন রাবেয়ার জীবনে কাল হয়ে উঠলো।

হাতেমের বয়স সেই সময়ে সবেমাত্র আট বছর। বড় দুই ছেলের মৃত্যুর পর জন্ম হয় হাতেমের। ছেলের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎচিন্তা রাবেয়াকে অস্থির করে তোলে। বাঁচার তাগিদে রাবেয়া চণ্ডিপুর গ্রামের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো সহযোগিতা না পেয়ে অবশেষে নরসুন্দা নদীর ওপারে লতিবপুর গ্রামে আরোজ বেপারীর বাড়িতে কাজ নেয়, কিন্তু বংশপরম্পরায় লতিবপুর গ্রামের মানুষের সাথে চণ্ডিপুর গ্রামের মানুষের বৈরী সম্পর্কের কারণে লতিবপুর গ্রামে রাবেয়ার কাজ নেয়ার বিষয়টি চণ্ডিপুরগ্রামবাসী মেনে নিতে পারে না।  
দবিরউদ্দিন প্রামাণিক একদিন রাতে রাবেয়ার বাড়িতে এসে রাবেয়াকে শাসিয়ে যায়,
শোনো কবজের বউ, তোমার সম্পর্কে গ্রামে নানান কথা হাওয়ায় ভাইস্যা বেড়ায়। তুমি নাকি লতিবপুরে আরোজ বেপারীর বাড়িত কাম নিছ ?
রাবেয়া দবিরউদ্দিন প্রামাণিকের কথার উত্তর দিতে গেলে দবিরউদ্দিন প্রামাণিক মাঝ পথে তাকে থামিয়ে দেয়, ধমকের সুরে বলে,
থামো, মাইয়্যা মানুষের এতো কথা কিসের ? বার হাত কাপড়ে যাগর গতর ঢাকেনা, তাগর এত বুঝন ঠিক না ! তুমি চণ্ডিপুরের ইজ্জত মারছ। আইজকার মতন তোমারে কইয়া যাই, লতিবপুর গ্রামে যেন তোমারে আর যাইতে না দেখি !
কথাগুলো বলেই হনহন করে বেরিয়ে যায় দবিরউদ্দিন প্রামাণিক। রাবেয়া অস্ফুটে বলে,
যেইসময় মায়-পুতে তিন দিন না খাইয়া ছিলাম, গেরামের একটা মানুষ খোঁজ নিলনা বাইচ্চা আছি, না মইরা গেছি ; অহন গায়ে জ্বলন ধরে ক্যান ? পেটে ভাত না থাকলে গেরামের ইজ্জত দিয়া কি করবাম ?

সেদিনের পর থেকে কারণে অকারণে রাবেয়ার বাড়িতে আসে দবিরউদ্দিন প্রামাণিক। ঘরে বসে অসংলগ্ন কথা বলে ভাব জমাতে চেষ্টা করে রাবেয়ার সাথে,
শুনলাম বেপারীর বাড়িতে কাম বন্ধ কর নাই, কথাটা কি ঠিক ?
যাউগ্যা, কাজকাম কইরা খাইতাছ খাও।
কাজ কাম কইরা খাওন দোষের কিছুনা, তয় গ্রামের ইজ্জতের দিকে একটু খেয়াল রাইখ্যো।
পাকা আমের মতন গতর তোমার, কাউয়ায় নি আবার মুখ দেয়।
কথাগুলো বলেই শকুনের মতন ক্ষুধার্ত দৃষ্টিতে রাবেয়ার দিকে তাকিয়ে গুড়গুড় শব্দে হাসতে থাকে দবিরউদ্দিন প্রামাণিক।

প্রথম প্রথম রাবেয়া দবিরউদ্দিনকে বাড়িতে না আসতে অনুরোধ করতো, কিন্তু দবিরউদ্দিন সে কথায় কান দিতো না। রাবেয়ার ভয়, কলঙ্ক রটে গেলে সে কীভাবে সমাজে মুখ দেখাবে ?
রাবেয়া পুনরায় অত্যন্ত কঠিন ভাবে দবিরউদ্দিন প্রামাণিককে বাড়িতে আসতে বারণ করে। দবিরউদ্দিন প্রামাণিক অপমানিত হয়। অপমানিত হয়ে সে চণ্ডিপুর গ্রামের লোকজনকে ক্ষেপিয়ে তোলে।
শেষমেশ লতিবপুরের বেপারী বাড়ির কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় রাবেয়া। সংসারের অভাব অনটন রাবেয়াকে দিশেহারা করে তোলে। কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে কবজ শেখের রেখে যাওয়া জমিটুকুুতে হাতেমকে নিয়ে কোদাল দিয়ে কোপিয়ে চাষবাস করে এবং জমানো কিছু টাকা দিয়ে হাটে-বাজারে ভাসমান দোকান চালিয়ে কোনোরকমে রাবেয়া ক্ষুন্নিবৃত্তি করে।
স্ত্রীলোকের এমন অবাধ চলাফেরা ভাঁটি অঞ্চলের মানুষ ইতঃপূর্বে কখনো দেখেনি ; তাই উছমানপুর, লতিবপুরসহ গ্রাম-গ্রামান্তে রাবেয়াকে নিয়ে সমালোচনা ও নিন্দার ঢেউ বইতে থাকে। চণ্ডিপুর গ্রামেও সে ঢেউয়ের ধাক্কা এসে লাগে।

রাবেয়ার এরুপ কর্মকাণ্ড- চণ্ডিপুর গ্রামের মানুষকে লজ্জিত করে। দবিরউদ্দিন প্রামাণিক ডেকে এনে রাবেয়াকে বাড়ির ত্রিসীমানার বাইরে যেতে নিষেধ করে, কিন্তু রাবেয়া নির্বিকার। অবশেষে চণ্ডিপুর গ্রামে দবিরউদ্দিন প্রামাণিকের বৈঠকখানায় রাবেয়াকে নিয়ে দরবার বসে। রাবেয়ার এ সকল নির্লজ্জ কর্রমকাণ্ডের জন্য দবিরউদ্দিন প্রামাণিক রাবেয়াকে কাঁচাকঞ্চি দিয়ে বেদম পেটানোর নির্দেয় দেয়।
রাবেয়া প্রতিবাদ করে,
গেরামের বেটাইন মানুষ যদি সব কাম করবার পারে ; হাট বাজারত যাইবার পারে, তয় আমি পারতাম না ক্যান ? বেইটান বইল্যা আমি কি মানুষ না ? আফনের এই এক চইখ্যা বিচার আমি মানতাম না !
রাবেয়া দবিরউদ্দিন প্রামাণিকের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করলে চণ্ডিপুরগ্রামবাসী লাঠিসোটা নিয়ে রাবেয়ার উপর চড়াও হয়, দবিরউদ্দিন প্রামাণিক গ্রামের মারমুখী লোকজনকে শান্ত থাকতে বলে মনে মনে রাবেয়াকে ঘায়েল করার ভিন্ন ফন্দি আটতে থাকে।
দরবার শেষ হলে রাবেয়া টলতে টলতে ঘরে ফিরে আসে। গ্রামের পুরুষ শাসিত সমাজের প্রতিকারহীন দাম্ভিকতা ও বর্বরতার কথা মনে পড়ে রাবেয়ার দুইগণ্ড বেয়ে চোখেরজল গড়িয়ে মাটিতে পড়তে থাকে।

একদিন ঝড় বৃষ্টির রাতে আধভেজা হয়ে কোথা থেকে দবিরউদ্দিন প্রামাণিক রাবেয়ার ঘরের দরজায় এসে রাবেয়াকে চুপি চুপি ডাকতে থাকে। রাবেয়া বিরক্ত হয়ে ঘরের দরজা খোলে। হাতেম তখন ঘুমে অচেতন। দবিরউদ্দিন রাবেয়ার গাঘেঁষে বসে অপ্রাসঙ্গিক আলাপ জুড়ে দেয়,
আহ্হারে, সোনার যৈবন পুইড়া আঙ্গার, দেখার মানুষ নাই !
কথাগুলো বলতে বলতে দবিরউদ্দিন রাবেয়াকে বুকের কাছে টেনে নেয়। রাবেয়া দপ করে জ্বলে উঠে,
আফনে বাইরন্ ঘর থাইক্কা, অখ্খনি বাইরন্ !
দবিরউদ্দিন ফিস্ ফিস্ করে বলে,
চিল্লাইও না, ময়না পাখি। তোমারে আমি কলেমা পইড়া হালাল কইরা লইবাম।
রাবেয়া খেঁকিয়ে উঠে,
আফনে অখ্খনই বাই’রইয়া যাইন ঘর থাইক্যা। নইলে দাও দিয়া কোফাইয়া কল্লাটা নামাইয়া ফেললাম।
অবস্থা বেগতিক দেখে দবিরউদ্দিন প্রামাণিক দ্রুতপদে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় এবং বার বার তাকে অপমানের কঠিন শোধ নেয়ার সংকল্প করে বাড়ি ফেরে।

দবিরউদ্দিন প্রামাণিক সুযোগ খুঁজতে থাকে। রাবেয়াকে সে লোভ দেখায় সুখী ও সমৃদ্ধজীবনের ; লোভ দেখায় নতুন আরেকটি সংসারের। কোনো কিছুতেই কিছু হলো না। কেবল একদিন হঠাৎ রাবেয়াকে খুঁজে পাওয়া গেলনা। সকালবেলা গ্রামের লোকেরা দেখলো নরসুন্দা নদীতে ভাসছে রাবেয়ার লাশ।
গ্রামে রটে গেল, অভাবের যন্ত্রণা সইতে না পেরে রাবেয়া নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

 

শেখ মোহাম্মদ হাসানূর কবীর

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top