সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১


শিক্ষকতা কী, শিল্প না দর্শন? : নজরুল ইসলাম


প্রকাশিত:
১৯ মে ২০২০ ২০:৫৭

আপডেট:
১৯ মে ২০২০ ২১:০৬

 

আমি যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি, তখন সেটা নব্বই সাল। দেশের রাজনীতির এক উত্তাল সময়। তবে সেই সময় দশ বছর বয়সি এক কিশোরের মনে দেশের রাজনৈতিক গতিপ্রবাহ কেমন তা নিয়ে চিন্তা করার কথা নয়। আমার মনেও তখন রাজনৈতিক কোনো চিন্তা বা দর্শন ছিল না। নিতান্তই কিশোর এক শিক্ষার্থীর ভাবনা জুড়ে যা থাকত, তা হচ্ছে তার নিজের বানানো স্বপ্নের জগৎ। মাঝে মাঝে সেই স্বপ্নের দুনিয়ায় হানা দিত স্কুলের ‘হোম ওয়ার্ক’। তারপরও আমি কখনও স্কুলবিমুখ ছিলাম না; বরং কী যেন একটা ভালোলাগা কাজ করত। হয়ত সেটা কিছুটা ঘোরলাগার মতো ছিল।

মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। সময়টা দুই হাজার দশ সাল। সেই সময় সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের সঙ্গে শিক্ষক ও শিক্ষণ নিয়ে কথা বলার সুযোগ হলো। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন, আমাদের দেশের প্রখ্যাত নাট্যকার, অভিনেতা ও ভাষাসৈনিক মমতাজউদদীন আহমদ চট্টগ্রাম কলেজে পড়ার সময় তাঁর শিক্ষক ছিলেন। অবসরপ্রাপ্ত সেই সামরিক কর্মকর্তার মতে, তিনি ছিলেন অসাধারণ এক শিক্ষক। যখন তিনি শ্রেণিতে বাংলা ভাষা সাহিত্য এবং বাংলা ও ইউরোপীয় নাট্য বিষয়ে পড়াতেন তখন অন্য শ্রেণির শিক্ষার্থীরা দরজা-জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকত! শিক্ষক সম্পর্কে ওনার সর্বশেষ উচ্চারণ ছিল, ‘হোয়াট আ ট্রিমেনডাস টিচার হি ওয়াজ!’

আমি ওনার কথা শুনে অভিভূত হয়ে গেলাম। যতটা না শুনে তিনি কত ভালো শিক্ষক ছিলেন, তার চাইতে বেশি একজন শিক্ষার্থীর তার শিক্ষককে নিয়ে গর্ব করার ধরন দেখে, মুগ্ধতা দেখে। বিশেষ করে শেষের দিকে উচ্চারণ করা কথাটা শুনে!

এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। আগেই বলেছি, ‘হোম ওয়ার্ক’ ভীতির মধ্যেও স্কুল নিয়ে আমার মধ্যে একটা দারুণ ভালোলাগা কাজ করত। স্কুলের শিক্ষাবর্ষের শেষের দিকে এসে সেই ঘোরলাগাটা আরও বেড়ে গেল। পঞ্চম শ্রেণিতে আমাদের শেষের ঘণ্টা নিতেন হেড স্যার মাকসুদুল হক বাবলু। আমি সারা দিন অধীর আগ্রহে বসে থাকতাম ওই শেষের ঘণ্টাটা করার জন্য। স্যার যখন পড়াতেন তখন আমার সময় কখন যে উড়ে চলে যেত, তা আমি কোনো দিনই টের পেতাম না।

পুরো পিরিয়ডের শেষের দিকের পাঁচ মিনিট বরাদ্দ থাকত গল্পের জন্য। না, শিশু-কিশোরদের শোনানোর জন্য কোনো সস্তা গল্প নয়, বিশ্বসাহিত্যের বিখ্যাত সব গল্প। আমার মনে আছে, বিশ্বসাহিত্যের যত শিশু-কিশোর গল্প ছিল, তার প্রায় অনেকগুলোই সেই সময়ে আমার জানা হয়ে গিয়েছিল। স্যার যখন পড়াতেন বা গল্প করতেন তখন আমি দেখেছি অন্য শ্রেণির শিক্ষার্থীরা একটু আগে তাদের শ্রেণি থেকে বেরুবার চেষ্টা করত, শুধু আমাদের শ্রেণির দরজা-জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়ে স্যারের ক্লাস দেখার জন্য।

লেখার ঠিক এই পর্যায়ে এসে সেই শিক্ষক সম্পর্কে আরেকটু বলতে ইচ্ছে করছে। আবার একটু অস্বস্তিও অনুভব করছি, কারণ আমার মনে হচ্ছে এই প্রচেষ্টা সেই শিক্ষকের প্রতি আমার যে মুগ্ধতা, তা অতিক্রম করতে পারবে না। আসলে সেই সময়েই হয়ত একজন ক্ষুদ্র শিক্ষার্থীর মনে একজন শিক্ষকের জন্ম নেওয়া শুরু হয়েছিল। আমি শিক্ষক হবো, তা কখনও ভাবিনি। তবে এই বিষয়টা আমায় খুব প্রভাবিত করত যে, একটা মানুষ অনেকের সামনে দাঁড়িয়ে নতুন নতুন সব জ্ঞানের কথা বলছেন, আর সবাই অবাক বিস্ময়ে তার কথা শুনছে!

জীবনের একটা পর্যায়ে এসে আমি একজন শিক্ষক ছিলাম। শিক্ষক তৈরি হওয়ার তো কোনো স্কুল নেই, যেমনটা আছে ডাক্তার বা প্রকৌশলী হওয়ার জন্য। একজন ডাক্তার বা প্রকৌশলীও জীবনের কোনো একটা সময়ে শিক্ষক হতে পারেন। আবার কোনো একটা বিশেষায়িত জ্ঞান অর্জন না করেও কেউ শিক্ষক হতে পারেন। প্রশ্ন হচ্ছে কী এমন গুণ বা অনুপ্রেরণা যা একজন মানুষকে শিক্ষক বানায়? আমার মনে হয়, প্রত্যেকটা মানুষের শিক্ষক হওয়ার পেছনে একজন শিক্ষক থাকেন, একজন শিক্ষকের দর্শন থাকে। কারণ প্রত্যেক শিক্ষকই তো একজন দার্শনিক।

শিক্ষকতা একটা শিল্প, প্রভাবিত করার শিল্প। আমার শিক্ষক হওয়ার পেছনে যে দর্শন বা অনুপ্রেরণা কাজ করেছে তা আমি জানি না। তবে পঞ্চম শ্রেণির ওই শেষের ঘণ্টাটা আমাকে দারুণ প্রভাবিত করেছিল, এবং এখনও করে। অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের মতো মাকসুদুল হক বাবলু স্যার সম্পর্কে আমারও বলতে ইচ্ছে করে, ‘সত্যিই, হোয়াট আ ট্রিমেনডাস টিচার হি ওয়াজ!’

যখন শিক্ষক ছিলাম, আমি নিজেও সুযোগ পেলে শ্রেণিতে আমার শিক্ষার্থীদের বিশ্বসাহিত্যের শিক্ষামূলক শিশু-কিশোর গল্প বলার চেষ্টা করতাম। আমি অবাক হতাম, ওরা প্রাথমিক স্তর শেষ করে এলেও অনেকেই এই গল্পগুলো আগে শোনেনি। হয়ত সিলেবাসে ছিল না, তাই শোনেনি। অথচ আমরা কি সৌভাগ্যবানই না ছিলাম!

যখন আমি শ্রেণিকক্ষে পড়াতাম তখন আমার শিক্ষার্থীরা আমাকে অতটা আগ্রহ নিয়ে শুনত কিনা তা আমি জানি না। কিংবা মাঝে মাঝে যখন গল্প বলার চেষ্টা করতাম তখন অন্য শ্রেণির শিক্ষার্থীরা দরজা-জানালার পাশে চুপিসারে এসে দাঁড়াত কিনা, তাও খেয়াল করা হয়নি। তবে একটা স্বপ্ন প্রায়ই দেখতাম, একদিন হয়ত আমার কোনো এক শিক্ষার্থী আমার সম্পর্কে বলবে, ‘হোয়াট আ ট্রিমেনডাস টিচার হি ওয়াজ!’ তবে এই স্বপ্ন যদি সত্যি নাও হয়, ক্ষতি নেই। কারণ এখানে স্বপ্ন সত্যি হবে কিনা তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, আমি যে স্বপ্ন দেখেছি, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

যেসব শিক্ষার্থী আগামী দিনে একজন ‘ট্রিমেনডাস টিচার’ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, তাদের জানাই অগ্রিম শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

 

নজরুল ইসলাম
কলাম লেখক, প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ; উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়
এমফিল রিসার্স ফেলো, স্কুল অব এডুকেশন, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top