সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১


কারিগর : মুহাম্মদ শামীম রেজা


প্রকাশিত:
২০ মে ২০২০ ১১:২৭

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৭:১৩

 

স্কুল বিমুখ দুষ্টু ছেলেরা আজ যে যার মতো পালাচ্ছে। কেউ ঝোপ-ঝাড়ে, কেউ টয়লেটে, কেউ-বা গোয়াল ঘরে। কিন্তু তারপরও নিস্তার পাওয়া যাচ্ছে না। আব্দুল্লাহ স্যার কাউকে গোয়াল ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসছেন, কাউকে ভাঙা টয়লেট থেকে, কিংবা ঝোপ-ঝাড় থেকে। এই চিত্র প্রায় প্রাত্যহিক। যেসব ছাত্র স্কুলে অনুপস্থিত থাকে আব্দুল্লাহ স্যার তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্কুলে নিয়ে আসেন। তাঁর সাথে থাকে একদল ছাত্র। যারা স্কুল পালানো ছেলেমেয়েদের ধরে নেওয়া অর্থাৎ স্কুলে নিয়ে যাওয়া ব্যাপারটা খুব উপভোগ করে। অনেক ক্ষেত্রে খুনসুটি কিংবা ঝগড়াঝাটির সময় ওই ছাত্রদের বেশ আয়েশ করে বলতে শোনা যায়- ‘ওই আমি তরে ইস্কুলে ধইরা আনছি মনে নাই?’ পাঠক এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন আমাদের আব্দুল্লাহ স্যার একজিন শিক্ষক। মানুষ গড়ার কারিগর। এই অঞ্চলে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়।জনশ্রুত এই অঞ্চলের চেয়ারম্যান কিংবা ভবিষ্যতে চেয়ারম্যান হতে ইচ্ছুক সবাই আতঙ্কে থাকে এই ভয়ে যে, কখন না আবার এই লোক ঘোষণা দিয়ে বসেন যে উনি চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। যতো দিন যাচ্ছে অর্থাৎ আব্দুল্লাহ স্যারের অবসরের  দিন ঘনিয়ে আসছে ততোই তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে। 

এক শ্রেণির লোক ছাড়া আব্দুল্লাহ স্যার সবার কাছে সমান জনপ্রিয়। অনেকের মতে এই এলাকার মানুষের সাত জনমের ভাগ্য যে তারা আব্দুল্লাহ স্যারের মতো শিক্ষক পেয়েছে।
রাস্তাঘাটে হাগবো না
পাখির বাসা ভাঙবো না...
আব্দুল্লাহ স্যার সুর করে পড়াচ্ছেন। ক্লাস শুরু করার পূর্বে প্রত্যেক দিন তিনি এই নীতিছড়া শোনান। ছাত্ররা এই ছড়া উপভোগ করে শোনে। আব্দুল্লাহ স্যারের ছড়া চলাকালীন ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়-
: স্যার কে জানি আসছে!
স্যার মহাবিরক্ত হলেও দরজার বাইরে তাকান...। তাঁর চোখ ছানাবড়া! আজ শনিবার। এই দিনে তো শিক্ষা অফিসার আসার কথা না। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে শিক্ষা অফিসার। নাহ্ আর ভাববার সময় নেই। ভাবতে ভাবতে পড়ি তো মরি, আব্দুল্লাহ স্যার অফিসের দিকে ছুটলেন। অবশ্য ছাত্রছাত্রীরা কেউ অবাক হলো না। তারা জানে উপর থেকে কেউ স্কুলে এলে প্রায়ই স্যার এমন কান্ড করেন। কারণ অন্য কিছু না, আব্দুল্লাহ স্যার প্রায় সময়ই লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি পড়ে স্কুলে আসেন। অফিসে পাজামা তোলা রাখা থাকে। বড় অফিসার কেউ এলেই কেবল স্যার পাজামা পরে্ন আজও তাই তাড়াহুড়ো করে স্যার পাজামা পরতে গেলেন। ছাত্ররা ক্লাসে বসে থাকলো। শিক্ষা অফিসার চলে গেলে স্যার আবার পাঠদানে মনোযোগী হন। কিন্তু তার আগে ঘটে অভাবিত ঘটনা। ক্লাসের ছাত্ররা মনে হয় এই ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। আব্দুল্লাহ স্যার ক্লাসের দুষ্টু ছেলে হিসেবে পরিচিত জাহিদকে ডাকলেন-
: জাহিদ এদিকে আয়।
জাহিদ এলো না। ভয়ে গুটিয়ে গেল। আব্দুল্লাহ স্যার অভয় দিলেন-
: আরে আয় ব্যাটা! তুই আমার বাপের কাজ করেছিস রে পাগলা। লুঙ্গি পরার অপরাধে আজ তো আমার শোকজের দিন ছিল রে। আয়...।
জাহিদের এবার বিশ্বাস হলো স্যার মারবে না। জাহিদ এগিয়ে এলো। স্যার তাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। পরম মমতায় আদর করতে লাগলেন। জাহিদের চোখে পানি চলে এলো।  হঠাৎ তার কী হলো কে জানে! জাহিদ ঘোষণা দিয়ে দিলো-
: স্যার আমি আর দুষ্টামি করুম না। নিয়মিত স্কুলে আসুম। কাউরে মারুম না।  
জাহিদের এমন পরিবর্তনে মনে হয় ক্লাসের সবাই বেশ খুশি হয়। আনন্দে সবাই একত্রে হাততালি দিয়ে জাহিদকে স্বাগত জানায়।
সেদিন ছিল শরতের শেষ দিন। স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আব্দুল্লাহ স্যার। এমন সময় স্যারের প্রাক্তন ছাত্র আকবর অফিসে ঢুকল। স্যার জিজ্ঞেস করলেন-
: কিরে কী খবর?
আকবর কিছু বলল না। তার চোখ দিয়ে টপটপ অশ্রু ঝরতে লাগল। স্যার অবাক হলেন-
: কিরে, কী সমস্যা? কাঁদছিস কেন?
আকবর কোনো কথা বলতে পারছে ন। কেঁদেই যাচ্ছে। স্যার হাত ধরে বসালেন। যা জানা গেল নতুন কিছু না, আকবরের এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপের টাকা নেই। দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান আকবর। বাবা বলেছে পড়াশোনার দরকার নাই। গরিবের আবার কিয়ের লেখাপড়া! কিন্তু আকবর পড়ালেখা করতে চায়।
স্যার অনেকক্ষণ নীরব থেকে বললেন-
: এই তোর সমস্যা? আচ্ছা যা আমি টাকা দিব। তুই বাড়ি যা। কাল এসে টাকা নিয়ে যাস।
আব্দুল্লাহ স্যারের রাতে ভালো ঘুম হলো না। একে বয়স বাড়ার কারণে এমনিতেই ঘুম কম হয়, তার উপর আকবরের জন্য টাকার যোগাড় কোথা থেকে করবেন? এই চিন্তায় ঘুম হলো না। যে বেতন পান তা চার সদস্যের সংসারে টানাটানি লেগেই থাকে। স্ত্রীর কাছে যে কথাটা তুলবেন তারও সাহস পাচ্ছেন না। পাছে সংসারে অশান্তি হয়। কিন্তু তারপরও তিনি ভাবলেন সকালে স্ত্রীর কাছে টাকা চাইবেন। সকালবেলা তার ঘুম ভাঙলো ছেলের চিৎকার চেঁচামেচিতে। তিনি তার স্ত্রীর কাছে টাকা চাইতে পারলেন না। এই পরিস্থিতির পর আসলে টাকা চাওয়ার বিষয়টা গৌণ হয়ে যায়। তিনি এখন ভাবছেন, কী করা যায়? কার কাছে টাকা ধার চাওয়া যায়। হঠাৎ বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নিত্য বাবুর কথা মনে পড়ে যায়। তার কাছে গেলে অবশ্যই একটা ব্যবস্থা হবে। কিন্তু সমস্যা হলো আব্দুল্লাহ স্যার প্রচনড আত্মমর্যাদাশীল মানুষ। কারো কাছে টাকা ধার নিতে গেলে দ হয়ে আসে। আবার আজকের মধ্যে টাকার ব্যবস্থা না হলে ছেলেটার পরীক্ষায় বসা হবে না। সামান্য ক’টা টাকার জন্য কামগ্ধ্বত্তরো লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে, স্যার তা মেনে নিতে পারছেন না। নিজের সন্তান তো উচ্ছন্নে গিয়েছে।  জীবনে কতো স্বপ্ন ছিল ছেলে লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হবে। তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হবে। লোকে দেখে বলবে ‘ওই দেখ আব্দুল্লাহ মাস্টারের ছেলে যায়। আহা! বাপকা বেটা!’ অথচ কী আফসোস! কী নির্মম সত্য। আব্দুল্লাহ মাস্টরের সন্তান বিপথগামী, নেশাগ্রস্ত। ছেলে যখন আধো আধো বুলিতে বাবা বলে ডাকতো, তখন মনে হতো সকল জাগতিক সুখ যেন কেবলই তার। আর এখন যখন কেউ বলে ছেলে নেশা করে পড়ে আছে তখন দুঃখে কষ্টে অপমানে বোবা কান্না ভেতর থেকে ডুকরে কেঁদে ওঠে। বলে ‘মাটি তুই দুই ভাগ হয়ে যা, আমি লুকিয়ে পড়ি।’

হঠাৎ মাস্টার সাব সম্বোধনে আব্দুল্লাহ স্যারের পিলে চমকে যায়। ফিরে দেখেন নিত্য বাবু।
: কী মনে করে আসছিলেন মাস্টার সাব।
: আমার কিছু টাকার দরকার ছিল, যদি দিতেন।
: ম্যানেজার, মাস্টার সাবের কত লাগে দিয়া দেও।
: ধন্যবাদ বাবু...
: হঠাৎ টাকার প্রয়োজন হলো যে...? না, মানে আপনি কখনো....
: আমার প্রাক্তন ছাত্র টাকার জন্য এসএসসি’র রেজিস্ট্রেশন করতে পারছে না। জানেন তো মাস্টার মানুষ, মাস শেষে পকেট থালি থাকে... তাই!

আকবর বাড়িতেই ছিল। আনমনে জানালার বাইরে তাকিয়ে কি যেন ভাবছিল। হয়তো ভাবছে আজই তার লেখাপড়ার শেষ দিন। স্কুলের বকেয়া টাকাও জমা দিতে পারবে না। পরীক্ষাও দেওয়া হবে না। আহা মানুষের যে কেন এত অভাব থাকে? সৃষ্টিকর্তা যে ক্যান এমন করে? সকলেই তো তাঁর সৃষ্টি। অথচ কারো অনেক টাকা। আবার কারো একেবারেই নেই। আকবরের মা হাঁক ছাড়েন-
: আকবর তর ছার আইছে...। ঘরতন বাইর হ।
আকবরের কানে মায়ের ডাক পৌঁছায় না। সে উদাস মনে তাকিয়েই থাকে।
আব্দুল্লাহ স্যার ঘরে ঢুকলেন। পরম মমতায় তার মাথায় হাত রাখেন। আকবর কারো স্পর্শ অনুভব করে। তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রæ ঝরছে। স্যার তার অশ্রæ মুছে দেন।
: কিরে কাঁদছিস কেন?
আকবর এবার শব্দ করে কেঁদে ফেলে।
: স্যার আমার আর লেখাপড়া অইবো না। বাবা বইলা গ্যাছে, গরিবের পড়ালেখার দরকার নাই।
: আমি তো আছি। তর আব্দুল্লাহ স্যারের উপর ভরসা নাই? বাবার কথা বলছিস? আরে পাগলা মানুষের পকেটে টাকা না থাকলে মন মেজাজ ঠিক থাকে না। আর মেজাজ ঠিক না থাকলে মানুষ অনেক কথাই বলে। তুই তো পড়ালেখা করে মানুষের মতো মানুষ হতে চাস, তাই না? মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখিস না? শোন আকবর মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় হয়। তোর কাজ পড়ালেখা করা, তুই তাই কর। বাকিটা আমি দেখছি।
আব্দুল্লাহ স্যার পকেট থেকে টাকা বের করে আকবরের হাতে দিলেন। হঠাৎ আকবরের কী হলো কে জানে? আব্দুল্লাহ স্যারকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগল। আকবরের মা এই সময়ে ঘরে না ঢুকলে হয়তো আবেগঘন এই পরিবেশ চলতেই থাকতো।
: মাস্টার সাব আফনের এই ঋণ আমরা ক্যামনে শোধ দিয়াম?
: আপনাকে কিছুই করতে হবে না। আকবর বড় হয়ে যখন চাকরি করবে তখন আমাকে একটা কিছু কিনে দিলেই হবে। কিরে দিবি না?
আকবর ফিক করে হেসে দেয়...।
: যা এবার স্কুলে টাকা জমা দিয়ে আয়।

আব্দুল্লাহ স্যারের আজকাল কিছুই মনে থাকে না। সেদিন স্ত্রীকে এক বিখ্যাত ব্যক্তির উক্তি দিচ্ছিলেনÑ ‘আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে একটি শিক্ষিত জাতি দিব’। সমস্যা হলো নেপোলিয়ানের এই বিখ্যাত উক্তিটি বলতে পারলেন নাম মনে রাখতে পারলেন না। অথচ তিনি এই উক্তি কতবার কতজনকে শুনিয়েছেন হিসেব নেই।
আব্দুল্লাহ স্যার আরও একটি সমস্যায় ভুগছেন। ঘুমের মধ্যে তিনি হৈচৈ-এর শব্দ শুনতে পান। আর মাঝরাতে চিৎকার দিয়ে ওঠেন, ‘এই চুপ-একদম চুপ, কোনো শব্দ নেই’। স্ত্রী তখন একটু ধাক্কা দেন।
: কী সমস্যা তোমার? কারে চুপ থাকতে কও! ঘুমের মধ্যেও তুমি মাস্টারি করবা?
তিনি তখন শান্ত হন, কিছুটা লজ্জিতও হন। কিন্তু স্ত্রীর কথায় কোনো আগ্রহ দেখালেন না। বিশেষ করে ছেলে সুমনকে যেদিন নেশাগ্রস্ত অবস্থায় পুলিশ ধরে নিয়ে গেল সেদিন থেকে সমস্যা বেশি দেখা দিচ্ছে। ছেলেকে তিনি ছাড়িয়ে আনতে চাননি। ভেবেছেন অনেক হয়েছে, আর না। একবার জেল খেটে যদি কিছু শুধরায়। আফসোস কত ছেলে-মেয়ে তার হাত ধরে মানুষ হলো। অথচ নিজের সন্তান...?
এজন্য একটা প্রবাদ তৈরি হয়েছে, ‘বাতির নিচে অন্ধকার’। সারা জীবন আলো ফেরি করে বেড়ানো মানুষের সন্তান বিপথগামী। এরচে’ হতাশার আর কী হতে পারে? এজন্য স্ত্রীর অবদানও কি কম ছিল। মায়ের আশকারা পেয়ে অধঃপতনের চূড়ায় পৌঁছেছে। নিজে তো শাসন করেইনি। উল্টো শাসন করতে গেলে বাঁধার প্রাচীর হয়েছে। একমাত্র ছেলে বলে ন্যায়-অন্যায় সব আবদার পূরণ করেছে।
নাহ! আব্দুল্লাহ স্যার আর ভাবতে পারছেন না। রাত বাড়ছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অস্থিরতা, দুঃশ্চিন্তা। তিনি মুক্তি চান, প্রশান্তির ঘুম চান। কিন্তু চাইলে যে মুক্তি পাওয়া যায় না। জীবনের চাওয়া-পাওয়া কিংবা দেনা পাওনার হিসেব বড় জটিল। জটিলতা বাড়ে মুক্তি মিলে না...।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top