সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১


পরিবেশ ও আমাদের দায়বদ্ধতা : অনজন কুমার রায়


প্রকাশিত:
২ জুন ২০২০ ২৩:২২

আপডেট:
২৬ জুন ২০২১ ১৯:৫৩

 

শরতের আকাশটা নীল দেখায় বলে অবলোকন করতে ভালবাসি। অলস দুপুর আমাকে এতটুকু কাছে টেনে নেয় না বলে রাঙানো বসন্তকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করি। উৎসুক মনে ঘুমিয়ে থেকে উপভোগ করার চেষ্টা করি বৈশাখে এক পশলা বৃষ্টি।

ভাবি, বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের অবয়বের জন্য ধরণী আজ এত সুন্দর! সৌন্দর্য্যের সবটুকুই পরিবেশের সান্নিধ্যে থেকে অবলোকন করা সম্ভব। প্রকৃতির প্রতি ভালবাসা কিংবা গভীর মমত্ববোধেই আঁচ করতে পারি সৌন্দর্য্যের মহিমা। প্রাকৃতিক পরিবেশটুকু সুন্দর হলেই আমরা কেবল পরিবেশের ইতিবাচক দিক উপলব্ধি করতে পারি।

পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করা এবং আমাদের ধরিত্রীকে বাঁচানোর অঙ্গীকার নিয়ে প্রতিবছর ৫ জুন 'বিশ্ব পরিবেশ দিবস' পালণ করা হয়। ১৯৭৪ সাল থেকে পৃথিবীব্যাপী সচেতনতার লক্ষ্যে দিনটি প্রতি বছর পালিত হয়ে আসছে। প্রতি বছরই আলাদা আলাদা প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে পালিত হয়ে থাকে দিবসটি। প্রথম বিশ্ব পরিবেশ আন্দোলনের থিম ছিল 'Only One World' বা 'একটি মাত্র পৃথিবী'। ২০২০ সালে প্রতিপাদ্য 'Biodiversity' বা 'জীববৈচিত্র্য'।

সুস্থ পরিবেশে প্রাণিজগৎ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার নিয়ামক বলেই পরিবেশের উপর নির্ভর করে প্রাণী জগতের অস্তিত্ব টিকে আছে।

অন্যদিকে বিষাক্ত পরিবেশ মানুষ তথা জীব বৈচিত্র্যকে নির্জীব করে তুলে। মানুষ একদিকে যেমন নিজের প্রয়োজনে নতুনত্ব আনয়ন করে পরিবেশকে সৃষ্টি করতে চায়, তেমনি পরিবেশের জন্য অশনি সঙ্কেতও বয়ে নিয়ে আসে নিজেরাই। পরিবেশের প্রতি এ অনিয়ন্ত্রিত আচরণের কারণে জীব বৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখীন।

অতি প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন কোন সত্ত্বা নয়। যুগ যুগ ধরে মানুষ এবং প্রকৃতির মাঝে নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেও আস্তে আস্তে তা বিষিয়ে আসছে। কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরনে লিপ্ত থাকা। প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের যখন থেকেই আগ্রাসন শুরু হয়ে আসছে তখন থেকেই পরিবেশ দূষিত হয়ে আসছে। এ আগ্রাসন আপাত দৃষ্টিতে মানুষের স্বার্থে মনে হলেও প্রকৃত পক্ষে বৈপরিত্যই বটে।

বায়ুমণ্ডলে যদি থাকে বিষাক্ত বায়ু, ধূলিকণা, সীসা তবে পরিবেশের জন্য অকল্যাণই বয়ে নিয়ে আসবে। বায়ুমন্ডলে সীসার প্রভাব হেতু মানুষের স্নায়ুবিক দুর্বলতা ব্যাহত হতে পারে। শব্দ দূষণ পরিবেশ দূষণের জন্য বহুমাত্রিক দায়ী। শব্দ দূষণের দরুণ উচ্চ রক্তচাপ তথা আমাদের পরিবেশের উপর যথেষ্ট বিরূপ প্রভাব ফেলে।

আবার গাড়ীতে জ্বালানী ব্যবহারের ফলে কার্বন মনোক্সাইড বের হয়ে আসে যাকে নিরব ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

এছাড়াও গাছ-পালা কেটে পরিবেশ বিনষ্ট করা হচ্ছে। নির্মল বায়ুতে প্রাণ নেয়া দিন দিন কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের মাঝেই আমরা পরিবেশের সঠিক ভারসাম্য খুঁজে পাই। সেদিক বিবেচনায় সারা বিশ্বে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বজায় নেই। পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব নিরসনে আমাদেরকেই সচেতন হতে হবে।

মানবসৃষ্ট কর্তৃক বিভিন্ন কারণে উৎপাদিত গ্রীন হাউস গ্যাস, রাসায়নিক বর্জ্য, আগাছা নাশক, তেজস্ক্রিয় পদার্থ যা পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। তেজস্ক্রিয় ও পারমাণবিক বিস্ফোরন কিংবা কার্বন নি:সরন মানব জাতির হুমকিস্বরূপ। আবার, এয়ার কন্ডিশনার, রেফ্রিজারেটর, প্লাস্টিক, রং তৈরির কারখানা থেকে প্রচুর পরিমাণে ক্লোরোফ্লোরো কার্বন গ্যাস নির্গত হয় যা ওজোন স্তরকে ধ্বংস করে। ওজোন হচ্ছে অক্সিজেনের রূপভেদ যা পৃথিবীর সুরক্ষার ঢাল হিসেবে কাজ করে থাকে। সূর্য থেকে আসা অতি বেগুনি রশ্মি এটি শোষণ করে অতি বেগুনি রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে প্রতিহত করে প্রাণীকূলকে সহজেই রক্ষা করে। অতি বেগুনি রশ্মি উদ্ভিদ কোষের সৃষ্টি এবং বৃদ্ধিকে ব্যাহত করতে পারে। ক্যান্সার রোগের জন্যও অতি বেগুনি রশ্মিকে দায়ি করা হয়।

পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব হেতু গাছ-পালা নিধন করা হচ্ছে। আস্তে আস্তে বিভিন্ন প্রয়োজনের তাগিদে গাছ-পালা কেটে সাবাড় করা হচ্ছে। সেখানে তৈরি করা হচ্ছে ঘর-বাড়ি। গড়ে তুলা হচ্ছে নগরায়ন। একটি দেশে প্রয়োজনের তুলনায় গাছ-পালা কম থাকলে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দেয়। শুরু হয় অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কোন দেশে মোট ভূমির পরিমাণের শতকরা পঁচিশ ভাগ বনভূমি থাকার প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে সে আনুপাতিক হারে বনভূমি নেই। সে পরিমাণ বনভূমি বা বৃক্ষ না থাকায় বায়ু মন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই দিন দিন বৈশ্বিক তাপমাত্রাও বেড়ে চলেছে। এভাবে বিষাক্ত গ্যাস নির্গতের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে বায়ুমন্ডলীয় স্তর দূষিত হচ্ছে। ফলে পরিবেশ ক্রমশ ভারসাম্যতা হারাচ্ছে। অথচ গাছ কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে নির্মল বাতাস দান করে, অক্সিজেন প্রদান করে। প্রাণীকূল এবং মানুষের অস্তিত্ব রক্ষায় গাছের ভূমিকা অপরিসীম।

যুগের সাথে তাল মিলিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যের তাগিদে নির্বিচারে ব্যবহার করে আমাদের পরিবেশ আমরাই বসবাসের অনুপযোগী করে তুলছি।

এ প্রসঙ্গে গান্ধীজির একটি কথা মনে আসে-" Nature is enough for our need, but it is not for our greed".প্রকৃতির এই মৃতপ্রায় অবস্থা সামগ্রীকভাবে আমরা নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছি। এর জন্য আমরাই দায়ী। মানুষ নিজের স্বার্থ হেতু প্রকৃতির সাথে বিরুদ্ধাচরন করে চলেছে। মেনে নিয়েছে বিশৃঙ্খলা।

প্রকৃতির এ ধ্বংসযজ্ঞ গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেই হয়তো রবি ঠাকুর 'প্রশ্ন' কবিতায় লিখে যান-

যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছো, তুমি কি বেসেছ ভালো।

তাই হয়তো প্রকৃতি প্রেমী ওয়ার্ডওয়ার্থও তাঁর 'টিনটিন অ্যাবে' কবিতায় নদীর তীরে দাঁড়িয়ে বিষাদময়তায় কাঁন্নার ধ্বনি শুনতে পান। নদীর মর্মর ধ্বনি যেন হারিয়ে গেছে! তাই লিখে যান-

“Five years have past; five summers, with the length
Of five long winters! and again I hear
These waters, rolling from their mountain-springs
With a soft inland murmur.—Once again”

যেহেতু জলবায়ু পরিবেশের উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে, তাই জলবায়ুর পরিবর্তনে পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। অনুকূল পরিবেশে জীবনধারণের জন্য প্রাকৃতিক ভারসাম্যের উপর জোর দিতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। তাই সার্বিক অবস্থা বিবেচনাপূর্বক বনায়নের উপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। সেজন্য শুধু দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় নয়, আস্তে আস্তে সকল এলাকায় বনায়ন বাড়াতে পারলে পরিবেশের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা সহজ হবে।

তাছাড়াও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমানো যায় এমন জিনিসের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে।

যে পরিবেশকে ঘিরে মানুষ বসবাস যোগ্য স্থান পেয়ে আসছে, সেই মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার্থে পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার তাগিদেই আমাদের পৃথিবী আমাদেরকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে হবে। তবেই আমরা প্রাণের স্পন্দন অনুভব করতে পারব। না হয় আস্তে আস্তে বিলিন হয়ে যাবে মানব জাতির অস্তিত্বটুকু যেভাবে পরিবেশের কাছে হার মেনে কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে বিভিন্ন প্রজাতির ডাইনোসর।

কাজেই পরিবেশের সাথে মানুষের চাহিদাকে এক সুরে বাঁধতে না পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সম্ভাবনা অর্থহীন করে তুলবে। প্রকৃতির এমন মেলবন্ধনেই কেবল আমরা দেখতে পাব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের অবারিত ধারা। তবেই বলতে পারবো-

এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।

 

অনজন কুমার রায়
 ব্যাংকার ও লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top