সিডনী বুধবার, ১৫ই মে ২০২৪, ৩১শে বৈশাখ ১৪৩১


গল্প - ঋতিহীন প্রতিদিন : সাজেদা আকতার


প্রকাশিত:
৫ জুন ২০২০ ০০:৩২

আপডেট:
১৫ মে ২০২৪ ০৪:৩০

 

গ্রামের নাম চৌহাঁটি। কথিত আছে, এই গ্রামের মানুষগুলো সব সময় চারজন দল বেঁধে হাঁটতো। তাই এর নাম চৌহাঁটি রাখা হয়েছে। ছায়া সুনিবিড় এই গ্রামে কোন অভাব ছিল না। নিজেরাই নিজেদের বিপদে আপদে উৎসবে একাকার থাকতো।কষ্টে উৎপাদনের খাদ্য সামগ্রী প্রয়োজনের অতিরিক্তটা  অন্যদের মাঝে বিলিয়ে দিত নির্দ্বিধায়। আন্তরিকতার কোন কমতি ছিল না সেখানে। সকল বিষয়ে একে অপরকে সাহায্য করতো। সেই গ্রামেরই একটি মেয়ে নোভা। উচ্চশিক্ষার নেশায় একদিন ছুটে যায় গ্রাম থেকে শহরে। শহরের চাকচিক্য ও বিলাসিতায় নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি। কারণ লেখাপড়া যে তার ব্রত।

কলেজে প্রথম বর্ষের মেধাবী ছাত্রী নোভা। মাধ্যমিকে বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে পাস করেছে। শান্ত-শ্যামলা বুদ্ধিমতি মেয়ে। পড়ালেখায় প্রচুর আগ্রহ। বিনয়ী নম্র নোভা অন্ধকারের অভিশাপ থেকে বেরিয়ে,  আলোর প্রদীপ জ্বালানোর নিমিত্তে, সলতে পাকানোর হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে কলেজকে। কলেজের ওরিয়েন্টেশন ক্লাশে অনেকের সাথে পরিচয় হয়। বন্ধুত্বও হয়ে যায় কয়েকজনের সাথে। তাদের মধ্যে কণা,বীণা, বিলাস, লুনা, নীলা উল্লেখযোগ্য।

পড়ালেখা করে উত্তম  মানুষ রূপে নিজেকে গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে চলছে। সময়মত কলেজে যাওয়া-আসা ছাড়া খুব একটা ঘর থেকে বেরোয় না। স্যার ম্যাডামদের সাথে পড়া বিষয়ক আলোচনা করে। না বুঝতে পারলে স্যারদের সহযোগিতা নিয়ে পড়ে। ভাল ফলাফল তাকে করতেই হবে-- এ স্বপ্নের কথা একজন ম্যাডামকে জানায়। ম্যাডামের নাম চামেলি। নিঃসন্তান হওয়ায় তিনিও নোভাকে নিজের সন্তানের মতো স্নেহ করেন। পড়ালেখা বিষয়ক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। 

কলেজ যাওয়ার জন্য যখনই বের হয় দুএকটা উড়ো টিটকারি যে উড়ে আসে না তা নয়। গ্রাম্য ভূত,ক্ষেত এগুলো তার সহে গেছে। সে প্রশ্ন করে,

"শহর এমন কেন?"

কলেজে যাতায়াত, টিফিন, হাত খরচ, বই কেনা পুরোটাই বাবার উপর নির্ভরশীল হতে নোভার আত্মসম্মানে লাগে। তাছাড়া বাবার অবস্থাও আহা মরি ভাল নয়। সে ভাবে, একটা পার্ট টাইম চাকুরি করলে মন্দ হয় না। তাছাড়া বাবার উপর আর্থিক চাপটাও কমবে। অনেক খুঁজেও পার্ট টাইম চাকুরি জুটলো না তার কপালে। শেষে সহপাঠি কণা তাকে একটি টিউশনি করার পরামর্শ দিল। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে কণা। নোভা বেশিরভাগ সময় তার থেকে বই ধার করতো। কিন্ত টিউশনি সে কিভাবে করবে? সে যে নতুন শহরে এসেছে। সবকিছু এখনো চিনে উঠতে পারেনি। কে তাকে টিউশনি দেবে? খুব চিন্তায় পড়ে গেল নোভা। 

কয়েক দিন পর হঠাৎ মেঘ না চাইতেই জল এর মতো প্রতিবেশী বুসরার  আম্মু জিজ্ঞেস করল,

"আমার  মেয়েকে একটু পড়াতে পারবে?

ক্লাশ ওয়ানে পড়ে। ভীষণ দুষ্টু। আমার কাছে পড়তেই বসে না। তুমি যদি পারো।"

নোভা রাজী হয়ে গেল। সে তো পয়সা উপার্জনেরই পথ খুঁজছিল,বাবার পাশে দাঁড়ানোর জন্য। 

শুরু হলো তার টিউশনি চাকুরি। যা টাকা পায় তাতে হাত খরচ হয়ে যায়। দুষ্টু বুসরাও নোভার কাছে মনোযোগ দিয়ে পড়ে। বুসরার আম্মুও মহাখুশী। নোভা খুব আদর করতো বুসরাকে। পড়তে না চাইলে  বলতো,

"আজ পড়তে হবে না,আসো আমরা খেলবো"।

এই বলে কোলে নিয়ে বসতো। চকলেট দিত। কখন যে খেলতে খেলতে বুসরা পড়া শেষ করে ফেলতো বুঝতে পারতো না। নোভা বলতো,

"ছুটি"

এভাবে নোভা শিক্ষক থেকে  বুসরার আপু হয়ে উঠলো।

পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করাতে বুসরার পরিবার নোভার মাইনে বাড়িয়ে দিল। নোভা তো খুশি। ভেবেছিল আরো একটি টিউশনি করবে কিন্তু তার আর দরকার হয়নি। তাছাড়া নিজের পড়ালেখাও আছে।

এভাবে ভালই চলছিল। প্রথম বর্ষ সমাপনী পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করে দ্বিতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু অভাগা যেদিকে যায়, সাগর শুকিয়ে যায়। নোভারও ভাগ্যদেবী রুষ্ট হলেন। কলেজ থেকে ফলাফল নিয়ে রিক্সাযোগে দৌড়ে আসছিল। খুশির খবরটা তার বাবাকে দিবে বলে। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো আচমকা একটা ধাক্কা অনুভব করলো এবং সেই সাথে চিৎকার ধ্বনি। মুহূর্তের মধ্যে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর দেখলো, সে হাসপাতালের বেডে। ডাক্তার বলছে, একটি পা কেটে ফেলতে হবে। পাশে সেই গাড়ির মালিকও বসে আছেন। তিনি চিকিৎসার সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছেন। তারপর তার বাবাকে জানানো হলো। বাবা ও মা শুনে পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসলো। তাদের আদরের কন্যা। যাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন। সব কি কাঁচের মতো ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। দিশেহারা বাবা মার সৃষ্টিকর্তাই এখন একমাত্র ভরসা।

একটি পা কেটে ফেলার পর সম্পূর্ণ সুস্থ্য হতে নোভার প্রায় তিন মাস সময় লেগে যায়। হাঁটতে গেলে ক্রাচে ভর দিতে হয়। নতুবা হুইল চেয়ারে বসে চাকা ঘুরিয়ে এদিক ওদিক যেতে হয়। এ জীবন সে মেনে নিতে পারে না। বাবাকে কথা দিয়েছিল, লেখা পড়া শিখে চাকুরি করবে। ছেলের মতো সংসারের হাল ধরবে।

স্বপ্ন যখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়, তখন তো আর কিছু করার থাকে না। করুণ সুরগুলো গুমরে কেঁদে ওঠে। নোভার জীবনের গতি ছন্দ হারিয়ে গেছে। কে এর দায় নিবে? তখন ঈশ্বর প্রদত্ত উপহারের মতো পাশে দাঁড়ালো তার  কলেজের পরম শ্রদ্ধেয় সেই চামেলি ম্যাডাম। সব শুনে ও দেখে তিনি সাহায়্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। কান্নায় ভেঙে পড়লেন। পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

"চিন্তা করো না, আমি তো আছি"

শুধু বলেই ক্ষান্ত হননি। কলেজের গরীব তহবিল থেকে বৃত্তির ব্যবস্থা করে দিলেন। এককালীন কিছু অর্থও সাহায্য নিয়ে দিলেন। আর দিলেন শক্ত হওয়ার মনোবল।

ঘরে বসেই নোভা পড়ালেখা করছে মনোয়োগ দিয়ে। কলেজে খুব একটা যেতে পারে না নেহায়েৎ  প্রয়োজন ছাড়া। প্রতিবেশি এবং আত্মীয় স্বজনদের কটুক্তিতে ম্যাডামের দেয়া মনোবল হারিয়ে ফেলে সে। বাবা মাও অসহায় বোধ করে। নিজেকে পরিবার ও সমাজের বোঝা ভাবে তখন সে। এইসব ভাবনায় সময় গড়িয়ে যায়। পরীক্ষা ঘনিয়ে আসে। পরীক্ষায় তো অংশগ্রহন করতে হবে।

তারপর এলো মাহেন্দ্রক্ষণ। শুরু হল পরীক্ষা। পরীক্ষায় সব বিষয় আশানুরূপ হয়েছে। পঙ্গু বলে ম্যাডাম তাকে কিছুটা সময় বেশি দিয়েছে। এবার ফলাফলের অপেক্ষা।

আজ আর ফলাফল জানতে নোভার যাওয়া হলো না। সে যে আগের মতো দৌড় ঝাপ করতে পারে না। ঘাতক মটর  সাইকেল তার সব কেড়ে নিল। কলি কে ফুটতেই দিল না। তার চেয়ে একবারে জীবন প্রদীপ নিয়ে নিলেই ভালো হতো। মচকে যাওয়ার চেয়ে ভেঙে যাওয়া যে অনেক ভালো। প্রতি পদে পদে লাঞ্চনার ইতিহাস তাড়া করে বেড়ায়। অনাগত ভবিয়্যৎ নিয়ে নোভা কুন্ঠিত। একটু অসতর্কতা সারা জীবনের কান্নার মালা হয়ে রইলো নোভার গলায়।

দ্বিতীয় বিভাগে পাস করে নোভা একটি চাকরি খুঁজতে  শুরু করলো। কিন্তু কে নোভাকে চাকরি দেবে? সে যে পঙ্গু। এই পঙ্গু সার্টিফিকেট আমাদের সমাজে একটি মেয়ের জন্য বড় সার্টিফিকেট হয়ে দাঁড়ায়। বিভিন্ন জায়গায় সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের  শিকার হয়েছে। অভাবের টানা পোড়নে পরিবারের  পাশে ঢাল হিসেবে দাঁড়ানো কি তার স্বপ্নই রয়ে যাবে?

এমন দুঃসময়ে তার পাশে দাঁড়ালো রতন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক। সে বুঝে, জীবনকে জীবন দিয়েই উপলব্ধি করতে হয়। জীবনের এই জোয়ার ভাটা অতিক্রম করতে পারলেই জীবন পরিপূর্ণ হয়। সে নোভাকে মেয়ে হিসেবে না ভেবে  মানুষ ভাবতে শুরু করলো। সত্যি এই সমাজের ঘরে ঘরে যদি রতনের মতো ছেলে থাকতো, তাহলে সমাজের চেহারাই পাল্টে যেতো।

নোভা যখন হাতল ছাড়া নড়বড়ে সাঁকোর উপর দিয়ে ক্ষীণ পায়ে হাঁটছিলো, তখন রতন শুধু আশার বাণী শুনিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। প্রথমে সম্মান দিয়েছে জীবন সঙ্গী করে। তারপর প্রতি পদে পদে নোভাকে পা নেই বুঝতে দেয়নি। শক্ত হয়ে দাঁড়ানোর জন্য পাশে থেকেছে। নোভার পরিবারও রতনকে পুত্রের মতো কাছে টেনে নিয়েছে।

রতনের ভালবাসায়, সম্মানে,  সহযোগিতায় বছর কেটে গেল। কোল জুড়ে একটি ফুটফুটে সন্তান এলো। কণ্যা সন্তান। নাম রেখেছে কুসুম। কুসুমকে নিয়ে এখন তার অনেক স্বপ্ন। ঋতিহীন জীবনের একমাত্র আশার আলো। প্রদীপ জ্বালানোর সলতে।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top