সিডনী শুক্রবার, ১০ই মে ২০২৪, ২৭শে বৈশাখ ১৪৩১


ছোটগল্প - ইছেপুর : আশিকুর রহমান বিশ্বাস


প্রকাশিত:
৭ জুন ২০২০ ২০:২০

আপডেট:
২৭ জুন ২০২০ ২১:২৭

 

পাকা রাস্তা পেরিয়ে আসার পর রাশেদ ভাবে তার কোথাও যেন একটা ভুল হয়েছে। এরপর কাঁচারাস্তা ঢের পথ। যতদূর চোখ যায় বাড়িঘর চোখে পড়ে না। রাস্তার দু'পাশে কোমর অবধি পানি, আর সেই মুক্ত পানিতে ভেসে চলেছে কৃষকের কাটা ধান। রাতে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল এখানে, সকাল থেকে ভ্যাপসা গরম, মাঝে মাঝে গুমোট কেটে পরিষ্কার রোদ বের হয়েছে। সে যে কারো কাছ থেকে শুনে নিবে সে উপক্রম এখুনি নেই, যেতে হবে আরো খানিকটা পথ। সেখানে কিছুটা উঁচু ধানিজমি, কয়েকজন লোক কাজ করছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, অস্পষ্ট দেখা যায়, শোনা যায় কিছু কথা তাও ঢের অস্পষ্ট। বৈশাখের মাঝামাঝি এখন। দিনের শেষ ভাগ। আকাশে মেঘ করেছে। মেঘগুলো জমাটবদ্ধ নয়, এলোমেলো উড়ছে এদিক-ওদিক।

রাশেদের গন্তব্য ইছেপুরে। কিন্তু সে হঠাৎই দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে গেল কারণ, অবেদ আলির বর্ণনায় সে যে ইছেপুর সম্পর্কে জেনেছে এমনকি গোপনে হৃদয়ে কল্পনা করে ফেলেছে তার সাথে এখানকার বিন্দুমাত্র মিল নেই। আবেদ আলি বলেছিল, 'গাঁয়ের রাস্তাটি হবে পাকা, কিছুদূর বাড়িঘর নেই পরিষ্কার রাস্তা চলে গেছে সর্পিল গতিতে, দু'ধারে নারকেল গাছ সারিসারি অভিবাদন করবে দাঁড়িয়ে, ওই রাস্তা বেয়ে হেঁটে চলে যেতে হবে কারণ জনবসতি কম হওয়ায় গাড়ি চলাচল ওখানে মন্থর।' সে বর্ণনায় একটি নদী অথবা বাওড়ের ইঙ্গিত করেছিল, অবশ্য তা ছিল অস্পষ্ট। অথচ বাস থেকে তাকে বলা হয়েছিল, 'এটাই ইছেপুর, আপনি জলদি বাম পা ফেলে নেমে পড়ুন, কেননা বাস সামান্য গতিরোধ করবে মাত্র'।

রাশেদ একবার ভাবে সে ফিরে যাবে। আপেক্ষিক উন্নত কোনো বাজারে গিয়ে আজ রাতে আশ্রয় নিবে সে। অথচ সে পেছন ফিরে দেখে রাস্তায় আর কোনো গাড়ি চলছে না। হঠাৎই তার মনে পড়ে, পাশের সিটে বসা এক ভদ্রলোক কার সাথে যেন বলছিলেন, 'ভাগ্যিস বাসটা পেয়ে গেলাম! নইলে কী উপায় যে হতো আজ!' রাশেদ অনুমান করে, বাসটি বোধহয় দিনের শেষ বাস ছিল। অবশ্য মানুষের ভিড়, গুঞ্জন, ইঞ্জিনের ধীর গতি তা ইঙ্গিত করেছিল আগেই। তারপর সে আর ভরসা পায় না ফিরে যাবার, বাধ্য হয়ে হেঁটে চলে সামনের দিকে। ধান কুড়োনির দল বাড়ি ফেরে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে, লম্বা পা ফেলে, কেননা এখুনি ঝড় উঠতে পারে। রাশেদ ভাবে, তাদেরকে সে জিজ্ঞেস করবে, অথচ সংকোচে সে তা পারে না। এক বয়স্ক মহিলা তাকে দেখে ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসে - সামনের ময়লা দাঁতগুলো বেরিয়ে আসে বাইরে, বড় কুৎসিত দেখায়। রাশেদের গা গুলিয়ে আসে তখন।

একসময় সে লোকগুলোর কাছে গিয়ে পৌছয়, এবং জিজ্ঞেস করবে বলে ঠিক করে নেয়। সে চিন্তা করে, আগে জিজ্ঞেস করবে - ' এটা কি ইছেপুর?' তারপর বলবে, ' রহিম বক্স কি জীবিত আছেন?' অবশেষে সবকিছু ঠিক থাকলে রহিম বক্সের বাড়িটা দেখিয়ে নেবে বলে ঠিক করে নেয় সে।

অথচ কেউই তার দিকে তাকায় না বরং বারবার আকাশের দিকে তাকায় তারা। কী অদ্ভুত ভাবে হাত চালিয়ে কাজ এগিয়ে নেয়! কী অসম্ভব ব্যাস্ততা! শুকনো ধানগুলো যেন বৃষ্টিতে না ভেজে, ঝড়ে উড়িয়ে না নেয়- এজন্য নানান কায়দা করে তারা। বড় বড় বোঝা মাথায় তুলে নিয়ে উঁচু জায়গায় ঢিপি করে। রাশেদ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কাজ দেখে। তারও ইচ্ছে হয় তাদের সাথে কাজে নেমে পড়ার, সংকোচে পারে না। আকাশ কালো মেঘ দখলে নেয়। দক্ষিণ-পূর্ব কোণ থেকে বাতাস ছাড়ে - প্রথমে ধীরে, তারপর প্রবল গতিতে। রাস্তার একমাত্র জামগাছের মগ ডালটি আছড়ে উঠে ভেঙে পড়ে মাটিতে। হাতের কাজ কমে যায় সবার - হঠাৎই। এবার বাড়ি ফেরার পালা। ঝড়ের গতি কমে আসে ঈষৎ। তাদের একজন যেতে যেতে জিজ্ঞেস করে,

'কে আপনি?'

'আমি রাশেদ।'

'বাড়ি?'

সে এবার আর কথা বলতে পারে না, কেননা তার গ্রাম হয়তো এটাই হবে, যদিনা সে ঠিক জায়গায় এসে থাকে। ইছেপুর হবে তার আসল ঠিকানা, পৈতৃক ভিটা, যেখানে তার অধিকার রয়েছে। অথচ সে এখনো দ্বিধাগ্রস্থ। রহিম বক্স তাকে ছেলে হিসেবে আদৌ মেনে নিবে কিনা, তার আর সন্তান আছে কিনা, তাছাড়া সে কি আদৌ জীবিত না মৃত্যু - এমন অসংখ্য প্রশ্নে। যদিও এসব বিষয়ে মোটেও ইঙ্গিত দেয়নি আবেদ আলি।

রাশেদ প্রশ্ন করে বলে, 'এটা কি ইছেপুর?'

তারা হেসে ওঠে অদ্ভুত ভাবে, যেন সে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে ফেলেছে। এসময় রাশেদের মনে হয় তারা যেন তাকে পাগল হিসাবেই সাব্যস্ত করে নিয়েছে। এমনকি তাদের হাসি বলে দিচ্ছিল এটাই ইছেপুর। সেই অবহেলিত ইছেপুর, ঠিক দুই যুগ আগের মতো, একটুও বদলায় নি, একটুও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি।  

'ইছেপুর কার বাড়ি যাবেন?' - তাদের ভেতর থেকে একজন প্রশ্ন করে তাকে।

রাশেদ বলে, 'রহিম বক্স কি জীবিত?'

এবারও সে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে ফেলে। লোকগুলো আর তারসাথে কথা বলতে আগ্রহী হয় না। ঝড় গতি পায় আবার, বৃষ্টি নামে ফোট ফোট। সবাই লম্বা পায়ে হেঁটে চলে, রাশেদও হাঁটে তাদের সাথে, উদ্দেশহীন। একসময় সবাই মিলিয়ে যায় নিজ ঠিকানায়, শুধু একজন থাকে রাস্তায়, রাশেদ ওখানে দেখিনি তাকে, একদম অপরিচিত। একাকী হেঁটে চলেছে গন্তব্যে।

রাশেদ ডাকে, 'ভাই শুনছেন?'

লোকটি দাঁড়ায়। রাশেদ অনুরোধ করে বলে, 'দাঁড়াতে হবে না, চলুন।'

'আপনাকে আগে দেখিনি তো! আপনি কোন গ্রামের?'

'আমি রাশেদ।' আর কিছু বলতে পারেনা সে। নিজের ঠিকানা সে কিছুতেই বলতে পারে না। জোর গলায় দাবি করতে পারে না যে, 'আমি ইছেপুরের রাশেদ।'

সে বলে, 'আপনি নিশ্চয় এ গাঁয়ের?'

'জ্বি।'

'আজ রাতটা যদি -'

কথা শেষ না হতে লোকটি বলে, 'থাকবেন তো?'

রাশেদ লজ্জিত হয়ে বলে, 'আপনার দয়া হলে।'

'চলুন আমার সঙ্গে।'

দুজন এগিয়ে চলে। রাশেদ হাঁটে পিছে, লোকটি আগে। একসময় সে লোকটির বাড়িতে গিয়ে ওঠে। গায়ের ভেজা কাপড় বদলে শুকনো কাপড় পরে নেয় সে। লোকটি আবারো প্রশ্ন করে, 'আপনি কার ঠিকানায় এলেন বললেন না তো?'

'রহিম বক্স।' স্তব্ধতার দেহ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে যেন কথাটি।

'তিনি আপনার কে হন?'

'বাবা।'

'বাবা!'

লোকটির কথায় তীব্র আর্তনাদ বুঝতে পারে রাশেদ। যেন রহিম বক্স বাবা হবার যোগ্যতাই রাখে না, সে কখনো বাবা হয়নি এমন। নতুবা সেই একমাত্র ছেলে তার আর কোনো ছেলে থাকতে পারে না। রাশেদ তখন অনুমান করে এবং স্থির হয়, এটা নিশ্চয় রহিম বক্সের বাড়ি হবে। এরপর লোকটি নিজের ঘরে চলে যায়। ঝড় থেমে বৃষ্টি শুরু হয়। একটানা। বিরতিহীন ভাবে।

বৃষ্টি চলে গভীর রাত অবধি।

বৃষ্টির তালে তালে একে একে সব জটলা খুলতে শুরু করে একসময়। রাশেদ জানতে পারে রহিম বক্স বেঁচে নেই। এমনকি সে, তার এবং তার মায়ের সম্পর্কে কিছুই বলেনি এখানে। রাশেদ এতটুকু বিস্মিত হয় না এ'কথায়, কেননা তার কাছে জনকের ভিটা অপেক্ষায় জনককে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় তখন। যার খোঁজে এতদূর আসা তাকেই যখন সে পেলো না আর তার উপার্জিত সম্পদের আশা সে কেমনে করে। সে শুধু ডুকরে কেঁদে ওঠে। তার চোখের পানিতে নিজের স্থায়ী ঠিকানা, যা সে বলতে পারেনি লজ্জায়, ভয়ে, সেসব দাবি ভেসে চলে যায়। মিলিয়ে যায় অজানায়। তার কোনো পিতা আদৌ ছিলোনা বলে সে মেনে নিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়। রহিম বক্সের শেষ সন্তানটি মেয়ে। সে রাশেদের কাছে এসে নিঃশব্দে বসে।

রাশেদ তার দিকে তাকায়। বলে, 'তুমি কে?'

'বৈশাখী। পিতা রহিম বক্স। ঠিকানা ইছেপুর।'

মেয়েটি জিজ্ঞেস করে, 'আপনি কে?'

'কেউ না। আমি কেউ না।'

'কে বলেছে আপনি কেউ নই? আপনি আমাদের ভাই। ঠিকানা ইছেপুর। পিতা রহিম বক্স।'

রাশেদ মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে। মেয়েটিও কেঁদে ওঠে এসময়। আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করে। সকাল হতে আর বাকি নেই বেশি।

 

আশিকুর রহমান বিশ্বাস
কথাসাহিত্যিক; শিক্ষার্থী, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top