সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১


বড় গাড়ি : সায়মা আরজু


প্রকাশিত:
৮ জুন ২০২০ ২১:৪২

আপডেট:
২৪ জুন ২০২০ ২১:২৬

 

এই বাড়িটাতে প্রায় পনের বছর কাটিয়ে দিলাম, ছেলে রবিনের টিফিন, বক্সে ঢুকাতে ঢুকাতে ভাবছে তৃষা। দাদা শ্বশুর খুব শখ করে বাড়িটা বানিয়ে ছিলেন আশির দশকের শুরুতে। ভাই বোন মিলেঝিলে অনেক মানুষ তবে হাড়ি আলাদা। আশে পাশে সব দশ-বার তলা বিল্ডিং তার মাঝখানে হঠাৎ এই চার তলা বাড়িটা বেমানান তবে অভিজাত। অনেকেরই লোভ সামনের বড় উঠোনটার জন্য আর ওটাই বাড়িটার প্রান।আজ আবার রবিনের একঘন্টা আগে ছুটি। গত মাসে হঠাৎ ই রাশেদ পাজেরো টা কিনল। কোনও দরকার ছিলো না। স্কুলের সামনের রাস্তাটা ছোট। অতবড় একটা ঢাউস গাড়ি অনেক সময়ই স্কুল অবদি নেয়া যায়না, বড় রাস্তায় পার্ক করে হেটে যেতে হয়। ওদিকে আবার যখন তখন কেস খাওয়ার ভয়ে ড্রাইভারটা বেশ তটস্থ থাকে। এ গাড়িটাকে এখনও তৃষার কেমন পরপর মনে হয়। এর আগের গাড়িটা ছোট ছিলো,কিন্তু আপন ছিল। কত আনন্দ নিয়ে সেই গাড়ি কেনা! রবিনের জন্মের পর ওকে নিয়ে হসপিটাল থেকে ঐগাড়িতে করেই বাসায় এসেছিলাম। যাই হোক, পুরানো হয়ে গেলে হয়তো সবকিছুরই কদর কমে যায়। তৃষার ইচ্ছা ছিলো নীল রংয়ের একটা কার। কিন্তু রাশেদের ঐ এক কথা, কোথাও যেতে হলে বড় গাড়ি না হলে চলেনা,ষ্ট্যাটাস ও থাকেনা। তবে তৃষা জানে ছোট গাড়িতে সবাইকে কত কাছে পাওয়া যায়! রবিনটা কেমন ঘুমিয়ে পড়ে তার কোলে! আর এগাড়িতে রবিন পুরা একটা সিট নিয়ে একা বসবে!

 এখনও মাঝে মাঝে ভুল হয়ে যায় তৃষার নিজেদের গাড়ি চিনতে। এইতো সেদিনও কিছু দরকারি জিনিসপত্র কেনাকাটা করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল সে।হঠাৎই কোথা থেকে এক মস্ত গাড়ি এসে তার সামনে দাঁড়াল। তৃষা ভাবছিল হায় হায় আমার ছোট গাড়িটাকে দেখব কেমন করে,কোথায় সেটা! ড্রাইভার মামুনের ডাকে ভ্রম ভাঙ্গলো।

রবিনের ডে শিফট স্কুল, ছুটি পাঁচটায় তবে আজ সাড়ে তিনটায়। রবিনকে স্কুলে নামিয়ে আসার পর থেকেই মাথাটা ধরেছে। ক'দিন ধরে ভার্টিগোর ওষুধ খাচ্ছে। অফিস থেকেও ছুটি নিয়েছে পর্যাপ্ত ঘুমের জন্য। তা কি আর হয়! এসময় রাস্তার শব্দ, আলো প্রচন্ড বিরক্ত লাগে। দেড়টায় দুপুরের খাবারের পর ওষুধ খেয়ে দোতলায় শ্বাশুরিকে ফোন করল,' মা আমি একটু ঘুমালাম, আপনি রবিনকে আনতে ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিয়েন। মা,আজ কিন্তু রবিনের সাড়ে তিনটায় ছুটি'।

ঘুম ভাঙ্গলে তৃষা দেখল ঘরটা অন্ধকার। ক'টা বাজে? মোবাইলে সময় দেখল সাড়ে আটটা। এমা এতক্ষণ ঘুমালাম। যাক মাথাটা ছেড়েছে। রবিন হয়তো দাদুর কাছে খেলছে। এক কাপ চা খাওয়া দরকার। কেটলিতে পানি বসিয়ে রবিনের রুমে উঁকি দিল। রবিনের স্কুলের ব্যাগ কই? ইন্টারকমে শ্বাশুড়িকে ফোন দিল,
-'মা রবিন কই'।
- ‘রবিন তো এখানে না। আমি ভাবলাম উপরে'।স্কুল থেকে ফিরে এখানে আসে নাই। ড্রাইভারকে তো তিনটায় আনতে পাঠালাম।

অস্থির শোনালো তার গলা। তৃষা ড্রাইভারকে ফোন দিল। এই এক মানুষ জীবনেও ফার্ষ্টকলে ফোন রিসিভ করেনা। দ্বিতীয়বার ফোন দিতেই মামুন ধরলো।
- মামুন, রবিন কই
- আমি তো ম্যাডাম রবিন রে নামাইয়া তুলি আপারে আনতে গেছিলাম
- রবিন কে উপরে দিয়ে যাওনাই।
- না ঐসময় স্যারের ফোন আইছিল। আমি গেট খুইলা দিছি। পরে আপনাদের ফ্ল্যাটের সামনে ব্যাগ রাইখা আসছি।
কথা বলতে বলতেই তৃষা দেখে রবিনের ব্যাগ দরজার সামনে। এরমধ্যে বাকি ফ্ল্যাটগুলোতে খোঁজ পরে গেছে। কিন্তু রবিন কোথাও নাই। ব্যাস্ত হাতে তৃষা স্কুলে ফোন দেয়। রিং হতে হতে ফোনটা কেটে যায়,কেউ উঠায় না। ফের ড্রাইভারকে ফোন দেয়, ' গাড়ি বের কর, স্কুলে যাব'। তৃষার মাথা এখন আর কাজ করছেনা। কই আমার বাবুটা! তুলি বলল,' ভাবি আমিও যাব'। তৃষার আগেই তুলি নেমে যায়। তাড়াতাড়ির সময় যা হয়, আজ ফ্রন্ট ডোরের লকটা আটকাচ্ছে না। তিন বারের চেষ্টায় আটকালো। মোটামুটি দৌড়ে নীচে নেমে এল সে। আসতে আসতে শুনতে পেল শ্বাশুড়ি পিছন থেকে বলছেন 'ফি আমানিল্লাহ '..। গাড়ি পর্যন্ত এসে তৃষার মনে হল স্বপ্ন দেখছে। দেখল তুলির কোলের মধ্যে রবিন। তৃষার মুখ থেকে কথা বের হলোনা। তুলি বলল, ' রবিন গাড়ির পিছনের সিটে ঘুমিয়ে ছিল। ড্রাইভার দরজা খুলে দিয়েছে ঠিকই কিন্তু রবিন যে বের হয়নাই সেটা দেখে নাই।' রবিন কে জড়িয়ে ধরে তৃষা আর কিছু বলতে পারলনা। দুষ্টু রবিনটা ভয়ে কেঁদে ফেললো। একটু ধাতস্ত হয়ে রবিনের গায়ে, মাথায় হাত দেয় সে। এক নিঃশ্বাসে জিগ্যেস করে,'বাবা জ্বর জ্বর লাগছে, শ্বাসকষ্ট'?এরমধ্যে সারা বাড়ি নীচে নেমে এসেছে। কিছুটা অভিমান নিয়েই তৃষা বলল, এবার নিজের টাকায় একটা ছোট গাড়ি কিনব। ঠিক সেই সময় কাঁধের উপরে একটা নরম হাত অনুভব করলো তৃষা, সেটা আর এক মায়ের....

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top