সিডনী শুক্রবার, ১০ই মে ২০২৪, ২৭শে বৈশাখ ১৪৩১


জীবন যেখানে যেমন : এম. তামজীদ হোসাইন


প্রকাশিত:
৮ জুন ২০২০ ২২:১২

আপডেট:
৮ জুন ২০২০ ২২:১৪

এম. তামজীদ হোসাইন

 

পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে যুগে যুগে মানুষ তার জ্ঞান ও মেধা দিয়ে পরিবর্তন করেছে জীবনযাত্রার মান। আজকের আধুনিক বিশ্ব একদিনে সৃষ্টি হয়নি। মানব সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার আগুন। আদিম যুগে মানুষ পাথরের সাথে পাথরের সংঘর্ষণ করে আগুন উৎপন্ন করতো। এরপর মানুষ কৃষি, উদ্ভিদ ও পশুপালন করতে শিখে। মানুষ তার জ্ঞান ও মেধাশক্তি দিয়ে প্রমাণ করেছে তারা সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষের পড়ার মতো কোন কাপড় ছিল না; তাই আদিম যুগে মানুষ উলঙ্গ ছিল। একসময় মানুষ গাছের পাতা দিয়ে কিংবা কোন বড় গাছের পেছনে দাঁড়িয়ে লজ্জা নিবারণ করতে শিখে। খ্রিষ্ট যুগের শুরুতে মানুষ গাছের পাতাকে সেলাই করতে শিখে এবং পশুর চামড়া দিয়ে নিজেদের লজ্জা নিবারণ করতে শিখে। মধ্য যুগে মানুষ সুতা দিয়ে কাপড় বুনতে শিখে। এই যুগে ভেড়ার চামড়া দিয়ে ভাল পোষাক বানাতো। রেনেসাঁ যুগে মানুষ কাপড়ের ডিজাইন করতে শিখে। এভাবে যুগে যুগে মানুষ কত কি আবিষ্কার করল। মানুষ ঘরবাড়ি, কম্পিউটার আবিষ্কার, আকাশযান, নৌযান, যানবাহন, রোবট আবিষ্কার করল, স্যাটেলাইট অর্থাৎ একটা সুন্দর জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত করল। তবে পৃথিবীর বুকে মানুষের এতো সাফল্যের মধ্যে কিছু ব্যর্থতাও রয়েছে। ঠিক ব্যর্থতা না। মানুষের উদাসীনতার ফলে মানব উন্নয়নে কিছু ঘাটতি রয়ে গেছে। যা আধুনিকতার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। 

পৃথিবীতে কখনো দেশভেদে মানুষের জীবনযাত্রার মান ভিন্ন আবার কখনো একই দেশের মধ্যে এলাকাভেদে মানুষের জীবনযাত্রার মান ভিন্ন হয়ে থাকে। বাংলাদেশের কথায় বলি। এদেশে নগরের নাগরিকরা উঁচু উঁচু দালানে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তারা যতরকমের আধুনিকতা আছে তা নিয়ে জীবন পরিচালনা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আর যদি পাহাড়ি-আদিবাসী বা তার পার্শ্ববর্তী বসবাস করা মানুষগুলোর দিকে তাকানো হয় মনে হবে এরা যেন ভিনগ্রহের মানুষ। তাঁদের কাছে মোটরযান নেই। পাহাড়ের পাদদেশ ঘেঁষে খণ্ডখণ্ড জমিতে কৃষি আর গৃহপালিত পশু পালন তাদের একমাত্র পেশা। পাহাড়ি এলাকায় মাঝে মাঝে বাই-সাইকেল দেখা যায়। অনেক সময় সাইকেলে ঝুলানো থাকে কলা আর কিছু জ্বালানী কাঠ। এমন দৃশ্য দেখে মনে হবে এটিই মনে হয় এখানকার সবচেয়ে আধুনিকতা। এদের কাছে থাকেনা কোন স্মার্টফোন বা ইন্টারনেট। এসবের উৎকর্ষতা তারা এখনো পায়নি। এদের পরনে থাকেনা আধুনিক পোষাক। 

সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার মাধবপুর হ্রদে গিয়েছিলাম। সেখানে চা বাগানের এবং হ্রদের পাহারাদার কান্তির জীবনের গল্প শুনেছিলাম। তার জন্ম ঐ পাহাড়ের কোন এক বাড়িতে। তার বেড়ে ওঠা ঐ পাহাড়ে। চা বাগানের মালিকের নিয়ম অনুযায়ী চা বাগানে কাজ করতে পারে এক পরিবারের একজন সদস্য। কান্তির ভাষ্যমতে এটি ব্রিটিশ আমল থেকে এখানে প্রচলিত নিয়ম। তাই তার বাবা যখন বেঁচে ছিলেন তিনিই এই চা বাগানে কাজ করতেন। কান্তি বিয়ে করার পর কাজ পেল বাগানে। কান্তি দুই সন্তানের জনক। দুইজনই স্কুলে পড়ে। কান্তি সারাদিন চা বাগানে পাহারা দিয়ে মজুরি পান ১০০ টাকা। ১০০ টাকা দিয়ে সংসার চালাতে হয়। তার জীবনের গল্প শুনলে অবাক লাগে। তাদের চাওয়া পাওয়ার মাঝে নেই ভাল পোশাক পরিচ্ছদ। দুই বেলা খাওয়ার মত বাড়িতে কিছু থাকেনা। তাই চা পাতার ভর্তা করে খেতে হয়। কান্তি আর তার স্ত্রী প্রত্যহ এই চা পাতার ভর্তা খায়। আর বাচ্চাদের শুধু ভাত খাওয়ান। শুধু কান্তির জীবনের গল্প এমন তা না। কান্তির মত হাজার হাজার চা বাগানে কাজ করা এই পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর সবার জীবনের গল্প একই। চাইলে কান্তি পাহাড়ে পর্যটকদের কাছে কিছু টাকা চেয়ে নিতে পারে। এমনকি ঐ হ্রদে বিদেশী পর্যটকরাও আসেন। আমি আর বন্ধু শাহরিয়ার দুপুরে লাঞ্চ করছিলাম পাহাড়ে। এক পর্যায়ে কান্তি আসলেন আমাদের পাশে। লাঠি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তখনো তার সাথে আমাদের পরিচয় হয়নি। এতক্ষণে আমাদের খাওয়া শেষ। কান্তি বলল আপনাদের খাবারের উচ্ছিষ্ট প্যাকেটগুলো ডাস্টবিনে ফেলবেন। যেখানে সেখানে ফেললে বিদেশী পর্যটকরা মাইন্ড করবে। আমরা বলেছি হ্যাঁ ডাস্টবিনে ফেলব। তারপর তার কাছে জানতে চাইলাম দুপুরে খেয়েছে কিনা। সে খানিকক্ষণ চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো স্যাঁর আমাদের আর কি খাওয়া... এরপর আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলে সে বলল তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া গল্প। তাকে টাকা দিতে চাইলাম সে নিতে নারাজ। কারণ যদি আমি চা বাগানের মালিকের কেউ হয়ে থাকি তাহলে তার চাকুরী থাকবে না। অথচ শহরে এরকম একজন না খেয়ে থাকা মানুষের জীবনের গল্প অন্যরকম। জানি না এই কান্তি বা তার আশেপাশের মানুষেরা এই করোনা মহামারীতে কেমন আছে। শ্রমিকদের মজুরী কি এখন ঠিকমতো চা মালিকরা দিচ্ছে কিনা কয়েকদিন ধরে সেই দুশ্চিন্তায় আছি। আসলে জীবন যেখানে যেমন মানুষকে সেখানে তেমন হতে হয়। বাস্তবতা মানুষকে কখনো লোভ লালসা করতে বাধ্য করে। এরপরও খেতে না পারা অনেক মানুষ সৎ পথে জীবনযাপন করে। কান্তি এমন সৎ মানুষদের জীবন্ত দৃষ্টান্ত। মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবন থেকে আমাদেরও অনেক শিক্ষা নেওয়ার আছে।

 

এম. তামজীদ হোসাইন
কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক 

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top