সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১


আমার চোখে হারিয়ে যাওয়া বই পাড়ার গল্প : বটু কৃষ্ণ হালদার


প্রকাশিত:
৯ জুন ২০২০ ২৩:১০

আপডেট:
১০ জুন ২০২০ ২০:৪৩

ফাইল ছবি

 

একটা বই মানুষের জীবনে "Friend,philosopher, and Guide" এই উক্তিটি অত্যন্ত বাস্তব সম্মত। বই হলো মানসিক শক্তি। অর্থ দিয়ে মানুষ পৃথিবীর প্রায় সব সম্পদ ক্রয় করতে পারেন।, কিন্তু মায়ের স্নেহ, সম্পর্ক,আর জ্ঞান কখনো কিনতে পারা যায় না। এক ব্যক্তি অর্থ দিয়ে নয় জ্ঞানের আলোকে সমাজের পরিপূরক হয়ে ওঠেন। প্রকৃত জ্ঞানের ভান্ডার হলো শুধুমাত্র বই। একটি ছোট্ট শিশুর জীবন যেমন গড়ে ওঠে তার মাকে ঘিরে, ঠিক তেমনি প্রকৃত জ্ঞানী হয়ে ওঠার মূল সম্পদ বই।বই হচ্ছে মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এই বইয়ের সঙ্গে মানুষের নাড়ির সম্পর্ক একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। এমন একদিন হয়তো আসবে পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ নষ্ট হয়ে যাবে কিন্তু একটি ভালো বই থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান কখনোই শেষ হবেনা তার চিরকাল হৃদয়ে জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখবে। একটা কথা জেনে রাখা দরকার, জীবনে সফলতার চরমসীমা পৌঁছানোর একমাত্র অবলম্বন হলো বই। একজন সফলতম ব্যক্তি জীবনে চরম সফলতা পাওয়ার পরেও বই পড়া থেকে নিজেকে বঞ্চিত কখনোই রাখেনা। বই পড়ার মধ্য দিয়ে রোজ রোজ নিজেকে সমৃদ্ধ করে তোলা যায়।

একটা বই শুধু তথ্য দেয় না, প্রশ্ন করতে শেখায় এবং নতুন করে চিন্তা করতে শেখায়। বই পড়ার মধ্যে দিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকা যায়। বইয়ের ভেতরে থাকে অজানা তথ্যের খাজানা।বিদেশ ভ্রমণ না করেও বইয়ের পাতার মধ্য দিয়ে সমগ্র বিশ্বকে আমরা চিনতে বা জানতে পারি। আর জ্ঞান সব সময় একজন মানুষকে সমৃদ্ধশীল করে তোলে। সেই জ্ঞান পাওয়া যায় শুধুমাত্র বইয়ের পাতায়। বই পড়ার ফলে মানসিক চাপ অনেকটাই কমে যায়।তাছাড়া বই আমাদের মস্তিষ্কের নতুন নতুন কানেকশন তৈরি করে ফলে আমাদের নতুন করে জানার আগ্রহ মনে রাখার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।আবার আধুনিক গবেষণায় এমন তথ্যই উঠে এসেছে যে রোজ নিয়ম করে বই পড়লে বেড়ে যায় একাগ্রতার শক্তি। অনেকেরই একটা সমস্যা প্রায় থেকে যায়, সেটা হল সময়মতো ঘুম না আসা। আবার ঘুমের আগে শোয়ার সময় মোবাইল ফোন কিংবা ল্যাপটপের সময় কাটানোর ফলে কমতে থাকে গাড়ো ঘুমের সম্ভাবনা। তাই গবেষণায় উঠে এসেছে যদি ঘুমানোর আগে একটি ভালো বই পড়া যায় তাহলে মস্তিষ্কের কোষগুলির শান্তভাবে কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করে ফলে খুব তাড়াতাড়ি ঘুম চলে আসে আর মস্তিষ্কে প্রশান্তির ফলে রোগ  থেকে বিরত থাকার প্রবণতাও তৈরি হয়।রাত্রে সোশ্যাল মিডিয়ার এডিকশন থেকে বাঁচতে বই পড়া একটি অন্যতম পন্থা হতে পারে। তাইতো জসেফ অ্যাডিশন ৩০০ বছর পূর্বে বলে গেছেন_"reading is to the mind what exercise is to the the body"।

বর্তমানে মডার্ন সাইন্স গবেষণা দ্বারা এই কথাটির সত্যতা প্রমাণ করেছে। আর বই কথাটা মনে পড়লে সবার প্রথমে আসে কলকাতার কলেজ স্ট্রিট এর বই পাড়া র কথা। যুগ যুগ ধরে বইপ্রেমীদের সকল আশা আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেছে এই বইপাড়া। বইপাড়া হল, স্তরে স্তরে স্তরে সজ্জিত বই দোকান, যেদিকে তাকাই শুধু বই আর বই, নতুন বইয়ের গন্ধ, হই হুল্লোর হাকডাক, খদ্দেরদের সঙ্গে দর কষাকষি, কলকাতার ট্রাম, হাতে টানা রিকশার টুংটাং আওয়াজ, সংস্কৃত কলেজ কলেজ, স্কোয়ার সুইমিং পুল, কলকাতা  ইউনিভার্সিটি, প্রেসিডেন্সি কলেজ কলকাতা মেডিকেল কলেজ এবং এবং অবশ্যই কফি হাউসের আড্ডাখানা।বইপ্রেমীরা বই কিনতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে সাহিত্যের ঝড় তুলতে থাকে। এই হাউসের হাত ধরে নতুন প্রেমিক প্রেমিকাদের শুরু হয় নতুন জীবনের পথ চলা।

আমার জীবনে কলেজ থেকে বই পড়ার সঙ্গে প্রথম আলাপ ২০০২ সালে। রাজপুর বিদ্যানিধি হাই স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হয় সংস্কৃত কলেজে। সেই সময়ে কলকাতার বই পাড়ার চেহারা ছিল অন্যরকম। সেসময় এই বইপাড়ায় বইপ্রেমীদের ভিড়ে মেলা লেগে থাকত। যেদিকে তাকাই সেদিকে কালো কালো মাথার সারি। বইপ্রেমীদের ভিড়ে গা গোলানো যেত না। চিত্কার-চেঁচামেচি হট্টগোল লেগেই থাকত সর্বদা। সেই বই পাড়ায় ছিল অনাবিল প্রাণের আনন্দ। কারণ বইও পাঠককুল বাঙালি সমাজের মধ্যে ছিল আত্মার সম্পর্ক। সে সময়েদূর দূর দূরান্ত গ্রাম থেকে লোকে কলকাতা গিয়েছে কিন্তু কলকাতার বইপাড়ায় পা রাখেনি এমন মানুষজন বোধহয় খুব কম ছিল। আবার ছুটির দিন খাওয়া-দাওয়ার পর  দুপুর কিংবা রাতে বই নিয়ে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, মাইকেল, মধুসূদন, শরৎচন্দ্র, বিবেকানন্দ, বিদ্যাসাগর কে মনে করেনি এমন বাঙালির সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। আর যারা পড়তে পারতেন না তারা গল্প শুনতেন কিংবা সন্ধ্যায় গ্রামের পাঠশালার গুলোর আশেপাশে ভিড় জমাতেন মহান মনীষীদের জীবনের গল্প শোনার জন্য। সে সময়ে বিয়ে বাড়ি থেকে শুরু করে পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে বিভিন্ন বই উপহার দেয়ার রীতি প্রচলন ছিল। এসব রীতিনীতি বর্তমান সমাজে বিলুপ্তির পথে। কারণ ধীরে ধীরে আধুনিক সভ্যতার উন্মেষ ঘটতে থাকে।

বিজ্ঞানের অন্যতম আবিষ্কার ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্ব আজ তালুবন্দি। এই ইন্টারনেট কে হাতিয়ার করে মানুষ ঘরে বসেই বিশ্বকে জানতে বা পড়তে পারে। যার ফলে ধীরে ধীরে ছাপানো বইয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণ কমে যায়। এর ফলে এই ম্যাগাজিন বা ই-বুক বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। এসবের কারণে মাথায় হাত পাবলিশার্স ও সম্পাদকদের। ছাপানো বইয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণ কমে যাওয়ায় ধীরে ধীরে ধীরে পাঠকদের ভিড় কমতে থাকে কলকাতার বই পাড়ায়।বহু ছাপাখানা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে, বহু পাবলিশার্স বই ছাপানো বন্ধ করে দিয়েছে, এতে কাজ হারিয়েছে বহু শ্রমিক। দোকান আছে, নেই দোকানের মালিক, শ্রমিকদের ব্যস্ততা।২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে হঠাৎই কর্মসূত্রে আবার মা, বাবা কে নিয়ে কলেজে বইপাড়ায় পদার্পণ করি। বইপাড়ায় ঢুকতেই বুকের মধ্যে এক চরম নিঃসঙ্গতা গ্রাস করল।২০০২ সালের বই পাড়া আর ২০১৯ সালের বই পাড়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক। ২০০২ সালের জমজমাট বই পাড়া ভরদুপুর বেলায় লোকজন শূন্য। আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম সংস্কৃত কলেজের দিকে। দোকানদাররা একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা খরিদ্দার তাদের কাছে যে কত গুরুত্বপূর্ণ সেই দিনই উপলব্ধি করলাম। অথচ একসময় খদ্দেরদের নিয়ে এত গরজ ছিল না দোকানদারদের।আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছি আর দোকানদাররা ডাকাডা কি বই নেবেন কি বই নেবেন,কি নেবেন? সেই ডাক, মনটা ভরে গেলো, তার সঙ্গে সঙ্গে দুঃখের একরাশ কালো মেঘ আঁধারে ঢেকে গিয়েছিল হৃদয়ে। ভাবতে লাগলাম এ কোন বই পাড়া? এ কোন সভ্যতা গ্রাস করল কলকাতাকে? খুব চেনা বই পাড়া কেমন অচেনা লাগলো সেই দিন।শেষমেষ কফি হাউজের নিচে একটা দোকান থেকে লক্ষ্মীর পাঁচালী ও কৃষ্ণের শতনাম বই দুটি কিনলাম মায়ের জন্য। বই কেনার শেষে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম কাকা এই অবস্থা কেন? দোকানদার টি আমার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল কি আর বলব বাবা, সংসার চালানোর খরচ ওঠেনা। বাংলার প্রাচীন সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এখানে পড়ে আছি মায়ার টানে। তবে ভাত,ডাল,আলু,পোস্ত খাওয়া বাঙালি যতই রেস্তোরাঁ মুখি হোক না কেন, মায়ের হাতের ডাল,আলু,পোস্ত খাওয়ার জন্য মনটা কেমন আকুল হয়ে ওঠে। ঠিক তেমনি বই হাতে বাঙালি কেমন ভাবে ভুলে যাবে নতুন বইয়ের পাতা উল্টানোর গন্ধ।

নতুন বইয়ের পাতা উল্টানো বন্ধের মধ্যে আছে আত্মতৃপ্তি। উমপুন ঝড় এসে যেমন বেশ কয়েক দিনের জন্য মানব জীবনের দৈনন্দিন রুটিন কে এলোমেলো করে দিয়ে গেল, তবে তা বেশি দিনের জন্য নয়। এ ঝঞ্ঝা কাটিয়ে মানুষ আবার তার নিজেদের নিয়ম রুটিন মাফিক সাচ্ছন্দ জিবনে ফিরে আসে, ঠিক তেমনই বই মুখি পাঠককুল বাঙালি সমাজ আবার ফিরে এসেছে ছেমহিমায়২০২০ সালের বই মেলায়। বিগত ১৫_১৬ বছর বইমেলা শুধু নাম মাত্র হয়েছে। বিগত এই কয়েক বছর মেলায় বই ছিল কিন্তু ছিল  না শুধু বইমুখী পাঠক। মানুষ বইমেলায় আসতো কিন্তু বই কিন ত না। প্রেমিক প্রেমিকা হাত ধরাধরি করে মেলায় ঘুরে ফুচকা খেয়ে বাড়ি চলে যেত। সম্পাদক,পাবলিশার্স রা হাঁ করে মাছি তাড়াত বইমেলায়। তবুও কিছু পাবলিশার্স,সম্পাদকরা হাল ছাড়েনি। এরই মাঝে কিছু পুরানো পাবলিশার্স হারিয়ে গেছে, কিছু নতুন পাবলিশার্স,সম্পাদক আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লড়াই করে এসেছি। ২০২০ সালের বইমেলার চিত্র একদম অন্যরকম। নিরাশ করেনি সম্পাদক পাবলিশার্সের। এই বই মেলায় প্রচুর বই বিক্রি হয়েছে। বইমেলায় বই মুখী পাঠক শুধুু ফুচকা খেতে আসেনি, কিনেছে নিজেদের পছন্দ মত বই। আনকোরা পাবলিশার্স সম্পাদকদের হাত ধরে বহুুু নবাগত লেখকদের বই বিক্রি হয়েছে। নতুন নতুন সম্পাদক পাবলিশার্স এর সাথে সাথে উঠতি লেখকরা সমৃদ্ধ শীল হয়েছে সমাজের বুকে। বই মেলায় বই কেনা য় যে ভাটার টান পড়েছিল, সেই ভাটার টানে এখন জোয়ারের  বন্যায় উচ্ছ্বাসিত মেলা কর্তৃপক্ষ,পাবলিশার্স সম্পাদক ও নবাগত লেখকরা। মানুষ বই পড়বে সমৃদ্ধশীল হবে, বই পড়ে  জ্ঞানের আধারে সমাজের যোগ্য হয়ে উঠবে, বইয়ের টানে আবার বইপাড়ায় লোকজনের সমাগম হবে এটাই তো নিয়ম হওয়া উচিৎ। কিন্তু ভাগ্যদেবী যেন প্রসন্ন হয়েও হলো না। এবার বাদ সাধল বিশ্বের অন্যতম ত্রাস করোনাভাইরাস। এই ভাইরাসের হুঙ্কারে সমগ্র বিশ্ব বাঁশি গৃহবন্দী  পড়ে।দুই হাজার কুড়ি সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলা শেষ হবার পরেই, ভারতবর্ষে লকডাউন ঘোষিত হয়।

বইমেলা ফেরত বহুু বই সম্পাদক ও পাবলিশার্সের হাত ধরে  হয় কলকাতার বই পাড়ায়। বই পাড়া কিছুটা স্বস্তির  ফেল না ফেলতেই করোনার প্রকোপে পড়ে সমগ্র বিশ্ব। চীন-আমেরিকা  ফ্রান্স ইতালি রাশিয়ার মতো দেশগুলো লক ডাউন হয়ে যায়, সেই তালিকা থেকে বাদ পড়েনি ভারত। ২১ সে মার্চ থেকে ভারতবর্ষে লকডাউন ঘোষিত হয়। কলকাতার বইপাড়ায় বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় দু মাস যাবত ভারতবর্ষের লকডাউন চলাকালীন দোকানদার পাবলিশার্স সম্পাদকরা আর ফিরতে পারেনি বইপাড়ায়। এরমধ্যে উম পুনের ধাক্কায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে কলকাতা। সমগ্র কলকাতা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। বইপাড়ায় বন্ধ দোকানের মধ্য জল ঢুকে নষ্ট হয়ে যায় লক্ষ লক্ষ টাকার বই। মাথায় হাত পড়ে দোকানদার পাবলিশার সহ-সম্পাদকদের। জলের মধ্যে বই ভেসে থাকার এমন চিত্র আগে কেউ দেখেনি। এই অচল অবস্থা থেকে অন্যতমম জনপ্রিয় বইপাড়া আবার প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে এমনটাই আমরা সবাই কামনা করব।

 

বটু কৃষ্ণ হালদার
কবরডাঙ্গা,কলকাতা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top