সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১


শ্মশানে সন্ধ্যায় একা : হুমায়ূন কবীর


প্রকাশিত:
১১ জুন ২০২০ ২১:৫৮

আপডেট:
২৮ জুন ২০২০ ২১:৩১

ফাইল ছবি

 

বান্ধবী ঝর্ণার কাছথেকে 'যথার্থ গীতা' বইটি পড়তে নিয়েছিলাম দুইমাস আগে। আজ সেটা ফেরত দিয়ে দিলাম। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। 

বাজারের পথে সবসময় ধূলোর মেঘ ওড়ে। তাই ঐ পথে আর ফিরবোনা। ফিরে যাবো নদীর পাড়ের পথ ধরে। পথটা যে শ্মশানের মাঝ বরাবর একেবারে তার পেটের ভিতর দিয়ে গেছে তা খেয়াল ছিলোনা।

সাথে নজরুল ভাই ছিলো। উনি একজন কবি। দুইজন গল্প করতে করতে আসছিলাম বলে এতো কিছু আর মনে ছিলো না।

নজরুল ভাই ব্রীজের কাছথেকে বিদায় নিয়ে চলে গলো। আমি নদীর ঢাল বেয়ে শ্মশানের পথে নেমে এলাম।  

নদীতে একজন লোক তখনো ছোট নৌকায় বসে তার জাল গুলো পাতছে। দেখে ভালো লাগলো। তারমানে কিছু লোক এখনো আশেপাশে আছে।বিকালে কতো লোকই তো নদীর পাড়ে গরু,ছাগল চরাতে আসে ঘুরতে আসে।

আমি হাঁটতে হাঁটতে শ্মশানের দক্ষিন পাশের ঘন জংগলে প্রবেশ করলাম। জংগলটা শেয়ালদের নিরাপদ বাড়ি। আমার হঠাৎ মনে হলো সন্ধ্যার শেয়াল নাকি খুব হিংস্র হয়।এই সময় ওদের সামনে পড়লে অন্যরকম কিছু ঘটে যেতে পারে।

মনের ভিতর ভয় ঢুকেগেলো। আত্মরক্ষার জন্যে একটা ঢিল কুড়িয়ে নিলাম। শ্মশানের কাছাকাছি এসে দেখি আশেপাশে কোথাও কেও নেই।একটা মানুষ কি গরু, ছাগল কিছুই না। একটা শেয়ালও যদি থাকতো! তাও নেই।

এখন এই নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় হাজার বছরের পুরনো এই নির্জন শ্মশান ভূমি আমি কীভাবে পার হবো? ভয়ে শরীর ভারি হয়ে আসছে। পা দুটো যেনো পাথরে পরিণত হচ্ছে।         

মূল শ্মশানের এলাকাটি রাস্তা থেকে একটু উঁচু। আমি ভেবেছিলাম শ্মশানে প্রবেশের সাথে সাথে আমার সাথে ভয়ংকর কিছু একটা ঘটবে। কিন্তু ঘটলো উল্টো। আমার সমস্ত ভয় চলে গলো। শরীরের ভারি ভাব কেটে গেলো। আমি বাতাসের মত হাল্কা অনুভব করতে লাগলাম।আমি স্পস্ট অনুভব করলাম কিছু অশরীরী অত্মা আমার ডানে, বামে এবং পিছনে।তারা আমাকে গাইড করছে। তারা আমার সাহায্যকারি। এখানে তারা আমার সাথে কিছুতেই খারাপ কিছু ঘটতে দেবেনা। তারা এমন একটা পরিবেশ তৈরি করলো যেনো শ্মশান একটা ভয়ভীতিহীন নিরাপদ জায়গা। আসলে তো তা না।

যদিও ভয় করছিলোনা তবু আমি একটু ভয় ভয় ভাব নিয়ে শ্মশানের ঝাকড়া ভূতুড়ে ষঢ়া গাছটার দিকে তাকালাম। কিন্তু নিরাশ হলাম।না সেখানেও ভয়ের কিছু নেই।

আমার পবিত্র আত্মার অশরীরী গাইডরা আমাকে দ্রুত এই নিরব নিস্তব্ধ সন্ধ্যার বিরান শ্মশান ভূমি পার করে দিতে ব্যস্ত।

 

আমি ভয় পাওয়ার শেষচেষ্টা স্বরূপ নদীর পানির কাছাকাছি যেখানে চিতা সাজানো হয় সেখানে তাকালাম। সেখানে চারটি মোটা মোটা গাছের গুঁড়ির লম্বা লম্বা খুটি মাটিতে পোতা আছে। গুড়িগুলোর ভিতরের পাশ চিতার আগুনে পুড়ে পুড়ে কালো কয়লা কয়লা হয়েগেছে। ঐ পোড়া চারটি গুঁড়ির মাঝখানে মানুষের শেষ এবং অতি ভয়ংকর যন্ত্রনাদায়ক শয্যা রচনা করা হয়। মৃত্যুর পর মানুষের সমস্ত শরীরে অভাবনীয় ব্যাথা হয়। সামান্য হাতের স্পর্শেও সে হাউমাউ চিৎকার এবং কান্নাকাটি করে। কিন্তু কেউ তা শুনতে পায়না। সেই অবস্থায় যদি একজন মানুষের শরীর অসমান কাঠের চিতার উপর নির্দয় ভাবে শুইয়ে দেওয়া হয় তা হলে তার কতটা কষ্ট হয়? তারপর তার শরীরে যদি আবার আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় তা হলে তার কত যন্ত্রনা হয়?

কেউ হয়তো বলবেন মরা মানুষের আবার ব্যাথা কিসের?কিন্তু জ্যান্ত মানুষের তো ব্যাথা আছে। কষ্ট আছে। সতি দাহ প্রথার নামে কতো জীবিত মানুষকেও কতো শত হাজার বছর ধরে পোড়ানো হয়েছে। সেই পুড়ন্ত জ্যান্ত মানুষগুলোর আর্তচিৎকার, বিক্ষুূব্ধ  আত্মারা আজো এই সন্ধ্যার নির্জন নিস্তব্ধ শ্মশান ভূমিতে ঝড়ের মতো ছাই শয্যা ছেড়ে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়।

এই পবিত্র আত্মারা আমাকে সেই বিক্ষুব্ধ আত্মাদের আক্রোশের ঝড়ের হাতথেকে রক্ষা করতেই দ্রুত মূল শ্মশান ভূমি থেকে নিরাপদে এবং সম্মানের সাথে বের করে দিলো।  

আমি শ্মশানের পবিত্র আত্মাদের উঁচু আবাস ত্যাগ করে প্রচলিত নিচু পথে নামলাম। পথে নামার সাথে সাথে ভয় আবার আমাকে গ্রাস করলো। সমস্ত শরীর ভারি হতে শুরু করলো।পা দুটো আটকে যেতে লাগলো।

এদিক ওদিক না তাকিয়ে প্রাণপণে পা দুটো টেনে টেনে তুলতে লাগলাম। নিরাপদ দূরত্বে পৌছে ইচ্ছে হলো একবার পেছন ফিরে তাকায়।আবার মনে হলো কী দরকার।ভালোই ভালোই তো ভয়ংকর স্থানটা পার হয়ে এসেছি।তাহলে আবার সেইদিকে তাকানোর কী দরকার। শেষে কী দেখতে কী দেখবো শেষে তার প্রভাব কী ভাবে শরীর মনে আঘাত হানবে তার কোনো ঠিক আছে?সবচে ভালো হয় এই নিরাপদ  নিরাপত্তার চাদরে মোড়া সুখ স্মৃতি নিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়া।

মগজ ভাবে এক আবেগ করে আর এক।আবেগ চোরাবালির মতো আমাকে পেছনে তাকাতে টানতে লাগলো। বাধ্য হয়ে তাকালাম।

দেখলাম চিতার মঞ্চের কাছে একটা মোটা কালো বিশাল ভয়ংকর এঁড়ে গরু চোখ লাল করে আমার  দিকে তাকিয়ে আছে। কী আশ্চর্য ব্যাপার এই গরুটা এতোক্ষন কোথায় ছিলো?

আমি শ্মশানে ঢোকার সময়, চলার সময় সারাক্ষণ চারপাশ তন্ন তন্ন করে খুজেছি। কোথাও কিছু ছিলোনা।সমস্ত এলাকায় একটা মানুষ কি গরু,ছাগল,পাখি, শেয়াল কিছুই দেখিনি। এখন হঠাৎ কোথা থেকে এতো বড় একটা কালো গরু  এলো?

তাড়াতাড়ি গ্রামের দিকে পা বাড়ালাম। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব লোকজনের ভিতর পৌছতে হবে।ব্যাপারটা সুবিধার মনে হচ্ছেনা। মন সবসময় যুক্তির বিপরীতে চলে এবং বিপদকে দাওয়াত করে আনে।

কয়েক পা এগুনোর পর মন পা কে থামিয়ে দিলো।সে আর একবার পেছন ফিরে তাকানোর পক্ষে। বাধ্যহয়ে আবার তাকালাম। না গরুটা আছে।

আবার সামনে পা বাড়ালাম। এইবার মন ভয়ংকর এক যুক্তি দিলো। মন বললো এই ভাবে গরুটাকে শ্মশানে ফেলে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না।ওটা হয়তো আমাদের গ্রামেরই কারো গরু। এই সন্ধ্যাবেলায় গরুটা রেখেগেলে শেয়ালে খেয়ে ফেলবে।শ্মশানের জংগলে শেয়ালের তো অভাব নেই। তার চে ওটাকে শ্মশানের জংগল থেকে এনে ফাকা স্থানে বেঁধে রেখে যাই। পরে যার গরু সে এসে নিয়ে যাবে।

 

মাত্র এক পা এগিয়েই মুহূর্তের ভাবনায় সিদ্ধান্ত নিলাম আবার শ্মশানে ফিরে যাবো। কিন্তু হঠাৎ একটা সাদা ধবধবে লালচে ঠোটের ছোট পাখি আস্তে করে আমার কানের পাশদিয়ে উড়েগেলো। বলে গেলো, খবরদার আমরা এর হাত থেকেই তোমাকে বাঁচানোর জন্যেই পাহারা দিয়ে সন্ধ্যার ভয়াল শ্মশান পার করে দিয়েছি। বাঁচতে চাইলে পালাও।

কিন্তু কোথায় পালাবো সংসারে কোথাও শ্মশানের মতো এতো নিরাপদ জায়গা আর আছে নাকি? শ্মশানের নেশা আমাকে পেয়ে বসেছে। আমি শ্মশানের প্রেমে পড়েছি।

আসলে পুরো পৃথিবী তো এখন এক শ্মশানভূমি। 

আবার শ্মশানে যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছি।কিন্তু কোথায় গরু কোথাও সেই গরু নেই।

একমুহূর্তের ভিতর গরুটা কোথায় চলে গেলো? 

ওটা কি আসলে গরু? নাকি পৃথিবীব্যাপী নষ্ট রাজনীতির চিতায় নিরন্তর জীবন্ত জ্বলতে থাকা ক্রুদ্ধ মানুষের আত্মা!

 

হুমায়ূন কবীর,
মানিকদিহি, যশোর

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top