সিডনী শুক্রবার, ১০ই মে ২০২৪, ২৭শে বৈশাখ ১৪৩১


কবি ও অনুরাগিনী: তাপস বড়ুয়া


প্রকাশিত:
১৪ জুন ২০২০ ২২:১৯

আপডেট:
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:৪৭

 

১.

অনুষ্ঠান শুরু হতে যতটা দেরী হবে ভেবেছিলেন দেবাশীষ, ঠিক ততটা দেরী হলো না। দশটার অনুষ্ঠান সাড়ে দশটার দিকে শুরু হতে পারলো। সকালে খুলনা থেকে রওনা হয়ে গাড়ীতেই আসা গেল রাধানগর পর্যন্ত।   এটা দেবাশীষের কাছে এক বিস্ময়। অনেক বছর এদিকে না আসলেও জীবনের প্রথম আঠারো-উনিশটি বছর তার কেটেছে এই দিকেই। রাধানগর থেকে আঠারো-কুড়ি কিলোমিটারের মধ্যেই তাদের বাড়ী। আশির দশকে কুড়ি কিলোমিটার যেতে প্রায় সারাদিন লাগতো। হাঁটা রাস্তা, পথে তিনটি খেয়া পার। না হলে মাইল ছয়েক হাঁটার পরে হাতে বাওয়া নৌকা। সে এক বিশাল বিড়ম্বনা।

ওদিকে তখন কোন কলেজ ছিলো না। ওখানকার ছেলেমেয়েরা পড়তে আসতো এদিককার কলেজে। বিভিন্ন বাড়ীতে মেসে থাকতো তারা। কলেজে তার বেশ কিছু ক্লাসমেট ছিলো যাদের বাড়ী এদিকের বিভিন্ন গ্রামে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে সেই যে ঢাকায় যাওয়া আর এদিকে আসা হয়নি।

তিরিশ বছরের ব্যাবধানে আজ আবার এদিকে এলেন তিনি। এবার রাধানগর কলেজের দশ বছর পূর্তি উৎসবের প্রধান অতিথি হয়ে। কলেজের প্রিন্সিপাল ভদ্রলোক সজ্জন ব্যাক্তি। দেবাশীষকে শহর থেকে আনতে নিজে গিয়েছিলেন গাড়ী নিয়ে। তিনি শুধু প্রিন্সিপাল নন। এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতাও। ধন্যাঢ্য ব্যক্তি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার পরে যশোরের এক কলেজে কিছুদিন চাকরি করেন। তারপর বাবার মৃত্যুর পরে পারিবারিক চিংড়ি ঘের দেখাশোনার জন্য গ্রামে আসতে হয়। তখন প্রতিষ্ঠা করেন বাবার নামে কলেজ। দশ বছর পূর্তি উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেবাশীষকে ডাকার উদ্দেশ্য একটাই, বর্তমানে দেশের শীর্ষস্থানীয় কবিদের মধ্যে দেবাশীষ এই এলাকার মানুষ। অন্তত একসময় তাই ছিলো।

এলাকার কৃতি সন্তানকে দিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করানোর পরামর্শ নাকি তাকে তার স্ত্রী দিয়েছিলেন, একথা ভদ্রলোক জানালেন কথায় কথায়। এরকম দূর গ্রামে তার অনুরাগিণী পাঠক আছেন জেনে একটু শ্লাঘা বোধ করেন দেবাশীষ। তথাকথিত ব্যক্তিত্বের ভাব বজায় রাখতে গিয়ে আর কোন প্রশ্ন তিনি করেন না। কিন্তু সেই অনুরাগিনী পাঠকের একটা ছবি তিনি মনে মনে  আঁকতে থাকেন। একটা ইচ্ছা তার মনে দানা বাঁধে, তার কবিতার অনুরাগিণীকে দেখার।

২.

অনুষ্ঠানের পরে তিনি জানতে পারেন, তার মধ্যাহ্নভোজের ব্যাবস্থা প্রিন্সিপালের বাড়িতে। তখন ভোজের কল্পনা নয়, না দেখা একটা মুখ তার কল্পনায় ভেসে ওঠে। দুপুরের দিবানিদ্রার আগে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে তার কবিতার বই যে পড়ে বুকের উপর ধরে। হয়তো লালপাড় সাদা শাড়ী পরা। কপালে সিঁদুর। সিঁথির দু’পাড় উপচে একটু চুলেও লেগেছে। হাতে সোনা-বাঁধানো শাঁখা। ফর্সা সেই হাতের লম্বা লম্বা আঙুলে ধরা তার লেখা কবিতার বই। তিনি ভাবছেন, সেই হাত আজ তার পাতে হয়তো বেগুনভাজা তুলে দিতে আসবে। শাখার দু’পাশে কি দুটো সোনার চুড়ি থাকবে! নাকি সোনা বাঁধানো পলা।

দেবাশীষকে নিয়ে মাতলো বড়ীর সবাই। কচি ডাবের জল এনে দিলেন প্রিন্সিপাল সাহেব নিজের হাতে। দেবাশীষ পুরোটা শেষ করে বললেন, “এবার একটার মুখ কেটে দিন তো। গ্লাসে ঢালা লাগবে না।” সে চুমুক দিয়ে খেতে গিয়ে জামা ভিজিয়ে ফেললো। ধোয়া তোয়ালে এগিয়ে দিলেন একজন, সে কোন রকমে গলা-বুকের দিকটা মুছলো।

সাধারণ আমন্ত্রিতদের জন্য আয়োজন বাহির উঠোনে। সামিয়ানা টানানো হয়েছে সেখানে। বাজার থেকে বাবুর্চি-ডেকোরেটর আনা হয়েছে। সব ব্যাবস্থা তারাই দেখছে। বিশিষ্ট কয়েকজন অতিথির খাবার ব্যাবস্থা করা হয়েছে বাড়ির মধ্যে। সাবেককালের দালানের বিশাল চওড়া বারান্দা। সেখানে চেয়ার-টেবিল পাতা হয়েছে। আজকালকার শহুরে এপার্টমেন্টে এত বড় ডাইনিং দেখা যায় না। এখানে খাবার পরিবেশন করছেন বাড়ির মেয়েরা। অনেক দিন পরে চুইঝালে রান্না করা মাছ-মাংস খাচ্ছেন দেবাশীষ। তার স্ত্রী ঢাকার  মেয়ে, চুই ঝাল চেনেই না। তিনি এক টুকরো চুই মুখে পুরে চিবোতে লাগলেন। মিষ্টি ঝালের আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। ছেলেবেলায় ফিরে যাচ্ছেন তিনি। প্রিন্সিপাল বাবু বোধহয় তার কাউকে ডাকলেন, “স্বপ্না, ওনাকে আরো চুই দাও। উনি পছন্দ করেছেন।” দেবাশীষের চোখ আপনা থেকেই খুলে গেল, দু’টো ঝটকা লাগলো একসাথে। এইবার কি তিনি তার ভক্ত পাঠিকাকে দেখবেন! কার নাম স্বপ্না!

স্বপ্না নামে একটি মেয়ে তার কবিতার অনুরাগিনী ছিলো। একসময় স্বপ্নাকে শোনাবার জন্যেই সে কবিতা লিখেছে কত। তারুণ্য আর প্রথম যৌবনে স্বপ্নাকে নিয়েই তার স্বপ্ন ছিলো। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে স্বপ্না ছিটকে গেছে তার জীবন থেকে। একবার তার মনে হয়েছিলো, একটা বই তিনি স্বপ্নাকে উৎসর্গ করবেন। যদিও যোগাযোগ নেই অনেক বছর। তার অদেখা স্বপ্নার সংসার এবং তার নিজের সংসারের কথা ভেবে নিজেকে সামলেছেন।

মোবাইল ফেসবুক আসার আগে যারা হারিয়ে গেছে তাদের ‘ট্রেস’ করা সহজ নয়। তিনি ফেসবুকে স্বপ্নার নাম লিখে সার্চ দিয়েছেন অনেকবার; কাজের কাজ কিছু হয় নি। হয়তো সে ফেসবুক ব্যাবহারই করে না।

একটা কাঁসার চামচে করে বড় একখন্ড চুই আসলো। যে হাতে সেই চামচ ধরা সেই হাতে সোনা বাঁধানো শাখা, দু’পাশে দু’টি চিকন সোনার চুড়ি। লম্বা লম্বা আঙুল নয়: বরং একটু খাটো খাটো। ফর্সা। তার নিচে অন্যহাতে ধরা একটা কাঁসার বটি, যাতে চামচ থেকে ঝোল না পড়ে নিচে। হাত হয়ে দেবাশীষ পরিবেশনকারীর মুখের দিকে তাকালেন। স্বপ্না! স্বপ্নাই তার স্বামীকে বলেছে তাকে নিমন্ত্রণ করে আনতে! এতদিন পরে দেখতে চেয়েছিলো বুঝি! কথা সরে না তার মুখে। স্বপ্নাও কিছু বলে না। চুই দিতে এসেছিলো, চুই দিয়ে চলে যায়। অন্যরা যেমন পরিবেশন করছিলো, সেভাবেই খাওয়ার পর্ব শেষ হয়।

খেয়ে উঠে এলামেলো মনে সোফায় বসে আছে দেবাশীষ। অনেকে অনেক কথা বলছে। সে চুপ। এমনিতে সে পাঠকদের খুব সম্মান করে, তাদের কথা মনেযোগ দিয়ে শোনে। আলোচনায় অংশ নেয়। আজ মনে হচ্ছে, এদের অনেকেই তার কোন লেখা পড়েনি। এমনিই বলছেন প্রিয় কবি, খুব পছন্দ ইত্যাদি। বিরক্ত লাগে তার। মেজাজ খিচড়ে যেতে চায়। এমন সময় দরজার ওপাশ থেকে ভেসে আসে, “কবি পান খাবে কিনা জিজ্ঞেস কর।”  কেউ একজন বলছে কাউকে। কিন্তু তাকে শুনিয়ে। স্বপ্না তাকে পান খাওয়ার নিমন্ত্রণ করছে।

একদিন বয়রা গার্লস কলেজের মোড়ে পান খাওয়ায় কি ভৎসনাটাই না করেছিলো সে। “লাল দাঁত নিয়ে আমার সাথে হাঁটবে না” বলেছিলো। সেই নিয়ে মান অভিমান। এরপর থেকে ঘোরার শেষে স্বপ্না একটা পান কিনে দিতো দেবাশীষকে, “রাতে খাওয়ার পরে খেয়ে দাত ব্রাশ করে ঘুমাবে”। দেখা অবশ্য তিন মাস ছ’মাস পরপর হতো দেবাশীষ খুলনায় গেলে। স্বপ্না তখন বয়রা কলেজের ছাত্রী। দেবাশীষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের।

প্রিন্সিপাল সাহেব বললেন, “ভেতরে আসো। কবির সাথে কথা বলো।” দেবাশীষের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার খুব ভক্ত। আপনার প্রায় সব বই আছে আমাদের বাড়িতে।” দেবাশীষ ভদ্রতার খাতিরে বললেন, “তাই নাকি?”

কাঁসার বাটায় পান নিয়ে স্বপ্না এলেন। সেন্টার টেবিলে রাখলেন। “তোমরা কথা বলো” বলে চলে গেলেন। দেবাশীষের মনে হলো, হাত ধরে টেনে বসায় তাকে। বলে, “কেন এমন করছো; আসো কথা বলি। আমাদের গেছে যে দিন একবারেই কি গেছে?” বলা হলো না। স্বপ্নার সংসার আছে। সে যে তাকে ব্যাক্তিগতভাবে চেনে এটাও যেহেতু বলেনি কাউকে, তার আর ওদিকে না যাওয়াই ভাল। স্বপ্না যে তাকে এত বছর পরে দেখতে চেয়েছে, দেখা হওয়ার ব্যাবস্থা করেছে এই বা কম কিসে।

সবাই জড়ো হয়েছে। কবি চলে যাবেন। স্বপ্নাও এলেন। লালপাড় সাদা শাড়ী পরেছেন। কপালে সিঁদুর। হাতে শাখা। একসময় এই সাজের কথা দেবাশীষ তাকে খুব বলতো। তরুন আবেগি গ্রগলভ দেবাশীষ। শুধু বলতো, দেখেনি কখনো। আজ সেই সাজে তিনি দেখলেন স্বপ্নাকে পঁচিশ বছর পরে। বয়স হয়েছে, চুলে ঈষৎ সাদার আভাস। কিন্তু খুলনার দক্ষিণের লোনা জল হাওয়া তার গায়ের রঙে কোন ছাপ ফেলতে পারে নি। লক্ষী প্রতিমার মত তার গায়ের রঙ। তেমনি চোখমুখ। গালের বাম পাশে একটা বড় তিল, রঙটা কতটা ফর্সা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

উঠোনেই দাঁড়ানো ছিলো গাড়ী। অল্পবয়সী একটি মেয়ে একটি টিফিন কেরিয়ার ড্রাইভারের হাতে দিলেন। কবির জন্য রাতের জন্য খাবার। তারপর স্বপ্না এগিয়ে এলেন। দেবাশীষকে বললেন, “এই পানগুলো নিয়ে যান, রাতে খাওয়ার পরে খাবেন”। এই প্রথম এবং শেষ কথা পঁচিশ বছর পরের দেখায়। দেবাশীষ কী বলবে ভেবে উঠতে উঠতে স্বপ্না সরে গেছে দূরে। উপস্থিত পুরুষদের মধ্যে যারা সামনের দিকে ছিলেন তাদের  সাথে হ্যান্ডশেক করে আর নারী ও অন্যদের দিকে হাত নেড়ে, প্রিন্সিপাল বাবুকে আবার আসার কথা দিয়ে তিনি গাড়ীতে ওঠেন।

৩.

দুপুরেই অতিরিক্ত খাওয়া হয়ে গেছে। রাতে আর খেলেন না দেবাশীষ। হোটেলের রূমে বসে সিগারেট টানছেন একর পর এক। পানের পুটলিটা বের করছেন, হাত বুলাচ্ছেন, আবার রেখে দিচ্ছেন। দু’টো পান সেখানে। খেয়ে ফেললে তো আর থাকবে না। তার ঘুম আসছে না। তার আশা ছিলো স্বপ্না হয়তো তাকে ফোন করবে। স্বামীর মোবাইল থেকে নম্বর নেয়া কঠিন কাজ নয়। কিন্তু তেমন কিছু ঘটলো না। দেবাশীষও তো স্বপ্নার স্বামীকে ফোন করে বলতে পারে না যে আপনার স্ত্রীর সাথে কথা বলবো। এসব ভাবতে ভাবতে রাত প্রায় তিনটার দিকে তিনি পান দু’টো একসাথে মুখে পুরলেন। আরেকটা সিগারেট ধরালেন। সারদিনের ধকলও ছিলো, মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগলো। তিনি সিগারেটটা এ্যাসট্রেতে গুঁজে দিলেন।

পরদিন অনেক বেলায় হোটেলের লোকজন পুলিশ ডেকে দরজা ভেঙে দেবাশীষের মৃতদেহ উদ্ধার করে। দুপুর থেকে সব চ্যানেলে এটাই ব্রেকিং নিউজ, দেশ বরেণ্য কবি দেবাশীষের মৃতদেহ খুলনার একটি হোটেল রূম থেকে উদ্ধার। সব চ্যানেলের সব বুলেটিনেও এটাই লিড স্টোরী।

সন্ধ্যা নাগাদ কোন কোন চ্যানেলের পূর্ণাঙ্গ বুলেটিনে আরেকটি খবর শেষ দিকে প্রচার করলো, পাইকগাছার রাধানগরে পুকুরে ডুবে গৃহবধূর মৃত্যু।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top