মহামারীর সংক্রমন রোধে আমাদের অসচেতনতা : অনজন কুমার রায়
প্রকাশিত:
২০ জুন ২০২০ ২০:৫৫
আপডেট:
২ জুলাই ২০২০ ২১:০১

ইংরেজী সাহিত্যের ছদ্মাবরণে যেমন মহামারীর প্রকোপ তুলে ধরা হয়েছে, তেমনি বাংলা সাহিত্যেও মহামারী বা মড়কের স্থান লাভ করেছে। তখনকার সময় মহামারীকে ' মড়ক ' হিসেবেই সবাই চিনত। আদিকাল থেকেই মানব সমাজে এমন মহামারী ছড়িয়ে পড়ার আভাস পাওয়া যায়। বর্তমান যুগের তুলনায় তখনকার সমাজ ব্যবস্থায় অপ্রতুলতার কারণে অনেক পিছিয়ে ছিল বলে হয়তো মহামারী অনেক বড় আকার ধারণ করেছিল।
তাই, বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ' শ্রীকান্ত ' উপন্যাসে যদি এ সংক্রান্ত অবতারনা আমরা লক্ষ্য করি তবে মহামারীর বিভীষিকাময় জীবন সহজেই আঁচ পারি।
"পরদিন বেলা এগার-বারটার মধ্যে জাহাজ রেঙ্গুন পৌঁছিবে, কিন্তু ভোর না হইতেই সমস্ত লোকের ভয় ও চাঞ্চল্যের একটা চিহ্ন দেখা দিল। চারিদিক হইতে একটা অস্ফুট শব্দ কানে আসিতে লাগিল, 'কেরেন্টেন'। খবর লইয়া জানিলাম, কথাটা 'Quarantine'. তখন প্লেগের ভয়ে বর্মা গভর্ণমেন্ট অত্যন্ত সাবধান। শহর হইতে আট-দশ মাইল দূরে একটা চড়ায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়া খানিকটা স্থান ঘিরিয়া লইয়া অনেকগুলি কুঁড়েঘর তৈয়ারী করা হইয়াছে, ইহার মধ্যে সমস্ত ডেকের যাত্রীদের নির্বিচারে নামাইয়া দেওয়া হয়। দশদিন বাস করার পর, তবে ইহারা শহরে প্রবেশ করিতে পায়।"-
তখনকার সাহিত্যেও আমরা ' কোয়ারেন্টিন ' শব্দটির সাথে পরিচিত হই এবং অনুধাবন করতে পারি মহামারীর ভয়াবহতা। মহামারীতে কতটুকু প্রতিকূলতা সইতে পেরে মানুষ এগিয়ে যায় তার উদাহরণ এখনকার দু:সময়ই বলে দেয়। তখনকার সময়ের সাহিত্য থেকেও ধারণা লাভ করতে পারি।
প্রথমদিকে কোভিড-১৯ ভাইরাস চীনে ধরা পড়লেও বিশ্বে তেমন একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি বলে সকলের মাঝেই স্বস্তির নি:শ্বাসটুকু ছিল। আস্তে আস্তে যখন তাবৎ দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে তখন আতঙ্ক আরো ঘনিভূত হতে থাকে। কয়েকটি দেশে সংক্রমন মাত্রা বেশি ঘটিয়ে আতঙ্কের ছাপটা আরো বেশি করে নাড়া দেয়। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম বলা চলে না।
বর্তমান সময়ের জীবন বাঁকে এসে চিন্তিত মনে সবাই দিন পার করছে। কখন যে আক্রান্তের লেখচিত্রটা নিচে নেমে আসবে। কিন্তু, আমাদের দেশে আক্রান্তের গ্রাফটা দিন দিন উপরের দিকে উঠে আসছে। এসব ভয়ার্ত খবর তীব্র উদ্বেগের সৃষ্টি করে। আতঙ্কে সীমাবদ্ধতার মাঝে কোন গন্ডি নেই বলে সকলের মুখে মলিনতার ছাপটুকু বেড়েই যায়। ভাসমান মানুষগুলোর দারিদ্র্যের কষাঘাতে দিনাতিপাত করছে। নেমে আসে নিস্তব্ধতার আঁধার। খুঁজে নিতে হয় নতুনভাবে বাঁচার পথ।
দেশে লক ডাউন সামান্য শিথিল করার ফলেই শহরের অলিতে গলিতে মানুষের আনা-গোনা বেড়ে যায়। কেউ কেউ আঁচ করতে চায় না পরিস্থতির বিষণ্নতা। কোন কোন মানুষ প্রয়োজনের তাগিদেই হয়তো ঘর থেকে বের হয়, কেউ কেউ প্রয়োজন ব্যতিরেকে বের হওয়ার পথ খুঁজে নেয়। আবার কেউ হয়তো দরজায় খিল দিয়ে নিস্তব্ধতায় দিনগুলো অতিবাহিত করছে।
বিশেষ করে যারা কর্মক্ষেত্রে কাজ করে চলেছেন তাদের জন্য বিপর্যয়ের হাতছানি। প্রয়োজনের তাগিদেই কর্মস্হলে গমণ করতে হয়। নিজেরা সচেতন থাকলেও অন্যের অসচেতনতার প্রভাব ভাবিয়ে তুলে। অবচেতন মনকে মানিয়ে নিয়ে তারা সীমাবদ্ধতায় লাগাম টেনে রাখতে চায় না।
এক্ষেত্রে প্রতিদিনকার ব্যাংকের চিত্র দেখলেই আঁচ করতে পারা যায় কিছু মানুষের সচেতনতার দৃষ্টি ভঙ্গি।
আবার কিছু প্রান্তিক জনগোষ্ঠী আছে যারা মাস্ক ব্যবহার করে না, কেউ কেউ ব্যবহার করলেও হাতে দস্তানার বালাই নেই। তাদের মতে, মাস্ক ব্যবহারেই সংক্রমনের সীমাবদ্ধতা থেকে যায় !
টাকা পয়সার যোজন-বিয়োজনে কিছু রিক্সার দেখা মিললেও অন্য বাহনের কমই দেখা মিলে। শহুরের পাড়ার গলিতে মাঝে মাঝে ভ্রাম্যমান চায়ের দোকান পরিলক্ষিত হয়। কিছু মানুষ ভাবনার তেমন ফুরসত খুঁজে পায় না, তাই হয়তো মাছ কিংবা সবজির বাজারে গা ঘেষে চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
গ্রামের ক্ষেত্রেও সচেতনতার বালাইয়ে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় না। তাইতো কেউ কেউ সিগারেট টেনে ধায়, শহরতলী কিনা পোড়ে না; গ্রাম। সে তো এ গ্রামের মানুষদের কল্যাণে স্থিমিত। তার মাঝে বয়োবৃদ্ধদের কথার বরখেলাপ চলে নাকি! অস্পৃশ্যতা মানব মনের চাহিত চাহিদা। সেটা অপয়াদের আঘাত করে। বঙ্গদেশে কি আর পশ্চিমা হতে ঘূর্ণিঝড় তেড়ে আসে? মহামারী; সেটা তো তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। আমাদের জীবন বাঁকে ওসব খেলা করতে আসবে না। তাদের (পশ্চিমাদের) জীবনের ছন্দ এভাবেই রচিত হয়ে আছে! স্থির থেকে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আবারো কেউ কথার ফুরসত বাড়িয়ে দেয়।
বাক সচেতন কিছু মানুষ সাবান কিংবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দু'একদিন ব্যবহার করলেও তৃতীয় দিন থেকে হর হামেশাই পুরাতন ধাচে চলে আসে। মহামারীর প্রেক্ষাপটে সাবলীলতার বহি:প্রকাশ এভাবেই আসে। হাতে নেই কোন দস্তানা , তবে মুখে রয়েছে মাস্ক। একটি টি স্টলে দুই তিনটা ছোট বেঞ্চ থাকে বলে সবাইকে গাদাগাদি করেই বসতে হয়। চায়ে এক চুমুক কিংবা দু' চুমুক দিয়ে তবেই আরেকটি কথার ফুলঝুরি কিংবা আলোচনার গতি নির্ধারিত হয়।
কিছু লোক হয়তো এত শত বুঝে না। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কথা গলাধকরন করে। দোকানের টিভিতে সামাজিক দূরত্ব কিংবা Social Distancing-এর কথা দেখতে পেলেও মন:সংযোগ বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনায়ই নিহিত থাকে। দূরত্ব বজায় রাখলে কি সুবিধা হবে সেটা বুঝতে চাইলেও কেউ তাদের কথার মতান্তরে আসে না। অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবারও টিভিতে দেখতে পায় হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করার নিয়ম। ' হ্যান্ড স্যানিটাইজার ' যে কি এখনো তাদের মাথায় আসে না। সত্যিই তো, কয়জনই বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার সম্পর্কে ধারণা রাখে।
পরক্ষণেই ভাবি, হার্ড ইমিউনিটি মনে হয় ওখানেই বেশি কাজ করে। তা না হলে কাছে আসার গল্পে কিংবা কাছে যাওয়ার মননে নিজেদের কেমনে আগলে রাখে! হার্ড ইমিউনিটি না থাকলে হয়তো রসালো আলাপ-চরিতা চায়ের দোকানে স্থান পেত না! তাইতো, ভাষার অন্বেষণে কিংবা পারদর্শিতার বিচারে আরও এক ধাপ এগিয়ে থাকে তারা।
পাড়ার রোমিওর দলটি যারপড় নাই মানুষের সাহায্যোর্থ সময় ক্ষেপণ করছে। কাউকে শুদ্ধি অভিযানের নামে বাড়িতে থাকতে বলছে, কাউকে বা কাছে না ঘেষার জন্য বলছে। ভাবনার স্ফূরনটুকু স্বত:স্ফূর্তভাবে তাদের মাঝেই দেখা যায়।
আবার নিম্নশ্রেণীর লোকেরা অসহায়ত্বে দিনগুলো পার করছে। তাদের অসহায়ত্বের চাহনি গোটা সমাজকে ভাবিয়ে তুলে। কেউ হয়তো কর্মক্ষেত্রে কাজ করার অধিকারটুকু হারিয়ে কায়-ক্লেশে জীবন যাপন করছে। এদের জন্যেই কেউ হয়তো মানবতার দক্ষিণ হস্তটুকু বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ভাবি, সবকিছুই চলেছে আপন গতিতে।
ভোর বেলায় লেজ নাড়াতে নাড়াতে কাঠবিড়ালিটি এ গাছ থেকে ও গাছে লাফিয়ে চলে। ফিঙ্গে পাখিগুলো আওয়াজ তুলে খেলায় মত্ত থাকে।
একপশলা বৃষ্টির পর পানি লেগে আছে বাড়ির উঠানে। তাতেই লুটোপুটি খাচ্ছে বাড়ির হাঁসগুলো।
সন্ধ্যে বেলায় ঘরের উপর দিয়ে উড়ে যায় বকগুলি। সাদা পালকগুলি স্পন্দিত করে জানান দেয় নীড়ে ফিরে আসার ঠিকানায়।
এভাবেই আশা নৈরাশার দোলাচলে আশাকে নিয়েই আমরা বাঁচতে শিখি। ভাবি, অচিরেই ফিরে পাবো আমাদের দেখা স্বপ্নগুলি। আবারও ডানাগুলো মেলতে শিখবে ঈপ্সিত আকাঙ্ক্ষাগুলি।
অনজন কুমার রায়
ব্যাংকার ও লেখক
বিষয়: অনজন কুমার রায়
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: