সিডনী মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৭ই বৈশাখ ১৪৩১


নিউটনের তৃতীয় সূত্র : সিদ্ধার্থ রায় চৌধুরী


প্রকাশিত:
২৩ জুন ২০২০ ২২:৫৪

আপডেট:
২৩ জুন ২০২০ ২৩:১২

 

নদী বারান্দায় রেলিং উপর ভর দাঁড়িয়ে বাগানের সদ্য ফোটা গোলাপে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে; যেন উদ্ধত গোলাপগুলো বলছে আমরা তোমার থেকে কম সুন্দর নই। ঘরের ভিতর থেকে হঠাৎ ছেলে আকাশের চিৎকার " বাবা কিস্তিমাত "। নদীর চোখের সামনে আস্তে আস্তে ভেসে উঠলো পুরানো দিনের ফেলা আসা স্মৃতি -

নদী  গোঁড়া রোমান ক্যাথ্লিক খৃষ্টান পরিবারের মেয়ে। বাবা অরিন্দম বোস যদিও বোস পদবি ওনার পূর্বপুরুষ খৃষ্টান ধর্ম গ্রহন করলেও পদবিটা থেকে গেছে। নদী দেখতে ডানাকাটা পরী নাহলেও বেশ সুন্দর। ওর মুখের বিশেষ আকর্ষণ হ'লো অতল গভীর চোখদুটি।তাই বাবা সাধ করে নাম রেখেছিলেন নদী। ছোটবেলা থেকেই বাবার সাথে প্রতি রবিবার পার্ক সার্কাস চার্চে যাওয়া অভ্যাস। লেরটোতে স্কুল জীবন শেষ করার পর বেথুন কলেজে থেকে ইংরেজি আনার্স নিয়ে শেষ বর্ষের পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। তাই ছুটির মেজাজে বাবার সাথে রবিবার চার্চে হাজির। ওই চার্চে নিয়মিত আসতো রবিন ডিকষ্টা ওর বাবা ও মায়ের সাথে। বিত্তশালী শিল্পপতি পরিবারের ছেলে। স্মার্ট ঝকঝকে বেশ বেপরোয়া ছাপ চেহারায় । ওরা আসতো সিলভার কালারের ওডি গাড়ি নিয়ে।এই রবিবার ডিকষ্টা পরিবারও এসেছেন। প্রার্থনা শেষে মিষ্টার ডিকষ্টা বাবাকে ডেকে বললেন, 'মিষ্টার বোস আপনার সংগে একটু বিশেষ জরুরি কথা ছিল'।

বাবা একটু আবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করলেন;

' হ্যাঁ, বলুন কি কথা?

' আপনার মেয়েটিকে আমাদের পরিবারের সবার পছন্দ। আমার ছেলে রবিনের সংগে বিয়ের প্রস্তাবের অনুরোধ রাখছি '।

ওরকম পয়সাওলা পরিবারের ছেলে দেখতে শুনতে বেশ ভালো।

কয়েকদিনের মধ্যেই চার্চে বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর তিনটি বছর উদ্দাম বল্গাহীন জীবন। তারপর এলো সেই ভয়ানক রাত। রবিন ব্যবসা কাজের জন্য পার্টিতে যেতে পারিনি , তাই পার্টির শেষে একাই নদী গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছিল । হঠাৎ বাঁক নেবার মুখে দেখলো একটা লরী তীব্র বেগে ধাক্কা মারলো সোজাসুজি ওর গাড়ির মুখে । তারপর নদীর আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরলো দেখে বেল ভিউ নার্সিংহোমের কেবিনে শুয়ে আছে। সারা মুখে সারা গায়ে প্লাষ্টারে  জাড়ানো, মুখে সারা শরীর অসহ্য যন্ত্রণা। উদ্বিগ্ন মুখে উসখুসকো চেহারায় রবিনকে দেখতে পেল বেডে পাশে। রবিন উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,

'এখন কেমন বোধ করছো। তিনদিন তুমি কোমায় ছিলে। ঈশ্বরের দয়ায় তোমার জ্ঞান ফিরেছ। প্রানে বেঁচে গেছো '। নদী কোনোরকমে জড়ানো গলায় বললো

 'শরীরে ভিষন যন্ত্রণা হচ্ছে '। রবিন শুনে বললো

 ' হবে না। অ্যাক্সিডেন্টে তোমার গাড়ি তাল পাকিয়ে গেছে। আমরা তো তোমার বাঁচার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। ঈশ্বরের অশেষ করুনায় তুমি বেঁচে গেছো '।

অতি কষ্টে নদী বললো

'আমার কথাও বলতে কষ্ট হচ্ছে '।

রবিন শুনেই বললো,' আচ্ছা তুমি ঘুমাও। আমি ডাক্তারের সংগে কথা বলে বাড়ি যাবো। গত তিনদিন বাড়ি যাইনি বলে কেবিন থেকে রবিন বেরিয়ে গেল '।

 

চারদিন পর মুখের প্লাস্টার খোলার পর নদীর মনে হলো মুখের চামড়াটা কেমন যেন বদলে গেছে। নার্সকে বারবার অনুরোধ করা সত্বেও একটা আয়না নদীকে দিল না। বিকালে রবিন প্রচন্ড উদ্বিগ্ন মুখ ওর কেবিনে ঢুকেই নদীকে দেখার পর; রবিনের মুখটা বিবর্ন ফ্যাকাশে গেল। নদীর মনে হলো আয়নার আর দরকার নেই। রবিনের মুখ দেখেই বুঝতে পারলো ও কতটা এখন কুৎসিত দেখতে হয়েছে। নাসিংহোমে আর রবিন আসেনি তাকে দেখতে। নাসিংহোম থেকে ছুটির দিন ড্রাইভার এসে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে গেল  তার একমাসের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। নদী ফিরে আসে বাপের বাড়িতে। নদী যেদিন নাসিংহোম থেকে ফিরে এসে প্রথম সেইদিন আয়নায় নিজের মুখ দেখে জ্ঞান হারিয়েছিল। এতটা কুৎসিত হয়েছে সে ! এখন আয়না আর মুখ দেখেনা শুধু যিশুর ছবির সামনে কাঁদে আর জিজ্ঞাসা করে " GOD; Why did you do to me? কেন তুমি আমার সংগে এমন করলে? আমি তো কোনো পাপ করিনি, তবে কেন আমার সংগে এত অবিচার করলে? এখন নদীর সংগী চোখের জল, অন্ধকার আর যিশুর ছবি।

এইভাবে দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে গেলে। একদিন বাবার হার্টের বেশ গুরুতর সমস্যা দেখা দেওয়াতে বাবাকে নিয়ে পিয়ারলেস হাসপাতালে বাবার বন্ধু বিখ্যাত হার্ট স্পেশালিষ্ট ডাক্তার ডি সিলভার চেম্বারে নিয়ে যেতে বাধ্য হলো। গত এক বছরের মধ্যে এই প্রথম দিনের আলোয় প্রকাশ্যে রাস্তায় বের হলো। ভালো করে ওড়না দিয়ে  মুখটা এমন ঢেকে নিল যাতে কেউ মুখটা দেখতে না পায়। স্লিপ পাঠাতেই ডাক্তারবাবুর চেম্বারের ভিতরে ডেকে নিলেন। নদী চেম্বারের ভিতর ঢুকেই দেখে একজন সৌম্য সুন্দরকান্তি যুবক  উদাসীন চোখ নিয়ে বসে আছে ডাক্তারকাকুর পাশে। একটু অস্বস্তি বোধ করলো মনেমনে। ডাক্তারকাকু মুখ তুলেই ওদের দেখে বললেন, 'আয় নদী আয় বাবাকে নিয়ে'। তারপর নদীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'এর সংগে আগে আলাপ করিয়ে দেই ও হচ্ছে দিগন্ত রায় চৌধুরী বিখ্যাত একজন প্রসাধনীক শল্য চিকিৎসক ও গবেষক । এই যুবা বয়সে  প্রচুর ও চিকিৎসা শাস্ত্রে সাফল্য পেয়েছে'।

দিগন্ত হঠাৎ  আচমকা  নদীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

' এইভাবে আপনি মুখ ডেকে আছেন কেন? কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি যতেষ্ঠ আধুনিক। সমস্যাটা কি '?

আচমকা এইরকম প্রশ্নের জন্য নদী প্রস্তুত ছিল না তাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। নদীকে এই অপ্রীতিকর পরিস্থিতি থেকে ডাক্তার ডি সিলভা বাঁচালেন। উনি বিস্তারিত ভাবে নদীর সমন্ধে সব খুলে বললেন। দিগন্ত কিছুক্ষন চুপ থেকে নদীকে উদ্দেশ্য বলে উঠলো 

' আপনি আগে ওর বাবাকে দেখে নিন,তারপর আমার কিছু বলার আছে '। ডাক্তারকাকু বাবাকে ভালোভাবে দেখে বললেন,

' মানসিক চাপ থেকেই এইসব উপসর্গ দেখা দিয়েছে। আমি ঔষুধ লিখে দিচ্ছি নিয়মিত খাওয়াবে। ভয়ের কিছু নেই'। নদী দিগন্তকে দেখছিল ও যেন গভীর চিন্তায় ডুবে আছে।ডাক্তারকাকুর ডাকে ওর সম্বিৎ ফিরলো। দিগন্ত কোনো ভনিতা না করেই বললো,

'আমি আপনার মুখটা পরীক্ষা করতে চাই, প্রসাধনীক চিকিৎসার উপর আমি গবেষণা করছি। আমি আপনার মুখের উপর কয়েকবার পরিক্ষামূলক অপারেশন করতে চাই। তাতে আপনি হয়তো আরো কুৎসিত হতে পারেন বা আগের রুপ ফিরে পেতে পারেন'। ডাক্তারকাকুর বারবার অনুরোধে মুখের ওড়নাটা খুলতে হলো। দিগন্ত অনেকক্ষন ধরে মুখ পরীক্ষা করলো। তারপর অন্যমনা গলায় বললো;

' আগামীকাল জামাকাপড় নিয়ে আমার বাড়িতে চলে আসুন। ছ মাসের মতো সময় লাগবে কারন অনেকবার পরীক্ষামূলক বেশ কয়েক বার  অপারেশন করতে হবে,' বলেই হাতে ওর ঠিকানা লেখা এক টুকরো কাগজ ধরিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল। নদী বাবাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে অন্ধকারে বসে অনেকক্ষন ভাবলো " দেখতে অতি কুৎসিত হয়ে গেছি আর কতো কুৎসিত হবো। আমার উপর পরীক্ষা করে দিগন্তবাবু যদি সাফল্য পায় তাহলে ভগবান যিশু আমাকে দিয়ে একটা মহৎ কাজ করিয়ে নেবেন আর আগামী দিনে বেঁচে থাকার মানেও খুঁজেও পাবো। নদী মনে মনে  ঠিক করে নিল, ও কাল দিগন্তবাবুর বাড়িতে যাবেই । ও এই সিধান্তের কথা  বাবাকে জানালো। বাবাও তাতে সায় দিলেন। তারপর ছ মাস ধরে বহুবার দিগন্তর ছুরি ওর মুখের উপর খেলা করেছে। ছ মাস পর দিগন্ত একটা আয়না নিয়ে এসে নদীর সামনে ধরে বললে,

'দেখুন তো নিজেকে চিনতে পারছেন কিনা '?

কাঁপা হাতে আয়না নিয়ে, ভয়ে ভয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে চোখটা স্থির হয়ে যায়। একি! এ কাকে দেখছি অপরুপ সুন্দরী ! উদাত্ত কন্ঠে দিগন্ত হেসে বলে উঠলো, দিগন্ত নতুন পদ্ধতি আমি আবিষ্কার করতে সফল হয়েছি, আমি পেরেছি আমি সফল'। নদীর দুটি গাল তখন চোখের জলে গালদুটি ভিজে গেছে।

নদী মনে মনে যিশু স্মরন করে বলে উঠলো "হে ঈশ্বর তুমি আছো। তোমার পাঠানো দূতের সেবায় বাকি জীবন কাটিয়ে দেবো"

নদী জলভরা চোখে বলে উঠলো, 'এ জীবন আপনি দিয়েছেন।আমি আপনার সেবায়, আপনার গবেষণার কাজে সাহায্য করে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চাই। আপনি  দয়াকরে আমাকে এইটুকু সাহায্য করবেন আর আমি কিছু চাই না '। শুনে উদাসীন কন্ঠে দিগন্ত বলল, 'হ্যাঁ। ঠিক আছে থাকতে পারেন। আমি একা মানুষ সবদিক সামলাতে পারিনা তাছাড়া আমার সত্যি একজন সহকারী চাই'। নদী দিগন্তের কাছে থেকে গেল কিন্তু তাতে আরেক সমস্যা তৈরি হলো। নদীর মতো সুন্দরী  মেয়ে দিগন্তের কাছে একা রাতদিন থাকে তা নিয়ে  দিগন্তের নামে নদীকে নিয়ে নানারকম কুৎসা রটতে লাগলো। নদী একদিন সহ্য করতে না পেরে ব্যাথিত গলায় দিগন্তকে বললো, 'ডাক্তারবাবু, আপনি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন। আপনি আমার কাছে ঈশ্বরের দূত।আমার জন্য আপনার বদনাম, এ আমি সহ্য করতে পারছিনা। আমি ঠিক করেছি এখন থেকে চলে যাবো '।শু নে চিন্তিত গলায় দিগন্ত বললো, ' নদী তুমি চলে গেলে কিন্তু বদনাম যা রটেছে তা আমাকে ছেড়ে যাবে না। এই সমস্যার একটাই সমাধান। চলো আমরা বিয়ে  করে নেই । তাহলে কেউ আর বদনাম রটাতে পারবে না'।

নিয়তি কে ন বাধ্যতে। ওরা সোজা ম্যারেজ রেজিঃস্ট্রি অফিসে গিয়ে বিয়েটা সেরে ফেলল। রেজিঃস্ট্রি অফিস বের হবার আগে নদী দিগন্তেকে বললো,' জানো কতদিন কেঁদেছি আর জিজ্ঞেস করেছি ঈশ্বর আমার সংগে এটা করলে কেন? ঈশ্বর তার উত্তর দিলেন আজ'।

শুনে দিগন্ত হেসে বলে উঠলো, 'দেখ নদী, আমি ডাক্তার; আমি ঈশ্বর বিশ্বাস করিনা। আমি বিজ্ঞানে বিশ্বাস করি। তুমি মন প্রান দিয়ে নতুন জীবন চেয়েছিলে তাই পেয়েছো। নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মতো’।

ঈশ্বর বিশ্বাসী নদীর গম্ভীর মুখ দেখে দিগন্ত বলে উঠলো, আরে তোমাকে মনে কষ্ট দেবার জন্য বলিনি, তোমার দিক থেকে তুমি ঠিক আর আমার দিক থেকে আমি ঠিক'। নদীর মুখে মিষ্টি হাসি দেখা দিল। এবার দুজনে হাত ধরাধরি করে বাড়ি দিকে রওনা দিল আর মনে হচ্ছিল ঈশ্বর আর নিউটনের তৃতীয় সূত্র যেন ওদের পিছন পিছন ওদের ঠিকানায় পৌঁছে দিতে যাচ্ছে।

আবার ঘরের ভিতর থেকে ছেলে আকাশের চিৎকার ভেসে এলো " বাবা আবার কিস্তি মাত " এবার নদী হেসে ফেললো আর নিজের মনে বলে উঠলো " ঈশ্বর আর নিউটনের তৃতীয় সূত্র একসাথে দাবা খেলছে"।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top