কাব্যশস্য : আশরাফ মাহতাব


প্রকাশিত:
২৪ জুন ২০২০ ২১:০৯

আপডেট:
১৪ মার্চ ২০২৫ ১৩:৫২

 

একজন কবির অভিধানে প্রথম ও শেষ প্রেম বলে কোন শব্দ খোঁজা কাঁঠাল গাছে আম খোঁজার মতই অর্থহীন। সে বার বার প্রেমে পড়ে,অভিসারে মিলিত হয়, একেকবার প্রেম-সঙ্গমের মানস-বীর্যে ভূমিষ্ঠ হয় একেকটি কাব্য সন্তান। ভবঘুরে এক কবি সেদিন কাব্যের অনুষঙ্গ খুঁজছিল, প্রেম-সারথীর দর্শন পেতে উন্মুখ ছিল তার মন। পদরথে সওয়ার হয়ে গুটি গুটি চলন গতিতে সেদিন সে তেপান্তরের মাঠে গিয়ে উপস্থিত হল। এ তো মাঠ নয়, যেন একটি আকাশ! লাখো তারার মত রূপসী যুবতীর মেলা বসেছে সেখানে। কবির চোখে ধাঁধার বিদ্যুৎ চমকাল, সে এখন কোন রূপসীর রূপ বন্দনা করবে? কার প্রেমের মধু সে মৌমাছির মত ঠোঁটে ভরে কাব্য-মৌচাকে জমাবে?  চরম সিদ্ধান্তহীনতায় চোখ বুজে সে এক রূপসীর বাহু স্পর্শ করল।রূপসী দখিনা হাওয়ার তালে সমবেত নৃত্য করছিল। তাই বেসামাল স্পর্শে রূপসীর ধারালো নখের ঘায়ে কবির হাত কেটে রক্ত ঝরতে লাগল। কিন্তু নৃত্যমগ্না রূপসী দখিনা হাওয়ায় সবুজ শাড়ির আঁচল উড়িয়ে নৃত্য করেই যাচ্ছিল। দখিনা হাওয়া ক্লান্ত হয়ে তার ঢোল থামাল, নাচুনে কাঠি রূপসীও অবশেষে তার নাচ থামাল। সবুজ শাড়ি পরা সুগঠিত কটি বিশিষ্টা রূপসীর নির্মল রূপ কবিকে বিমোহিত করল। কবি রূপসীর সর্বাঙ্গে হাত বুলিয়ে বলল,'তুমি অনেক সুন্দর। আমি তোমাকে ভালবাসি।' রূপসী কোন কথা বলল না। কবি বুঝে নিল, নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ। কবির প্রেম হয়ে গেল রূপসী যুবতী ধান গাছের সঙ্গে। ভূমিষ্ঠ হতে যাচ্ছিল তাদের প্রেমের ফসল কাব্যসন্তান। কিন্তু..হঠাৎ কবির মন বিদ্রাহী হয়ে উঠল। কাব্যসত্তা ছুটি নিল তার মানসজগৎ থেকে।

সে দেখল, একটি শালিক ধানক্ষেতের এদিক ওদিক আহার খু্ঁজে খু্ঁজে এতটাই ক্লান্ত হয়েছিল যে, তার যদি ঘামগ্রন্থি থাকত; তবে তার পালকগুলি ভিজিয়ে ঘামের ধারা বইত। অবশেষে, সবুজ ধানগাছের অরণ্যে আত্মগোপন করা একটি সবুজ ঘাসফড়িং ধরে তার ক্লান্তি শান্তিতে রূপ নিল। সে ফড়িংটিকে ঠোঁটে ধরে ধোপার মত ধোলাই করে মেরে খাওয়ার উপযোগী করে নিল। পেটের গহীনে ক্ষুধা-চিতার অনলে মৃত ফড়িংটির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করার জন্য যখনই সে গলনালির পথে শবযাত্রা করানোর প্রস্তুতি  নিচ্ছিল, ঠিক তখনই একটি দস্যু ফিঙে এসে এক ছুঁ মেরে তার আহার কেড়ে নিল। শালিক বুকফাটা চিৎকার করে, অসহায় চোখে চেয়ে রইল দস্যুফিঙের দস্যুপনার দিকে। শালিকের সেই হাহাকার কবির মনকে সংক্রমিত করে তুলল। সে নিজেকে শালিকের মত অসহায় বাঙালি সাব্যস্ত করল, আর দস্যুফিঙে যেন সাক্ষাত পাকবাহিনী। কবি এবার হাহাকার করে বলতে লাগল, 'আমি কোথায় কাব্যশস্য ফলাব? আমার তো নেই স্বাধীন জমিন। আমি কেমনে শরৎ আকাশে পাখির মত ডানা ঝাপটে মেঘের তুলো কুড়াব? আমারতো পা বাঁধা পরাধীনতার শিকলে।'  তাই কবি মনে মনে একজন মহাকবিকে কামনা করছিলেন। যে কবি তাঁর বজ্রবারুদে ঠাসা মহাকাব্যের প্রতিটি শব্দের মহাবিস্ফারণে পুড়ে খাক করে দিবেন পাকবাহিনীদের দুঃশাসন, যে কবি স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করবেন পথহারা পরাধীন বাঙালিদেরকে। কবির মনোবাসনা অবশেষে পূর্ণ হল। আমরা পেলাম একজন মহাকবিকে। এবার কবি মহাকাব্য সমেত উপস্থিত হলেন রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার সামনে। মহাকাব্যের প্রতিটি শব্দ কণ্ঠ-কামানে বজ্রের মত গুড়ুম গুড়ুম করে বর্ষিত হতে থাকল। বাংলার মানুষ মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল।অবশেষে আমরা হায়েনাদের হাত থেকে ছিনিয়ে আনলাম মুক্তিকামী বাঙালিদের রক্তে জবজবে হয়ে থাকা একটি ভুখণ্ড-বাংলাদেশ। এবার স্বাধীন কবি স্বাধীন আকাশে-বাতাসে শ্বাস বিতরণ  করে, বাংলার ধানগাছ, ফুল, নদী, পাখি, চাঁদ, ভোরের সূর্য, গোধূলি লগ্নের সাথে প্রেম করে মুক্ত ভূমিতে ফলায় স্বাধীন বাংলার কাব্যশস্য।

 

আশরাফ মাহতাব
প্রভাষক(বাংলা)
কর্ণফুলী এ জে চৌধুরী কলেজ
কর্ণফুলী,চট্টগ্রাম।


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top