সিডনী মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৭ই বৈশাখ ১৪৩১


মনাচোর : আশিকুর রহমান বিশ্বাস


প্রকাশিত:
২৭ জুন ২০২০ ২১:০৬

আপডেট:
২৭ জুন ২০২০ ২১:২৬

                                         

মনা'র বয়স বেড়েছে ঢের। বয়সের ভারে তার লিকলিকে শরীরটা ধনুকের মতো বেঁকিয়ে এসেছে। দিনের চকচকে আলোয় সে এখন ঝাপসা দেখে। দিঘলীর মরা কপোতাক্ষ দেখলেও তার বুকের ভেতরটা কেমন যেন ভয়ে ধুক-ধুক করে ওঠে। অথচ একসময় সে এই কপোতাক্ষ একদমে পার হতো সাঁতরিয়ে। নদ পার হলেই হরিপুর গ্রাম। হরিপুর গ্রামের পূর্ব পাড়ায় ঠিক নদের কোল ঘেঁষে মনার বাস। ভাঙা বাঁশের চাটাইয়ের একটা পুরনো ঘরে সে এখন একা থাকে। বউটা গলায় ফাঁস দিয়ে মরেছিল তাও বছর দশের আগের কথা। তার মাস দুয়েক পর খুব শক্ত ভাবেই বিয়ের ঝুল তুলেছিল সে, উঠেপড়ে লেগেছিল সেবার। কিন্তু তার সাথে মেয়ে দিবে কে? অত্রাঞ্চল জুড়ে লোকে তাকে ডাকে মনাচোর নামে। একমাত্র ছেলে সেও তো মায়ের মৃত্যুর পর তাকে ছেড়ে চলে গেছে গ্রামবাসীদের গঞ্জনা সইতে না পেরে। মনার এখন কোনো উপার্জন নেই; এমনকি তার দিকে কেউ সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দেয় না। অথচ কীভাবে যে তার দিন চলে সেই প্রশ্নে উৎসুক জনতা আবার চায়ের দোকান মাতিয়ে রাখে তাও গভীর রাত অবধি। কেউ বলে: তার ঘরের নিচে থরে থরে সোনাদানা, এমনকি নগদ টাকা পয়সা পর্যন্ত পোঁতা আছে, এখন সেগুলো সে মাটি খুঁড়ে তোলে আর খরচ করে। কেউবা বলে: ওগুলো বড্ড বাড়িয়ে বলা তোমাদের। মনার সাথে রয়েছে অদৃশ্যবাদীদের কারবার, তারাই তাকে পালে। অবশ্য সেসব কথা ফেলে দেবার মত নয়। মনা তার দীর্ঘ চোর জীবনে কখনও কোনোদিন পাবলিকের হাতে ধরা পড়েনি। এমনকি তাকে চুরির মাল ঘরে আনতেও দেখি নি কেউ। এই পেশায় তার অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় নি। সে মাটিতে খেঁজুর পাতার মাদুর বিছিয়ে শোয়। চোখে পড়ার মতো তেমন কিছু তার ঘরে নেই। পিতলের থালাটা, টিনের একটা গ্লাস, মাটির দুটো হাড়ি আর ভাঙা কড়াইটা নিয়ে তার সংসার। একটা ঘুণেধরা আলনা ছিলো তাও বছর দুই আগে ভেঙে পড়েছে। অথচ সে এক প্রতিষ্ঠিত চোর। কয়েক দশকের চুরির অভিজ্ঞতা তার। 'মনাচোর' নামটা ছোট বড় সবার মুখে মুখে।

এ নেহায়েত অদৃশ্যবাদীদের কাণ্ডকারখানা। লোকে তাই বলে। বিস্ময়, গুঞ্জন, আর অতিকথা মনা'কে পিছু ছাড়ছে না যেন।

এই অঞ্চলের ভয়ংকর সিঁদেল চোর ছিলো মনা। হ্যাঁ ভয়ংকরই বটে, বাঘা বাঘা সব লোকজনের বাড়ি থেকে সে চুরি করে নিয়ে গেছে নিঃশব্দে। কেউ জানতে পারে নি কোনোদিন। ঘুটঘুটে অমাবস্যায় তার কাজকারবার, জোছনায় পূর্ণ বিশ্রাম। জোছনা রাতে তার চোখ ভেঙে আসে ঘুমে। অমাবস্যায় হাত পা কামড়ায়, চুলকায়, অদ্ভুত এক অস্থিরতায় সারারাত এপাশ ওপাশ করে সে, একদম ঘুম হয় না। তখন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে বাইরে। চোখদুটি জ্বল জ্বল করে ওঠে তার। আবার কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে সে।

মনার নাতনিটা তার কাছে থাকতো। মনা তাকে বড় করেছে, কয়েক ক্লাস স্কুলে পাঠিয়েছে, এমনকি যৌবনের শুরুর দিকে বনিয়াদি ঘর দেখে বিয়ে অবধি দিয়েছে তাকে। ছেলেকে তার ভার বইতে হয় নি কখনও। এই নাতনিটাকে বড্ড ভালোবাসে সে। মেয়েটির কিছু হলে যেন আর বাঁচে না মনা। মেয়েটিও দাদার নেওটা। তার সব আবদার এই বুড়ো দাদাটির কাছে। যা কিছু শখ, যা কিছু আহ্লাদ তাও কিনা একসময় দাদার ঘাড়েই চেপে বসে নিঃশব্দে এসে। একবার সে শ্বশুর বাড়ি থেকে এসে কড়া আবদার করে বসল, 'দাদাজান আপনাকে এবার চুরি ছাড়তে হবে।'

মনার চোখ কপালে উঠলো। লাফিয়ে উঠে সে বলল, 'অ্যাঁ, বলিস কী রে! মনাচোর চুরি ছাড়বে!'

মেয়েটি কাঁদো গলায় বলল, 'যদি না ছাড়েন তয় আমি আর ওখানে যাবো না।'

মনা বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। সে তার হাতদুটো চেপে ধরে কাঁপা গলায় বলল, 'তোকে কি ওরা কিছু বলে?'

ডুকরে কেঁদে উঠলো মেয়েটি। জড়ানো গলায় বলল, 'বলে না আবার? সবাই বলে। বলে, ঐ দেখ চোরের জাত। আরো বলে।'

মনা হাসলো।

'দাদাজান আপনি হাসছেন?'

'সত্যিই তো বলে ওরা।'

মনা আবার হাসে। তার বড় হাসি পায়। চুরিতে তার একটুও অপরাধবোধ জেগে ওঠে না। তার বিশ্বাস সবার সম্পত্তিতে তাদের একটু হলেও হক আছে। সেই হক থেকে সে খানিকটা অংশ দুই-একবছর পর গিয়ে নিয়ে আসে মাত্র। এখানে দোষের কী হলো? তার শক্ত যুক্তি। এককালে তাদের অনেক সম্পত্তি ছিলো, এখন কিছুই নেই। মামলা মোকদ্দমা, দখলদারিত্ব, রেষারেষি আর দলাদলিতে সব ছেড়ে চলে গেছে একে একে। তার দৃঢ় বিশ্বাস এখন সবাই তাদের সেই সম্পত্তিগুলোই ভোগ করে খাচ্ছে। অবশ্য তার এই বিশ্বাস ভিত্তিহীন। সে যখন গাঁয়ে এই জাতীয় কথাবার্তা প্রচার করে লোকে তখন তার উপর চটে যায়। মারমুখো হয়ে বলে, 'গেলি না তুই এখান থেকে মনা? চোর কোথাকার।'

মনা হাসে। হাসিতেই যেন তার আত্মতৃপ্তি। এই হাসি প্রতিবাদের। এই হাসি তার সব বিশ্বাসের শক্ত ভিত্তি। রাতে ঘুম না এলে গাঁয়ের বউরা যখন স্বামীদের মৃদু তিরস্কার ভাঙ্গিতে বলে, ' আজ এখনও ঘুমাও নি কেনো?'

'ঘুম যে আসে না বউ।'

'মনা এসে ভর করেনি তো? যাবা নাকি একটা দান মারতে?'

মনা তখনও হাসে। হাসতে হাসতে ক্ষ্যাপা কুকুরের মত হাঁপিয়ে ওঠে সে। হাঁপানিটাই এখন নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকাল সে সামান্য হাঁটলে হাঁপিয়ে ওঠে, উচ্চস্বরে কথা বললে হাঁপিয়ে ওঠে, এমনকি হাসলেও।

মনা তার অবস্থান থেকে সরে এলো। নাতনির কথা না রেখে পারলো না সে। একদিন সকালে সে তার নাতনিকে কথা দিলো, আজ থেকে আর চুরি করবে না। নাতনি খুশিতে কেঁদে ফোললো সেদিন। মনা তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

'তোকে যে আমি কত ভালোবাসি জানিস?'

'জানি।'

মনা ম্লান হেসে বলল, 'জানিস না। তুই সেটা জানিস না।'

মেয়েটি বিস্ময়ে তাকালো দাদার দিকে। মনা বলল, 'আমিও জানি না। পাল্লায় কি তা মাপা যায়? যায় না।' মনা মৃদু মাথা নাড়লো বারকয়েক।

মেয়েটি এবার ফিক করে হেসে দিলো। মনার মুখেও হাসির রেখা দেখা দিলো।

কিন্তু মনাকে শেষ বয়সে এসে সংগ্রাম করতে হলো। এক শানকি ভাতের জন্য সংগ্রাম, একদিন বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম। এক জীবনে সে চুরি ছাড়া আর কিছুই শেখেনি। কিন্তু নাতনিকে সে কথা দিয়েছে চুরি করবে না। কখনো না, কোনোদিনই না। সংগ্রাম সে করবে, দিনরাত সংগ্রাম করবে। মনার ঘুৃম হয় না রাতে। সারারাত সে নিজের সাথে কথা বলে। সে-ই বক্তা, সে-ই আবার শ্রোতা। নিজেকে সে জিজ্ঞেস করে, 'মনারে চুরিটা তুই ছেড়েই দিলি?'

'নাতনি যে শোনে না। লোকে মন্দ বলে।'

'তোর সারাজীবনের সাধনা। ছাড়লি। পেট পোড়ে না?'

'পোড়ে। সারারাত পেট পোড়ে আমার।'

বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে মনা। এরপর অনেকক্ষণ বাইরে হাঁটাহাঁটি করে সে। ঘরের কাঁথা কম্বল, পিতলের থালা, মাটির কলসটা একবার বাইরে - একবার ঘরে, আবার বাইরে, আবার ঘরে- এভাবেই করে সে। কিন্তু তৃপ্তি তার কিছুতেই আসে না। এভাবে তার অতৃপ্ত আত্মা ধীরে ধীরে ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো হয়ে উঠে। তামাম দুনিয়াটা সে চুরি করতে চায় একদিন।

এক অমাবস্যায় তার বড্ড চুরির সাধ জাগে। চোখে সেইরাতে সে স্পষ্টই দেখতে পায়। গায়ে শক্তি ফিরে আসে। মনার মন বলে সে যৌবনকালের মত আজও সাঁতরে পার হতে পারবে কপোতাক্ষ। চিন্তা করে জীবনের শেষ চুরিটা আজ সে করবে। নাতনিটা তার কাছেই আছে। সন্তানসম্ভবা সে। অসুস্থ শরীরে সে বেরিয়ে এসে দাদাকে বাঁধা দেয়। পূর্বের প্রতিজ্ঞা মনে করিয়ে দিয়ে বলে, 'দাদাজান আপনি কথা দিয়েছিলেন।'

'আজ তুই বাঁধা দিস না। আমি কারো কথা শুননো না আজ।'

'আমার কথাও না?'

'না।'

মনার শক্ত গলায় নাতনি হতভম্বের মতো হয়ে যায়। সে সত্যিই জানেনা তার দাদাজান তাকে কতটা ভালোবাসে। পাল্লা থাকলে আজ সে মাপতে পারতো। মেপে দেখতে পারতো। সেদিনের কথা মনে হয় তার, মনা বলেছিল, 'জানিস না, তুই সেটা জানিস না'।

মনা বেরিয়ে পড়ে। হরিপুর ছাড়িয়ে কপোতাক্ষ সে পার হয়। সাঁতরিয়েই পার হয় সে, কিন্তু একদমে পারে না, হাঁপিয়ে ওঠে। অমাবস্যার অন্ধকারে জোনাকিপোকার দলও যেন ভয়ে পালিয়েছে আজ রাত্রে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না চারিদিক। শুনশান নীরবতা। মনা দেখতে পাচ্ছে, স্পষ্টই দেখছে সবকিছু। আজ সে বেঁকিয়ে হাঁটছে না, যৌবনে যেমন হাঁটতো আজও তেমন হাঁটছে। হেঁটেই চলেছে সে। দিঘলী ছাড়িয়ে কাংশারীপুর গ্রামে ঢুকলো মনা। মাঝ রাত তখন। হঠাৎ তার গা টা ভয়ে ছমছম করে উঠলো। পেছন ফিরে তাকালো সে। একবার। কিছুপর আরো একবার। নীরবতা, অন্ধকার, গুমোট বাতাস চারিদিক। কিছুই দেখলো না।

মনার ভয় বাড়ছে। বুকের ভেতরটা ধুক-ধুক করে উঠছে তার। কেনো উঠছে কে জানে! মনা আবার হাঁটে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। একটা পায়ের আওয়াজ শুনতে পারে সে। তারপর ধীরে ধীরে চোখের সামনে একজন মানুষ স্পষ্ট হয়।

কিন্তু তার মতই দেখতে। একই চেহারা, একই পোশাক। মনা অবাক হয়। ভয়ার্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,

'কে তুমি?'

লোকটি গম্ভীর গলায় জবাব দেয়, 'আমি মনা। তুমি?'

'আমিও মনা।'

লোকটি হাসে। হাসতে হাসতে সে বলে, 'মানুষের কি কোনো নাম হয়? হয় না। নাম হয় আত্মার। আত্মা চলে গেলে মানুষ হয় লাশ।'

মনা নির্বিকার ভঙ্গিতে শুধু শুনে যায়। এমন কথা তাকে আগে কেউ শোনায় নি কখনও। কী গাম্ভীরতা বচনে! বাণীতে কী এক আদি সত্য! সে একসময় মুখ ফুটে বলে ফেলে, 'কোথায় যাবে?'

লোকটি বলে, 'তুমি কোথায় যাবে?'

'কোথাও না।'

'আমিও কোথাও না।' তারপর লোকটি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, 'আমরা কেউ কোথাও যাবো না জানো।'

মনা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। লোকটি উচ্চস্বরে হেসে আবার বলে, 'অথচ আমরা সবাই মনা। চোর মনা। সবাই আমরা একেক জন মস্ত বড় চোর। তুমি হলে বাইরের, আর আমি ভিতরের টা।'

মনা কিছুই বুঝতে পারলো না, শুধুই হতভম্বের মতো লোকটির দিকে তাকিয়ে রইলো। লোকটি আরো আওয়াজ করে হাসছে। সেই হাসি মনা ছাড়া আর কেউ শুনতে পাচ্ছে না।

 

আশিকুর রহমান বিশ্বাস
কথাসাহিত্যিক; শিক্ষার্থী, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top