সিডনী মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৭ই বৈশাখ ১৪৩১


হন্তারক : অরুণ কুমার বিশ্বাস


প্রকাশিত:
২৭ জুন ২০২০ ২২:৩৬

আপডেট:
২৮ জুন ২০২০ ০০:৩৬

 

পাটখড়ির পাতলা বুননে গাঁয়ের প্রান্তসীমায় মাথা উঁচু করে আছে একটুকরো ঘর। বাঁশের খুঁটির ঘেরাটোপে হোগলাপাতার বেড়া ভেদ করে ঢুকে পড়ে এক চিলতে বেলেজোছনা। রাত গভীর হলে খোলা আকাশে মেঘের আনাগোনা বাড়ে। ফলে জোছনার অস্বচ্ছ আলো ক্রমশ তিরোহিত হয়, আর রাতের প্রগাঢ়তা বাড়ার সাথে সাথে উত্তেজনা তৈরি হয় শুকুরের বুকে। বহুব্যবহারে নারকোলের ছোবড়া বেরিয়ে আসা নোংরা ময়লা তেল-চিটচিটে তোষকে পিঠ রাখা দায় হয়ে পড়ে। শুকুরের চোখে ঘুম থাকে না। কেবলই মনে হয়, এবেলা তার বেরোনো দরকার। নইলে হালিমার কাছ থেকে রহস্যের খবরটা আর জানা হবে না। মামুলি ঘটনা তো নয়, একজনের জীবনের প্রশ্ন সেখানে জড়িত।
এই মধ্যরাতে শুকুর আলীকে ঘরের বাইরে যেতেই হবে। কেউ তাকে ডাকছে। যদিও এ ডাক কোন ব্যক্তিবিশেষের, নাকি ¯্রফে অনুমান বা নিশির আহŸান- এই প্রশ্নের সমাধান এক শুকুর ছাড়া আর কারো জানা নেই। সেই থেকে এমন হচ্ছে। মানে যেদিন হালিমা মারা গেল, তার দাফন-কাফন হল। মেলা লোক এসে ছোটমিঞার বাড়িতে পেটপুরে খেয়ে গেল।
শুকুর আলী পেশায় ঘরামি। পড়াশুনা খুব একটা এগোই নি, তাই বাপের দেখাদেখি মা-মরা শুকুর পাড়া-পড়শির ঘরের চাল ছাওয়ার কাজটা মোটামুটি রপ্ত করেতে পেরেছে। খেয়ালি প্রকৃতি শুকুরের জন্য আশির্বাদ বলা চলে। ফি-বছর গ্রীষ্মের শুরুতেই ঝড়জল এসে গাঁয়ের মানুষের সংসার তছনছ করে দিয়ে যায়। তাতে ভারি আমোদ হয় শুকুরের। কথায় বলে, কারো পৌষমাস আবার কারো সর্বনাশ। বছরে তার এইটুকুনই কামের সময়। পাশেই সুন্দরবনের সোনাখালি থেকে গোলপাতা নিয়ে আসে শুকুর। যার যেমন সামর্থ্য, সেই অনুযায়ী ভেঙেপড়া ঘর ও নতুন গোল দিয়ে চাল মেরামতের ঠিকে নেয় শুকুর আলী।
পেটে বিদ্যে না থাকলে কী হবে, কাজেকামে বেশ ওস্তাদ শুকুর। বাপজান বলে দিয়েছে, বাকি-বক্কায় কাম করবা না। তাইলে ধনেপ্রাণে মরা পড়বা। তবে একই গ্রামে থেকে সে খুব একটা কঠোর হতে পারে না। টাকা নাই তো কী হয়েছে! সে থাকতে পাড়াপড়শির মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে না এ কেমন কথা! টাকার বদলে চাল-চিঁড়ে দিলেও কাজ করে শুকুর। শুধু গোলের খরচাটা নগদে মেটাতে হবে। ওখানে কোন নকশা চলবে না।
তো যা বলছিলাম- শুকুর বড় আতান্তরে পড়েছে। তার কাজেকামে মন নাই। বৃদ্ধ বাপটা ঘরে শুইয়ে সারাক্ষণ খঙর খঙর কাশে। টিবি নাকি ক্ষয়কাশ কে জানে! বাপকে ডাক্তার দেখানো দরকার। কিন্তু মনে সুখ নাই, সে কেবল নিশির ডাকের অপেক্ষায় থাকে। হালিমা তাকে কিছু বলতে চায়। কিন্তু কী সেই গুহ্যকথা- যা সে আর কাউকে বলতে পারে না!
পায়ে পায়ে গোলের ছাউনি থেকে বেরিয়ে আসে শুকুর আলী। তার গন্তব্য খুব একটা দূরে নয়। ওই তো সামনে ছোট্ট নালাখাল পেরিয়ে বাঁশঝাড়। পাশেই মিঞাবাড়ির কবরখানা, হালিমাকে যেখানে দাফন করা হয়েছে। শুকুর গায়ে একখানা চিমসে-ঘ্রাণঅলা তামাকরঙ আলেয়ান জড়িয়েছে। কেমন যেন শীত শীত লাগছে, তাছাড়া কারো চোখে সে পড়তে চায় না।
রাতের চেহারা এখন বড়ই রহস্যময়। অন্তত শুকুরের তাই মনে হয়। জোছনার ছিঁটেফোঁটাও নেই। সেখানে জেঁকে বসেছে নিগূঢ় অন্ধকার। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুকুর এগিয়ে যায়। খালের কিনারে এসে লুঙ্গিটা খানিক গুটিয়ে নেয়। বেশ খানিকটা উপরে তুলতে হয়, নইলে খাল পেরোনো যাবে না। দিনের বেলা হয়ে গাঁয়ের দুষ্টু ছেলেরা তার টাকিবৎ ইয়েটা দেখে নির্ঘাত হাততালি দিত। একলাফে খালের ওপারে গিয়ে একটু থামে শুকুর। গায়ে ঘাম ছোটে। গরমে নাকি উত্তেজনায় বলা কঠিন।
ওই নিশির ডাক শোনা যায়। কেউ যেন বলছে- আয়, শুকুর কাছে আয়। হালিমা তোরে কিছু কইবার চায়। বাঁশঝাড়ের কাছে আসামাত্র তার বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। আহা, বেচারি হালিমা। কোন দুঃখে সে আত্মঘাতী হল! একবারও কি মনে হয় নি, ও না থাকলে খুব কষ্ট পাবে শুকুর। এতটা বেবুঝ ও হতে পারলো! এই দুনিয়ায় আসলে কেউ কারো নয়। মানুষ স্বভাবতই আত্মসুখে মশগুল, অতিশয় স্বার্থপর। শুকুরের বুক থেকে চোরা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
এই তো মাত্র সেদিন মিঞাবাড়ির গোয়ালঘর মেরামত করে এলো শুকুর আলী। ছোট মিঞার বউ হালিমা খাতুন- যে কিনা এখন লাশ, কবরে শুয়ে আছে- রসালো গলায় বলল, ও ঘরামির পো, এবার একখান বিয়া করো। টেকাপয়সা তো কম কামাইলা না। খাইবো কেডায়? মেইয়ে দেখুম- যদি ইজাজত দেও তো খোঁজ লাগাই।
আহা হা, বড়ই ঢলঢলে মায়াবী চেহারা। লেখাপড়া জানা উঁচুবংশের মেয়ে হালিমা। শুধু পড়তি ঘর তাই মিঞাবাড়ির পোলা ছোট মিঞার কপালে এসে জুটলো। শুকুর ও হালিমা খাতুন বয়সের বিচারে সন্নিহিত, হাসি-মশকরায় পারঙ্গম। কোন কারণে মন খারাপ হলেই সে ছুটে যেত ছোটমিঞার বাড়ি। হালিমাকে একপলক দেখবে বলে। না, এর মাঝে আমিষের কিছু নেই। প্রচলিত অর্থে ভালবাসাও নয়। কারণ বামুন হয়ে চাঁদে হাত রাখা যে রীতিমতো অন্যায় ও অসম্ভব, এটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি শুকুরের ছিল। তবে একথা সত্যি- হালিমাকে সে ভাল পেত। দূরাগত আলোর ন্যায় শুকুরের যত মনখারাপ এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে পারত ছোট মিঞার বউ হালিমা খাতুন।
এই মুহূর্তে হালিমার কবরের সামনে দন্ডায়মান ঘরামি শুকুর আলী। হয়তো ভাবছে, এমন কি হতে পারে না- শুকুরকে চমকে দিয়ে কবর থেকে এক্ষুণি উঠে আসবে হালিমা খাতুন! মাইরি বলছি, তাতে একটুও ভড়কাবে না শুকুর। বরং মদ্যপ ছোটমিঞার একবার বিয়েকরা বউ হালিমাকে নিয়ে সে দূরে কোথায় চলে যাবে। যেখানে ওদের দুজনকে কেউ আর চিনবে না।
অনর্থক এসব কী ভাবছে শুকুর আলী ! এমন কখনও হয় নাকি! কবর থেকে কে কবে উঠে এসেছে! শুকুরের কপালে বিনবিনে ঘাম, বুকের ভেতর উথাল-পাথাল ঝড়। এই ঝড়ে ভেঙেপড়া শুকুরের মনের চাতালে কে দেবে গোলের ছাউনি! ঘরামির ঘর বানানোর যে কেউ নেই এই দুনিয়ায়! যে দিতে পারতো সে এখন লাশ। কবরে শুয়ে আছে।
এমন সময় একটা উদ্ভট কথা মনে এলো শুকুরের। সত্যি সত্যি গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে হালিমা, নাকি -?
নাকি ? আর কী হতে পারে ঘরামি শুকুর! ছোটলোক বামুনের মতো থাকবে। এত বেশি বোঝার কী দরকার ? জানো তো, এই গাঁয়ে মিঞাবাড়ির উপরে কথা চলে না। বলেছ তো, সোজা চালান হয়ে যাবে। ভুলে যেও না, থানার বড়সায়েবও সপ্তাহান্তে মিঞাবাড়ির ভেতরবাড়িতে পাত পাতেন।
শুকুরের শীতবোধ আরো বাড়ে। কুলকুল করে ঘামতে থাকে। সে বোঝে, ভয়ের কথা ওখানেই। মিঞাবাড়ি আর বড়বাবুর মেহমানদারি যখন এক হয়ে যায়, তখন আর ভরসা কী! কিন্তু ছোটমিঞার হুঁকোবরদার ফটিক যে বলল, পুলিশ এসে ঘরের আড়া থেকে হালিমার লাশ নামিয়েছে! তারপর সরকারি ডাক্তারের চেম্বারে পোশমটেম না ময়নাবিবির তদন্ত-ফদন্ত কী কী সব হয়েছে। তাতেও নাকি রিপোর্ট দিয়েছে, হালিমা গলায় ফাঁস দিয়েই মরেছে।
কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারে না শুকুর আলী। খটকা থেকেই যায়। মারা যাবার দুদিন আগে অবশ্য একখান কথা বলেছিল হালিমা। ভাল-মন্দ দুদিকেই ধরা যায়। সেই রাতে শুকুর আলী কিছুতেই ঘুমাতে পারে নি। কেবলই মনে হয়েছে, আল্লাহ চান তো হালিমা তার হলেও হতে পারে। মিঞাবাড়িকে সে মোটেও ভয় পায় না। পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া!
হালিমা বলল ছোটমিঞার ঘরে সে ভাল নেই। সুখে নেই। সে মদ্যপ, সহবত জানে না। নিত্যরাতে বাড়ি ফিরে তার সাথে যা নয় তাই করে। আদর না ছাই! ধর তক্তা মার পেরেক মতোন তার উপর হামলে পড়ে ছোটমিঞা। গোঁয়ার অশিক্ষিত লোকটা তার উপর রাতভর অত্যাচার চালায়। পরদিন উঠে দাঁড়াতে কষ্ট হয়।
এটা দুঃখের কথা। শুনে অব্দি শুকুরের বুকে ভায়োলিনের করুণ রাগিনী বাজতে থাকে। কষ্ট হয়। তবে শুকুরের ভাল লাগে হালিমা যখন বলে, ঘরামি তুমি ঝড়জল উপেক্ষা করে এত মানুষের ঘর বেঁধে দিলে, পারো না আমার জন্য কিছু করতে ? একটু কিছু ?
শুকুর সাহসী হয়। জানতে চায়, কী করতাম কন আপনার জন্যি। চান তো জান লড়িয়ে দিতাম।
হয়েছে হয়েছে। আমি এত কিছু চাই না। তুমি কত বড় বীর ঢের জানি। হালিমা সুরে পানি ঢালে। তারপর লঘু অথচ অর্থপূর্ণ দৃষ্টি মেলে বলল, তুমি পারবে আমাকে এখান থেকে দূরে কোথাও নিয়ে যেতে! অনেক দূরে- যেখানে ছোটমিঞার বর্বরতা আমাকে আর সইতে হবে না। শেষ দিকে হালিমার গলার স্বর বুজে আসে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, ¯্রফে হেঁয়ালি নয়। মন থেকেই সে কথাটা বলেছে।
ঘরামির হাতের কাজ থামে। বুকের ভেতর দ্রিমি দ্রিমি বাজে। চোখ জ¦ালা করে এবং যুগপৎ অন্তরের গহিনে জেমস ওয়াটের অন্তর্ঘাত ইঞ্জিন চালু হয়।
শুকুর সদর্পে বলে- কী চাও সত্যি করে বলো হালিমা। আমি তোমার জন্য সব করতে রাজি। জীবন দিতেও।
জীবন দিবা ঘরামি! এত্ত সাহস তোমার দিলে ! হালিমা সুরে মাখন মেশায়। যদি পারো, তাইলে শুনে রাখো ঘরামি, আমি সবচে বেশি খুশি হব।
শুকুর মনের উচ্ছ¡াস ফুটিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল। হালিমা তাকে থামায়। বাঁচোখ সরু করে চাপা স্বরে বলে, এখন যাও। ছোটমিঞার চামচা ফটিক আইসা পরবো। ও একটা বদমাইশ। খাটাস প্রকৃতির প্রাণী। জানলে আর রক্ষা নাই। পরে কথা হইবো নে।
শুকুর আপসে মেনে নেয়। ফটিকের চরিত্র তারও অজানা নয়। ঠিক ভয় না পেলেও কৌশলী হয় শুকুর আলী। বুকের ভিতর স্বপ্নরা ভিড় করে। মা-মরা শুকুর বাপের অতিরিক্ত আদর সোহাগে পড়ালেখা করে নি ঠিক, তাই বলে বিগড়োই নি। সোনাখালির মানুষ তাকে মন্দ বাসে না। মানুষ হতে গেলে যেটুকু মানবিক বোধ থাকা সমীচীন সে-টুকু শুকুরের আছে বলেই হালিমার মতো উচ্চঘরের পড়াশুনা জানা মেয়ে তার উপর নির্ভর করে নির্ভার হতে চায়। এ কি কম কথা!
এই মুহূর্তে শুকুরের নিজেকে আলেকজান্ডার বা হাতেম তাই গোছের কেউ একজন মনে হয়! চোখে সারাক্ষণ হালিমার চেহারা ভাসে। পঁয়ত্রিশ এমএম ফিল্মের মতো মনের সেলুলয়েডে কেবল হালিমা আর হালিমা। ভালবাসা এমনই। মানুষকে ঠিক হেমায়েতপুরি পাগল না বানালেও পাগলামিটা বেশ জোরেসোরে জেঁকে বশে মনে ও মগজে।
এর ঠিক দুদিন পরের ঘটনা। কিংবা বলা যায় অঘটন। অর্থাৎ সুখের সাগরে উথালপাথাল ঢেউ উজিয়ে খুব বেশি দূর সার্ফিং করা হয় নি শুকুর আলীর। আসলে সুখ জিনিসটা এমনই। অনেক কায়দা কসরত করে সুখ লুটতে চাইলেও অনেকের কপালে জোটে না। যারও বা ভাগ্য খানিক সুপ্রসন্ন হয়, সাময়িক মাত্র। সুখ নয়, নেহাতই সুখের ইমিটেশন। যেমন হয়েছে শুকুরের কপালে। শুরু হতে না হতেই বিদায়ের ঘণ্টাধ্বনি বাজলো। মারা গেল হালিমা খাতুন। পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী আনফরচুনেট ডেথ। অপঘাতের মামলা হবে। কারণ হালিমা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহনন করেছে।
লাশের ময়নাতদন্তও হয়েছে। মিঞাবাড়ির ইচ্ছেমতোই রিপোর্ট তৈরি হয়েছে। কারণ ছোটমিঞার বউ স্বেচ্ছায় মরেছে- এটা খবর হলেও হতে পারে। মিডিয়া বলে একটা ব্যাপার আছে। সময়ে সামাল দিতে না পারলেও বারুদ হয়ে উঠতে কতক্ষণ! বড়মিঞা নিজে এই কেসের আইও, সিভিল সার্জেনের প্রতিনিধি, প্রেসক্লাব ও অন্যান্য কেষ্টবিষ্টুদের সাথে নিয়ে বৈঠক করেছেন। মিঞাবাড়ির সম্মান বলে কথা! মামুলি চোর-ছেঁচর তো নয়। যে মারা গেছে সে মিঞাবাড়ির বউ। কথাটা ভুললে চলবে না।
পুরো ঘটনা শুনলেন। হালিমা সুইসাইড করেছে। কেন সে হঠাৎ মরতে গেল এই প্রশ্নের পোস্টমর্টেম করা যেতেই পারে। কিন্তু বাস্তবতা হল সেসব কিছুই হয় নি। যে মরেছে সে যেহেতু আর ফিরবে না, তাই এই কেসের অহেতুক কাটাছেঁড়া অবান্তর বৈকি।
কিন্তু আসল ঘটনা জানে ঘরামি শুকুর আলী। অন্তত এই দাবি সে করে। নিশির আহŸানে সাড়া দিয়ে সে প্রতিরাতে ঘরছাড়া হয়। হালিমা তাকে ডাকে- বা সে হালিমার মুখ থেকে ঘটনা আদতে কী ঘটেছিল সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে চায়। এখানে অকারণ রহস্য সৃষ্টির প্রয়োজন পড়ে না। কারণ শুকুর পরে জেনেছিল, সেদিন সে চালের উপরে বসে আর হালিমা উঠোনে দাঁড়িয়ে যে মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল, তার কিঞ্চিত অংশীদার ছোটমিঞার সাগরেদ ফটিকও হয়েছে। করিতকর্মা ফটিক এ খবর ছোটমিঞার কর্ণগোচর করতে মোটেও সময় নেয় নি। আর গোঁয়াড়গোবিন্দ ছোটমিঞা কারো সাথে কোন রকম সলাপরামর্শ না করেই দ্বিচারিণী হালিমাকে দূরে কোথাও পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এত দূরে যে, অনেকটা সেই বিড়ালপারের মতো আর যাতে কখনও পথ চিনে ফিরতে না পারে।
কাহিনীর মূলঅংশ এখানে শেষ, তবে গল্প শেষ নয়। ঘরামি শুকুর আলীর কিছু পাওনা এখনও বাকি। হালিমার মৃত্যুজনিত বুদ্বুদ খানিকটা থিতোলেও ছোটমিঞা নিশ্চিন্ত হতে পারে নি। কারণ অন্যায়ের ছুরিতে বাঁট থাকে না। অপরকে খোঁচাতে গেলে নিজেকেও কখনও সখনও বিদ্ধ হতে হয়। ছোটমিঞা বলল, এই ফটকে, শুক্কুরালির উপর নজর রাখ। ও শালা বহুত হারামি। কিছু টের পাইছে মনে অয়।
ফটিক বলল, হুঁ। মানে সে কড়া নজর রাখবে। দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা। টের পাইলে তারেও কিছু টের পাওয়াইতে অইবো। মিঞার বেটার সাথে পেজোমি!
ফটিক তার কথা রেখেছে। সারাক্ষণ ছায়ার মতো লেগেছিল শুকুর আলীর পিছে। এমন কি মাঝরাতেও শুকুরের সাথে তার দূরত্ব রচিত হয় নি। অদৃশ্য সুতোর মতো ধারেকাছেই ছিল।
শুকুরের মন বলছে হালিমা নিজে থেকে মরে নি, তারে সরিয়ে দিয়েছে কেউ। তার মানে ওদের গোপন কথায় আড়ি পেতেছে। সে আর কেউ নয়, ছোটমিঞার লোক-সম্ভবত ফটিক। হালিমার কবরের পাশে হাঁটুগেড়ে বসে শুকুর। শেষ কথাগুলো বারবার ঘাই মারে হৃদয়ের নিভৃতকোণে। ওরা পালাতে চেয়েছিল-দূরে কোথাও। শুকুরের দুচোখে জলের ধারা বয়। একটু নাটকীয়, তবে অনাবশ্যক নয় নিশ্চয়ই। ঘরামি বলে কি তার বুকে প্রেম থাকতে নেই! কিংবা উচ্চবংশীয় হালিমা মনের মতো কাউকে খুঁজে পেলে তাকে লতিয়ে উঠতে চাইতেই পারে। তাতে সমাজ সংসারে এমন কোন রীতিভঙ্গ হয় না।
রাত ফুরিয়েছে। কিংবা ভোরের হাওয়া বয় হালিমার কবরে। শুকুর আলী সব রকম দ্ব›দ্ব-সন্দেহ-দ্বিধা ভুলে স্বগতোক্তি করে- আমি জানি হালিমা, তুমি মরো নি। আমাকে ফেলে পালাতে পারো না। তোমাকে ওরা মেরে ফেলেছে। ফটিক আর ছোটমিঞা।
ব্যস, এক্ষেত্রে স্বগতোক্তির শব্দবিন্যাস কিঞ্চিত জোরালো হয়ে থাকবে। যাত্রাপালার নেপথ্য উক্তির মতো কেবল বক্তা নয়, শ্রোতার কানেও পৌঁছে যায় শুকুর আলীর বক্তব্য। কিন্তু এত রাতে বাঁশঝাড়ে আর কে আছে! কেউ নেই। এক সদ্যসমাহিত হালিমার প্রেতাত্মা ছাড়া! নেহাতই ভুল। ছিল আরো একজন- হন্তারক- ছোটমিঞার অতি নিকটজন ফটিক।
হালিমার মৃত্যসংক্রান্ত শুকুর আলীর প্রত্যয়পাঠ শেষে বাঁশঝাড়ে শোনা যায় আরো একটি স্বগতোক্তি। ফটিকের- শালায় তাইলে সব জানে! মিঞাসাবরে কইতে অইবো। তারপর একটু থেমে আবার বলে ফটিক, কী আর করা! আরো একখান লাশ পড়বো। কুনও পবলেম নাই। খুন এট্টায় যা শাস্তি, দুইডাও তাই। খিক্ খিক্ খিক!

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top