সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১


জোয়াল : হুমায়ূন কবীর


প্রকাশিত:
২৮ জুন ২০২০ ২১:০০

আপডেট:
২৮ জুন ২০২০ ২১:২৯

 

"গেলে না? সমস্ত গ্রামের মানুষ তোমার জন্য রাত জেগে কষ্ট করে বসে আছে, করিম ভাই বারবার ডাকতে আসছে আর তুমি মাথায় যন্ত্রনা দেখাচ্ছো!"

মা ধমক দিতেই আব্বার প্রচণ্ড মাথায় যন্ত্রনা সেরে গেলো।সাথে সাথে শোয়া থেকে উঠে আব্বা বিছানায় সোজা হয়ে বসে করিম চাচার দিকে তাকিয়ে শব্দ না করে হাসতে লাগলো।

আব্বা এতক্ষণ এই ধমক অনুমতির অপেক্ষায় ছিলো।এখন বিছানা ছেড়ে উঠে জামা খুঁজতে লাগলো,"আমার জামা কই ওরে আমার জামা?ও জামা,জামা। "

আব্বার জামা কোথায় আছে মা জানে।আব্বাও জানে।

রহিম চাচা অধৈর্য হয়ে বললো,"ও ভাই,জামা কী করবা?তোমার গায়ে তো গেঞ্জি আছে।আর এখন রাতের বেলা তোমার জামা দেখতে আসছে কে?তুমি রোস্তম আলী বিশ্বাস এই এলাকার মাতব্বর তুমি। মানুষ তোমার চেনে না?সমস্ত গ্রামের মানুষ তোমার অপেক্ষায় বসে আছে। তুমি না গেলে শালিস শুরু হয়?ও ভাবি, তুমি রাগ করো কেন?আল্লা কি সবার কাঁধে সব ভার দেয়?"

আব্বা করিম চাচার প্রশংসায় ভিজলো না।আব্বা জানে বিচারের রায় যদি করিমের বিপক্ষে যায় তো কাল থেকেই সে দুর্ব্যবহার শুরু করবে।এখন হারিকেনের আলোই এগিয়ে নিয়ে যাবে শালিস শেষে অন্ধকার পথে একা ছেড়ে দেবে।আব্বা সবসময় সবার কথা ভালোভাবে শুনে সঠিক রায় দেয়। সে রায়  শক্তিশালীর পক্ষে কি দূর্বলের পক্ষে যার পক্ষেই যাক। কে রাগ করলো আর কে খুশি হলো তাতে তার কিছু যায় আসে না।রায় পছন্দ না হলে অনেকে অনেক সময় অস্ত্রধারীদের দিয়ে হুমকি ধামকি দেয়।সেই কারণে মা আব্বাকে শালিসে যেতে দিতে চায় না।

আব্বা আসলে এখন হারিকেনটা নিতে চাচ্ছে। হারিকেনটা খাটের নিচে মাটির মেঝেতে জোর কমিয়ে রাখা আছে।সেটা টিপ টিপ করে জ্বলছে। বাড়িতে একটাই হারিকেন। ওটা নিয়ে গেলে সব অন্ধকার হয়ে যাবে। আব্বা তাই সাহস করে কিছু বলতে পারছেনা। শুধু জামাকে ডাকছে,"ও জামা, জামা।"

জামা তো আর মানুষ না যে ডাক শুনবে।ডাকাডাকিতে মা বিরক্ত হয়ে খেকিয়ে উঠলো।খাটের নিচ থেকে হারিকেনটা বের করে আলোটা উসকে দিয়ে আব্বার হাতে দিলো।জামাটা হাতে ধরিয়ে দিলো।আব্বা  জামাটা ঘাড়ে নিয়ে হারিকেনটা হাতে করে শালিসে বিচার করতে বেরিয়ে গেলো।

বাড়ি এখন অন্ধকার।একটু পরে মা বিছানা ছেড়ে উঠে কেরোসিনের ল্যাম্প জ্বেলে একটা পান মুখে দিয়ে চিবাতে লাগলো। মার ঘুম আসছে না।  আমরা ভাই -বোনরা সব ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালবেলা ভোরে আব্বা মাঠে লাঙল চষতে চলেগেছে।  একটু বেলা হলে আমি আর আমার ভাগ্নে আশরাফ খেয়েদেয়ে আব্বার জন্যে মাঠে ভাত নিয়ে যাচ্ছি।গামলায় পান্তাভাত,কাঁচামরিচ,

পেয়াজ কিছু তরকারি ।গামলা আমার হাতে পানির জগ ভাগ্নে আশরাফের হাতে।মসজিদের কাছে তেমাথায় দেখি কিছু লোক এই চৈত্রমাসে চাদর গায়ে দাঁড়িয়ে আছে।তারমানে ওদের চাদরের নিচে অস্ত্র আছে।তারা আব্বাকে খুন করার হুমকি দিচ্ছে।আমরা কাছাকাছি হলে একজন বললো,"এটা রোস্তম আলী বিশ্বাসের ছেলে আর ঐটা নাতিছেলে। এরা প্রাইমারীতে পড়ে।"

একজন বললো," মাটির বাড়ি খড়ের চাল সে আবার সারা এলাকার মাতব্বর দেশের লোকের বিচার করে বেড়ায়। শালা নিজেও টাকা খাবে না কাউকে খেতেও দেবে না।"

এদের কাছে ইদরিস চাচা দাঁড়ানো।তারমানে কালকের রায় এর বিপক্ষে গেছে তাই লোক ভাড়া করে এনেছে আব্বাকে হুমকি দেয়ার জন্য।

আব্বা এইসব  লোকের সাথে ফালতু তর্ক করেনা। এইসব লোক কিছুদিন কুকুরের মত ঘেও ঘেও করবে তারপর চুপ হয়ে যাবে।আব্বার সততা এবং সাহসের জয় হবে।

আমরা ভাত নিয়ে পূর্বপাড়ার মাঠে এসে দেখি গরু দুটো জমির মাঝখানে দাড়িয়ে আছে লাঙল খাড়া করা আছে।আব্বা নেই।এতবেলা হয়েছে আব্বা সেই ভোরে মাঠে এসেছে অথচ একটুও জমি চাষ হয়নি।আব্বা দূরে দাঁড়িয়ে আছে।তার সাথে একটা লোক কথা বলছে।লোকটার গায়ে চাদর।

আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে লোকটা চলেগেলো।আব্বার তখন হুশ হলো-সে লাঙল চষতে এসেছে। কিন্তু এখন সে জোয়াল খুঁজে পাচ্ছে না।গরুর ঘাড়ে জোয়াল না দিতে পারলে লাঙল চষা হবে কী ভাবে?এইবার আব্বা চিৎকার শুরু করলো,"ওরে আমার জোয়াল কই,ওরে আমার জোয়াল কই?ও জোয়াল, জোয়াল?"

আব্বা এত জোরে চিৎকার করছে যে জোয়ালের কান থাকলে আজ সে ডাক না শুনে পারতোনা। 

আশরাফ হেসে উঠে বললো,"ও নানা,কী খোঁজ করছো?"

-জোয়ালরে নানা।

-তোমার ঘাড়ে কী?

আব্বা জোয়াল ঘাড়ে করে সমস্ত মাঠ জোয়াল খুঁজে বেড়াচ্ছে।

আমার একবার ইচ্ছে হলো জিজ্ঞেস করি,"এতবড় ভারি জোয়াল কাঁধে রেখে কী কারণে ভুলেগেলে?"

আব্বার চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে আর সাহস পাইনি।

অনেক বছর হলো আব্বা আর মা তেঁতুলগাছের ছায়ায় পাশাপাশি  মাটির নিচে ঘুমিয়ে আছে।সেখানে হারিকেন কিম্বা ল্যাম্প নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই।আর এখন তো  ল্যাম্প,হারিকেনের দিন শেষ।এখন গ্রামে গ্রামে বাড়ি বাড়ি কারেন্টের আলো।

চারিদিকে সবকিছু ঝকঝকে চকচকে শুধু সেই দায়িত্ববান ঝকঝকে চকচকে আলোকিত সাহসি মানুষের প্রচণ্ড অভাব।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top