সিডনী মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৭ই বৈশাখ ১৪৩১


 রেনু : সোহেল দ্বিরেফ 


প্রকাশিত:
২৮ জুন ২০২০ ২১:৪৭

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২৪ ০৭:২৭

 

বেশ কয়েকদিন থেকে রেনুকে অত্যন্ত আনন্দিত দেখাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে, ওর আকাশে নতুন নতুন অনেকগুলো তারার উদয় হয়েছে কিন্ত তারাগুলো কোন ধরনের বা কোন আকাশ থেকে এসে ওকে বদলে দিল সেটা জানা আমার পক্ষে এখনো সম্ভব হয়নি! কোন কথাই সরাসরি বলবে না,কৌশলে নিজেকেই বের করে নিতে হয়। দুপুর থেকে একটির পর একটি ফোন কল দিয়েই যাচ্ছে কিন্ত ঘুমের মধ্য বিচরণ করার কারণে তা রিসিভ করা আর সম্ভব হয়নি। পরে কল ব্যাক করলে মাথার উপর দিয়ে দুই মিনিট যেন সুনামি ঝড় বয়ে যায়! 

অনেক কষ্টে ঝড় সামলাতে সক্ষম হই অবশেষে। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে দেখা করতে বের হলাম। এসে দেখি, ক্যান্টিনে সুন্দর মুখটি গোমড়া করে বসে আছে । অবশ্য খারাপ না, দূর থেকে দেখতে বেশ ভালই লাগছে! ও যদি রেগে থাকে তাহলে ওর সৌন্দর্য যেন আরো বহুগুণ বেড়ে যায় অনেকটা সকালের সূর্যের মতো।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যত কাছের বন্ধু পেয়েছি, তার মধ্যে রেনু অন্যতম। মাঝে মাঝে ওর শাসন, বারণ আমি খুব উপভোগ করি। আর সব থেকে যেটা বেশি ভালো লাগে, তা হল ওকে রাগানো। কারণে অকারণে ওকে রাগিয়ে আমি এক প্রকার আত্মীক শান্তি খুঁজে পাই। সবকিছু যেমন তেমন সে কিন্ত কিপ্টাও বটে। কিছু খাওয়াতে বললে আজ না কাল, কাল না পরশু বলে শুধু গাড়ির চাকার মতো ঘুরায়। আমিও যেন নাছোড় বান্দা, ওকে না জ্বালাইতে পারলে আমার পেটের ভাত সহজে হজম হয় না।

কথা বলতে বলতে কিছুক্ষণ পর একটা টিফিন বক্স খুলে আমার সামনের দিকে এগিয়ে দেয় আর বলে, 'অনেক কষ্টে তোর জন্য রান্না করে এনেছি। ভাল পারি না তবুও চেষ্টা করেছি।'

শুনেই মনটা খুশিতে ভরে গেল। তখন আমি বললাম, 'সূর্যটা কোন দিকে উঠেছে আজ? তবে পূর্ব -পশ্চিম যেদিকেই উঠুক না কেন এভাবে প্রতি সপ্তাহে আমাকে দিয়ে ট্রায়াল দিতে থাক দেখবি, একদিন তুই ভাল মানের রাঁধুণী হয়ে যাবি, এমনও হতে পারে দিদি নাম্বার ওয়ানে তুই সেরা রাঁধুণী হয়ে গেছিস! তখন তোর জন্যে বাংলাদেশের নাম উজ্বল হবে।'

কথাটা শেষ করতে না করতেই সে বলে, 'এটাই প্রথম এটাই শেষ,হুম। আমি আর পারব না। রান্না করতে আমার ভালো লাগে না,কী যে কষ্ট রে বাবা!'

 

স্বপ্নের মত দিনগুলো কাটতে লাগল। প্রতিদিন একসাথে ঘুরতে যাওয়া, ক্লাস শেষে কৃষ্ণচূড়া রোডের পাশে বসে আড্ডা দিয়ে সময় কাটানো, মাঝে মাঝে সুজন মামার চায়ের দোকানে বসে চা খাওয়া, চায়ের ধোঁয়ার সাথে কত রঙিন রঙিন স্বপ্ন দেখে যাওয়া, আবার সেই স্বপ্ন কূল খুঁজে না পেলে ধোঁয়ার মত শূন্যে মিশে যাওয়া সবই হয়।

 

রেনু হয়ত আমাকে অনেক বিশ্বাস করে কিন্ত কেন বিশ্বাস করে সেটা জানি না। আমি তো বাউন্ডুলে কখন কী করি,না করি কিছুই ঠিক থাকে না। ও কেন আমাকে নিজের বন্ধু বানিয়েছে এটা আজও বুঝতে পারিনি! তবে ওকে যতই পঁচানোর চেষ্টা করিনা কেন এতে তার কিছু আসে যায় না। ওর মত এমন বন্ধু কখনো পাব চিন্তাতে আসেনি! আমি যতদূর জানি, সাধারনত ব্যাকবেঞ্চার ছাত্রদের কেউ মন থেকে ভালবাসে না। বিভিন্ন প্রয়োজনে এদের ভালমতো ব্যবহার করা যায় মাত্র । কারণ এরা নিজের কাজ করা থেকে অন্যর কাজ করে দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আবার এরাই এক সময় হয়ে যায় তুখোড়  ছাত্রনেতা,সন্ত্রাস, বখাটে, ঝরেপড়া ছাত্র। আর এজন্যই প্রথম সারির কোন ছাত্র ব্যাকবেঞ্চারদের বন্ধু হিসেবে কখনো মন থেকে মেনে নিতে পারে না। যার শিকার আমি বহুবার হয়েছি।  এক প্রকার অন্ধকারের মধ্য দিয়েই জীবনটা অতিবাহিত হতে থাকে আমার মত ছাত্রদের। একটা সময় আমরা নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাই। সিগারেটের ধোঁয়ার মত সুন্দর জীবনটা আস্তে আস্তে সর্বনাশী আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাই। 

রেনু আমাকে অবশ্য এতটা নষ্ট হতে দেয়নি। আমার অবিভাবক হয়ে সবসময় যেন পাশেই থাকে। ওর কাছে কোন বিষয় খারাপ লাগলে ছোট বাচ্চার মত শাষন করে। তবুও আমাকে অবহেলা করে ফেলে যায়নি কখনো । এটাই হতে পারে তার কাছে সত্যিকারের বন্ধুত্ব।

দেখতে দেখতে আজ চারটা বছর পার হয়ে গেছে।এর মধ্য অনেক ঘটনাদিও ঘটে গেছে। একটু পিছু ফিরে তাকালে কতগুলো স্মৃতি খুব ভাবিয়ে তোলে, কতগুলো আবার আনন্দ হাসির খোরাক জোগায়।বড়ই অদ্ভুত আমাদের বন্ধুত্বটা! অনার্স ইতোমধ্যে শেষ করে ফেলেছি। অনেকে চলে গেছে ক্যাম্পাসকে বিদায় জানিয়ে। রেনু সেদিন হঠাৎ করে বলল, 'আমারও যাওয়ার সময় হয়েছে, চলে যেতে হবে! খুব সম্ভবত কানাডা যাব পি.এইচ.ডি করতে। বাবা সে ভাবেই কাজ করছে। তোকে আগে বলিনি চমকে দিব বলে! তোদের সবাইকে ছেড়ে চলে যাব ভেবে খুব খারাপ লাগছে!' 

এ কথা বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। গাড়ির টিকিট করার জন্যে আজ ওর সাথে যাওয়ার কথা। সবকিছুই ঠিকঠাক কিন্ত আমি এত কষ্ট পাচ্ছি কেন! ওর বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না, বুক ফেঁটে কান্না আসছে। এতদিন আমার মাথার উপর মেঘের মত ছায়া হয়ে ছিল, আর আজ আমায় ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্যে টিকিট কাটতে যাবে! আবার আমি নিজের হাতে করে টিকিট কেটে দিব! এটা কীভাবে সম্ভব! এ সবকিছু ভাবলে দম বন্ধ হয়ে আসছে। কোন হিসেব যেন মিলছে না আমার খাতায়। 

আমি কিছু না পারলেও অন্তঃত আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি বেশ ভালমতো।  কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আমি হেরে যাচ্ছি। আমি চোখের পানিকে আজ কোন ভাবেই বুঝাতে পারছি না। কোনরকমে চোখ দুটো মুছে নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করি। রেনু হেসে হেসে বলে, 

'কী সমস্যা তোর? চোখে পানি কেন? কোন সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারিস, যাওয়ার আগে সমাধান করে দেয়ার চেষ্টা করব।'

 

'আমায় ছেড়ে চলে যাবি খারাপ লাগবে না তোর? আমাদের আড্ডার সময়গুলো মিস করবি না?'

কোন উত্তর না দিয়ে রেনু মাথা নিচু করে বসে আছে। অনেকক্ষণ ভেবে উত্তর দিলো,

 'না তোকে মিস করব না। কেন মিস করতে হবে তোকে? অনেক হয়েছে চল এখন।'

বিকালে একসাথে বের হয়েছি টিকিট কেনার জন্যে। যথারীতি কাজ সেরে ফিরে আসি ক্যাম্পাসে।  সারারাত দু'চোখের পাতা একমুহূর্তের জন্যেও এক করতে পারিনি। ওকে এত অনুভব করছি কেন এর উত্তরও কেন জানি খুঁজে পাচ্ছি না। আগে তো কখনো এমন হয়নি। মনে মনে সংশয় জাগছে, আমি কি রেনুকে ভালবেসে ফেলেছি! না, না, এটা কীভাবে সম্ভব!

 

সকাল ছটায় রেনুর ফোন আসলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো,

'কই তুই, আমাকে বিদায় দিবি না? তাড়াতাড়ি চলে আয় পার্কের মোড়ে। আমি বের হচ্ছি। এত সকালে আমি একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না। তুই তাড়াতাড়ি চলে আয়।'

৬:৩০ মিনিটে গাড়ি আসার কথা। যাত্রী ছাওনীতে বসে বসে তাই গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি। আজ রেনুকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। মাথা নিচু করে বসে আছে রেনু। মাটিতে কিসের যেন ইন্দ্রজাল খুঁজতে ব্যস্ত নাকি আমার মত ওর বুকের মধ্যও ঝড় বয়ে যাচ্ছে, যা আমাকে বলতে চাচ্ছে না। বাস এসে হাজির, হর্ন দিচ্ছে। ওর ব্যাগপত্র নিয়ে বাসে উঠিয়ে দিই। ওর চোখের কোনে জল সকালের শিশির কনার মত চিকচিক করছে। শেষে একটা কথায় বলল, 

'ভাল থাকিস, তোকে আজীবন মনে থাকবে আমার। আর তুই তোর স্বপ্নের সমান বড় হবি এই দোয়া রইল।'

কোন উত্তর না দিয়ে আমি নেমে আসি। তাছাড়া বাস ছাড়ারও সময় হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যই বাসটি দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়। চোখের পানি আর কোন বাধা মানতে চাইছে না, মনে হচ্ছে বুকের মধ্যে হৃদপিন্ডের স্পন্দন ক্রমে ক্রমেই থেমে যেতে চাইছে! আজ শুধু মন বলতে চাইছে, তুই সাথি আমার বন্ধু আমার। তোর শাষন ছাড়া এই এলোমেলো আমি কিভাবে চলব, কে আমায় অন্ধকারে আলোর পথ দেখাবে? রেনু, অনেক অনেক মিস করব তোকে।'

 

সময় গড়িয়ে যায়, জীবন চলতে থাকে জীবনের নিয়মে। মাঝে মাঝে কিছু আলোকবর্তীকার আগমনে কেউ কেউ সত্যর সন্ধান খুঁজে পায়; যার আলোয় আলোকিত করে নিজের ভুবনকে। আবার কেউ কেউ অযত্নে, অবহেলায় হারিয়ে যেতে থাকে  অন্ধকারের সর্বনাশা ছোবলে।

 

সোহেল দ্বিরেফ 

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top