সিডনী মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৭ই বৈশাখ ১৪৩১


 গুজব : আবু সেলিম রেজা


প্রকাশিত:
২৮ জুন ২০২০ ২১:৫১

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:৩২

 

কালিয়া বিল গ্রামের পাশ দিয়ে নিমাইচন্ডির দিকে যে কাঁচা রাস্তাটা গেছে, সেই রাস্তাটিতে এ বছরই নতুন মাটি ফেলা হয়েছে। সরকারি রাস্তা তাতে মাটি ফেলতে হয় রাস্তার দু'পাশের আবাদি জমি থেকে, ভিটেমাটি থেকে,পুকুর খাল থেকে মাটি তুলে।

কালিয়া বিল গ্রামের শেষ প্রান্তে জগাই মাঝির পোড়ো বাড়িটার ওপাড়েই 'কাঞ্চন ভিটা'। সেখানে পুরনো দিনের কিছু ইটের স্তুপ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এদিক-ওদিক। কিছু বিষাক্ত কাঁটাযুক্ত ঝোঁপ- ঝাড় ভিটেটাকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে কতকাল ধরে তার ইয়ত্তা নেই।

তো মাটিকাটার শ্রমিকেরা ঝোঁপঝাড়, ইটের স্তুপ সরিয়ে মাটি কাটছে তো কাটছে। হঠাৎ নইমুদ্দিন এর কোদালে খঠাৎ করে একটা শব্দ হলো ! মাটি সরাতে একটি পিতলের কলসির কানা ঝকঝক করে বেরিয়ে এলো। 

সাথে সাথে শোরগোল শ্রমিকরা কোদাল রেখে টুকরি রেখে হই হই রই রই, গ্রামবাসী এলো, সাংবাদিক এলো, পুলিশএলো, জন-প্রতিনিধি এলো, কালিয়া বিলের নিভৃত জনপদটি মুহূর্তেই সারাদেশে পরিচিতি লাভ করলো।

স্থানীয় পত্রিকায় খবর এলো,'কালিয়া বিলের কাঞ্চন ভিটায় কলসি ভর্তি সোনার মোহর প্রাপ্তি'

 জাতীয় পত্রিকায় খবর এলো, "রাজশাহীর বানেশ্বরের কালিয়া বিলে মোহর ভর্তি সোনার কলসি উদ্ধার, পুরাকীর্তিতে সমৃদ্ধ প্রাচীন নগরীর সন্ধান লাভ" ।

সরকারি বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো তাদের বিশেষ প্রতিনিধির মাধ্যমে গুপ্তধন প্রাপ্তির বিষয়টি লাইভ প্রচার করতে শুরু করল। ভারী ভারী যন্ত্রপাতি এবং টিভি ক্যামেরা ও বুমসহ বাঘা বাঘা যত সাংবাদিক, নবিশ যত সাংবাদিক চাকচিক্যময় পোশাক পরে, গ্রাম্য পরিবেশের ধুলি কাদায় অতিষ্ঠ হওয়ার ভাব কে চেহারায় ধারণ করে, ডাইনে-বাঁয়ে মাথা দুলিয়ে বিশেষজ্ঞের মতন সপ্রতিভভাবে এখানকার ঐতিহাসিক গুরুত্ব, প্রত্নতাত্ত্বিক সম্ভাব্যতা এবং পর্যটনের লাভজনকতা নিয়ে নাতিদীর্ঘ প্রতিবেদন লাইভ সম্প্রচার শুরু করলো, সেই সুযোগে গ্রামের অশীতিপর লোলচর্মের দরিদ্র বৃদ্ধ যারা কিনা ঘরের বাহির হতেই পারেনা তাদের কদর বহুগুণে বেড়ে গেল, দীর্ঘদিন পরে তার তুলে রাখা ছেঁড়া জামাটা গায়ে দেয়ার প্রয়োজন হল- টেলিভিশনে কথা বলার জন্য। প্রতিবেদক চোখ নাচিয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে বৃদ্ধের নাম জিজ্ঞেস করে, তার বয়স কত এবং সে ছোটবেলায় এই ভিটেতে কি দেখেছে তার বাবা-মা বা পূর্ব-পুরুষের কাছে এই ভিটে সম্পর্কে কি কি জনশ্রুতি শুনেছে- তা জানতে চায়।

 বয়সের ভারে ন্যুব্জ, সমাজের অপাংক্তেয় বৃদ্ধ সহসা তার গুরুত্ব বেড়ে যাওয়াকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে এবং এই ভিটে সম্পর্কে তার যা জানা এবং যা কল্পনা সবকিছু একাকার করে একটি চরম উপাদেয় গল্পের অবতারণা করে। তার ভাষ্য অনুযায়ী এই ভিটেয় রাজা রানী  বিশাল রাজত্ব, টাকশাল, হিন্দু রাজার অত্যাচার, মুসলিম ফকিরের আগমন, যুদ্ধ,  হিন্দু রাজার পরাজয় রাজকন্যা ও রানীর পুকুরে আত্মাহুতি, শিকলওয়ালা সিন্দুক,তার কথা যে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি, তা প্রমাণ করার জন্য তারই সমবয়সী স্মৃতিশক্তি হীন নিরক্ষর বৃদ্ধ ছোমের আলি কে সাক্ষী মানে। সাংবাদিক ছোমের আলীকে যা জিজ্ঞেস করে সে শুধু প্রত্যুত্তরে ঘাড় নেড়ে সম্মতি সূচক অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলে! 

এলাকার এই অবহেলিত জংলা ভিটেটি যে একটি প্রাচীন রাজ্যের রাজধানী,এবং এখানে লুকিয়ে আছে অনেক গুপ্তধন,প্রত্ন-সম্পদ এমনটি চাউড় হওয়াতে এলাকার সচেতন যুবসমাজ তথা সাধারন জনগণ তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিরাট শোভাযাত্রা বের করে সরকারি অফিসে স্মারকলিপি দেয়।

 

স্থানীয় 'পাঁচপীর' এর খানকাহ্ শরীফ থেকে এই স্থানটিকে হক্কানী পীর হযরত শাহ্ সুফি তুবতুবি বাগদাদী এর মাজার বলে ঘোষণা দিয়ে এর পবিত্রতা রক্ষার জন্য বিশাল সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয়া হলো। মাজার শরীফের উন্নতিকল্পে দান খয়রাত গ্রহণের জন্য সুরক্ষিত দানবাক্স এবং তার চেয়েও "শক্ত খাদেম কমিটি"গঠন করা হলো।

সমস্যা হলো স্থানীয় মন্দির কমিটি থেকে স্থানটিকে ঘোর কলিযুগের বিপত্তারিনী জাগ্রত সন্তোষীমাতার মন্দির বলে চিহ্নিত করা হলো এবং শতবর্ষের ধূলো,গোবর, মল-মূত্র কবলিত ইটগুলোর গায়ে গোলাপজলের ছিটা পড়লো। তারপরে সেগুলোকে দুধ দিয়ে ধুয়ে সিঁদুর মাখিয়ে সকাল-সন্ধ্যা নমঃ নমঃ ধ্বনিতে চারপাশ মুখরিত করে পুজো-অর্চনা শুরু হলো।

সন্তোষীমাতার অসুরবধ মূর্তি ছেপে বিশাল সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয়া হলো। মন্দিরের উন্নতিকল্পে যথারীতি দানবাক্স এবং "নিঃস্বার্থ"

সেবায়েত কমিটি গঠন করা হলো।

তারপরের ঘটনা সহজেই অনুমেয় ! মাজার- মন্দির নীরব থাকলেও খাদেম-সেবায়েত কমিটি গলার জোর, গায়ের জোরে একে অপরকে পরাস্ত করতে থাকার ক্রমাগত প্রচেষ্টায় নয় জনের কপাল রক্তাক্ত, পাঁচজনের ঠ্যাঙের হাড়ে পেরেক, সাতজনের হাত ব্যাগে ঝোলানো,আর চারজন বেহেশত ও স্বর্গের প্রথম ধাপ কবর ও শ্মশানবাসী ! 

ভূমিকম্পের পর অনেকগুলো মৃদু ভূমিকম্পের মত প্রত্যেহ এ পক্ষের কলার বাগান সাবাড় তো ও পক্ষের পেঁপের বাগানের কল্লা কচুকাটা, এদের মেয়ে স্কুল থেকে ফিরলোনা তো ওদের বৌ ঘাট থেকে নিখোঁজ-দু'জনের লাশ পাওয়া গেল দু'দিন পর কাউয়াডোবা বিলের দামের তলে।

মোকদ্দমা উনিশটি। এখন এখানে শুধু ইউনিফর্ম পরিহিত কিছু স্মার্ট লোকের আনাগোনা দেখা যায়। সদরে উকিল সা'ব আর উকিল বাবুরা বাজারের সেরা মাছটি দরাদরি না করেই থলেতে পোড়েন- বলাবাহুল্য থলেটি কিন্তু এরাই ধরে ! 

 

কিন্তু যাকে দিয়ে গল্পের শুরু সেই নইমুদ্দিন কোথায় ?

ও হ্যাঁ! সেদিন কোদালের কোপে একটা ভাঙ্গা পিতলের কলসির কানা উঠেছিল বটে, তাতে সোনার মোহর দূরে থাক ! কলসির তলাও ছিল না। লোকজনের অমন অহেতুক শোরগোলে সেই কলসির ভাঙা টুকরোটিও যে কোথায় গেল তা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

 তারপর সহকর্মী, লেবার সর্দার, কন্ট্রাকটর, পুলিশ, সরকারি আমলা, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা-সবার সন্দেহ তার দিকে। সে ওই মুহূর্তে কলসি কোন অজান্তে গায়েব করে দিয়েছে। মুহুর্মুহু জিজ্ঞাসা, জেরা-জবানবন্দিতে অতিষ্ঠ হয়ে এক সময় সে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। লোকের মুখে মুখে প্রচারিত হয় খইমুদ্দিন এর ছেলে নইমুদ্দিন ঘড়া ভর্তি সোনার মোহর পেয়ে সেটি নিয়ে পালিয়েছে !

আসলে নইমুদ্দিন কোথায় আছে জানেন ? 

লেখক এর সাথে কল্পনায় তার দেখা হয়েছিল। লৌহজং উপজেলার পদ্মাসেতুর নিকটবর্তী একটি গ্রামের ভাড়া করা একটি টিনের ছাপড়া ঘরে পরিবার পরিজন নিয়ে তার বাস। 

সে এখন সেতুর বালুর ঠিকাদারের সরদারি করে।

 

আবু সেলিম রেজা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top