সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১


স্বপ্ন-বানজারা : রঞ্জনা রায়


প্রকাশিত:
৮ জুলাই ২০২০ ২১:০০

আপডেট:
৮ জুলাই ২০২০ ২১:০৪

রঞ্জনা রায়

   

দুপুর একটা থেকে তিনটে – একটা নিটোল অবসর।সারাদিনের মধ্যে এইটুকু সময়ই একান্ত ভাবে নীলার নিজস্ব অবকাশ। সারাদিন সে এই সময়টুকুর জন্য অপেক্ষা করে থাকে, মনে দোলে পেন্ডুলাম, চোখ থাকে ঘড়ির কাঁটায়।কলিং বেল বেজে ওঠে,চোখ চলে যায় ঘড়িতে – সাড়ে বারোটা। দরজায় চারতলার ফ্ল্যাটের মাসিমা, নীলা দরজা খোলে –“ওমা মাসিমা আপনি, আসুন। কেমন আছেন?”

“ভালো আছি মা, তুমি তো আর ওপরে ওঠোই না।”

“হ্যাঁ মাসিমা সময় পাই না, বান্টির পড়াশোনার চাপ, মেয়ের আবার আমার কাছে না হলে পড়াই হয় না। তার ওপর সংসারের হাজারটা কাজ।”

“বুঝি মা সবই, সামনের রবিবার পুতুলের জন্মদিন, ওর একবছর হলো, তোমরা যেয়ো সবাই সন্ধ্যাবেলা, অমিতকে বোলো, বান্টিকে নিয়ে যাবে।”

“হ্যাঁ মাসিমা আপনার নাতনির জন্মদিনে অবশ্যই যাবো।”

“আসি মা ভাল থেকো।”

ঘড়িতে একটা বাজতে পাঁচ।নীলা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে – যাক উঠলেন তাহলে! বেসিনে গিয়ে চোখে মুখে জল দেয় – মনের ঘুড়ি আকাশে। নীলা ঢোকে তার সাজানো গোছানো ফ্ল্যাটের লিভিং রুমে।

প্রায় দশ বছর হল নীলার বিয়ে হয়েছে। স্বামী অমিত চ্যাটার্জ্জী এক নামকরা বিদেশী ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। একমাত্র মেয়ে অপরূপা কনভেন্টে পড়ে – ক্লাস ফাইভ। নীলা থাকে সোনা বাঁধানো খাঁচায়। উত্তর কলকাতার বনেদী রক্ষনশীল বাড়ির মেয়ে সে। গ্র্যাজুয়েশন বেথুন কলেজে। জীবনে বসন্ত এসেছিল বড় সঙ্কুচিত আবেগে, বড় দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে। ফাগুনের ফাগে নিজেকে কখনোই সে নিঃসঙ্কোচে রাঙাতে পারে নি। মনের ভিতর রক্ত গোলাপ কুঁড়ি হয়েই থেকে গেছে, ফুটলো না কোনদিনই; ফোটবার আশায় পাপড়িগুলো থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে অসাড়, বিবর্ণ হয়ে গেছে কিংবা কুড়িটাই ভুলে গেছে ফোটবার কথা। নীলার  ভাবনাগুলো লেখা থাকে তার কবিতার খাতায়।কবিতা নীলার নিজস্ব মুক্তির অঙ্গন।নোনাধরা একঘেয়েমি কেটে যায় কবিতার স্পর্শে। তার একাকীত্ব ভাষা পায় ...

“মানুষ বড়ো একা –

সেই একাকীত্বের বৃত্তে কে তুমি ?

বন্ধু !

সত্যি কি তুমি দোসর –

এই হৃদয়ের  এই মননের

এই আশা-নিরাশায় ভরা অসীম জগতে ,

পাবে কি তোমার হাত

যে চায় তোমাকে!”

দোসরের অপেক্ষায় নীলা বসে থকে । কবিতায় কবিতায় ভরে ওঠে তার খাতা ।

                               ২

“ মিতুলদা  এই কবিতাটা দেখো না, প্লিজ দেখো।”

নিলয় ক্যানভাস থেকে চোখ সরায় , সামনে নীলা।গোলাপি সালোয়ার কামিজ, পিঠে একঢাল কালো চুল, আয়ত চোখের শ্যামলা মেয়ে, দেহশ্রীতে ভাস্কর্যের সুষমা। বেথুনে পড়ে, ফাস্ট ইয়ার।

 “কি রে কি হল? পেত্নীরা যে কবিতা লেখে এই প্রথম জানলাম। ও সব আঁউ- মাঁউ-খাঁউ কবিতা আমি পড়তে পারবো না।”

 “হ্যাঁ, মশাই এযুগে পেত্নীরা লেখে আর ভূতেরা পড়ে। তুমি এই কবিতাটা পড়ে একটা ছবি এঁকে দেবে। আমি একটা পত্রিকাতে দেবো। ব্যাস্, এই আদেশ দিয়ে গেলাম।”

“আবার আদেশ ! বাড়ি যা।”

জ্যৈষ্ঠের মাঠে এক পশলা আষাঢ়ের বৃষ্টি ।

পরদিন দুপুরে নিলয় ব্যস্ত ক্যানভাসের সামনে। একমনে তার সাধনায় মগ্ন , দুচোখে বড় শিল্পী হবার উচ্চাশা, গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে থার্ড ইয়ারে পড়ে। হঠাৎ দমকা সুগন্ধী হাওয়া, পর্দা ওড়ে, সামনে নীলা –

“মিতুলদা, আমার পেন্টিংটা দাও প্লিজ।”

“হয় নি, যা ভাগ্।” 

“মিতুলদা প্লিজ দাও না, আজ বিকেলেই পত্রিকা অফিসে জমা দিতে হবে।”

“কাজ করছি, প্লিজ আমার কনসেনট্রেশন নষ্ট করিস না।” 

“মিতুলদা প্লিজ, তুমি চাও না আমার লেখাটা প্রকাশ হোক। প্লিজ-ই মিতুলদা দাও।”

নীলা কাছে আসে, আয়ত চোখে আবদার নিয়ে তাকায়। 

“আগে চোখ বোজ তবে পাবি।”

নীলার গা শিরশির করে। মিতুলদার আশেপাশে ঘুরলে কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি, ভালোলাগা মনকে আচ্ছন্ন করে। মিতুলদার গায়ের গন্ধে এক নেশাধরা আমেজ, নীলা আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করে।

“উহু, চোখ মিটমিট করলে হবে না।”

“না গো, এই তো বন্ধ।”

নির্জন দুপুর, নিস্তব্ধ ঘর, মিতুলদার ঘন নিঃশ্বাস দুচোখের পাতায়।

“বাঃ, এই তো আমার বনময়ূরী, নীলপরী।”

নীলার ডান হাতের তালুতে উষ্ণ স্পর্শ, নীলা গলে যায়, শরীর জুড়ে সপ্তসুরে বীনা বেজে ওঠে। চকিতে চোখে চোখ, ঠোঁটে ঠোঁট মেলে। সম্বিৎ ফেরে, টেবিলে রাখা কবিতা ও ছবি নিয়ে নীলা ছুটে পালায় –

পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা

ঝর্নায় ছন্দের কল্লোল ,

প্রান খুঁজে পায় প্রানের মাঝে

বসন্তের আগমনী হিল্লোল ।

মিতুলদা মায়ের বন্ধু মল্লিকা মাসিমার ছেলে।দুই বাড়ির মধ্যে ভালোই সখ্যতা আছে, আসা – যাওয়া আছে। সেই দিনের পর থেকে মিতুল, ওর ভালো নাম নিলয়, ওদের বাড়ি একটু ঘন ঘনই আসতো। ওকে দেখলেই নীলার বুকে সাগর তরঙ্গ, উথাল-পাথাল ঢেউ। মৎস্যকন্যার মত নিলয়ের নীল চোখের গভীরে মন সাঁতার কাটতে চায়। কে জানে মা কি বোঝে, নীলার বিয়ের তোড়জোড় শুরু করেন। কিছু দিনের মধ্যেই অমিতের সঙ্গে নীলার বিয়ে ঠিক হয়। নীলা কোনদিনই নিজের মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে নি। মা-বাবার একমাত্র মেয়ে, চিরকালই ভেবেছে – এমন কোন কাজ করবো না, যাতে মা-বাবা মনে কষ্ট পান। নিলয়কে ভালবাসার কথাটা মনের অন্তঃস্থলেই রয়ে গেছে – তাকে সবার সামনে বিশেষত মা কিংবা বাবা কারোর কাছেই প্রকাশ করতে পারে নি।

                                                       ৩

লিভিং রুমে নীলা ডেক্সটপটা খুলে ফেসবুকে লগ ইন করে। এখন নীলা আস্তে আস্তে এই সোশ্যাল নেট ওয়ার্কিং সাইটটির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, কারণ যে সব কবিতা নীলার খাতায় বন্দী হয়েছিলো – তাদের মুক্তি ঘটেছে ফেসবুকের ওয়ালে। নীলা সব নোটিফিকেশন গুলো দেখে। গতকাল ফেসবুকে একটা কবিতা পোষ্ট করেছিলো, অনেকগুলো লাইক পড়েছে, কিছু কমেন্ট ও এসেছে। মনে হচ্ছে সকলের ভালোই  লেগেছে, কিছু বন্ধুদের বন্ধুরাও কমেন্ট করেছে। আর এসেছে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট – নাম ‘স্বপ্ন–বানজারা’। ও বুঝলো কেউ তার আসল নাম লুকিয়ে ওকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। প্রোফাইলটা চেক করলো, দেখলো লন্ডনে থাকে, একটা মাল্টি ন্যাশানাল কোম্পানিতে চাকরি করে। তবে পুরুষ না মহিলা সেটা বুঝতে পারলো না। বোধ হয় পুরুষই, কারণ পুরুষরাই মেয়েদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। মনে হচ্ছে কবিতা ভালোবাসে, ওয়ালে প্রচুর কবিতা পোষ্ট করা আছে। নীলা রিকোয়েস্টটা এ্যাকসেপ্ট করলো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চ্যাট বক্সে ভেসে উঠলো

“হাই ধন্যবাদ”, স্বপ্ন–বানজারা অন আছে।

“হাই , ওয়েলকাম” নীলা বললো ।

“অমৃতা কেমন আছেন?”

“আমি নীলা, অমৃতা নই, আপনি কেমন আছেন?”

“আপনি খুব সুন্দর কবিতা লেখেন। যার লেখার মধ্যে অমৃত আস্বাদ করা যায়, তাকে আমি অমৃতাই বলবো, প্লিজ কিছু মনে করবেন না।”

ফেসবুকের চ্যাট বক্সে ওদের পরিচয় বন্ধুত্বে রঙিন হয়। নীলা জানতে পারে স্বপ্ন–বানজারার আসল নাম নীলার্ক। কবিতা ওর প্যাশন আর পেন্টিং ওর ধ্যান। একটা বিষয় নীলাকে খুব অবাক করে যা হল – নীলার্কের ওয়ালে ওর নিজস্ব কোন ছবি নেই। নীলার্ককে কেমন দেখতে নীলার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে। প্রায় চার মাস হল দুপুর একটা থেকে তিনটে এই সময়টা নীলার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান হয়ে উঠেছে। এই সময়টা সে নীলার্কের সঙ্গে কথা বলে – তার বেহিসেবী মনের আলাপন। নীলার মনে হয় সে যেমন নীলার্কের জন্য অপেক্ষা করে তেমনি নীলার্ক ও বোধ হয় তার জন্য প্রতীক্ষায় থাকে। এ যেন খাঁচার পাখী আর বনের পাখীর আকস্মিক মিলন, আকস্মিক স্বপ্ন – যাপন!

                                                ৪

“হাই অমৃতা, আমি পরশু কলকাতায় পৌঁছচ্ছি।”

“তাই, কি মজা, তোমায় আমায় দেখা হবে।”

“হ্যাঁ, অমৃতা শুধু সেই জন্যই আমি যাচ্ছি। অমৃতা ধারায় অমর হয়ে উঠবো বলে।”

“যাও, আর বেশি বক্ বকম করতে হবে না।”

“অমৃতা বুধবার বিকেল সাড়ে পাঁচটায় সল্ট লেক সিটি সেন্টার এর সামনে আমাদের দেখা হচ্ছে।”

“ও কে, আই অ্যাম ওয়েটিং ডিয়ার।”

হাতে মাত্র সাত দিন, তারপর নীলার্কের সঙ্গে দেখা হবে । নীলার মনে অদ্ভুত টানাপোড়েন । একদিকে সংসার, মেয়ে, অমিত, তার চিরকালীন সংস্কার। অন্যদিকে নীলার্ক তার স্বপ্নের ফেরিওয়ালা, তার কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক, তার অনুভবের, তার মননের একাত্ম সঙ্গী।

বুধবার সকালে ফেসবুকে মেসেজ –“অমৃতা, আমার বন ময়ূরী, একটু ছায়া দাও, একটু সিক্ত করো, করো অনির্বাণ, অবিনশ্বর।” মেসেজটা পড়ে বুক কেঁপে ওঠে, হঠাৎ ঝড়ো হাওয়ায় মনের পাতাগুলো উল্টে যায়।

বিয়ের ঠিক দু দিন আগে সে তো এসেছিল, এক নির্জন দুপুরে তার ঘরে, হাতে সুদৃশ্য কাগজে মোড়া একটা উপহার। নীলার হৃদয়ে প্লাবন, শ্রাবণের বর্ষণ, নীলা আস্তে আস্তে বলে -

 “ কি এটা।”

 সে বলে - “খুলে দেখো বন ময়ূরী” সেই প্রথম আর সেই শেষ সে তাকে ‘তুমি’ বলে ডাকলো, হৃদয় বীনায় ভৈরবীর তান। তারপর নিজেই মোড়কটা খুলে নীলার হাতে দিল। নীলার অপূর্ব সুন্দর একটা পোট্রেট। নীলা মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে ছবিটির দিকে, বৃষ্টি আর রোদ খেলা করে দুচোখে।

সে বলেছিল “নীলা ভীষণ কষ্ট, ভেঙে খান্ খান্ হয়ে যাচ্ছি, ছোরাটা বিঁধে আছে, রক্তাক্ত চারপাশ।”

আর তখন নীলা বোধহীন এক অবশ জড়পিণ্ড।

তারপর কেটে গেছে এতোগুলো বছর।নীলা শুনেছিল ভালো চাকরি নিয়ে সে বিদেশে গেছে। আজ সকালের এই মেসেজটা যেন হঠাৎ সেই স্মৃতির গুহায় হানা দেয়, মন থমকে যায় অজানা অভাবিত আশঙ্কায় – তবে কি?

কদিন থেকেই নীলার মনে অবিরত যুদ্ধ চলছে। অমিত তাকে সবই দিয়েছে। স্বামী হিসেবে চরিত্রবান, যাকে কিছুটা স্ত্রৈণও বলা যায়। তবু কেন এক অদ্ভুত শূন্যতা, বিষণ্ণ মরুভূমি নীলার অন্তরে! ঘড়িতে চারটে বাজে , নীলা তৈরী হয়। সল্টলেকে তার বাড়ি থেকে সিটি সেন্টার যেতে ট্যাক্সিতে বড়জোর পনেরো মিনিট থেকে আধ ঘণ্টা লাগবে। যাই হোক প্রস্তুত হয়ে, ব্যাগ হাতে নেয়। মেয়ে আজ মায়ের কাছে আছে, আজ ওর ছুটি।

এমন সময় কলিং বেল বাজে, কে আবার? অমিত হাসিমুখে দরজায়, সজ্জিতা নীলাকে  দেখে একটু অবাক হয়। বলে “তুমিও আমায় স্যারপ্রাইজ্ দিলে, একেবারে রেডি হয়ে আছ! ভালোই হলো। চট্ করে একটু চা করো, খেয়ে দুজনে বেরবো। আজ অফিসে একটু ছুটি পেয়ে গেলাম, দুটো টিকিট কিনে এনেছি  অ্যাকাডেমিতে নাটক দেখবো। তারপর ডিনার করে বাড়ি ফিরবো।”

মনে হল বিরাট ভূমিকম্পের মাঝে নীলা আস্তে আস্তে পাতালে তলিয়ে যাচ্ছে। হাত পা অবশ, যন্ত্রচালিতের মতো কিচেনে ঢোকে, চা করে অমিতের হাতে দেয়। অমিত আপন খেয়ালে বকেই চলেছে। নীলা বিবর্ণ হচ্ছে, কুড়ি থেকে গোলাপটা ফুটে উঠতে গিয়েও হঠাৎ শুকিয়ে গেলো, ঝরে গেলো পাপড়ি গুলো এই মুহূর্তে – কাঁটায় কাঁটায় রক্তাক্ত হৃদয়। নীলা গাড়িতে ওঠে, মিউজিক সিস্টেমে বাজে ‘যেতে যেতে একলা পথে নিভেছে মোর বাতি’ অমিতের প্রিয় গান।

বাইশটা মিস্ কলের সাক্ষী হয়ে সাইলেন্ট মোবাইলটা অব্যক্ত বেদনার শরশয্যায়  রাতের অন্ধকারে ডুকরে কেঁদে ওঠে।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top