সিডনী রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১


সেই তুমি এলে : পার্থ তালুকদার


প্রকাশিত:
১১ জুলাই ২০২০ ২১:৩৪

আপডেট:
১১ জুলাই ২০২০ ২১:৪০

পার্থ তালুকদার

 

বৃদ্ধাশ্রমের কেয়ারটেকার রতন সেদিন আমার জন্য রাতের খাবার নিয়ে এসে বলল, ‘জানেন দাদুভাই, আমাদের আশ্রমে গতরাতে এক দিদিভাই উঠেছেন। কী মায়াবী তার চেহারা !’

রতনের কথায় আমি কান দেই নি। কতজনই আসে, আবার ফিরেও যায়। বিষয়টা আমার কাছে স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে এসেছে। ইদানিং শরীরটা মোটেই ভাল যাচ্ছে না। উঠতে-বসতে উনআশি বছরের শরীরে জোড়ায় জোড়ায় সীমাহীন ব্যথা। তাই রতন রুটিন করে আমার রুমে তিন বেলার খাবার পৌঁছে দেয়।

আমাদের বৃদ্ধাশ্রমে দুটি অংশ। একটি পুরুষদের জন্য অন্যটি মহিলাদের। পুরুষদের অংশটির নাম দিয়েছি আমার নিজের নামে অর্থাৎ ‘মনমোহন কুটির’ এবং মহিলাদের অংশের নাম ‘বিনোদিনী কুটির’। ‘বিনোদিনী কুটির’ কেনো নাম দিয়েছি, তার বিশেষ একটা কারণ আছে; যদিও এখন বলছি না, একটু পরেই বলি। এখানে একটা রীতি আছে যে, পুরুষদের ডাকা হয় ‘দাদুভাই’ আর মহিলাদের ডাকা হয় ‘দিদিভাই’ সম্বোধন করে। বৃদ্ধাশ্রমের সীমানা প্রাচীরের ভেতরে আছে ফুলের বাগান, সবজির বাগান। গন্ধরাজ, গাঁদা, গোলাপসহ হরেকজাতের ফুল বাগানটিকে যেন স্বর্গলোকের মত মোহনীয় করে রাখে। শীতের শিউলি আর গন্ধরাজ আমার পছন্দের ফুল। মিষ্টি ঘ্রাণ ও কমনীয়তার জন্য ছাত্রজীবনেই এই ফুলগুলোর প্রতি আমার বেশ মুগ্ধতা ছিল।

রতন পরের দিন সকালে আবার আমাকে বলে, বুঝলেন দাদুভাই, আমাদের নতুন দিদিভাই সারাক্ষণ শুধু চোখের পানি ফেলেন। স্থিরদৃষ্টিতে টলটল চোখে বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকেন’।
আমি রতনকে বলি,‘এখানে কি কেউ নিজের ইচ্ছায় আসে রে, বাধ্য হয়। সকল ভালবাসা, হৃদয়ের বন্ধন ছিন্ন করে মানুষ এখানে আসতে বাধ্য হয়। তাই চোখের পানি আসাটাই স্বাভাবিক’।
রতন বলে,‘ না দাদুভাই, উনি অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা, কেমন জানি চুপচাপ থাকেন, কারো সাথে টু-শব্দটাও করেন না, এভাবে কি একটা মানুষ বাঁচতে পারে বলেন’।
আমি আবার রতনকে বলি- ‘তোর সাথে কি উনার কথা হয়েছে ? মানে কেনো তার বৃদ্ধাশ্রমে আসতে হলো, এ নিয়ে কোনো কথা বলেছেন’?

- না, না দাদুভাই। আমি ভয়ে উনার সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলিনি। তবে যতটুকু শুনেছি তার ছেলে আর ছেলের বৌ নাকি জোর করে তাকে এখানে রেখে চলে গেছেন।

এখানে যারা আসেন সবার মূল কারণটা প্রায় একই। একটা মানুষ পরিবারের কাছে কতটা মূল্যহীন হয়ে ওঠে, কতটা অকেজো হয়ে যায়, তা এই কঠিন পরিস্থিতিতে না পড়লে অনুধাবন করা যায় না। এই বৃদ্ধ বয়সে একটা মানুষ শরীরের জোর যেমন করে হারায় ঠিক তেমনি হারায় মনের জোর। এই দুঃসময়ে তারা ছেলে-মেয়ের কথার অবাধ্য হলেই তাদের উপর নেমে আসে চরম নির্মম যন্ত্রণা। তখন তারা না মুখ ফুটে সমাজকে বলতে পারেন, না পারেন এমন মর্মজ্বালা সহ্য করতে। উভয় সংকটের মধ্যে চলে তাদের যাপিত জীবন।

বৃদ্ধাশ্রমের পনেরো বছর পূর্ণ হওয়ায় সন্ধ্যায় ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এক হিসেবে দেখা গেল আমিই এই আশ্রমের সবচেয়ে বয়স্ক বাসিন্দা। তাই একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, সবাই আমাকে একটু শ্রদ্ধার চোখেই দেখেন। হঠাৎ খেয়াল করলাম একজন মহিলা একাকী শান্তভাবে একটা চেয়ারে বসে আছেন। পরনে সাদা-কালো শাড়ি। চেহারাতে মায়াবী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একটা অবয়ব স্পষ্টত খেলা করছে। আমি ধরে নিলাম উনিই রতনের নতুন ‘দিদিভাই’। আলো-আঁধারিতে এই মুখটা আমার ভেতরের জগতটাকে এমনভাবে নাড়িয়ে দিল যে, আমি আর অনুষ্ঠানস্থলে টিকতে পারি নি। সবাই যে যার মতো আমাকে ধরে রাখার চেষ্টা করলো, অনুরোধ করলো, কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি।

রুমে এসে একটা অস্পষ্ট ঘোরের মধ্যে আটকা পড়লাম। মানুষের সাথে মানুষের এমন অলৌকিকভাবে দেখা হতে পারে, যা অবিশ্বাস্য! বয়সের ভারে আমার দুচোখে ছানি পড়েছে, স্মৃতিভ্রম হয়, কিন্তু একদিন যে হৃদয়কে আমার হৃদয়ের সাথে বেঁধেছিলাম তাকে তো আর ভুলে যাওয়া চলে না। এই ভুলে যাওয়া তো অপরাধেরই সামিল। সে জন্যই হয়তো আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা কেমনজানি জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠল। যুব বয়সের পাগলপারা দিনগুলোর কথা মনে পড়লে আমার যেমন হাসি পায়, লজ্জা লাগে, ঠিক তেমনি আবার কথা রাখার জন্য গর্ববোধও হয়।

*দুই*

তার সাথে আমার দূরসম্পর্কের এক কাকুর বিয়েতে পরিচয়। তখনকার বিয়ের আয়োজন ছিল উৎসবমুখর। বিয়েবাড়িতে মাসখানেকের জন্য আত্মীয়রা নাইর আসতেন। বিয়ে করতে গিয়ে নতুন বর তার জনাপঞ্চাশ সঙ্গী নিয়ে কনের বাড়িতে গিয়ে দুই রাত কাটাতেন। তাই বরযাত্রী এবং কনের বাড়ির লোকজনের মধ্যে আনন্দফুর্তি খুব বেশিই হতো। তবে মাঝেমধ্যে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটে যেত; তা অস্বীকার করছি না। এমনই এক জাঁকজমক বিয়েতে তার সাথে আমার প্রথম দেখা, পরিচয়, তারপর হাসিঠাট্টা থেকে ধীরেধীরে শুরু হয় মন দেয়া-নেয়া।

মাস খানেক পরেই আমার প্ররোচনায় সে পড়াশুনার জন্য শহরে চলে আসে। আমি যে কলেজে পড়তাম অনেক ফন্দিফিকির করে তাকে সেই কলেজেই ভর্তি করাই। তখন আমাদের প্রেমটা আরো জমে উঠে। ও খুব সুন্দর করে শাড়ি পরতো। মাথার চুলে গুঁজে দিত গোলাপ অথবা গন্ধরাজ ফুল। তখন থেকেই মূলত আমার ফুলের প্রতি আকর্ষণ বাড়তে থাকে। কলেজের যে কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি ছিল অবধারিত। একবার একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে তার একক গানের শিডিউল ছিল। রিহার্সালও করেছিল টানা তিন দিন। কিন্তু অনুষ্ঠানের ঠিক আগের রাতে তার উঠল হাড়কাঁপানো জ্বর। এদিকে আয়োজকরা পড়ল বিপাকে। আমি ঔষধপত্র নিয়ে রাতেই তার হোস্টেলে গেলাম। পরদিন সকালে জ্বর কিছুটা কমলেও সে মারাত্মক দুর্বল হয়ে পড়ল। কিন্তু তবুও সে গান করবে। আমি তার জেদের কাছে হার মেনে অনুষ্ঠানে নিয়ে গেলাম। একটা গান শেষ করে যেই না দ্বিতীয় গানটি শুরু করবে তখনই ঘটল বিপত্তি। মাথা ঘুরে মঞ্চেই পড়ে গেল সে। আমরা তাকে সোজা হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। সে টানা তিনদিন হাসপাতালে ছিল। খবর পেয়ে বাড়ি থেকে আসলেন তার মা, তাই আমি বাধ্য হয়ে তিনদিন হাসপাতালের বাইরে ঘুরঘুর করেছি।

তখনকার দিনের আট-দশটা প্রেমের মতো আমাদের সম্পর্কও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তবে তাকে না পাওয়ার তীব্র জ্বালায় আমার মনের মধ্যে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল, তা আজও শুকায়নি। একদিন কলেজে এসে আমাকে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল তার বাবার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। মারা যাওয়ার আগে ক'দিনের মধ্যেই তাকে বিয়ে দিতে চান। আমি তখন মাস্টার্সে পড়ছি। সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা। এ কূল রাখি, না ও কূল। জীবনের এক কঠিন সময় পাড় করছিলাম। পড়ায় মন নেই, রাতে ঘুম নেই। অশান্তির কালো ছায়া আমাকে ঘাপটি মেরে ধরল। বুকের ভেতরটা জ্বলে-পুড়ে যেন ছাই হয়ে যাচ্ছিল। সর্বক্ষণ মনে হত কী যেন হারিয়ে ফেলছি আমি। এই কঠিন শূন্যতা পূরণ হবার নয়। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, পালিয়ে যাব। সাগর, পাহাড়, উপত্যকা, আগ্নেয়গিরির মতো সব দুর্গমতাকে পেছনো ফেলে আমরা পালিয়ে যাব।

কিন্তু আমাদের সকল পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। পরের দিনই বাড়ি থেকে একজন খবর নিয়ে এলো তার বাবা মারা যাচ্ছেন। এই লোকের সাথেই কেঁদে কেঁদে সে বাড়ির পথে পা বাড়ায়। ক'দিন পর আমি খবর পাই তার বাবা মারা গেছেন। তার বাবা মারা যাওয়ার সাথে সাথে আমাদের স্বপ্নও মারা যায়। সে আর কখনো শহরে আসেনি। তিন বছরের প্রেম তিন দিনেই সমাপ্ত। দু'মাস পর অন্যত্র তার বিয়ে হয়। আমি একা হয়ে গেলাম। এই একাকীত্বকে স্থায়ী করার মানসে, তার স্মৃতিকে সর্বদা জাগ্রত করার প্রয়াসে আমি রয়ে গেলাম অকৃতদার। বিয়েটিয়ে করে সংসার বড় করে শেষ জীবনে নিশ্চিত বৃদ্ধাশ্রমে আসার ঝুঁকি না নিয়ে বরং আগে থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া ঢের ভালো। এটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত উপলব্ধি। একটা চাকরি করতাম; রিটায়ার্ড করে এই বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তুলেছি। অবসরে যাওয়ার পর যখন ভীষণ একাকীত্বে ভূগতে থাকি তখন এক বন্ধুর পরামর্শে এই বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করে আমি নিজেই এখানে থিতু হয়ে গেলাম। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এই বৃদ্ধাশ্রমই হবে আমার শেষ ঠিকানা, আমৃত্যু আশ্রয়স্থল।

সময়ের পরিক্রমায় কে কোথায় স্থির হয় কেউ জানে না। ঘূর্ণায়মান পৃথিবীতে মধ্যাকর্ষণের ফলে আমরা আছড়ে পড়ি না সত্যি, তবে আমাদের নিয়তি, আমাদের ভাগ্য, আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে, তার হিসাব আমাদের সবারই অজানা।

শীতের সকালে শিউলি আর গন্ধরাজের মধুময় ঘ্রাণে সারা বৃদ্ধাশ্রম যখন মাতোয়ারা, তখন সেখানে ভর করেছে রাজ্যের নিরবতা। ঠিক এমনই এক সময়ে রতন আমার হুইলচেয়ার টেনে নিয়ে গেল তার দিদিভাই’র কাছে। আমার হারানো প্রেম এভাবে রতনের ‘দিদিভাই’ হয়ে একদিন আমার সম্মুখে এসে দাঁড়াবে, আমরা একই ছাদের নিচে বাস করবো, তা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করিনি।

আমি তার দিকে অপলক চেয়ে থাকি। এক রূঢ় বাস্তবতার ফেরে পড়ে পঞ্চাশ বছর আগে যেভাবে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়েছিলাম ঠিক একই বাস্তবতায় আজ আমরা মুখোমুখি দু'জন। তার মুখমন্ডলে বয়সের মলিন ছাপ স্পষ্ট হয়েছে ঠিক কিন্তু মায়াবী দ্যূতি যেন একটুও ফিকে হয়নি। রতনের দিদিভাই আমার দিকে হা করে চেয়ে থাকে। আমি জানি সেও আমাকে সহজেই চিনতে পেরেছে। কারণ এই ভাঙ্গা হৃদয়েই যে তার বাস।

সে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কম্পিত কন্ঠে বলে, তুমি ম-ন-মো-হ-ন !
আমি বলি হ্যাঁ বিনোদিনী, আমি তোমার সেই মনমোহন !

বিনোদিনীর চোখে টলটল জল। বাকরুদ্ধ আমি,সে, রতন। পরিবেশটাকে চঞ্চল করতে এবার আমি বলি- 'সেই তুমি এলে, বড় অসময়ে,জীবন সায়াহ্নে'! বিনোদিনী কম্পিত ঠোঁট মৃদু বাঁকা করে হাসে। বলে, বিনোদিনী কুটিরের সেই বিনোদিনী কি আমি? আমি মাথা নাড়াই। সে হাসে, রতন হাসে, হাসি আমিও। এবার আমি যেন ফিরে পাই আমার ‘হঠাৎ হারানো’ সেই সোনালি অতীত!

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top