সিডনী রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১


মুক্তি : শেখ মোহাম্মদ হাসানূর কবীর


প্রকাশিত:
১২ জুলাই ২০২০ ২২:২৬

আপডেট:
৫ মে ২০২৪ ০২:২৯

শেখ মোহাম্মদ হাসানূর কবীর

 

বাবার মৃত্যুর পর পড়াশোনা প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় তাহেরের। পড়াশোনায় বরাবরই খুব ভালো ছিল তাহের। গাঁয়ের লোকেরা তাহেরের মাকে বলল, যেভাবেই পারো ছেলেটার লেখাপড়া চালিয়ে যাও ; কিন্তু দরিদ্র স্বামীর রেখে যাওয়া অভাবের সংসারে তাহেরকে ময়মনসিংহ শহরে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো তাহেরের মায়ের কাছে যেন বিলাসিতার নামান্তর। তাহেরের আপন বলতে সংসারে মা ছাড়া তেমন কেউ ছিল না। ছেলের অসহায়ত্ব দেখে অবশেষে তাহেরের মা তার দুরসম্পর্কের এক ভাইকে ধরে বাজিতপুরের হেকমত তরফদারের বাড়িতে তাহেরের জায়গিরের ব্যবস্থা করে কোনো রকমে ছেলের পড়াশোনা টিকিয়ে রাখার বন্দোবস্ত করে।

বাজিতপুরের তরফদারদের একসময় দুর্দান্ত দাপট ছিল। শোনা যায়, হেকমত তরফদারের বাবা আলেফ তরফদারের ভয়ে বাঘে মহিষে একঘাটে জল খেতো। ভব্য অভব্য কিংবা ন্যায় অন্যায় তরফদারদের কাছে সবই ছিলো নস্যি ! ছেলের জায়গির বাড়ি সম্পর্কে এমন বিরূপ কথা শুনে তাহেরের মা শঙ্কিত হয়ে পড়ে ; কিন্তু বিকল্প কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে ছেলের অত্যুজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে বুকের ভেতর প্রবাহমান কষ্টগুলো লুকিয়ে রেখে তাহেরের মা হাসি মুখে ছেলেকে বিদায় দেয়।

অপরাহ্ণে তাহের তার বইপত্র ও ব্যবহার্য মালামাল সমেত ভ্যানরিক্সা করে তরফদার বাড়িতে উপস্থিত হয়। হেকমত তরফদার হাসি মুখে সাদরে তাহেরকে ঘরে নিয়ে আসে। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে বাড়ির বাইরে কাছারিঘরে তার থাকার ব্যবস্থা করে। হেকমত তরফদারের উষ্ণ আতিথেয়তায় তাহের অভিভূত হয়ে যায়। শ্রদ্ধায় আপনা আপনি মাথা অবনত হয়ে আসে।

হেকমত তরফদারের দুই স্ত্রী। বড় স্ত্রী নিঃসন্তান। ছোট স্ত্রীর ঘরে একটি মাত্র মেয়ে। মেয়েটির নাম নিয়তি। নিয়তির বয়স ষোলো সতেরো বছর। দেখতে সুশ্রী হলেও জন্ম থেকেই তার একটি পা খোঁড়া। নিয়তি সবেমাত্র কলেজে বি.এ ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। মেয়ের ভাবনায় হেকমত তরফদারের কাছে জীবনটা দুঃসহ মনে হয়। রাতে মাঝে মধ্যে বিছানায় শুয়ে হেকমত তরফদার মনে মনে ভাবে, জীবনে মানুষের ক্ষতিতো কম করিনি, হয়তো খোদা তার প্রতিশোধ নিচ্ছেন। স্ত্রী জোলেখা বেগম অভয় দেয়। মেয়েকে নিয়ে না ভাবতে আশ্বস্ত করে। তবু হেকমত তরফদারের চোখে ঘুম নেই। এক প্রকার নিরুৎসব বিষন্ন রাত কাটে তার।

বাজিতপুর থেকে নৌকা দিয়ে নদী পার হয়ে কিছুটা পথ পেরুলেই ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। থাকা খাওয়ার ভাবনা না থাকায় তাহের পুনরায় রীতিমতো পড়াশোনায় মন দেয়। নিয়তির কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন হওয়ায় নিয়তি হয় তাহেরের প্রতিদিনের সহগামিনী। প্রথম দিকে খোঁড়া মেয়েটিকে সাথে নিতে তাহেরের সংকোচবোধ হলেও পরে সে সংকোচ কেটে যায়। নিয়তির প্রতিবন্ধিতা তাহেরের অনুভূতিকে নাড়া দেয়। ধীরে ধীরে নিয়তির জীবনে তাহের হয়ে ওঠে ¯েœহ মমতায়পূর্ণ এক হৃদয়বান মহাপুরুষ।

তরফদার বাড়ির আঙিনা ঘেঁষেই বড় পুকুর। পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটে বিকেলে নিয়তি বসে থাকে। বসে তাকিয়ে থাকে জলের দিকে। কি অপরূপ মায়াবী মুখ তার ! আহ্হা, যদি তার পা টা ভালো থাকতো, তা হলে হয়তো কোনো রাজপুত্র এসে তাকে নিয়ে যেত সাতসমুদ্দুর তেরো নদী পারি দিয়ে ! প্রতিবন্ধিতার নিগড়ে আবদ্ধ এ বিস্বাদ জীবন তার আর ভালোলাগে না। হঠাৎ জলে ডুবে মরে যেতে ইচ্ছে করে কিংবা সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে দূরের কোনো জনশূন্য লোকালয়ে। জীবনের প্রতি অনাসক্তি তাকে দেউলিয়া করেছে বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষা থেকে।

কাছারিঘরের জানালা দিয়ে নিয়তির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে তাহের। নিয়তির ডাগর চোখের অপরূপ চাহনি ভালোলাগে তাহেরের। তাহেরের ইচ্ছে করে নিয়তির সাথে ঘাটে বসে জলের আয়নায় মুখ দেখতে ; কিন্তু সাহসে কুলোয় না। দরিদ্র বিধবা মায়ের সন্তান সে। অনেক আশা নিয়ে মা তাকে পাঠিয়েছে এ বাড়িতে। কোনো অবস্থাতেই সে তার মাকে কষ্ট দিতে চায় না।

তরফদার বাড়িতে প্রায় বছরখানেক পার হয়ে যায় তাহেরের। নিয়তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। সে ঘনিষ্ঠতা ¯েœহ মমতা আর দূর থেকে ভালোবাসার মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখে তাহের। তাহের তার জীবনের সাথে নিয়তিকে জড়াতে চায় না। একদিন গভীর রাতে লুকিয়ে নিয়তি কাছারিঘরের জানালায় এসে ফিসফিস করে ডাকে তাহেরকে। তাহের নিয়তির ডাকে সাড়া দিয়ে কলের পুতুলের মতন ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। নিয়তি তাহেরকে নিয়ে বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে বকুল ঝাড়ের নিচে মাচায় গিয়ে ধপ করে বসে পড়ে। চারিদিকে ঘন অন্ধকার। দু’জনের মধ্যে তেমন কথা হয় না। কিছুক্ষণ পর নিয়তি অকস্মাৎ তাহেরের হাতে একটি চিঠি ধরিয়ে দিয়ে কোনো কিছু না বলে দ্রুত প্রস্থান করে। তাহের বজ্রাহতের মতন বসে থাকে। কিছু বুঝে ওঠতে পারে না। কেবল অন্তরের গহীনে দারুণ শিহরণ অনুভব করে। মাতালের মতন টলতে টলতে ঘরে ফিরে আসে তাহের। ফিরে এসে হারিকেনের আলোয় চিঠিটা পড়ে। বিগত এতগুলো বছরে কখনো কেউ তাকে এভাবে চিঠি লেখেনি। সুতরাং চিঠিটা পড়ে সে রোমাঞ্চিত হয়। পুনঃপুন সে চিঠিটা পড়তে থাকে
প্রিয় তাহের,
দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে তোমাকে লিখছি। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা আমার প্রতিবন্ধিতা। যদিও তোমাকে ভালোবাসার কোনো যোগ্যতা আমার নেই, তবু তোমাকে ভালোবাসি। খুব বেশি ভালোবাসি। পার্থিব জীবনে হয়তো তোমাকে পাওয়া হবে না জানি, তবে পারলৌকি জীবনে অনন্তকাল ধরে তোমার অপেক্ষায় থাকবো।
ইতি
নিয়তি।
তাহের চিঠিটা পড়ে প্রত্যুত্তরে নিয়তিকে কি বলবে বুঝে ওঠতে পারে না। নিয়তির প্রতিবন্ধিতা আর তার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ; এ দুইয়ের দ্বন্দ্বে তাহের ক্ষত বিক্ষত হয়।

নিয়তির মনের অবস্থা জোলেখা বেগম বুঝতে পারে। আর বুঝতে পারে বলেই ভাবনায় পড়ে যায়। বিষয়টি সে হেকমত তরফদারের কাছে খুলে বলবে বলে স্থির করে। সকালে হেকমত তরফদার মোকদ্দমার কাজে সদরের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হতেই পেছন থেকে ডাক দেয় জোলেখা বেগম। হেকমত তরফদার বিরক্ত হয়। বিরক্ত হয়ে জোলেখা বেগমকে তিরস্কার করতে করতে বাড়ি ফেরে। ফিরে এসে ডাকার কারণ জিজ্ঞেস করলে জোলেখা বেগম ঈষৎ হেসে বলে
একটা কথা কইবাম ভাবছিলাম।
হেকমত তরফদার জোলেখা বেগমকে ধমক দেয়
কথা প্যাঁচাইয়োনা !
ভণিতা রাইখ্যা যা কইবার চাও, সোজাসুজি কও !
জোলেখা বেগম ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে থাকে
তাহের পোলাডারে আমরার নিয়তির খুব পছন্দ।
হের লগে নিয়তির বিয়া দিবার চাই।

কথা শুনে হেকমত তরফদার রেগে যায়
এই কথা কইবার লাইগ্যা আমারে পথ থাইক্যা ফিরাই আনলা ! এইডা তো পরেও কওন যাইতো। আর বিয়া যে দিবার চাও, পোলাডার মত আছে কিনা হেইডাও তো জানা দরকার।

জোলেখা বেগম আহ্লাদের সুরে হেকমত তরফদারের কথার জবাব দেয়
মত না দিয়া উফায় আছে নি ? মত হের দেয়ন লাগবই !
ভাত খায় মুরগী, যাইবো কই ?
হেকমত তরফদার আর কোনো কথা বাড়ায় না। ম্লান মুখে হনহন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সদরের রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে।

বিছানায় শুয়ে তাহেরকে নিয়ে কল্পনায় বিভোল হয়ে থাকে নিয়তি। নিয়তির ভাবনাগুলো খুব সাদামাটা ; একটি ছোট সংসার, যে সংসারের সবকিছু ঘিরে থাকবে তাহের। গলদ্ঘর্ম হয়ে দিনশেষে তাহের যখন ঘরে ফিরবে, মিনতি তখন প্রাণ ভরে ভালোবাসবে তাকে। ভাবতে ভাবতে একসময় নিয়তির ভাবনায় ছেদ পড়ে
সত্যিই কি তাহের তাকে বিয়ে করবে ? নাকি কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ পালিয়ে যাবে ? ভাবনা গুলো আস্তে আস্তে ঘন হয়ে আসে নিয়তির মনে। নিয়তির চোখ ছাপিয়ে দুগ- বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে। মায়ের কাছ থেকে সে জল আড়াল করতে নিয়তি ত্রস্ত পদে ঘর থেকে বেরিয়ে বকুল ঝাড়ের নিচে মাচায় গিয়ে বসে থাকে।

দিন কেটে যায়। সময় বদলাতে থাকে। তাহেরের পড়াশোনা শেষ হয়। পরিবর্তন আসে তাহেরের মনেও। তাহেরের প্রতি নিয়তির ভালোবাসা বাস্তবতার কাছে হেরে যায়। জীবনের এই টানাপোড়েন থেকে পরিত্রাণ পেতে শেষমেষ তাহের তরফদার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

জোলেখা বেগম তাহেরের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারে না। সুযোগ খুঁজতে থাকে তাহেরকে ফাঁদে ফেলার। বিদায়ের রাতে নিয়তি তাহেরের সাথে শেষ দেখা করতে কাছারিঘরে ঢুকলে জোলেখা বেগম টের পায়। টের পেয়ে বাইরে থেকে কাছারিঘরের দরজা আটকে দিয়ে হেকমত তরফদারকে ডেকে আনে। জোলেখার মুখে সবিস্তারে শুনে হেকমত তরফদার ক্ষেপে যায়। রাগে দুঃখে মেয়েকে কাছারিঘর থেকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে বের করে নিয়ে আসে। তারপর কোনো রূপ বিবেচনা না করে মেয়ের পিঠে দুই চার ঘা লাগিয়ে দিয়ে কাছারিঘরের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেয়।

শেষ রাতের দিকে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে নিঃশব্দে মায়ের আঁচল থেকে চাবি ছাড়িয়ে এনে নিয়তি কাছারিঘরের দরজা খোলে। চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢোকে কান্নাজড়ানো কণ্ঠে চুপি চুপি তাহেরকে বলে
পালিয়ে যাও, তাহের ! রাত শেষ হবার আগেই বাজিতপুর ছেড়ে পালিয়ে যাও।

তাহের সন্তর্পণে বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে এসে বড় রাস্তায় ওঠে। নিয়তির প্রতি পরম কৃতজ্ঞতায় তাহেরের চোখ দুটো ছলছল করে। পিছন ফিরে সে দেখে, নিয়তি স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নিয়তির নিষ্পলক চোখকে আড়াল করতে তাহের দ্রুত পা ফেলে। সমুখে চলতে চলতে একসময় সে ঘাঢ় অন্ধকারে মিশে যায়।
নিদারুণ কষ্টে দীর্ঘশ্বাস ফেলে খোঁড়াতে খোঁড়াতে নিয়তি ঘরে ফিরে আসে।

 

শেখ মোহাম্মদ হাসানূর কবীর

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top