সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১


প্রতিদান : মির্জা মুহাম্মদ নূরুন্নবী নূর


প্রকাশিত:
১২ জুলাই ২০২০ ২২:৩৬

আপডেট:
১২ জুলাই ২০২০ ২২:৩৮

 

মায়ের কোলে থাকতেই বাবার আদর সোহাগ থেকে বঞ্চিত হয় সাবিহা। বাবা মারা যাবার সময় সাবিহা তিন মাস বয়সী ফুলপরী। প্রজাপতির ডানার মতো উড়াউড়ি করে সাবিহার পবিত্র কচি দুটি হাত। ওর আধো আধো কথায় যেন খই ফোটে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সাবিহার পরিবর্তন আসে শারীরিক গঠনে। ভাইদের আদরের সোহাগী সাবিহা এখন অনেক বড় হয়েছে। বয়সে নয় শুধু চেহারাতেও পরিবর্তন এসেছে তার। পনের বছর বয়সী কিশোরী এখন অনেকেরই নজর কাড়ে! অনেকেই সাবিহাকে একনজর দেখতে উঁকিমারে। এখন দুনিয়ার স্বাভাবিক অনেক কিছুই বুঝতে পারে সাবিহা। বাবার আদর সোহাগ না পেলেও ভাইদের পরম স্নেহ মমতায় বেড়ে ওঠে সে। গ্রাম্য মেয়ে সাবিহাকে সবাই পছন্দ করেন। ওর মায়াবী ব্যবহার সবাইকে কাছে টানে। আপনার করে পাশে বসতে সহযোগিতা করে।

নবম শ্রেণির ছাত্রী সাবিহা এখন বেশ চঞ্চল হয়ে উঠেছে। নিয়মিত স্কুলে যাওয়া ওর রুটিন ওয়ার্ক। তাই পড়াশোনায় অনেক ভালো সে। ক্লাশের পড়া ঠিক না করে স্কুলে যায় না কোনদিন। গ্রামের মোঠোপথে হেঁটে চলছে সাবিহা। গন্তব্যস্থল ওর প্রিয় স্কুল আঙিনা। একটু এগিয়ে যেতেই পথে দেখা পায় জমিলার। গ্রামের অসহায় এক অশিক্ষিত কিশোরী বালিকা সে। অনাদরে অনাহারে কাটে ওদের পারিবারিক জীবন। উপার্জনক্ষম বাবা থাকলেও অভাবের সংসারের পরিবারে নেই একটু শান্তির ছোঁয়া। একটু সুখের আশায় ওরা ঘুরে বেড়ায় দুনিয়ার অনেক জায়গায়। অনেক কর্ম এখন ওদের নিয়মিত পেশায় পরিনত হয়েছে। বড়জোর সাত বছর বয়সী জমিলা অন্যের বাড়ি কাজ করে প্রতিদিন। তাও আবার ঝিয়ের কাজ। সাবিহা দাঁড়াতে বলে জমিলাকে। জমিলা সাবিহার পাশে দাঁড়ায়। কথা শুরু করে সাবিহা-কী নাম তোমার?

জমিলা।
কী কর তুমি?
অন্যের বাইত্তে কাম করি।
তোমার বাবা নাই? 
আছেতো।
তাহলে তুমি অন্যের বাড়ি কাজ কর কেন? 
আংগেরে যে অভাবের সংসার।  
তোমার বাবা কী করেন?
মাইনসের বাইত্তে কামলা দ্যান।
তোমার মা?
মায়ে মাইনসের বাইত্তে ঝিয়ের কাম করে।
তোমার ভাই নাই?
আছে।
কী করে ও।
মাইনসের গরু-বরকি আহে।
ওর বয়স কত?
পাঁচ বছর অইবো। 
তুমি পড়তে যাবে?
না।
কেন?
আংগেরে আবার পড়ার ভাইগ্য আছে!
যদি পড়ার সুযোগ করে দেয়া হয়।
অইবোনা বুইন।
কেন?
আংগেরে আব্বা পড়বার দিব না যে!
ঠিক আছে। তোমার সাথে অন্য দিন কথা হবে।
আইচ্ছা। 
আর কথা বাড়ায় না সাবিহা। স্কুলে চলে যায় সে। ক্লাশের পড়ায় মন দেয় সাবিহা। আজকে ওদের স্কুলের প্রথম দিন। বৈশাখি মেলার ছুটির পর আজকেই স্কুল খুলেছে।

দুই।
পাখিদের কূজনে ঘুম ভাঙ্গে সাবিহার। প্রাত কার্য সেরে নেয় সে। প্রতিদিনের ন্যায় আজকেও হাঁটতে বেড়োয় সাবিহা। সকালবেলা মর্নিংওয়ার্ক ওর নিয়মিত কাজ। স্বাভাবিক সুস্থ থাকতে হলে হাঁটাহাঁটি করা দরকার। তাই একাজের ব্যত্যয় হয় না ওর। একটু হাঁটতেই আবারো দেখা হয় জমিলার সাথে। ওকে কাছে ডেকে নেয় সাবিহা। আদরের পরশ বুলিয়ে জানতে চায়-
কেমন আছ জমিলা?
বালোই আছি।
এখান থেকে তোমাদের বাড়ি কতদূর?
ঐইতো এইহানে।  
কোথায় যাচ্ছ?
যাগত্তে কাম করি।
এতো সকালে যেতে হয়?
হ। 
কেন?
ঐ বাড়ির দুয়ার হুড়তে অয়। গরুর গোয়াল ছাপ করতে অয়। থালি বাসুন মাজতে অয়। এছাড়াও আরো মেলা কাম আছে যে!
কষ্ট হয় না তোমার?
কষ্ট অয়তো। 
তবুও এসব কর যে?
এইন্ন্যা না কইরলে খাইমু কি? 
খাবার জোগাড় করার দায়িত্বতো তোমার না।
ঠিক কইছেন। কিন্তু বাবায় যে একা পারে না।
বুঝলাম।
তয় আমাহে ছাইড়া দ্যান। আমি যাই।
দেব। তবে আর দুটি কথা শোন।
কন।
তুমি পড়তে চাইলে আমি পড়ার ব্যবস্থা করে দেই। পড়ালেখা করলে জীবনে অনেক সুখী হবে তুমি। সুন্দর একটা জীবন গড়ে উঠবে তোমার। 
আমি তা কইবার পামু না।
কে পারবে?
আব্বাহে কইয়েন।
ঠিক আছে। তোমার আব্বার নাম কি?
জাহিদ। পুরো নাম বল?
জাহিদুল ইসলাম। 
আচ্ছা। তুমি যাও তাহলে। 
এবার জমিলা চলে যায় ওর কাজের উদ্যেশ্যে। বাসায় পৌঁছতে দেরি হয় জমিলার। এতে রেগে যায় বাড়ির মালিকের স্ত্রী জয়নব বিবি। খুব রাগারাগি শুরু করে দেয় জমিলার সাথে। বকাবকিও দেয় আচ্ছা করে। কিছুটা খারাপ ব্যবহারও করেন তিনি। কিন্তু কী আর করা।  নীরবে সহ্য করে কাজে মন দেয় জমিলা। এতোদিন তেমন কিছু ভাবেনি জমিলা। কিন্তু আজকে বাড়ির মালিকের বউয়ের খারাপ ব্যবহারে অনেক কষ্ট পায় সে। ছোট্ট মানুসি মনে অনেক দুঃখ পায় ও। করার কিচ্ছু নেই। কপাল বলে কথা! কাজ যে করতেই হবে। বকাও শুনতে হবে, নতুবা আয় রোজগার হবে কেমনে! মনের মাঝে এক সাগর কষ্ট নিয়েই কাজ করে যায় জমিলা। দেরি করে আসার জন্য খাবারও দেয় দেরিতে। পাতিলের পোড়া ছেছড়া খাবার খেতে দেয় ওকে। অন্যান্য দিনের মতো আজকে তেমন একটা আদর পায়নি জমিলা। এসব আচরণে জমিলার মন খারাপ হয় সাবিহার প্রতি। জমিলা ভাবে সাবিহা যদি পথে না আটকাতো তাহলে ঠিক সময়ে ও বাড়ি পৌঁছত। কাজগুলো আগের মতোই যথাসময়ে করতে পারত। এজন্য ওকে বকা খেতে হত না। ওর মনে রাগ ধরে সাবিহার প্রতি। সাবিহার প্রতি আরো বেশি করে মন খারাপ হয় জমিলার। দিন শেষে কাজ সেরে বাড়ি ফিরে আসে জমিলা।

তিন।
সাবিহা জমিলার সাথে কথা বলেই ওদের বাড়িতে যায়। বাড়ি গিয়ে জমিলার বাবার সাথে দেখা করে সাবিহা। ততক্ষণে জমিলার বাবা কাজের জন্য বাইরে যায়নি। জাহিদ সাবিহাকে পিড়ায় বসতে দেয়। তিনি গরীব মানুষ। তাই চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থা নেই তার বাড়িতে। কাঠের পিড়ায় বসে জাহিদের সাথে কথা বলে সাবিহা। সাবিহা জাহিদকে উদ্যেশ্য করে জানতে চায়-
কেমন আছেন চাচা?
বালো আছি। তুমি কেডা মা?
আমি সাবিহা।
তোমার বাড়ি কোনে? 
দিঘলকান্দির উত্তর পাড়ায়।
তোমার বাপ কেডা? 
আবুল বাশার।
তোমার বাবা মারা গেছেন না?
জ্বী। 
কী কর মা? 
পড়াশোনা করি।
তো এতো সকালবেলা আমার বাইত্তে যে!
বেড়াতে এলাম। আসতে দেবেন না বুঝি!
ক্যানো আসপার দিমুনা মা!
তোমার বাপেতো খুব বালো মানুষ আছিলো। আমাহেও খুব বালোবাসতো। আগে  তোমাদের বাইত্তে অনেক কামলা দিছি আমি। তোমার মায়েও খুব বালো আছিলো। আমাদের কষ্টে অনেক সাহায্য সহযোগিতা করতেন তিনি। তোমার মায়ে বাঁইচা আছেন কি?
জ্বী। আম্মু জীবিত আছেন। 
তোমার চাচির হাতে কথা কও মা। আমি কামলা দিবার যামু। সময় অইছেতো তাই। তয় খাইয়া দাইয়া যাইও কিন্তু!
না চাচা। আমি বেশি দেরি করতে পারব না। আমি এসেছিলাম একটা বিষয় নিয়ে। আপনার সাথে কথা বলার জন্য।
তয় কও মা। কী তোমার কথা?
জমিলা নামের আপনার কোন মেয়ে আছে কি?
হ মা। আছেতো!
কী করে ও?
কী কইমু আর দুক্কের কথা! আমরা গরীব মানুষ। আয় রোজগার নেই। জমি জমাও নেই তেমন একটা। তাই জমিলা অন্যের বাইত্তে একটু আধটু ঝিয়ের কাম করে। তুমি ওকে চেন মা?
জ্বী। চিনি।
ক্যামন কইরা চেন মা?
জমিলার সাথে সাবিহার যেসব কথা হয়েছে তার  সবকিছুই খুলে বলে জাহিদকে। জাহিদ সে সব কথা মনোযোগের সাথে শোনেন। একান্ত দিলের কানে। জাহিদ এসব শুনে ভাবতে থাকেন। আপনার করে বুঝতে চেষ্টা করেন। ভাবনার গহীণ অরণ্যে হারিয়ে যান তিনি। জাহিদ ভাবেন সাবিহা কেন এমন করে বলছে। ওর মনে কোন খারাপ চিন্তা নেইতো! এখন বড়লোকেরা শিশুদের পাচার করে বাইরের দেশে বিক্রি করে অনেক টাকা কামাই করেন। সাবিহা এমন কিছু করবে নাতো আবার! মানুষ গরীব হলেও জাহিদ তার ছেলেমেয়েদেরকে যারপর নেই ভালোবাসেন। জীবনে তেমন একটা সুখ দিতে না পারলেও ছেলেমেয়েদের সাথে সর্বোচ্চ ভালো আচরণ করেন জাহিদ। আদরের চাদরে জড়িয়ে পাশে রাখতে চেষ্টা করেন তিনি। সরাসরি কোন জবাব দেন না জাহিদ। কৌশলী জবাব দিয়ে বলেন, আরেকদিন এসো মা। আমি তোমার সাথে বিস্তারিত কথা বলে জানাব। আজকে আর হাতে সময় নেই। কাজ করতে যাব যে।

ঠিক আছে চাচা। আপনি যান। আমি আসছি তাহলে। সময় করে আরেকদিন এসে কথা বলব খন। সাবিহাকে নাস্তা খাওয়ার জন্য বেশ জোড়াজোড়ি করলেন জাহিদুল ইসলাম। কিন্তু দেরি করল না সাবিহা। আবারও আসবে বলে সময় চেয়ে নিয়ে বাড়ির উদ্যেশ্যে রওনা করল সাবিহা। সাথে জাহিদও কামলা দেয়ার জন্য বেরিয়ে এলেন।

চার। 
তিনদিন পরে সাবিহা আবারো জমিলাদের বাড়ি এলো। জমিলার আব্বাকে সব বুঝালেন আপনার করে। একান্ত নিজের করে। জমিলার ভবিষ্যৎ ভালোর দিকগুলোও শুনালেন যত্নসহকারে। এবার কিছুটা বুঝতে পারলেন জাহিদ। দ্বিমত পোষণ করলেন না সাবিহার সাথে। জমিলাকে সাবিহার সাথে পাঠাতে সম্মত হলেন তিনি। সাবিহা জমিলাকে সাথে করে বাড়ি ফিরে এলেন। জমিলা এখন সাবিহাদের বাড়ি থেকে পড়াশোনা করছে। পড়াশোনায় বেশ ভালো জমিলা। ভালো ফলাফল করে এইচএসসি পাশ করল সে। পরে অনার্স পাশ করে মেধাবী জমিলা এখন মাস্টার্সের ছাত্রী। পড়াশোনা শেষ করেছেন জমিলা খাতুন। জমিলা চাকরি নিয়ে জর্জকোর্টের বিচারক এখন। ছোট ভাই কবির পুলিশ অফিসার। সময়ের পালাবদলে কবির পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সিনিয়র কর্মকর্তা হন। ওদের দিন চলছে এখন রাজার হালে। সুখী পরিবারের সদস্য এখন জমিলারা। জমিলার বাবা এখন পুলিশ অফিসারের জনক। এক সময়ের কামলা বিক্রেতা জাহিদ এখন বিচারক মেয়ের গর্বিত পিতা। ভাগ্য বলে কথা!

পাঁচ।   
সাবিহা এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। বিয়ের বয়স হয়েছে তার অনেক আগেই। দেখাশোনাও চলছে। বিয়ের ঘরও আসছে বিভিন্ন জায়গা থেকে। ওরাও দেখছে এদিক সেদিক। বর ঘর দেখতেছেন একান্ত নিজের করে। এক সময় এলাকার হযরত মাস্টারের ছেলে আমির আলীর সাথে সাবিহার বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়। আমির শিক্ষিত হলেও বেকার। চাকরি বাকরি কিছুই করে না সে। ভাইদের পছন্দে আমিরকে বিয়ে করতে রাজি হয় সাবিহা।

আজ সাবিহার বিয়ের দিন। বাড়িতে আনন্দের ধুম পড়েছে। সবাই হাসিখুশি। বাড়ি জুড়ে আনন্দের বন্যা বইছে যেন। কারো চোখে মুখে দুঃখের কোন আবেশ নেই। সবার মাঝেই আনন্দের হিল্লোল বিরাজমান। তবে সাবিহার মনটা কেন যেন ভালো নেই। অজানা এক আশংকা কেন যেন তার হৃদয়ে আঘাত করছে বারবার। বেশ শক্তকরে। কুঠারাঘাতের মতো করে। স্বস্তি নেই সাবিহার হৃদয় মনে। ভাগ্যের নিয়তি মেনে এক সময় বৈবাহিক কার্যাবলী শেষ হয় সাবিহার। নিয়ম মাফিক সাবিহা তার স্বামীর ঘরে চলে যায়। ভয় আর অজানা আশংকায় কেটে যায় সাবিহার বাসর রাত। সময়ের পালাবদলে স্বামীর সংসারে মনোযোগী হয় সাবিহা।

জীবন চলার পথে দুর্ঘটনার শিকার হয় সাবিহা।  চাকরি খোঁজার কথা বলে কোথাও চলে যায় সাবিহার স্বামী আমির আলী। দিন, সপ্তাহ, মাস গড়িয়ে যায়। বছর পেরিয়ে গেলেও স্বামীর খোঁজ পায়না সাবিহা। স্বামী আজো ফিরে আসেনা বাড়িতে। সাবিহার সংসার জীবন কাটে এখন স্বামী হারা একাকিত্বে। এক, দুই, তিন নয় টানা দশটি বছর কেটে গেছে সাবিহার জীবন থেকে। যৌবনের ভাটা পড়েছে। স্বামীর আদর বা সোহাগের কথা এখন ভুলেই যেতে বসেছেন সাবিহা। এখনও ফিরে এলোনা স্বামী। সাবিহা  জানেনা তার স্বামী আসলেইকি চাকরির নাম করে হারিয়ে গেছেন-নাকি প্রতারণার শিকার পিতা হারা সাবিহা! সাবিহা আজও পথ চেয়ে থাকে স্বামীর আগমনের প্রত্যাশায়! একদিন হয়তো ফিরে আসবে স্বামী। আবারো নতুন করে সংসার গড়বে সাবিহা। সংসারে আসবে সন্তান-সন্ততি। পারিবারিক বন্ধনের স্বাদ উপভোগ করবে সাবিহা। স্বামী হারা সাবিহার হৃদয়টি যেন এখন সাহারা মরুভূমির বিরান মাঠ। স্বামীর সোহাগ ও ভালোবাসার এক পশলা ওম পাবার প্রত্যাশায় আজও পথ চেয়ে থাকে সাবিহা।

ছয়।
কবির সাহেব এখন রংপুর জেলায় অবস্থান করছেন। ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে এসেছেন তিনি। বাবার সাথে কথা হচ্ছে কবির সাহেবের। এলাকার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল তার বাবার সাথে। প্রসঙ্গক্রমে এক সময় উঠে আসে সাবিহার কথাও। কবির সাহেব বাবার নিকট সাবিহার বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চান। বাবাও সাবিহা সম্পর্কে বিস্তারিত জানান। সাবিহার দুঃখের কথা শুনে কবির সাহেব অনেক কষ্ট পান মনে। যে সাবিহার সার্বিক সহযোগিতায় কবিরেরা এখন স্বাবলম্বী সেই সাবিহা এখন অসহায়! টাকা পয়সার অভাব না থাকলেও মানুসিকভাবে সে এখন নির্যাতিত। নিপিরীত। এটা মেনে নিতে পারেননি কবির সাহেব। একজন সফল গোয়েন্দা কর্মকর্তা কবির কিছু একটা করতে চান সাবিহার জন্য। বড় বোন জমিলা একজন বিচারক। না তারা এটা স্বাভাবিক মেনে নিতে পারছেন না। কবির সাহেব সাবিহাদের বাড়িতে যান বেড়াতে। প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উপহার সামগ্রী সাথে নিয়েছেন মিস্টার কবির। বাড়ির দরজায় নক করতেই বেড়িয়ে আসেন সাবিহা। হঠাৎ কবিরকে দেখে থমকে দাঁড়ায় সাবিহা-
আসসালামু আলাইকুম।
ওয়া আলাইকুম সালাম।
কেমন আছেন আপু?
আলহামদুলিল্লাহ।
আপনি কেমন আছেন?
ভালো আছি। তবে আপনি না বলে তুমি করে সম্বোধন করলে অনেক বেশি খুশি হবো আপু।
না তা হয়না কবির সাহেব। আপনি এখন সরকারের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। স্বনামধন্য গোয়েন্দা অফিসার। আমাদের জন্য এটা অনেক বড় পাওয়া ভাই।
তা ঠিক বটে। কিন্তু-
কিন্তু কী ভাই?
আমি আপনার আদরের কবির কিন্তু!
হ্যাঁ। অবশ্যই আপনি আমাদের আদরের কবির ভাই। সরকারের যোগ্য গোয়েন্দা অফিসার। আমাদের বড় পাওনা সেটা।
জ্বী। সেটাও কিন্তু আপনার অবদান। আমি একজন অফিসার মানে আপনি সে অফিসারের সুযোগ্য অভিভাবক। আপনার সহযোগিতা না পেলে কবির অফিসার নয় ভালো একজন কৃষকও হতো কিনা আল্লাহই ভালো জানেন।
অমন করে বলতে নেই ভাই।
তাহলে কেমন করে বলতে হবে আপু?
থাক অসব কথা। আমার জমিলা এখন কোথায়?
আপু এখন দিনাজপুরে আছেন।
শুনেছিলাম জমিলা এখন বিচারক!
জ্বী। আপু এখন বিচারক।
অনেক ভালো লাগছে ভাই। 
অবশ্যই ভালো লাগার বিষয় আপু। আপনি আমাদের যোগ্য অভিভাবক হয়েছিলেন বলেই আমরা এখন প্রতিষ্ঠিত। আমরা এখন স্বাবলম্বী।
চাচাজান কেমন আছেন?
ভালো আছেন তিনি।
আমি অন্য একটি বিষয় নিয়ে আপনার সাথে একটু শেয়ার করতে চাই যদি আপনার আপত্তি না থাকে।
অবশ্যই। আপনার সাথে আমার এমন কী বিষয় থাকতে পারে যা নিয়ে শেয়ার করার জন্য অনুমতির প্রয়োজন হবে?
না তেমন বড় কিছু না। তবে বিষয়টি একান্ত আপনার ব্যক্তিগত বিধায় অনুমতি চাচ্ছিলাম।
হোক না ব্যক্তিগত বিষয়। ভাই জানবেন বোনের বিষয় সেতো ভালো কথা। বলুন ভাই কী বিষয়ে জানতে চান আপনি?
এইতো আবারও আপনি বলছেন কিন্তু!
হ্যাঁ ভাই। সম্মানী ব্যক্তিদের সাথে সম্মান নিয়ে কথা বলাই ভদ্রোচিত ব্যবহার জানি ভাই।আপনার সব কথা যৌক্তিক, কিন্তু!
কিন্তু আবার কী ভাই?
আমি আপনার ছোট ভাই। আপনি না বলে তুমি করে বললে অনেক খুশি হব যে!  
ঠিক আছে। বল তোমার কথা।
ভয় হচ্ছে বলতে!
সমস্যা নেই। নির্ভয়ে বলতে পার ভাই।
ভাইয়া এখন কোথায় আছেন?
কিছুটা বিব্রতবোধ করলেন সাবিহা। তিনি ভাবেননি আমির সম্পর্কে এভাবে জানতে চাইবে কবির। কিন্তু কিছু করার নেই আর! একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুধু এতোটুকুই বললেন সাবিহা- "আমি জানিনা তোমার ভাইয়া কোথায় আছেন, কী করছেন। শুধু এতোটুকুই জানি তিনি আমাকে ভুলে গেছেন"। এর চেয়ে আর বেশি কিছু জানতে চেয়োনা ভাই!
তাই।
হ্যাঁ। তাই ভাই।
ভাইয়ার একটি ছবি দিতে পারবেন?
কী দরকার ভাই?
একটু চেষ্টা করে দেখতাম।
কী প্রয়োজন এসবের!
তবুও! 
ঠিক আছে। দেখি পাই কিনা। অনেক খোঁজাখুজির পরে আজ থেকে সেই দশ বছর আগের একটি সাদাকালো ছবি পেলেন সাবিহা। কবিরের হাতে ধরিয়ে দিলেন ছবিটি। ছবিটি পেয়ে আর দেরি করলেন না মিস্টার কবির সাহেব। আপুকে আস্বস্ত করে এগিয়ে চললেন নিজের বাড়ির দিকে।

সাত।
বাবার সাথে সাবিহা আপুর সব বিষয় নিয়ে কথা বললেন মিস্টার কবির। সাবিহার জন্য কিছু একটা করতে হবে এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন মিস্টার কবির। বাবার নিকট দোয়া চেয়ে পরের দিন ফিরে গেলেন কর্মস্থলে। একজন সফল গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে তার বেশ সুনাম রয়েছে। এটাকে কাজে লাগাতে চান তিনি। বড় আপু জমিলার সাথেও বিস্তারিত যোগাযোগ করেছেন মিস্টার কবির। একটা কিছু করবেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন দুই ভাইবোনে। কবির সাহেব নিজের উদ্যোগে শুরু করলেন গোয়েন্দা অভিযান। সহযোগিতা নিলেন সহকর্মী আরো অনেকের। দীর্ঘ দুই বছর পরিশ্রম করে সনাক্ত করতে পারলেন মিস্টার আমির আলীকে। আইন হাতে তুলে নিতে চাননা কবির সাহেব। আপু সাবিহাকে বুঝিয়ে একটা প্রতারণার মামলা ঠুকে দিলেন আদালতে। মামলার কপি সরবরাহ করলেন কবির সাহেবকে। কিছু দিন পরে আমির আলীকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করলেন বিচারের জন্য।

দীর্ঘ তিন বছর মামলা চলল। আজকে বিচারের রায়ের দিন ধার্য করেছেন মহামান্য আদালত। আদালতে উপস্থিত আছেন মিস্টার কবির, বাবা জাহিদুল ইসলাম এবং সাবিহা। আদালত পাড়ায় ভীর বেশ লক্ষ্য করার মতো। ছেলে পক্ষের আছেন শুধু আমির আলীর মা জুলেখা বেগম। ঠিক সময়ের মধ্যেই বিচারক জমিলা খাতুন এজলাসে এসে নিজের আসনে বসে পড়লেন। যুক্তিতর্ক শেষে বিচারক যখন রায় ঘোষণা করবেন ঠিক তখনই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা আসামী আমির আলী কয়েকটি কথা বলতে আদালতের অনুমতি চাইলেন। আদালত তার আবেদন গ্রহণ করে কথা বলার সুযোগ দিলেন। আমির আলী তেমন বিশেষ কিছু বললেন না। শুধু নিজেকে অপরাধী সাব্যস্ত করে আদালতের দেয়া রায় মেনে নিয়ে তার অপরাধের শাস্তি কার্যকরের অনুরোধ জানিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তার আর কোন কথা শোনা গেল না। আদালত আজকের জন্য রায় ঘোঘণা স্থগিত করলেন। রায়ের জন্য নতুন দিন তারিখের ঘোষণা জানিয়ে দিলেন পেশকার। এজলাস ত্যাগ করলেন বিচারক জমিলা খাতুন।

আজকে রায় ঘোষণার দিন। যথারীতি এজলাসে বসেছেন বিচারক জমিলা খাতুন। শুনানী শেষে রায় ঘোষণার পূর্বমূহুর্তে এজলাসের দিকে দুপা এগিয়ে গেলেন সাবিহা। বিচারকের সামনে গিয়ে একটি চিরকুট এগিয়ে দিলেন তিনি। চিরকুটটি হাতে নিলেন বিচারক জমিলা খাতুন। মনোযোগের সাথে চিরকুটটি পড়লেন বিচারক। এবার আদালত পাড়ার পরিবেশে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। বিচারকের রায় ঘোষণা করার পূর্ব মূহুর্তে একটি গোলাপ হাতে সামনে এগিয়ে গেলেন সাবিহা। একটু মোড় ঘুরে চলে গেলেন আমির আলীর কাছে। দাঁড়ালেন তার পাশে। দুচোখ বেয়ে কয়েক ফোটা তপ্ত নোনা জল গড়িয়ে পড়ল। কারো চোখ এড়িয়ে গেল বলে মনে হল না। আদালতের সবাই কিছু একটা আঁচ করতে পারলেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় এমন পরিবেশে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে। আর দেরি করলেন না সাবিহা। আমির আলীকে তার ডান হাত বাড়াতে বললেন তিনি। আমির আলীর হাত এগিয়ে দিতেই গোলাপটি ধরিয়ে দিলেন তার হাতে। সাবিহা এবার বিচারকের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন "এটিই হোক আমার স্বামীর উপযুক্ত প্রতিদান"।

 

মির্জা মুহাম্মদ নূরুন্নবী নূর 
ডিবি রোড, গাইবান্ধা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top