সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১


ভাইরাস, ভাইরাল, ভার্চুয়াল ও  ভ্যাকসিন : এডভোকেট দিদার আলম কল্লোল


প্রকাশিত:
১২ জুলাই ২০২০ ২২:৪৭

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ০৬:১৭


নভেল করোনা ভাইরাস এখনও প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের প্রান পৃথিবী থেকে কেড়ে নিচ্ছে। এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ প্রান হারালো। বিশ্বের ২১৩ টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া কোভিট ১৯ নামক দুষ্টু এ প্যানডেমিক ইউরোপ আমেরিকা থেকে অনেকটা সরে গিয়ে এখন ল্যাটিন আমেরিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায় ভর করেছে, মানুষের জীবন জীবিকা, স্বপ্ন, শক্তি, সাহস ও কল্পনা তছনছ করে দিচ্ছে। অথৈ সমুদ্রে দিশেহারা নাবিকের মত  বাংলাদেশ এখন করোনা ভেলায় ভাসছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন গানিতিক হারে বাড়ছে। আমাদের দেশে সরকারি ছুটি, লকডাউন, রেড জোন, ঘরে থাকা, মাস্ক পরা, সামাজিক দুরত্ব ইত্যাদি কোভিট প্রতিরোধে গৃহীত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অনেকটা ভোঁতা ও অকার্যকর হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়। স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নির্দেশনা মানার ব্যাপারে মানুষের  চরম উদাসীনতা, অজ্ঞতা ও অসচেতনতা নাকি বাংলাদেশে আসা চীনা চিকিৎসক দলকেও হতাশ ও হতবাক করেছে।

আগে মৌসুমী ভাইরাস জ্বর বা ভাইরাসজনিত রোগ হলে মানুষ বিষয়টাকে মামুলি জ্ঞান করত, রঙ্গ করে বলত, এটা তেমন কিছু না, ভাইরাস জ্বর, ঔষধ খাইলে সাত দিন, না খাইলে এক সপ্তাহ। কেউ পাত্তা দিত না। এছাড়া কম্পিউটার ল্যাপটপ এ ক্ষতিকর ভাইরাস প্রবেশ করে অনাকাঙ্ক্ষিত বিড়ম্বনায় ফেলে দিত। আর এখন ভাইরাসের নাম শুনলেই মানুষ ভূত দেখার মত চমকে উঠে।আগেকার ভাইরাস কম্পিউটার, ল্যাপটপে আক্রমণ করে সিষ্টেম অচল করে দিত,জীবনের গতি কমিয়ে দিত, এখনকার ভাইরাস মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে, সবকিছু নিশ্চল নিস্তব্দ করে দিচ্ছে। কম্পিউটারের জন্য এন্টি ভাইরাস সফটওয়্যার আবিষ্কার করে বহিঃশত্রুর আক্রমন থেকে কম্পিউটারকে রক্ষা করা গেলেও করোনা নামক প্রানসংহারী ভাইরাসটির ভ্যাকসিন বা ঔষধ আজঅব্দি আবিষ্কার না হওয়ায় সমানে মানুষ মরছে। একটি ভ্যাকসিনের জন্য সারা বিশ্বের মানুষ বিজ্ঞানীদের প্রতি চাতক পাখির মত হা করে চেয়ে আছে। কবে যে একটি কার্যকরী ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক আবিষ্কার হবে, মৃত্যু মিছিল থামানো যাবে! বিল গেটস বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন আপনারা কোটি কোটি ডোজ ভ্যাকসিন বা টিকা আবিষ্কার করুন, সব টাকা আমি দেব। বিশ্বের এক নম্বর ধনী এই ভদ্রলোক দম্পতি বহু আগেই তাঁদের প্রায় সমুদয় সম্পতি জনকল্যানে দান করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি করোনার সম্ভাব্য ভ্যাকসিন বৈশ্বিকভাবে জনগণের সম্পত্তি ঘোষণার আহবান জানিয়েছেন বিশ্বের ১১১ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিষ্ঠত ইউনূস সেন্টারের উদ্যোগে ১৯ জন নোবেল লরিয়েট, ৩২ জন প্রাক্তন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান, রাজনৈতিক নেতা, শিল্পী, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার প্রধানসহ এই ১১১ জন বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব এক বিবৃতিতে স্বাক্ষর করে বলেন আমরা বিভিন্ন সরকার, ফাউন্ডেশন, পরোপকারী ব্যক্তি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে এই ভ্যাকসিনগুলো বিশ্বব্যাপী বিনামূল্যে উৎপাদন এবং বিতরণ করতে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। বিবৃতি দাতাদের মধ্যে রয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ডেসমন্ড টুটু, মিখাইল গর্বাচেভ, মালালা ইউসাফজাই, রতন টাটা, আজিম প্রেমজি, শাবানা আজমিসহ বিশ্ব নেতারা। এই খবরটা যদি ভাইরাল হয়, বিশ্বমোড়লরা যদি তাঁদের বেনিয়া স্বার্থ ত্যাগ করে এগিয়ে আসে তাহলে  বিশ্বমানবতা উপকৃত হবে। প্রসঙ্গত এই বিশিষ্টজনেরা যদি আমাদের ঘাড়ে চেপে বসা এগার লক্ষের ও বেশী বাস্তুহারা রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহলের উদ্দেশ্যে এরকম একটি বিবৃতি দিতেন তাহলে কতই না ভাল হতো।

চীন ও যুক্তরাজ্য ভ্যাকসিন আবিস্কারের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে দাবি করলেও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোন ভ্যাকসিন এখনো মানবদেহে প্রবেশ করেনি। করোনার কোন ঔষধ ও ভ্যাকসিন অদ‌্যবদি আবিষ্কার না হওয়ায় এবং সেই সাথে অপর্যাপ্ত আইসিইউ, অক্সিজেন ও স্বাস্থ্যসেবাহেতু প্যানিক এ্যটাক হয়েও নাকি কেউ কেউ মারা যাচ্ছে। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আপন-পরের নিত্য নতুন সংজ্ঞা শিখছে, সমীকরণ মিলাচ্ছে মুমূর্ষু  নিঃস্ব মানুষগুলো।

এই করোনাকালে কিছু অমানুষের অমানবিকতা, নিষ্ঠুরতা, অসততা ও স্বার্থপরতার পরিচয় যেমন পাওয়া গিয়েছে, তেমনি বিপুল সংখ্যক পরার্থ, দয়ালু ও মানবিক মানুষেরও দেখা মিলেছে। এ সংক্রান্ত অনেক ঘটনা ভাইরালও হয়েছে। সেইসঙ্গে প্রচারপ্রিয় মানুষগুলোকে ভাইরালের ভাইরাসেও আক্রান্ত হতে আমরা দেখেছি। লকডাউনে কর্মহীন দরিদ্র মানুষের ডাকে সাড়া দিয়ে সর্বস্থরের  মানুষ প্রথমদিকে যেভাবে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল এখন সেই উদ্দ্যেগও অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছে। অথচ সরকারি বেসরকারি সাহায্যে অব্যাহত রাখা প্রয়োজন ছিল কারণ এখনো মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। এতদিনে আমরা হাঁটি হাঁটি পা পা করে অন্ধকার করোনা টানেলের প্রবেশমুখে এসে পৌঁছেছি মাত্র। জানিনা টানেলের অপর প্রান্তে আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে। মানবিক অমানবিক অনেক ঘটনা ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এগুলো পড়ে কখনো আমরা ব্যথিত,বিস্মিত হয়েছি, কখনো বা আশান্বিত। তবে যেটি ভাইরাল হয় না সেটি হচ্ছে মানুষের বোবা কান্না। অতিন্দ্রীয় শক্তির অধিকারী না হয়েও এখন কান পাতলে যে কেউ শুনতে পাবে একদা সচ্ছল অজস্র মানুষের নিরব কান্না, দিব্যি চক্ষে দেখতে পাবে তাঁদের অসহায়ত্ব, বেদনার বালুচরে লীন কাতর অসংখ্য অগণিত সর্বস্থরের মানুষের আহাজারি।

নাই কাজ তো খৈ ভাজ। এখন দেশ বিদেশের আত্ত্বীয় স্বজন,বন্ধুদের খুঁজে খুঁজে বের করে আমরা ভার্চুয়াল তথা ডিজিটাল আড্ডা দিচ্ছি, করোনা না এলে এত বন্ধুর সন্ধান কস্মিনকালেও পাওয়া যেত না। টিকা না পাওয়া গেলেও এ নিদানকালে এহেন আড্ডা যেন এক মহা স্বাস্থ্য বটিকা।

যারা আগে থেকেই অসামাজিক ও কিপটা স্বভাবের, অর্থাৎ আত্নীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবের ধার ধারত না, দুরত্ব বজায় রেখে চলত, সেইসব ঘরকুনো মানুষের কাছে  সামাজিক দুরত্বের কনসেপ্ট নুতন কিছু নয়। তাই  সামাজিক দুরত্ত্ব ও ঘরে থাকার ঘোষণায় তাঁরা মোটেই অখুশি নন, বরং খুশি।তারাতো আগে থেকেই অভ্যস্ত; বাকি জীবন ও যদি তাদের দুরত্ত্ব বজায় রেখে চলতে বলা হয় তাঁরা আরো খুশি হবে। এরা স্বভাবে কৃপন, স্বার্থপর ও লুটেরা প্রজাতির হওয়ায় এবং ব্যাংকে এদের গচ্ছিত টাকার পরিমাণ বেশি হওয়ায় মধ্যবিত্তের মত সঞ্চয়পত্র ভাঙ্গাতে হয় না। করোনা প্রলন্বিত হলেও তাদের ক্ষতি নেই, তাদের খরচ বাচবে, তাঁরা কাজের বুয়া বিদায় করে দিয়েছে, ড্রাইভার বিদায় করে দিয়েছে, অফিসের কর্মচারী ছাঁটাই করেছে। আর এঁরা টিকতে না পেরে দলে দলে ঢাকা ছাড়ছে। তাদের অব্যক্ত বেদনা ও বোবা কান্নায়  বাংলার আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। কিন্তু আমরা চাই ভাইরাস বিদায় হউক। নুতন সূর্যোদয় ভাইরাস মুক্তির  বার্তা নিয়ে আসুক। ভোরের বাতায়নে নিভে যাক সকল দুঃখের প্রদীপ, দূর হউক ব্যাধি জ্বরা, সূচি হউক ধরা। মানুষে মানুষে ঘুচে যাক দুরত্ব, বিপদে আপদে একে অন্যের পাশে গিয়ে দাঁড়াক। আনন্দ উৎসবে উদ্বেলিত উচ্ছসিত মানুষ আপনজনদের বুকে টেনে নিক, বাহুডোরে জড়িয়ে, আলিঙ্গন করে,কোলাকুলি করে হ্নদয়ের সমস্ত অর্গ,উষ্ণতা ও স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে আগের মত প্রতিটি মুহূর্ত স্মরনীয় করে রাখুক।

এখন আমাদের সন্তানরা ভার্চুয়াল ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে, ভার্চুয়ালী মিটিং, সম্মেলন, কনফারেন্স সবই হচ্ছে। ফেইসবুকে ভার্চুয়াল টক' শ, আইন, ইংরেজী, কবিতা, গানসহ বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক পাঠ, আলোচনা, সাক্ষাৎকার, রাজশাহীর নিজস্ব বাগানের কেমিক্যালমুক্ত আমের বিজ্ঞাপনের মত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনলাইনে পন্য কিনতে গিয়ে কারো কারো তেতো অভিজ্ঞতা ও মোহভঙ্গ হলেও আশাকরি কোরবানির পশু বেচাকেনার আসন্ন ভার্চুয়াল হাটের আস্থার হাড়িঁ কেউ ভাঙ্গবে না এই সুমিষ্ট হাড়িঁভাঙ্গা আমের সিজনে।

করোনাকালে ভার্চুয়াল কর্মকাণ্ডে কম্পিউটারের ব্যবহার অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে, আমাদের দক্ষতাও বাড়ছে, প্রযুক্তি ব্যবহারে আমরা অভ্যস্ত ও স্মার্ট হচ্ছি, সেই অর্থে করোনা কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশ বান্ধব। আমরা সীমিত পরিসরে ভার্চুয়াল কোর্ট করছি, যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বিধায় সার্বিক উদ্দেশ্য সাধনে খুব একটা সহায়ক হচ্ছে না। কঠোরভাবে স্বাস্থ্য বিধি মেনে সমন্নিত উদ্দ্যেগ গ্ৰহন করে বাস্তব পরিস্থিতি আমলে নিয়ে নিয়মিত কোর্ট চালু করার বিষয়টি অধিক গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে। যাতে করে পরিস্থিতির সুযোগে প্রতিপক্ষের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত অসংখ্য অধিকারহারা বিচারপ্রার্থী ভূক্তভোগী মানুষ ও আইনঙ্গনের সাথে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞ ষ্টেক হোল্ডারগন হয়রানি, ভোগান্তি ও নিদারুণ দু্ঃখ কষ্ট থেকে মুক্তি পায়। অন্যতায় দার্শনিক হারবার্ট স্পেনসার এর  বিখ্যাত উক্তি 'সারভাইভাল অব দি ফিটেষ্ট' তত্ত্ব তার বৈশ্বিক উপযোগিতা না হারালেও বাংলাদেশে অকার্যকর হয়ে যেতে পারে।
                           

দিদার আলম কল্লোল
এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top